শেষ রাতে হাঁটা শুরু। তার আগে ধারচুলা থেকে সাত দিন ধরে হাঁটছি আমরা। সেখান থেকে চিন সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় একশো কিলোমিটার রাস্তা। প্রথম দিন অনেকটা চড়াই ভেঙে পাঙ্গু, তার পর থেকে শিরখা, বুঁধি, গুঞ্জি। অতঃপর কালাপানি হয়ে শেষ রাত্রি নাভিদাং-এ।
কালাপানি পৌঁছনোর আগের রাতে থাকতে হল গুঞ্জি নামে এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে। সেখানে আমাদের পঁচিশ জন যাত্রীর ডাক্তারি পরীক্ষা হল। কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে সেখান থেকেই নীচে ধারচুলা হয়ে দিল্লি ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সামনে কালাপানিই ভারত-চিন সীমান্তের শেষ বড় চেকপোস্ট। আইটিবিপি-র বড় ক্যাম্প আছে। একটি ছোট নদী কালী নদীতে মিশেছে, তার পাশেই যাত্রীদের থাকার অস্থায়ী তাঁবু, ভিতরে ছোট খাট। এখানেই শেষ বারের মতো আমাদের পাসপোর্ট-ভিসা দেখা হল। আমাদের ক্যামেরা থেকে রিলগুলো খুলে দিয়ে দিতে হল, ওগুলো নিয়ে চিন-এ ঢোকা যাবে না।
সাতাশ বছর আগের কথা। তখনও ফটোগ্রাফি ডিজিটাল হয়নি। জওয়ানরা রিলগুলো জমা রাখলেন, ফিরতি পথে ফেরত পাওয়া যাবে। কালাপানি থেকে হাঁচোড়পাঁচোড় করে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে বেশ কিছুটা উঁচুতে শেষ স্টপ নাভিদাং। যাওয়ার পথে ডান দিকে একটা পাহাড়ের গায়ের খাঁজে বরফ জমে ওঁ-কারের মতো আকৃতি নিয়েছে। তাই তার নাম ‘ওম্’ পর্বত। নাভিদাংয়ে ফাইবার গ্লাসের ছোট তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা, অবশ্য মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। রাত তিনটেয় উঠে বেরোতে হবে। কঠিন চড়াই পথ আর প্রবল শীত ঠেলে প্রায় সাড়ে তিন কিমি হেঁটে পৌঁছতে হবে এই যাত্রার সবচেয়ে কঠিন পর্বে— লিপুলেখ পাস।
দুর্গম: ঘোড়ার পিঠে মালপত্র চাপিয়ে, এবড়োখেবড়ো পথে পায়ে হেঁটে যাত্রা। উপরে মূল ছবি, মানস সরোবর
ভোর তিনটে নাগাদ স্লিপিং ব্যাগ থেকে নিজেকে টেনেটুনে বার করে হাঁটা শুরু। ঘণ্টা তিনেক পর যখন লিপুলেখ পাসে পৌঁছলাম, তখন সবে পুব দিক লাল হচ্ছে। কিন্তু পাসের মাথায় এত ভিড় কেন? এত ঘোড়াই বা কোথা থেকে এল? কাছে গিয়ে বোঝা গেল, আমাদের আগের দলটা কৈলাস-মানস সরোবর দর্শন শেষে ভারতে ফিরছেন। আমাদের অভয় দিয়ে জানালেন, ও পারে কোনও অসুবিধে হবে না। ওঁদের মুখে পরিতৃপ্তির ছাপ। পাসের মাথায় তিব্বত থেকে চিনের লিয়াজ়ঁ অফিসার এসে উপস্থিত। আমাদের সঙ্গে ছিলেন আইটিবিপি-র প্রতিনিধি। ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে, কাগজপত্র বিনিময় করে আমাদের নীচে নামতে বললেন। আইটিবিপি-র কর্মীরা ফিরে যাবেন এ বার।
লিপুলেখ পাসের উচ্চতা ১৭,০৬০ ফুট। বছরের কয়েক মাস ছাড়া সব সময়ই বরফে ঢাকা, মানুষ চলাচলের অগম্য। চিন তিব্বত অধিগ্রহণ করার আগে এই পাস দিয়ে ভারত ও তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্য চলত। ২০১৫ সালে ভারত-চিন বাণিজ্য চুক্তির ফলে এই পথে আবার বাণিজ্য শুরু হওয়ার কথা ছিল, জানি না তা কতটা হয়েছে। লিপুলেখ পাসের পূর্ব দিকটা নাকি নেপালের অংশ। আমরা ১৯৯৩ সালে যথন এই রাস্তা বেয়ে কৈলাস পর্বত ও মানস সরোবরে গিয়েছি, কোনও চিহ্নিত সীমানা দেখিনি, নেপালের পুলিশ বা মিলিটারিও নয়।
আর দেখবই বা কী ভাবে? সম্প্রতি এই কালাপানি, লিপুলেখ পাস নিয়ে উচ্চকিত রণদামামা। ভারত সম্প্রতি কৈলাসযাত্রীদের জন্য লিপুলেখ পাস অবধি রাস্তা তৈরি করেছে। তার পরই চিনের পরোক্ষ প্ররোচনায় হট্টগোল শুরু। নেপাল নতুন মানচিত্রে দাবি তুলেছে, কালাপানি ও লিপুলেখ দু’টোই তাদের সীমানায়। রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধির আকচাআকচিতে মানুষ ভুলে গিয়েছে, এটি একটি বিখ্যাত তীর্থপথ। এবং চিনা সেনারাও সে সময় তাঁদের দেশে সারা পথ জুড়ে আমাদের সাহায্য করে গিয়েছেন। লিপুলেখ চড়াই থেকে নামার সময় যেমন! আইটিবিপি ফিরে গিয়েছে, আমরা উপরে উঠে দেখলাম, নামার রাস্তা এতই ঢালু যে পা রাখাই সমস্যা। তার উপরে অজস্র আলগা পাথর। সঙ্গীদের অনেকেই বয়স্ক, তাঁদের নামতে খুব সমস্যা হল। কমবয়সিদের ধরে ধরে নামলেন, দু’-চার জন বরফে আছাড়ও খেলেন। চিনা সেনারা কিন্তু আমাদের এই উতরাই পথে হাত ধরে নামতে যথেষ্ট সাহায্য করছিলেন।
মনে পড়ছে, এই জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস অবধি ছিল কালাপানি, লিপুলেখ হয়ে কৈলাসযাত্রার মরশুম। ভারত-চিন চুক্তি অনুসারে তখন ওই কয়েক মাসে দশ-বারোটি দলকে দু’ দেশের যৌথ তত্ত্বাবধানে কৈলাস ও মানস সরোবর ঘুরিয়ে আনা হত। এখন অবশ্য কাঠমান্ডু হয়ে আরও পথ খুলে গিয়েছে, কিন্তু তখন ভারতীয়দের জন্য সমস্ত ব্যাপারটাই পরিচালিত হত বিদেশ মন্ত্রকের ব্যবস্থাপনায়। আবেদন করার পর অপেক্ষা করতে হত, যদি লটারিতে নাম ওঠে। কয়েক বছর চেষ্টার পর আমার মতো ডাক্তারের কপালেও শিকে ছিঁড়েছিল। বাড়িতে টেলিগ্রাম এল, কাগজপত্র জোগাড় করে, টাকা ও পাসপোর্ট নিয়ে দিল্লিতে সাউথ ব্লক-এ বিদেশ মন্ত্রকের আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। দিল্লি থেকে যাত্রা শুরু, ২৮ দিন তীর্থভ্রমণ শেষে আবার দিল্লি ফেরা।
নেপালের কে পি শর্মা ওলি সরকার তো আচমকা মানচিত্র এঁকে লিপুলেখের রাস্তাটা নেপালের অন্দরে ঢুকিয়ে নিলেন... আমার আড়াই দশক আগের অভিজ্ঞতা বলি। দিল্লি থেকে আমাদের ২৫ জনকে বাস নিয়ে এসেছিল কুমায়ুনের পিথোরাগড় জেলায় নেপাল সীমান্তের ছোট্ট শহর ধারচুলায়। সেখানেই রাত্রিবাস। লজের একটু দূরেই ছোট্ট নালার উপর একটা সেতু। শুনেছিলাম, ও পারে নেপাল। নামেই সীমান্ত। কোনও চেকপোস্ট নেই, প্রহরীও নয়। দেখা গেল, ও পারে কয়েকটা দোকান, আইএসডি ফোনের ব্যবস্থা। সেই আমলেও নেপালের টেলিব্যবস্থা খুব উন্নত ছিল। মোবাইল ফোন তখন কোথায়!
ধারচুলা থেকে লিপুলেখ অবধি সাত দিনের হাঁটাপথে হাঁপ-ধরানো চড়াই ছিল শুধু প্রথম ও শেষ দিন। তা ছাড়া সারা পথেই সবুজের সমারোহ। মাঝেমধ্যে ছোট-বড় ঝরনারা গান শুনিয়ে যাচ্ছে, কয়েকবার নদীর কাছ দিয়ে যেতে হল। ও পারেই নেপাল, তবে নেপালি জনপদ বা মানুষজন চোখে পড়েনি। স্থানীয়রা গরু, ভেড়া, ঘোড়া নিয়ে যাতায়াত করেন। পথে ছোটখাটো গ্রাম, বাসিন্দারা উৎসুক চোখে তীর্থযাত্রীদের দেখেন। বাচ্চারা এসে ‘নমস্তে’ বলে, লজেন্স দিলে মিষ্টি হেসে হাতে নেয়। আড়াই দশক আগের সেই স্বপ্নভূমি এখন জাতীয়তাবাদী জিগিরে। তিন দেশের এই সীমানায় যুদ্ধের হুঙ্কার তোলায় ভারত-নেপাল-চিন কেউই কমতি নয়। সীমানা নিয়ে এই যুদ্ধজিগিরে অবশ্য রাজনীতিকদেরই যায় আসে, দেবতাত্মা হিমালয় নিজের মতোই অটল থাকেন।
লিপুলেখ পেরিয়ে, ও পারে চিনের উতরাই-পথে তাই আমাদের জন্য অভ্যর্থনা কম ছিল না। দেখলাম, অনেকগুলো তিব্বতি ঘোড়া অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। ওতে চেপে পাঁচ-ছয় কিমি যেতে হবে, তিব্বতের সীমান্ত শহর তাকলাকোটে নিয়ে যাওয়ার বাস অপেক্ষা করছে সেখানে। সেও এক যাত্রা বটে। বড় বড় ঘোড়ায় চেপে ঘণ্টাখানেক এবড়োখেবড়ো পথে চলে কোনও রকমে একটা প্রায় সমতল জায়গায় পৌঁছলাম। সেখান থেকে বাসে উঠলাম, একটা লরি আমাদের বাক্সপেঁটরা নিয়ে চলল। আমাদের লিয়াজ়ঁ অফিসার কমবয়সি একটি তিব্বতি ছেলে, ইংরেজি আর কাজ চালানো হিন্দি জানে। ঘণ্টাখানেক পর তাকলাকোট পৌঁছলাম। একটা ছোট্ট ঘরে আমাদের ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র দেখা হল, কাস্টমস-এর লোকজন এলেন কিন্তু কিছু চেক করলেন না। আমাদের থাকতে দেওয়া হল ছোট ছোট পরিষ্কার ঘরে, সেখানে হাসপাতালের মতো খাট। দুপুরে ভাত, আলু আর বিনসেদ্ধ খেয়ে বেরোলাম শহর দেখতে। ছোট্ট মিলিটারি শহর। পাহাড়ি বাজার এলাকায় কিছু দোকান, চিনা জামাকাপড় আর ছিটের দোকানই বেশি। ভারতীয় দেখলেই ডাকাডাকি করে। স্যুটের কাপড়ের দাম বেশ সস্তা, অর্ডার দিলে মাপ নিয়ে পর দিন সকালেই আমাদের লজে ডেলিভারি দেবে জানাল। বিদেশের অনেক শহরের মতো এখানেও বেসরকারি ভাবে বিদেশি মুদ্রা পরিবর্তন করার ব্যবস্থা আছে। দোকানগুলোই এই কাজ করে। সরকারি রেটের থেকে কিছুটা বেশি ইউয়ান পাওয়া যাচ্ছে মার্কিন ডলারের বদলে। সব মিলিয়ে আমাদের যে কোনও সীমান্তশহরের মতো পরিবেশ। দেশভক্তির চোটে যাঁরা আজকাল চিনা পণ্য থেকে সব কিছু বয়কটের ডাক দিচ্ছেন, প্রতিবেশী দেশকে শত্রু ভাবছেন, তাঁরা কেউই বোধ হয় গায়ে-মাথায় এই তীর্থপথের ধূলি মাখেননি।
পর দিন সকালে তাকলাকোট থেকে বাসযাত্রা শুরু। গন্তব্য তারচেন। তাকলাকোট থেকে শ’খানেক কিলোমিটার। রুক্ষ তিব্বত মালভূমিতে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে, মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাহাড়ি নদী পেরিয়ে পৌঁছলাম তারচেন। ঘিঞ্জি, দরিদ্র, অপরিচ্ছন্ন পাহাড়ি জনপদ। ভাঙাচোরা কাঠের দোকানে ঝুলছে কবেকার কাটা ইয়াকের ঠ্যাং। রোদে শুকোচ্ছে ইয়াকের মাংস, চামড়া আর লেজ। জোব্বা পরা তিব্বতি মহিলারা ঘরকন্না সামলাচ্ছেন, উল বুনছেন। পাহাড়ি নদীতে চান করছে ভেড়া, ইয়াক। কাচা হচ্ছে জামাকাপড়। সেই জলই পানীয় হিসেবে পাত্রে ভরে পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। সন্ধেয় দেখি, কিছু দূরে খাটানো হয়েছে অনেকগুলো তাঁবু। ভিতরে আলো জ্বলছে। গাইড জানাল, ওগুলো মালবাহকদের তাঁবু। কাছে গিয়ে দেখি, একটা বড় তাঁবুর মধ্যে জনা কুড়ি তিব্বতি মানুষ জেনারেটর চালিয়ে টিভিতে একটা সিনেমা দেখছেন একমনে। ‘শোলে’! আজকের জাতীয়তাবাদী ভারত খেয়াল রাখেনি, প্রতিবেশীদের কাছে তার ‘সফ্ট পাওয়ার’ বা নম্য শক্তির জোর কতটা!
তারচেন থেকে তীর্থযাত্রীদের দু’ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। এক দল যায় মানস সরোবর, অন্য দল কৈলাসে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সময় লাগে তিন দিন। একটা পরিক্রমা শেষ হলে অন্যটিতে নিয়ে যাওয়া হয় বাসে করে। দু’টি পরিক্রমা শেষে সকলকেই ফেরানো হয় তারচেনে। সেখান থেকেই আবার দেশে ফেরার পালা। আমি প্রথমে গিয়েছিলাম মানস সরোবরে। প্রথম যেখানে ছোট বাসটা থামল, যাত্রীরা পাগলের মতো ছুটে গেলেন মানসের জল স্পর্শ করতে। জল ঘেঁটে, পরস্পরকে ছিটিয়ে ভক্তি আর আবেগে, চোখের জলে মাখামাখি হলেন। মানস সরোবর তিব্বতীয় মালভূমির উপর প্রায় ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায়, প্রায় ডিম্বাকার হ্রদটির পরিধি ১০৬ কিমি। এর মধ্যে তখন ২৫ কিমি বাসে নিয়ে যাওয়া হত, বাকি পায়ে হেঁটে। প্রথম দিনের হাঁটাটাই সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪০ কিমি। সকাল চারটেয় বেরিয়ে রাত আটটায় পৌঁছলাম গন্তব্যে। অনেকে অবশ্য ঘোড়ায় চড়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে তার ভাড়া ছিল দিনে দশ ডলার।
সরোবরের পাশ দিয়ে পরিক্রমার রাস্তা খারাপ নয়। চড়াই-উতরাই নেই, জঙ্গল নেই। প্রায় সমভূমি। কিছু বুনো ঘাসের ঝোপে ফুল ফুটে আছে। সরোবরের ধারে নানা রং ও আকারের নুড়িপাথর। হ্রদের জল হালকা নীল। তাতে মৃদু ঢেউ। কয়েক রকম হাঁস ও পাখি দেখেছি। মানসের জল সুপেয়, তেষ্টা পেলেই গ্লাসে তুলে খেয়েছি।
সরোবর থেকে একটু দূরেই ছিল আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা। কোনও রকমে বালি, সিমেন্ট ও পাথরের গাঁথনি। মাথার উপর টিনের চাল। কোথাও লোহার খাট, কোথাও আবার মাটিতে কম্বল পেতে শোওয়ার ব্যবস্থা। গায়ে দেওয়ার জন্য ভেড়ার লোমের মোটা কম্বল। মানস কিংবা কৈলাস— কোথাও খাওয়াদাওয়ার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। দিল্লি থেকে কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গী মালবাহকরা শুধু জল ফুটিয়ে দিত। আমরা তাতে ভিজিয়েই যা পারা যায় তা-ই খেয়ে নিতাম।
প্রথম দিনের দীর্ঘ যাত্রার পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনের হাঁটা তুলনায় কম। তৃতীয় দিন ছিল ১৫ অগস্ট। আগের রাতে ঠিক করা হল, পর দিন ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষরা এক সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে যাত্রা শুরু করব। কিন্তু জাতীয় পতাকা তো সঙ্গে নেই! আমার একটা সাদা গেঞ্জি ছিল, যার সামনে দিকটায় বড় করে জাতীয় পতাকার ইমপ্রেশন করা। সেটাই শূন্যে পতাকার মতো দোলাতে দোলাতে তিব্বতের মাটিতে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইলাম। সে এক আশ্চর্য অনুভূতি! দু’বছর পর ১৯৯৫ সালে আর-এক স্বাধীনতা দিবসে তিব্বতে ছিলাম এভারেস্ট অভিযানের সদস্য হিসেবে। সে বার অবশ্য জাতীয় পতাকা সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুল হয়নি। রংবুক গ্লেসিয়ারের উপর এভারেস্ট বেসক্যাম্পে সে দিন জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলাম জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে।
সরোবর পরিক্রমার মধ্যে বিরতি নিয়ে রোজই স্নান করতাম মানসের জলে। কাচের মতো জল, পায়ের নীচে নুড়িপাথর ছড়ানো, খুব ঠান্ডা নয়। উঠতেই ইচ্ছে করত না জল থেকে। অনেকে সরোবরের ধারে পুজো-পাঠ-তর্পণ করতেন। গুজরাত থেকে মেহতা-দম্পতি এসেছিলেন শিব-পার্বতীকে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করতে। কিংবদন্তি, মধ্যরাতের পর শিব-পার্বতী সরোবরে আসেন স্নান করতে। এক রাতে মেহতা-দম্পতি জানালেন, ওঁরা ঘরের বাইরে থাকবেন, রাত জেগে দেখবেন সেই অলৌকিক দৃশ্য। কথামতো কম্বলটম্বল নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। সকালে জিজ্ঞেস করতে হতাশ গলায় জানিয়েছিলেন, শিব-পার্বতী দেখা দেননি। তবে ওঁরা হ্রদের জলের উপর এক অদ্ভুত আলো দেখেছেন। আমিও অসীম আনন্দ পেয়েছি, তবে তা ওই বিরাট সরোবর পরিক্রমা করে, তার নীল জলে কৈলাসের প্রতিবিম্ব দেখে, তিনশো ষাট ডিগ্রি জুড়ে থাকা নিরাভরণ-নিরাবরণ তিব্বতের রূপ দেখে।
মানস পরিক্রমা শেষে আমরা গেলাম কৈলাস পর্বত পরিক্রমায়। এখানেও তিন দিনের পদযাত্রা। পথ কম, তবে তুলনায় কঠিন। সবটাই রুক্ষ পাহাড়ি পথ, চড়াই-উতরাই আছে, সবুজের কোনও চিহ্ন নেই। যাঁরা হাঁটতে পারেন না, তাঁরা ইয়াক ভাড়া নেন। ভাড়া দিনপ্রতি ১৫ ডলার। দ্বিতীয় দিনের হাঁটাপথে চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় কৈলাস পর্বত। প্রায় একুশ হাজার ফুট উঁচু এই পর্বত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও স্থানীয় তিব্বতিদের কাছে অতি পবিত্র তীর্থস্থান। হিন্দু কল্পনায় সমগ্র পর্বতটিই জটাজূটধারী শায়িত শিবের মস্তক। দেখতে তেমনটাই লাগে। প্রচুর ছবি উঠল।
পরের দিন ওঠা হল এই পরিক্রমার সবচেয়ে উঁচু পথ দোলমা পাসে। প্রায় সাড়ে আঠেরো হাজার ফুট উঁচুতে উঠতে সময় আর দম দুই-ই লাগে। স্থানীয় তিব্বতিরাও অনেকে উঠছেন, অবশ্যই আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুত। জানলাম, ওঁরা পুজো দিতে যাবেন দোলমা পাসের মাথায়। পাসের সবচেয়ে উঁচু অংশে একটি বড় প্রস্তরখণ্ড, তার চারপাশে তিব্বতি রীতিতে ধ্বজা লাগানো। অনেকেই এই প্রস্তরের গায়ে বা খাঁজে সোনা-রুপোর গয়না, বেলপাতা ইত্যাদি নানা শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছেন। সব দেখে এ বার নামার পালা। ঠান্ডা নামছে, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে রাতের কুঠুরিতে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, বাস দাঁড়িয়ে। ঘরে ফেরার তোড়জোড় শুরু। ভ্রমণের দিনগুলোর কষ্ট মুছে গিয়েছে, সবার চোখে-মুখে প্রাপ্তির, তৃপ্তির ছাপ। মালভূমির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ যাত্রার পর এসে পৌঁছলাম সেই তারচেন। এরই মধ্যে ফিরে এসেছেন দলের সব যাত্রী। সাত-আট দিন পর দেখা, উচ্ছ্বাস বিনিময় হল। সন্ধ্যায় চিনের পর্যটন দফতর আমাদের বিদায় সংবর্ধনা দিলেন। আমরা যে ক’জন পুরোটাই পায়ে হেঁটে প্রদক্ষিণ করেছি, তাদের ভাগ্যে জুটল শংসাপত্র। এর পরও দেশটাকে শত্রু বলে ভাবতে হবে?
এ বার ঘরে ফেরার পালা। তিব্বতের মালভূমি, তাকলাকোট হয়ে আবার এক ভোরে লিপুলেখ পাসের মাথায়। আবার সেই ঘোড়ার ট্র্যাফিক জ্যাম। ভারত থেকে নতুন অভিযাত্রীর দল আসছে চিনে, আর আমরা ফিরছি দেশে। কাগজ বিনিময়ের কাজ শেষ হতেই পাস থেকে নামতে শুরু করলাম দ্রুত। একটু দূরে দেখলাম আইটিবিপি-র লোকজন দাঁড়িয়ে আছেন ফ্লাস্ক-ভর্তি চা নিয়ে। সহাস্যে বললেন, ‘‘আপলোগ সব ঠিক হ্যায় তো?’’ আমরা মাটি থেকে ধুলো নিয়ে সবাই সবার কপালে লাগিয়ে দিলাম, ওঁদের কপালেও। সবাই তখন সমস্বরে গাইছে— ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হমারা...।’ আমরা সুস্থ দেশপ্রেমিক— যুদ্ধ আর চিনা পণ্য বয়কটের ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদী ছিলাম না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy