ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: কমলেশ আহিরীকে ডেকে বিতানের কথা জিজ্ঞেস করলেন, তার মোবাইল নম্বরও চেয়ে নিলেন। ফোনে বিতানকে একটা রেস্তরাঁয় লাঞ্চে ডাকলেন। বিতান খেতে খেতে তার অসুস্থ বাবার কথা জানাল। কমলেশ ঠিক করলেন, বিতানের সঙ্গে একটা মনের লড়াই লড়তে হবে তাঁকে।
কমলেশ রায় বললেন, ‘‘বিতান, এ বার কাজের কথায় আসা যাক। আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক হয়েছে। সাধারণ সম্পর্ক নয়, যে সম্পর্ক দুটি ছেলেমেয়েকে সারা জীবন একসঙ্গে থাকার দিকে ঠেলে দেয়, সেই সম্পর্ক। এই সম্পর্কে তারা যুক্তিবুদ্ধি হারায়। বুঝতে পারে না বা চায় না, তারা একসঙ্গে থাকার উপযুক্ত কি না, একে অপরের যোগ্য কি না। তারা অবধারিত ভাবে ভুল করে।’’
বিতানের চোখমুখ কঠিন হয় যায়। সে থমথমে গলায় বলে, ‘‘আপনি কী বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি।’’
কমলেশ একটু ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় বললেন, ‘‘আমি আমার মেয়েকে ভালবাসি। সে কোনও কারণ কষ্ট পাক আমি চাই না বিতান। আশা করি তুমিও চাইবে না। যদি চাও, তোমার জীবনে উৎসাহ ফিরিয়ে আনার কিছু দায়িত্ব আমিও নিতে পারি। মুম্বইতে চাকরি, নিজের ফ্ল্যাট, অসুস্থ বাবার চিকিৎসা....’’
বিতান চোয়াল শক্ত করে বলে, ‘‘ব্যস, আর বলতে হবে না। আমার কিছু দরকার নেই। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, অপমানিত হতে আসিনি।’’
কমলেশ একটু হেসে বললেন, ‘‘এর মধ্যে অপমানের কী দেখলে ইয়ং ম্যান? ডিল খুব পরিষ্কার। হিন্দি সিনেমায় তো এক সময় খুব দেখা যেত। এখনও দেখায় না কি? কত দিন যে সিনেমা–থিয়েটার দেখিনি।’’
বিতান দঁাতে দাঁত চেপে বলল, ‘‘আর কথা বাড়াবেন না। আপনার কোনও ডিলে আসবার প্রয়োজন নেই। আপনি আমাকে কী শোনাতে এসেছেন? আমি খুব ভাল করেই জানি, আমার সঙ্গে আহিরীকে মানায় না। কোনও দিক থেকেই আমি ওর যোগ্য নই। আমি ওর মিনিমাম থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাটুকুও করতে পারব না। আমি সে কথা আপনার মেয়েকে জানিয়েও দিয়েছি।’’
কমলেশ দু’হাত ছড়িয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘‘ওহো, জানিয়ে দিয়েছ? দেন ইট’স ওকে।’’
বিতান উঠে দঁাড়াল। তার চোখমুখে রাগে, অপমানে থমথম করছে।
‘‘আপনি যখন আজ ফোন করে ডেকেছেন, তখনই বুঝেছিলাম, এ রকম কিছু বলবেন। আমি রেডি হয়েই এসেছি। কিন্তু এতটা নীচে নেমে বলবেন ভাবতে পারিনি। স্যরি, বলতে বাধ্য হচ্ছি, আহিরীর বাবা হিসেবে আপনাকে ঠিক মানাছে না।’’
কমলেশ ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, ‘‘ইয়ং ম্যান, এত রাগ করে না। প্রেমে পড়া মানুষ হয় দু’রকম। কাপুরুষ, নয় লোভী। তুমি যে লোভী নও সে তো বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমি যে দেখছি...’’
বিতান বলল, ‘‘আপনি কি আমাকে কাপুরুষ বলছেন?’’
কমলেশ একই রকম হেসে কঁাধ ঝঁাকালেন। বিতান রাগে কিছুটা কঁাপছে। কমলেশ বুঝতে পারছেন, লড়াইয়ে তিনি জিতে গেছেন। খুব অল্প আয়াসেই জিতেছেন। মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ালেন তিনি।
‘‘ও সব এ বার বাদ দাও বিতান। আমি কি তোমাকে লিফট দেব?’’
বিতান চাপা গলায় বলল, ‘‘স্যর, অনেক অপমান করলেন, এ বার একটা কথা শুনে নিন। আমি আমার যাবতীয় কনফিউশন ঝেড়ে ফেলে আপনাকে জানিয়ে যাচ্ছি, অহিরী রাজি হলে আমি তাকে বিয়ে করব। থাকা–খাওয়া পরে বুঝে নেওয়া যাবে। অন্তত আপনার কাছে হাত পাতব না।’’
বিতান বেরিয়ে গেলে মুচকি হেসে আরও একটা কফির অর্ডার দিলেন কমলেশ। এক ঝটকায় মন ভাল হয়ে গেছে তাঁর। এই ছেলে শেষ পর্যন্ত আহিকে বিয়ে করত হয়তো, কিন্তু দ্বিধা, হীনমন্যতায় যদি দেরি হয়ে যেত? দুজনেই সারা জীবন অসুখী হয়ে থাকত। এই ধাক্কাটার দরকার ছিল। নবনীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হল, কিন্তু মেয়ের ভালবাসার পাশে দঁাড়ানোটা অনেক জরুরি। ওরা ঠিক পারবে। আহিকে পাশে পেলে বিতান জীবনের উৎসাহ খঁুজে পাবে। কফি এল, তাতে একটা চুমুকও না দিয়ে বিল মিটিয়ে উঠে পড়লেন কমলেশ। নিজেকে খানিকটা পাপমুক্ত লাগছে। মনে মনে বললেন, এটা সাধারণ কোনও সম্পর্ক নয়, যে সম্পর্ক দুটি ছেলেমেয়েকে সারা জীবন একসঙ্গে থাকার দিকে ঠেলে দেয়, সেই সম্পর্ক। এতে যুক্তি-বুদ্ধি নেই। তারা অবধারিত ভাবে ভুল করে। ভুল করে তারা সুখী হয়। সারা জীবন অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় না।
মোবাইলে আহিরীর ছবি ফুটে উঠল। কমলেশ এই ফোনটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
‘‘কী হয়েছে ডার্লিং?’’
আহিরী থমথমে গলায় বলল, ‘‘বাবা তুমি বিতানকে কী বলেছ? ও বলছে, কালই আমাকে বিয়ে করতে চায়। কী বলেছ তুমি ওকে?’’
কমলেশ চুপ করে রইলেন। বহু দিন পর তাঁর চোখের কোণ ভিজে উঠল।
১৭
অফিসে পৌঁছতেই নিলয় একটা মুখবন্ধ খাম এগিয়ে দিল। ‘‘স্যর, সৌহার্দ্য বসু এটা আপনার হাতে দিতে বলেছেন।’’
কমলেশ ভুরু কঁুচকে বললেন,‘‘আমাকে!’’
নিলয়ের মুখ খুশি-খুশি। নিশ্চয়ই তাকে নতুন অ্যাসাইনমেন্টের কথা বলা হয়েছে। বলল,
‘‘হ্যঁা স্যর।’’
নিলয় বেরিয়ে যেতে সাদা লম্বা খামটা খুললেন কমলেশ। সৌহার্দ্যর খাম বলেই এত তাড়াতাড়ি খুললেন। এই ছেলে তাকে কী লিখেছে? ইংরেজিতে লেখা চিঠি। তাড়াহুড়ো করে লেখা। কমলেশ দ্রুত পড়তে লাগলেন।
‘স্যর, আপনার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করে কথা বলব ভেবেছিলাম, কিন্তু এই মুহূর্তে সম্ভব হল না। একটু আগে বাড়ি থেকে ফোন করে জানিয়েছে, মা ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে, হাসপাতালে নিতে হবে। আমি বাড়ি যাচ্ছি।
‘স্যর, আমি এই কোম্পানি ছেড়ে দিচ্ছি। মেলে রেজ়িগনেশন পাঠিয়ে দিলাম। অল্প দিনের জন্য হলেও অফিসের দিনগুলো আমার ভাল কাটল। এই অফিসে জয়েন করে আপনার নাম জানতে পারি। চমকে উঠি। কারণ কমলেশ রায় নামটির সঙ্গে আমি আগে থেকেই পরিচিত। ভেবেছিলাম নেহাতই নামের মিল। পরে জানলাম, না, মানুষটাও এক। কোম্পানির সাইট থেকে আপনার অতীত অনেকটাই জেনেছি। কোথায় পড়েছেন, কত দিন বিদেশে ছিলেন, তার পর কলকাতায় না ফিরে কোথায় চাকরি করলেন, এই সব।
‘স্যর, আপনার শিক্ষা, কেরিয়ার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। যে দিন আমি জানতে পারলাম, আপনি সব কর্মীদের পার্সোনাল ডেটাবেসে মায়ের নাম জানানো বাধ্যতামূলক করতে চেয়েছেন, আমার খুব আনন্দ হল। তার কারণ আমি আমার মা’কে খুব ভালবাসি। তিনি আমার বন্ধু। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কষ্ট আর অপমানের। কোনও অপরাধ ছাড়াই তাঁকে শাস্তি পেতে হয়েছে। অথচ তাঁকে যখন প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলি, তিনি আমাকে বকাবকি করে ঘর থেকে বার করে দেন। আমার মা শ্রীকণা বসু এতটাই ভাল।
‘স্যর, বলতে খুবই লজ্জা করছে, যে মানুষটা মাকে কষ্ট দিয়েছিল, অপমান করেছিল, অপেক্ষা করতে বলে পালিয়ে গিয়েছিল, তার নামও কমলেশ রায়। কী আশ্চর্য না? এই রাগে প্রথম দিন আপনার ঘরে একটা দামি কাপ ভেঙে ফেলেছিলাম।
আমাকে মাপ করবেন।’
চিঠি হাতে দীর্ঘ ক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন কমলেশ রায়। ঘোর কাটল ত্রিপাঠীর ইন্টারকমে। ত্রিপাঠী সৌহার্দ্যর রেজ়িগনেশনের খবর দিলেন। আর বললেন, ‘‘হিজ় মাদার ইজ় ইন ক্রিটিকাল কন্ডিশন। সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক।’’
কমলেশ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কোন হাসপাতাল?’’
১৮
আহিরী বললেন, ‘‘বাবা, তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।’’
‘‘এত রাতে?’’
আহিরী বলল, ‘‘হ্যাঁ। এত রাতেই যেতে হবে। আমি তোমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাব।’’
‘‘তোর মা...?’’
আহিরী বলল, ‘‘মা–ই তো বলল, তোর বাবাকে নিয়ে যা। উর্বরা অর্গানাইজেশনের সঙ্গে উনিও জড়িত ছিলেন। সেখান থেকেই মা সব কিছু জেনেছিল।’’
কমলেশ বসে আছেন মেয়ের ঘরে। তিনি মেয়েকে বলেছেন। শ্রীকণার সঙ্গে প্রেম, তার পর বিদেশে পালিয়ে যাওয়া, সৌহার্দ্যর অফিসে জয়েন করা, আজ শ্রীকণার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, সবটাই বলেছেন।
‘‘আহি, নিজেকে সর্ব ক্ষণ অপরাধী লাগে। তোর মা আমাকে ছোট চোখে দেখে।’’
আহিরী শান্ত ভাবে সব শুনেছে। তার পর বাবার গায়ে হাত রেখে বলেছে, ‘‘চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা, তুমি ওঁর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। আজই যাবে।’’
কমলেশ বিহ্বল ভাবে বললেন, ‘‘শ্রীকণা কি আমার কথা বুঝতে পারবে?’’
আহিরী বলল, ‘‘উনি না পারুন, তোমাকে বলতে হবে। তুমি হালকা হবে। মা খুশি হবে।’’
হাসপাতালে এই সময়ে কাউকে ঢুকতে দেওয়ার কথা নয়। কন্ডিশন খুব খারাপ বলে সৌহার্দ্য ব্যবস্থা করল। ‘স্যর’ আসায় সে খুবই ছোটাছুটি করতে শুরু করে দেয়। নার্স বললেন, ‘‘পেশেন্টকে একদম বিরক্ত করবেন না। দেখে চলে আসবেন।’’
সবাই কেবিনের বাইরে দঁাড়িয়ে রইল, ভিতরে শুধু ঢুকলেন কমলেশ রায়।
১৯
একটু পরেই সন্ধে নামবে।
মূর্তি নদীর পাশে দঁাড়িয়ে আছেন কমলেশ আর নবনী। আহিরী আর বিতান হানিমুনে গেছে জ়ুলুক। ওরা ট্রেক করবে, ক্যাম্পে থাকবে, বনফায়ার করে মুরগির রোস্ট খাবে। নবনীর এ সবে খুব আপত্তি। এ কেমন হানিমুনের ছিরি? কমলেশ হেসে বললেন, ‘‘রাগ করে কী হবে? চলো আমরাও হানিমুনে যাই।’’ এ দিক-ও দিক ঘুরে ওঁরা দুজনে আবার মূর্তি নদীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
নবনী স্বামীর হাত ধরে আছেন। কমলেশ নবনীর কঁাধ হাত রাখলেন।
সূর্য অস্ত গিয়েছে। কুলকুল আওয়াজে নুড়ি পাথর ধুয়ে চলে যাচ্ছে নদী।
সমাপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy