Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মা ভেবেছিলেন, উদয়শঙ্কর দাড়িওয়ালা এক বয়স্ক লোক

তখনও উনি নাচের দলে আসেননি। মাত্র বারো বছর বয়স। দাদু অলঙ্কার-ব্যবসায়ী, তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন প্যারিসে। বাবাকে তখন বড়দা বলতেন। ছোটকাকা রবিশঙ্করই সেই বিদেশে তাঁর খেলার সঙ্গী। আমার মা অমলাশঙ্কর আগামী বুধবার পা দিচ্ছেন শতবর্ষে। তখনও উনি নাচের দলে আসেননি। মাত্র বারো বছর বয়স। দাদু অলঙ্কার-ব্যবসায়ী, তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন প্যারিসে। বাবাকে তখন বড়দা বলতেন। ছোটকাকা রবিশঙ্করই সেই বিদেশে তাঁর খেলার সঙ্গী। আমার মা অমলাশঙ্কর আগামী বুধবার পা দিচ্ছেন শতবর্ষে।

দম্পতি: ‘কল্পনা’। উদয়শঙ্কর ও অমলাশঙ্কর। ছবি সৌজন্য: মমতাশঙ্কর

দম্পতি: ‘কল্পনা’। উদয়শঙ্কর ও অমলাশঙ্কর। ছবি সৌজন্য: মমতাশঙ্কর

মমতাশঙ্কর
শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বাবা-মায়ের কথা ভাবতে বসলেই আমার কেমন যেন মনে হয়, ভগবান বোধহয় সব কিছু আগে থেকে সাজিয়ে রাখেন। নইলে যশোরের একটা ১২ বছরের মেয়ে কী করে প্যারিস গিয়ে পৌঁছয়! চার বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে দাদু কেন এক কথায় মা-কেই সঙ্গে নিতে রাজি হলেন! মায়ের জীবনের গতিপথ তো অনেকাংশে নির্ধারিত হয়ে গেল প্যারিস থেকেই।

সেটা ১৯৩১ সাল। প্যারিসে সে বার একটা খুব বড় প্রদর্শনী হয়েছিল, ইন্টারন্যাশনাল কলোনিয়াল এক্সপোজিশন তার নাম। পশ্চিমি শক্তি আর তাদের উপনিবেশ দেশগুলো, সকলকে নিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির একটা মেলা। সেখানে দাদু গিয়েছিলেন ভারতের প্রতিনিধি হয়ে। নাম অক্ষয়কুমার নন্দী। ইকনমিক জুয়েলারি ওয়র্কস বলে ওঁর একটা গয়নার দোকান ছিল চৌরঙ্গিতে। বিদেশে ভারতীয় অলঙ্কারকে তুলে ধরতে দাদু তার আগেও বিলেতে গিয়েছিলেন। প্যারিসেও ভারতের প্যাভিলিয়নে ওঁর গয়না আর সেই সঙ্গে ভারতীয় হস্তশিল্পের একটা বড় সম্ভার নিয়ে যাওয়ার ভার পড়েছিল ওঁর উপরে। দাদু নিজে তো গেলেনই, মা একবার বলতেই সঙ্গে করে মাকেও নিলেন। পরিবারের মেজ মেয়ে, মায়ের তখন ১২ বছর বয়স মাত্র।

প্যারিসেই বাবার সঙ্গে মায়ের প্রথম দেখা। বাবারা চার ভাই আর ঠাকুমা সকলেই ওখানে ছিলেন। বাবা তখনই বেশ বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। ওঁরা সে সময় ইউরোপ টুর করছিলেন। তা ছাড়া প্যারিসের ওই প্রদর্শনীতেও উদয়শঙ্কর ভারতীয় নৃত্যকলার প্রতিভূ হয়ে যোগ দিয়েছিলেন। দাদুর সঙ্গে ওঁর আগে থেকে পরিচয় ছিল। মায়ের কিন্তু তখনও উদয়শঙ্কর বলতে ধারণা, নিশ্চয় খুব বয়স্ক, দাড়িওয়ালা কেউ! বাবাকে দেখে ভুলটা ভাঙল। ওঁদের গোটা পরিবারের সঙ্গেই খুব আলাপ জমে গেল। বিদেশ-বিভুঁইয়ে বাংলায় কথা বলার লোক পেয়ে মা ভারী খুশি। আর ঠাকুমার কোনও মেয়ে ছিল না। উনিও মাকে পেয়ে একেবারে নিজের মেয়ের মতো কাছে টেনে নিলেন। মা তখন বাবাকে ‘বড়দা’ বলেন আর ছোটকাকা রবিশঙ্কর মায়ের খেলার সাথী। ‘রবু’ যেন মায়ের পিঠোপিঠি ভাই!

প্রায় সাত মাসের প্রদর্শনী শেষে দাদু যখন দেশে ফিরবেন, ঠাকুমা বললেন, ‘‘অমলাকে আমার কাছে রেখে যান! আমরা যখন ফিরব, ও আমাদের সঙ্গে ফিরবে।’’ বাবার ইউরোপ টুরের বাকিটায় মা ওঁর নাচের দলে যোগ দিলেন। তখনকার একটা চিঠিতে বড়মাসিকে লিখছেন মা, ‘‘এখানে আমি এক মাসীমা পেয়েছি, ঠিক আপন মাসীমারই মতো। ইনি বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যবিৎ উদয়শঙ্করের মাতা।...এঁরা সমগ্র ইউরোপে নৃত্য দেখাতে যাবেন, আমাকে এঁদের সঙ্গে নিতে চান। বাবা এতে মত দিয়েছেন (বানান অপরিবর্তিত)।’’

এই নাচের একটু ইতিহাস আছে। প্যারিসের প্রদর্শনীতে ভারতের দলের হয়ে নেচেছিলেন মা। মাকে তার জন্য নাচ শিখিয়েছিলেন প্যারিসেরই প্রাচ্য নৃত্যবিদ নিয়তা-ইনিওকা। মাকে নাচতে দেখে বাবার তখনই খুব ভাল লেগেছিল। তার পর মা যখন ওঁদের বাড়িতে গেলেন, বাবা এক দিন একটা স্টেপ করে দেখাতে বললেন মাকে। মা সহজেই করে ফেললেন। একটা লাঠি বাতাসে ঘুরিয়ে দেখাতে বলতে মা সেটাও চমৎকার করলেন। বাবা তখনই বুঝেছিলেন, মায়ের মধ্যে নাচের খুব বড় প্রতিভা আছে। তার পরেই দাদুর কাছে অনুরোধ করলেন, মাকে রেখে দেওয়ার জন্য। বাবার সঙ্গে তখন সিমকি-র (ফরাসি কন্যা, নৃত্যশিল্পী সিমোন বারবিয়ে) জুটি খুব বিখ্যাত। মাকে নিয়ে দলে তিন জন মেয়ে হল— সিমকি, মা আর বাবার খুড়তুতো বোন কনকলতা (মীনা)। এই ভাবেই প্রথম বার বাবার সঙ্গে মায়ের মঞ্চে ওঠা। মায়ের মুখে শুনেছি, বাবা সিমকিকে বলেছিলেন, ‘‘অমলাকে কিছু কাপড় দাও।’’ টুকরো টুকরো কাপড় সেলাই করে মা নিজে হাতেই নিজের কস্টিউম বানিয়েছিলেন। ‘কালীয় দমনে’ মা কালীয় হতেন। বাবা কৃষ্ণ। শো-এর বিজ্ঞাপনে মায়ের নাম লেখা হত ‘অপরাজিতা’ বলে। ইউরোপ জুড়ে খুব সুখ্যাতি হয়েছিল সেই টুরের।

দেশে ফেরার পরে মা ওই তেরো-চোদ্দো বছর বয়সেই তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন। ‘সাত সাগরের পারে’ নামে ওই বইটারও খুব সমাদর হয়েছিল তখন। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র বসু সে বইয়ের জন্য প্রশংসা বার্তা লিখে দিয়েছিলেন। জাহাজে চড়ে ইউরোপ যাওয়া, প্যারিসের প্রদর্শনীর কথা, বাবার সঙ্গে আলাপ হওয়া এবং বাবার নাচের দলের সঙ্গে টুর করার গল্প ওই বইয়ে মা নিজেই লিখে রেখেছেন। এক ভারতীয় কিশোরীর চোখ দিয়ে সেই সময়কার ইউরোপকে দেখার অমন বর্ণনা আর ক’টা আছে জানি না।

তখনও কিন্তু নাচকেই বেছে নেওয়ার কথা মায়ের মনে আসেনি। দাদুও তেমন কিছু ভাবেননি। উনি বরাবর চাইতেন, মা বড় লেখক হোন। সুতরাং এখানে ফেরার পরে মা আবার পড়াশোনায় মন দিলেন। ডবল প্রোমোশন পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হলেন। ঘাড়ের কাছে একটা খোঁপা, মেরুন টিপ আর বর্ডার দেওয়া বড় হাতা ব্লাউজ— এই ছিল ওঁর কলেজের সাজ। সব সময়ে একটা ব্যক্তিত্ব ওঁকে আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা করে দিত। কলেজে মেয়েরা কেউ বলত, আমি চাই আমার বর এ রকম হবে, কেউ বলত ও রকম হবে। মা শুনতেন সবই, কিন্তু ওঁর যেন কাউকেই চোখে লাগত না। খুব ছোট্ট বয়স থেকে গোগ্রাসে সাহিত্য, মহাকাব্য পড়েছেন। মাইকেল মধুসূদন, নবীনচন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ...লার্জার দ্যান লাইফ পৌরাণিক নায়কেরাই যেন মাকে বেশি টানত। ওই সময়ে এক বার নিউ এম্পায়ারে বাবার একটা শো ছিল। দাদু, দিদা, মা আর ঠাকুমা একসঙ্গে বক্সে বসেছিলেন। বাবার তখন একটা খুব বিখ্যাত নাচ ছিল, কার্তিকেয়। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবাকে সে দিন ওই বেশে মঞ্চে দেখেই ওঁর মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠেছিল, ‘‘দিস ইজ দ্য ম্যান ইন মাই লাইফ!’’ মা যে খুব একটা ইংরেজি বলতেন সব সময়, তা নয় একেবারেই। কিন্তু সে দিন ঠিক এই বাক্যটাই মায়ের ভিতর থেকে উঠে এসেছিল। মা অবশ্য কাউকে কিছুই বলেননি। কিন্তু কী আশ্চর্য, এর কিছু দিন পরেই সুভাষচন্দ্র বসু আমার দাদুকে বললেন, ‘‘অমলাকে আপনি আলমোড়ায় পাঠাচ্ছেন না কেন?’’

আলোছায়া: উদয়শঙ্করের ক্যামেরায় অমলা। ছবি সৌজন্য: মমতাশঙ্কর

১৯৩৯-এর গোড়ার দিকে বাবা আলমোড়ায় ওঁর ডান্স সেন্টার খোলার কাজে হাত দিয়েছিলেন। গুণিজনেদের মধ্যে দারুণ সাড়া পড়ে গিয়েছিল সেই নিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই তাই সুভাষচন্দ্রের মনে হয়েছিল, মায়ের ওখানে যাওয়া উচিত। দাদু রাজি হলেন। আলমোড়ায় তখন কে নেই! সিমকি, জোহরা সেহগল, উজরা (জোহরার বোন), গুরু দত্ত, সর্দার মালিক (পরে বম্বের বিখ্যাত সুরকার), নরেন্দ্র শর্মা, শান্তি বর্ধন, প্রভাত গঙ্গোপাধ্যায়... কথাকলি শেখাতেন শঙ্করন নাম্বুদ্রি, মণিপুরীতে আমোবি সিংহ, ভরত নাট্যমে বালা সরস্বতীর গুরুজি কান্ডাপ্পা পিল্লাই... মাঝে মাঝেই আসতেন আলাউদ্দিন খাঁ। মা তো গুরু দত্তকে ভীষণ ভালবাসতেন! খালি ভাবতেন, ছেলে হলে যেন গুরুর মতো দেখতে হয়!

সারপ্রাইজটা এল ৮ ডিসেম্বর (১৯৩৯)। বাবার জন্মদিন সে দিন। রাত বারোটার পরে মায়ের ঘরে টোকা দিয়ে ঢুকে বললেন, ‘‘জানিস আমি বিয়ে করব ঠিক করেছি (বাবা মাকে তুই করে বলতেন)।’’ মা তো চুপ। কোনও মতে বললেন, ‘‘বাঃ খুব ভাল।’’ বাবা আবার বললেন, ‘‘জানতে চাইলি না তো কে? তার নাম অমলা!’’ ব্যস, আর কি বাঁধ মানে? মা খুশিতে একেবারে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললেন!

ওই আলমোড়া থেকেই এক বার পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া হয়েছে! তখন বাবা-মার বিয়েটিয়ে হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে গুরু দত্তও গিয়েছেন! এক দিন ঘরে ফিরে বাবা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ইমাজিনেশন-এর বাংলা কী?’’ মা বললেন, কল্পনা। গুরুর হাতে একটা খাতা ছিল। বাবা বললেন, ‘‘লেখো তো কল্পনা!’’ গুরু লিখে তলায় একটা লাইন টেনে দিলেন! সে খাতাতেই চিত্রনাট্য লেখা হল। বাবা বলতেন, গুরু দত্ত লিখতেন। এ-ই ‘কল্পনা’র শুরু! তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে। কিছু দিনের মধ্যেই নানা কারণে আলমোড়ার সেন্টারটা বন্ধ করে দিতে হল। বাবার মনপ্রাণ জুড়ে তখন ‘কল্পনা’। এখন বুঝি, ছবিটা সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। ক’দিন আগেও সঞ্জয় লীলা বনশালী আমাকে বলছিলেন, ‘‘ভারতীয় নৃত্যশৈলী বোঝার জন্য কল্পনা যেন বাইবেল!’’

‘সামান্য ক্ষতি’রও একটা মজার গল্প আছে। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ পালন হবে। জওহরলাল নেহরু বাবাকে ফোন করে বললেন, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু ভাবতে। বাবার তো মাথায় হাত! কী করা যায়? খুব বেশি গান নির্ভর কিছু করলে তো বাঙালিরা ছাড়া কেউ বুঝবে না। তবে? মা নিম-বেগুন রাঁধছিলেন! বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কোনও গল্প বা কবিতা মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের, যেখানে অনেক মেয়ে, রাজা-রানি সব থাকবে?’’ মা খুন্তি হাতেই বলে উঠলেন, ‘‘স্নানে চলেছেন শত সখীসনে, কাশীর মহিষী করুণা...।’’ বাবা ওঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একটা তুড়ি মেরে বললেন, ‘‘পেয়ে গেছি!’’

এই রকমই ছিলেন বাবা। বিদ্যুৎ গতিতে ভাবতে পারতেন। নইলে কুড়ির দশকে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব আর্ট-এ স্যর উইলিয়াম রদেনস্টাইনের প্রিয় ছাত্র উনি, আনা পাভলোভার সংস্পর্শে এসে উপলব্ধি করলেন, আঁকা নয়, নাচই ওঁর ব্রত। বাবাকে ঘিরে রদেনস্টাইন আর পাভলোভার মধ্যে বেশ একটা টানাপড়েনই হয়ে গিয়েছিল তখন। রদেনস্টাইন বললেন, ‘‘বেশ! শঙ্করকেই জিজ্ঞেস করা হোক, ও কোন দিকে যেতে চায়!’’ উনি ভেবেছেন, বাবা আঁকার দিকেই থাকবেন! বাবা সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘‘নাচ!’’

ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন বাবা! চেন্নাইয়ের জেমিনি স্টুডিয়োতে ‘কল্পনা’র প্রায় ৮০টা নাচের সিকোয়েন্স তোলা হয়েছিল। বাবা পরে তার অর্ধেক কেটে কেটে ফেলে দিয়েছিলেন। বলতেন, ‘‘বুড়ো বয়সের এই সব পারফরম্যান্স কেউ দেখবে না।’’ মা তা-ও জোর করে কার্তিকেয়, লেবার অ্যান্ড মেশিনারি-র (উদয়শঙ্করের বিখ্যাত নৃত্য-আলেখ্য) বেশ কিছুটা রাখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘সব ফেলে দিলে পরের প্রজন্ম কী জানবে?’’ বাবার পাশে মা আবার এ রকমই ধীরস্থির, শৃঙ্খলাপরায়ণ। আল্পনা দেওয়া থেকে রান্না থেকে ঘর সাজানো, যেটাই করেন, একশো শতাংশ দিয়ে করেন! কোনও দিন শেখেননি, কিন্তু আঙুল দিয়ে, নখের কোণা দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর ছবি আঁকেন। সে সব ছবির বেশ কিছু বাবা ‘রামলীলা’, ‘লাইফ অব বুদ্ধ’-য় ব্যবহার করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘আর্টে সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্র আমি। তুই তো না শিখেও আমাকে অবাক করে দিস!’’

আমার অভিনয়ের ঝোঁকটা ধরিয়েছিলেন বাবাই। ছোটবেলায় খুব ঘ্যানঘ্যান করতাম, খালি ‘ভাল্লাগছে না, ভাল্লাগছে না’ বলতাম। বাবা তখন বলতেন, ‘‘আয়নার সামনে গিয়ে বোস্‌! ‘ভাল্লাগছে না’ কথাটা কত রকম ভাবে বলতে পারিস দ্যাখ!’’ বকেধমকে শেখাতেন না কিছু। রিহার্সাল যখন হত, আমি ছেলেমেয়েদের পায়ে পায়ে ঘুরে নেচে বেড়াতাম। বাবা ওদের বলতেন, ‘‘ওর দিকে একদম মন দেবে না। ও যা করছে করুক। তোমরা শুধু খেয়াল রেখো, যাতে পায়ে জড়িয়ে পড়ে না যাও!’’ তার পর ফাইনাল রিহার্সালের সময়ে ডেকে বলতেন, ‘‘এ বার এসে বসো, চলো আমরা দেখি সবাই ঠিক ঠিক করছে কি না!’’ ব্যস, আমিও খুশি হয়ে বসে পড়তাম! নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে তো তখন!

আসলে ছেলেমেয়েদের নিজের মতো করে বাড়তে দেওয়ার ব্যাপারটায় বাবা-মা দু’জনেই খুব বিশ্বাস করতেন! উনিশ বছর বয়স থেকে আমি ফিল্মে অভিনয় করছি। মা কিন্তু কোনও দিন আমার পিছন পিছন শুটিংয়ে যাননি। শুধু জীবনের আসল কথাটা বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘সবার সঙ্গে মেশো, কিন্তু নিজের ওজনটা রেখে মেশো! নিজের চারপাশে একটা গণ্ডি রাখবে, যাতে কেউ তোমায় সহজলভ্য মনে না করে!’’

১৯৬৫ সালে কলকাতায় আবার নাচের অ্যাকাডেমি চালু করেছিলেন বাবা। আমি ওখানেই নাচ শিখেছি। কিন্তু উদয়শঙ্কর শৈলীর মর্মবস্তুটা আসলে কী, সেটা আমাকে শিখিয়েছেন মা। বুঝিয়েছেন, এটা শুধু নাচ নয়, এটা একটা দর্শন। শরীর, মন আর আত্মার মধ্যে পারস্পরিক মেলবন্ধন হলে তবে সেটা উদয়শঙ্করের শৈলী হয়। যাঁরা বলেন, উদয়শঙ্কর মানেই প্রাচ্য আর প্রতীচ্যকে যথেচ্ছ মেশানো, তাঁরা ঠিক বলেন না। মা আমাকে বুঝিয়েছেন, উদয়শঙ্করের স্টাইলে স্বাধীনতার প্রভূত সুযোগ আছে ঠিকই, কিন্তু তারও একটা কাঠামো আছে। একটা ব্যাকরণ আছে। কে যেন খুব সুন্দর করে বলেছিলেন এক বার, মৌমাছি নানা ফুল থেকে মধু নেয়। কিন্তু তার পর মৌচাকে যে মধুটা তৈরি হয়, তাতে আলাদা আলাদা ফুলের আলাদা আলাদা গন্ধ আর থাকে না। মিলেমিশে গিয়ে সেটা তখন আদ্যন্ত নতুন একটা জিনিস। মা-ই আমার চোখটা খুলে দিয়ে দেখিয়েছিলেন, কোনটা হলে উদয়শঙ্করের শৈলী হয়, কোন বিচ্যুতিটা হলে সেটা হয় না।

আজও যখন প্রাচীন ভাস্কর্য দেখি, বিশেষ করে শিব-পার্বতী, আমি কিন্তু আমার বাবা-মা ছাড়া কিছু দেখতে পাই না। এই ২৭ তারিখ শতবর্ষে পা দিচ্ছেন মা। একটাই দুঃখ থেকে গিয়েছে ওঁর, বাবার নামে আজও একটা সত্যিকারের ভাল মঞ্চ হল না। অথচ মায়ের কাছেই শোনা, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এক বার বলেছিলেন— বিশ্বের দরবারে ভারতকে পৌঁছে দিয়েছেন চার জন। মহাত্মা গাঁধী, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ আর উদয়শঙ্কর!

অনুলিখন: জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE