পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নন। প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসকও নন। তিনি ‘ইঞ্জিনিয়ার’। তাঁর পরিকল্পনায় তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প শিলং শহরকে বিদ্যুৎ জুগিয়ে চলেছে আজও। বিধানচন্দ্র রায়ের এই কৃতিত্বের কথা বাঙালি আজ প্রায় ভুলে গিয়েছে। গত বুধবার ছিল তাঁর জন্মদিন।
সালটা ১৯৮৩, পঞ্জাব যেন জ্বলছে! এক দিকে খালিস্তানি জঙ্গিরা আগুন জ্বালাচ্ছে, অন্য দিকে গ্রীষ্মের গনগনে সূর্য! সেই পঞ্জাবেই পোস্টিং আমার। আচমকাই এক দিন কম্যান্ডিং অফিসার ডেকে বললেন, ‘‘বাক্স-প্যাঁটরা গোছাও। তোমাকে গুলমার্গে হাই-অল্টিটিউড ট্রেনিংয়ে যেতে হবে।’’ গরমে ভাজাপোড়া হওয়া থেকে কাশ্মীরের গুলমার্গ! শুনেই তরুণ লেফটেন্যান্টের মনের মধ্যে যেন ‘কাশ্মীর কি কলি’র সুর বেজে উঠল।
হাই-অল্টিটিউড ট্রেনিং কী না জানলে অবশ্য গুলমার্গের নামে এমন হৃদয়-নাচন হতেই পারে। বরফচুড়োয় বসে দেশরক্ষা করার কষ্ট কেমন তা জানলে বোধহয় আমজনতার অনেকেই দ্বিতীয় বার সেই নাম করবেন না। লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চিনা সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু ‘বিশেষজ্ঞ’ দেখা যাচ্ছে। হাবেভাবে তাঁরা এখনই সিয়াচেন যেতে তৈরি। সে সব দেখেই আরও বেশি করে মনে পড়ছে ওই এলাকায় দীর্ঘ দিন কাজ করার, প্রশিক্ষণের কথা। কারণ, পাহাড়ি এলাকায় শত্রুর মোকাবিলা করতে হলে ওই প্রশিক্ষণ নিতেই হবে।
প্রশিক্ষণের জন্য রওনা হওয়ার ক’দিন আগেই ফের নির্দেশ। প্রশিক্ষণ তো হবেই, কিন্তু আমাকে সঙ্গে করে আমার আগ্নেয়াস্ত্র ও ফার্স্টলাইন অ্যামিউনিশন নিয়ে যেতে হবে। ট্রেনিংয়ে আবার অস্ত্র কেন? শুনলাম, ওই প্রশিক্ষণের সময় আমাকে লাইন অব কন্ট্রোলের কাছাকাছি যেতে হবে। লাইন অব কন্ট্রোলে ভারত নিজে থেকে গুলি চালায় না বটে, কিন্তু প্রতিপক্ষের হামলায় সঙ্কট তৈরি হলে ওই অস্ত্রই ভরসা। রওনা দিলাম। সঙ্গে দুই সহকর্মী লেফটেন্যান্ট বেণুগোপাল ও লেফটেন্যান্ট গুরিন্দর সিংহ কাঙ্গ। গুলমার্গে দু’সপ্তাহ ভালই কাটল। এ বার রওনা শ্রীনগর-লেহ সড়ক ধরে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের এক জায়গা। সেখানে রক ক্লাইম্বিং ট্রেনিং। ট্রেনিংয়ে ঝুঁকি ছিল কিন্তু পরে বুঝলাম, সে সব কিছুই না! কারণ শেষ দফা খারদুং লা-তে, যার একটু দূরেই রয়েছে মাচুই গ্লেসিয়ার!
অনেকেই ভাবছেন, খারদুং লা তো হামেশাই ঘুরতে যাচ্ছে লোকজন। কিন্তু আপনাকে যদি রাতে ৫০ ফুট গভীর কোনও বরফের খাদ বা ক্রিভাসে ফেলে দেওয়া হয়? ভাবছেন, মাথা খারাপ হল না কি? না, মাথা খারাপ নয়। ওটাই সিয়াচেনের তুষারচুড়োয় কর্তব্যরক্ষার প্রথম পাঠ। যেখানে টহলদারি করতে গেলে পায়ে পায়ে বিপদ, যেখানে সামান্য অসতর্কতায় বরফের অতলে তলিয়ে যাওয়ার হাতছানি, সেখানে এই ট্রেনিং নিতেই হবে। মনে আছে, ক্রিভাসের ভিতরে একটা অদ্ভুত মায়াবী আলো দেখা যেত। সেই আলো দেখতে দেখতেই পায়ের ‘ক্র্যাম্পন’ বা কাঁটাওয়ালা জুতো দিয়ে বরফের দেওয়ালে গর্ত করতে হত। তার পর আইস-অ্যাক্স দিয়ে গর্ত খুঁড়ে পেরেক লাগিয়ে তাতে দড়ি বেঁধে সেই দড়ি বেয়ে উঠে আসতে হত। এক বার, দু’বার নয়, বার বার এই প্রশিক্ষণ নিতে হয়, যাতে বিপদে নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারি। মনে পড়ে, আমি ছিলাম ‘লিডার’। শারীরিক সক্ষমতার জন্য আমি আগে উঠতাম, তার পর বেণু এবং সব শেষে দশাসই গুরিন্দর।
লেহ বা লাদাখ গেলেই অনেকের শরীর খারাপ লাগে, হাঁপ ধরে যায়। সেখানে গালওয়ান উপত্যকা, প্যাংগং সো হ্রদ কিংবা আরও উপরে সিয়াচেন যাঁরা পাহারা দেন কিংবা প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাতাহাতি করেন, তাঁদের সক্ষমতা এক বার ভেবে নিন। ওই প্রশিক্ষণের সময়েই সিয়াচেন চিনিয়েছিলেন মেজর ভি পি সিংহ। পরে আমাদের আর এক কর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল বি কে শর্মা সিয়াচেন হিমবাহ দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ওই যে দেখছ সিয়াচেন, ওর তাপমাত্রা মাইনাস ৪৫ ডিগ্রির নীচেও নেমে যায়। মানুষের পক্ষে বাঁচা কার্যত অসম্ভব।’’ ওই কথার দু’বছরের মধ্যেই পাকিস্তানের অভিসন্ধি আগাম জানতে পেরে ভারতীয় সেনা সিয়াচেনে ঘাঁটি তৈরি করে। এখনও জওয়ানরা বছরভর ঘাঁটি গেড়ে থাকেন ওই হিমবাহে। বাঁচার অযোগ্য পরিবেশ, ধূ-ধূ বরফের প্রান্তর, পদে পদে তুষারধস, বরফের চোরা ফাটল এবং তুষারক্ষত বা ফ্রস্টবাইটের হাতছানি তো রয়েছেই, আর আছে মানসিক ক্লান্তি। এই সব সয়েও অতন্দ্র পাহারা দেওয়ার নামই ‘ডিউটি’। যাঁরা ঘরে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় হুঙ্কার দেন, রণনীতি সমরকৌশল নিয়ে ‘মতামত’ দেন, তাঁরা কোনও দিনই এই পরিস্থিতির মর্ম বুঝতে পারবেন না।
তবে লাদাখে ভাল লাগত এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় চরকিপাক দিতে। লাদাখের পাহাড় বাকি হিমালয়ের পর্যটন কেন্দ্রের মতো গাছে ঢাকা, ফুলে ভরা সুন্দর নয়। বরং রুক্ষ মরুভূমির মতো নেড়া নেড়া পাহাড়গুলোকে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ বলা যায়। ট্রেনিংয়ের নিয়ম মেনেই রোজ ওই নেড়া পাহাড়ে টহল দিতে যেতে হত। ওই টহলদারি যেমন পাহারা দিতে শেখায়, পাহাড়ি যুদ্ধের কৌশল শেখায়, তার থেকেও বেশি শেখায় পাহাড় চিনতে, প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হতে। কারণ, উচ্চতা বাড়লে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে শুরু করে। শরীরে আচমকা অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে যে কোনও শক্তসমর্থ মানুষও ধরাশায়ী হবে, মৃত্যুও অস্বাভাবিক নয়। তাই বিভিন্ন এলাকায় হেঁটে হেঁটে আমাদের খাপ খাওয়াতে হয়। সে ভাবেই ওই এলাকায় চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যেতে হত। আমি তখন সেই অর্থে নতুন অফিসার, কিন্তু ওই টহলদারি বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমার বাহিনীর কত সেনা ওই কঠিন জায়গায় দিনের পর দিন পরিবার-পরিজন ছেড়ে পড়ে রয়েছে। টহলদারি কোনও বার হত মাচুই হিমবাহে, কোনও দিন হত প্যাংগং হ্রদের দিকে, কোনও দিন বা গালওয়ান উপত্যকায়। ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার কল্যাণে প্যাংগং সো বা লেকের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। নীল আকাশের নীচে ওই হ্রদ কি সেই আশির দশকের মাঝে আরও সুন্দর ছিল? কী জানি, হয়তো বা কঠোর প্রশিক্ষণ এবং রুক্ষ প্রকৃতিতে ওই নীল নিসর্গই আমাদের মনে অক্সিজেন জোগায়।
লাদাখ হোক, কাশ্মীর হোক বা উত্তর-পূর্বাঞ্চল, কাজের জায়গায় স্থানীয় মানুষের সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে। লাদাখে দেখেছিলাম, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা কী ভাবে পারস্পরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে থাকেন। ওই এলাকাতেই পরিচয় হয়েছিল নামগিয়াল বলে এক যুবকের সঙ্গে। ওর অনুরোধেই নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়েছিলাম। দেখলাম, এক হাঁড়ি ভেড়ার মাংস রান্না করে আনা হয়েছে। তাতে কিছু মাংসের টুকরোর গায়ে সুতো জড়ানো, আবার কিছু টুকরো এমনিই রয়েছে। আমি কৌতূহলী হয়ে তাকাতেই নামগিয়াল বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা। আসলে দু’টি ভেড়া কাটা হয়েছিল। একটা ‘ঝটকা’ বা ‘জাটকা’ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ এক কোপে ধড়-মাথা আলাদা করা হয়েছে। অন্য ভেড়াটিকে ‘জবাই’ করা হয়েছিল। মাংস কাটার পদ্ধতি নিয়ে মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সংস্কার রয়েছে। তাই একই সঙ্গে দু’ধরনের মাংস রান্না করা হলেও ‘ঝটকা’ মাংসে টুকরোর গায়ে সুতো জড়িয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। নামগিয়ালই বলেছিল, বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু বিয়ের পরে ধর্মান্তরকরণ বাধ্যতামূলক নয়। এখানেই বোধহয় লাদাখি সংস্কৃতি পাহাড়ের মতোই উদার। ওই এলাকায় পশুচারণ করা বাকরওয়াল মুসলিম সম্প্রদায়ও রয়েছে। সেই সম্প্রদায় সেনাবাহিনীর ‘ঘনিষ্ঠ’ বন্ধু। এমনই এক সম্প্রদায় জানিয়েছিল, নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক হানাদারেরা ঘাঁটি গেড়েছে। যার পরিণাম কার্গিল যুদ্ধ। তার ইতিহাস পুনর্চর্বণ না-ই বা করলাম।
তবে সীমান্তে যুদ্ধ কিন্তু ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধের পর ১৯৬৭ সালে নাথু লা সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল। তার পরে ১৯৭৫ সালে অরুণাচল প্রদেশে অসম রাইফেলসের একটি দল ভুল করে চিনে ঢুকে পড়েছিল এবং চিনা সেনার গুলিতে চার জন জওয়ান নিহত হয়। তার পর থেকে আর বড় মাপের সংঘর্ষ হয়নি। দু’দেশ মুখোমুখি হয়েছে, তর্কাতর্কি বা ধাক্কাধাক্কিও হয়েছে। আবার সৌহার্দ্য বিনিময়ের উদাহরণও কম নয়।
মনে রাখতে হবে, নিয়ন্ত্রণরেখায়— তা সে লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি হোক কিংবা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি)— দিনরাত গোলাগুলি চালানো নয়। দু’পক্ষের সমঝোতা মেনেই বহু সময়ে রাইফেল ছাড়াই যাওয়া হয় বা রাইফেল নিয়ে গেলেও তা পিঠে নিয়ে নল মাটির দিকে তাক করা থাকে। যাকে বলে ‘ব্যারেল ডাউন’। অর্থাৎ আমার এলাকা আমি নজরে রাখছি কিন্তু প্রতিপক্ষকে উদ্যত রাইফেলের সামনে দাঁড় করাচ্ছি না। কিন্তু আমার এলাকা দখল করলে আমি অস্ত্র তুলতে জানি। তবে ইদানীং চিন সীমান্তে গোলমাল বেড়েছে। ডোকলাম পরিস্থিতি ছাড়াও লাদাখ ও অরুণাচলে প্রায়ই ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। তার পিছনে চিনের আগ্রাসী মনোভাব বৃদ্ধি দায়ী। চিন কেন গালওয়ান উপত্যকার উপরে দখল বাড়াতে চাইছে তার একটি কারণ আমার মনে উঁকি দিচ্ছে। তা হল ঝিনজিয়াং প্রদেশের উপরে চিনের ক্ষমতা প্রদর্শন। ইতিহাসগত ভাবেই লাদাখের সঙ্গে চিনের এই প্রদেশের সম্পর্ক রয়েছে। এই প্রদেশটি মুসলিমপ্রধান এবং শোনা যায়, চিনা সরকার এই মুসলিমদের ‘মগজ ধোলাই’ করার (চিনা সরকারের ভাষায় ডি-র্যাডিকালাইজ়েশন) উদ্দেশ্যে শিবির করছে। কিন্তু দীর্ঘ সম্পর্কের সূত্রেই ঝিনজিয়াং প্রদেশের উইগুর মুসলিমরা লাদাখের মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান নিয়ে অবহিত এবং ভারতের প্রতি তাঁদের সমর্থন রয়েছে। ফলে এই সম্পর্কে বাধা দিয়ে ঝিনজিয়াংয়ে নিজের কর্তৃত্ব আরও কড়া করতে চায় শি চিনফিংয়ের সরকার।
শেষমেশ ফিরে যাই সেই লাদাখি মানুষদের কথায়, যাঁরা ভিন্ন ধর্মের মানুষকে সম্মান করতে পারেন, যাঁরা লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত এলাকা বলে ঘোষণা হওয়ায় খুশি। সেই মানুষদের কথা ভেবে কূটনৈতিক এবং সামরিক দৌত্যের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানই কাম্য।
অনুলিখন: কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy