Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪

কুষ্ঠরোগীর সেবা করেন খলনায়িকা‌‌

এই শশীকলাকে চেনে না বলিউড। নিজের হাতে বিছানায় লেগে থাকা রক্ত, ঘা ও পুঁজ পরিষ্কার করেন। মাদার টেরিজার আশ্রমে উজাড় করে দেন নিজেকে।বম্বের শশীকলা মুগ্ধ হয়েছিলেন কলকাতার মাদার টেরিজার কথা শুনে। অসহায়, বিপন্ন মানুষকে না কি বুকে টেনে নেন মাদার! সমাজ–পরিত্যক্ত কুষ্ঠ রোগীকেও ভালবাসার আশ্রয় দেন! জেনে শান্তি পেয়েছিলেন মনে। তখন নিজেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছেন শশীকলা।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০৩
Share: Save:

বম্বের শশীকলা মুগ্ধ হয়েছিলেন কলকাতার মাদার টেরিজার কথা শুনে। অসহায়, বিপন্ন মানুষকে না কি বুকে টেনে নেন মাদার! সমাজ–পরিত্যক্ত কুষ্ঠ রোগীকেও ভালবাসার আশ্রয় দেন! জেনে শান্তি পেয়েছিলেন মনে। তখন নিজেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছেন শশীকলা। সংসার ভেঙেছে ক’দিন আগে। ১৯ বছর বয়সে, বাড়ির সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে যাঁর সঙ্গে সংসার পেতেছিলেন, সেই ওমপ্রকাশ সায়গলকে আর এক মুহূর্তও সহ্য হচ্ছিল না। স্বামী, সংসার ছেড়ে আগেও এক বার পরপুরুষের হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সে বারও একই অস্থিরতা, একই বিরক্তি আর রাগ তাড়িয়ে ফিরেছিল তাঁকে। কিন্তু এ বার নিজের অস্তিত্ব নিয়েই সংশয়ে পড়েছেন। কেন, কাদের জন্য বেঁচে আছেন, কেন এখনও দু’–তিন শিফটে কাজ করতে হচ্ছে— কোনও প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছেন না!‌ শশীকলা তখন ৫৬। চাকরি করলে আর দু’বছর পর রিটায়ার করতেন!‌

সেটা ১৯৮৮ সাল। ‘ঘর ঘর কি কহানি’ ছবির কাজ সবে শেষ করেছেন। কাদের খানের খান্ডারনি বউয়ের চরিত্রে শশীকলা। নীচ, হীন মানসিকতার এক জাহাঁবাজ মহিলা। ঠিক যে ভাবে শশীকলাকে দেখতে অভ্যস্ত হিন্দি সিনেমার দর্শকেরা, তেমনই ‘খারাপ’ চরিত্র। তুখড় অভিনয়, প্রচুর হাততালি, যথারীতি।

কিন্তু ঝড় বইছিল মনের মধ্যে। সেটে বসে, শটের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠছিলেন। সারা জীবন শুধু কাজই করে গেলেন। নিজের খুশিতে নয়, অন্যের পেট ভরাতে। সেই কোন ছোট্টটি থেকে কাজ করছেন! মোটে ৭ বছর বয়স তখন। বাবা–মা, পাঁচ ভাই–বোনের পেট ভরানোর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল ওই বয়সেই। যখন পুতুল খেলার কথা, বাড়ির উঠোনে গোল্লাছুট-এক্কাদোক্কা খেলার কথা, তখন তিনি নৌটঙ্কি দলের সঙ্গে শোলাপুরের গ্রামে গ্রামে নাচ দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারণ বাড়িতে সাতটা অভুক্ত মুখ অপেক্ষা করে আছে। যাঁকে বিয়ে করলেন, সেই সায়গল সাহেবের ব্যবসা মার খেল। স্বামী, দুই মেয়ের দায়িত্বও তাঁকেই নিতে হল! মেয়েদের বড় করলেন, বিয়ে দিলেন। তাও কাজ ফুরোল না। স্টুডিও থেকে হা–ক্লান্ত হয়ে রোজ বাড়ি ফেরেন, আর ভাবেন, কেন? কীসের জন্যে?‌

ওই ’৮৮ সালেই অভিনয় ছেড়ে পুণের বাড়িতে ফিরে গেলেন শশীকলা। ঢের হয়েছে। আর নয়। এ বার বিশ্রাম। কিন্তু সংসার তাঁকে সেই শান্তি দিলে তো!‌ বাড়ি, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী তো দেখতে চায় ফিল্মি শশীকলাকে, যাঁর বাড়ির সামনে বাঘা বাঘা প্রযোজকদের গাড়ি এসে দাঁড়ায়। যাঁর নামে মোটা অঙ্কের চেক কাটা হয়, সেই শশীকলাকেই সবার দরকার। যত বুঝতে পারছিলেন, রাগে, বিতৃষ্ণায় উন্মাদ হয়ে উঠছিলেন। দিশেহারা লাগছিল। বুঝতে পারছিলেন না, কোথায় গেলে দু’দণ্ড শান্তি পাওয়া যাবে!‌ অস্থির হয়ে এক দিন ফোন করলেন কলকাতায়, ছোট মেয়ে শৈলজাকে। কাতর অনুরোধ, যে করেই হোক, মাদার টেরিজার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করতেই হবে।

তার আগে এক বারই মাত্র এয়ারপোর্টে দূর থেকে দেখেছিলেন মাদারকে। দিব্যজ্যোতি কেমন হয় জানেন না শশীকলা, কিন্তু সে দিন মাদারকে দেখে মনে হয়েছিল, অলৌকিক এক মায়াময় বিভা ঘিরে আছে তাঁকে। মনে হচ্ছিল, মাদারের কাছে গেলে হয়তো শান্তি পাবেন। এত পীড়িত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন মাদার, তাঁকে কি ফিরিয়ে দেবেন? অধৈর্য শশীকলা চলেই এলেন কলকাতায়। বার বার যান এন্টালির মাদার হাউসে। মাদার তখন খুব অসুস্থ, কারও সঙ্গে দেখা করছেন না। এক দিন গিয়ে শুনলেন, একটু সুস্থ হতেই মাদার বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন মিশনারিজ অব চ্যারিটির কাজে। দেখা হল তখন যিনি মাদারের ডান হাত, সেই সিস্টার অ্যাগনেস-এর সঙ্গে। আকুল শশীকলা আশ্রয় চাইলেন। বললেন, তিনি মাদার টেরিজার কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চান।

সিস্টার অ্যাগনেস তাঁকে পাঠালেন মাদারের শিশু ভবনে, আর এক সন্ন্যাসিনীর কাছে। তিনি সব শুনে শশীকলাকে বললেন পুণে ফিরে যেতে। সেখানে মাদারের যে আশ্রম, তার মাদার সুপিরিয়রের সঙ্গে দেখা করতে। কিছুটা হতাশ হয়েই ফিরে গেলেন শশীকলা। দেখা করলেন পুণের আশ্রমে। একেবারে পা ধরে কেঁদে পড়লেন। ‘কোথাও যাওয়ার নেই আমার। দয়া করে একটু আশ্রয় দিন। আপনাদের কাজ করতে দিন।’

প্রথম তিন দিন বাথরুম পরিষ্কারের কাজ দেওয়া হয়েছিল শশীকলাকে। বম্বের বাড়িতে ছ’জন কাজের লোক ছিল শুধু তাঁর জন্যে। সেই তিনিই মুখ বুজে তিন দিন ঝাঁটা দিয়ে ঘষে ঘষে বাথরুমের প্যান থেকে ময়লা ছোপ তুললেন। চতুর্থ দিনে দেওয়া হল ডর্মেটরি পরিষ্কারের কাজ। অসুস্থ মানুষের বিছানা, বালিশ–তোশকে রোগের গন্ধ লেগে। কিন্তু শশীকলার মুখে সামান্য বিরক্তিও নেই। বুঝতে পারছিলেন, এটা পরীক্ষা। এর মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। কিন্তু তাঁরও মরাঠিকন্যার জেদ। তারাচাঁদ বরজাতিয়ার ‘আরতি’ ছবির সেটে জীবনে প্রথম বার মীনাকুমারীর সঙ্গে শট। ঠিক করেছিলেন, এক শটে পার করবেন সিন। মীনাকুমারী যেন না ভাবেন, এ কোন আনাড়ির সঙ্গে পালা পড়ল!‌ সে দিন শট শেষে সবার হাততালির মধ্যে কিশোরী শশীকলার চিবুকখানি হাত দিয়ে একটু তুলে ধরে মীনাকুমারী তাঁর সেই বিখ্যাত আনুনাসিক গলায় বলেছিলেন, ‘হায় আল্লা, বহুত আচ্ছা পহেলা শট দিয়া তুমনে!‌’

কিন্তু জীবন তো সিনেমা নয়! আরও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।‌ পুণের আশ্রমে শশীকলার পঞ্চম দিনের পরীক্ষা ছিল অসুস্থ মানুষদের স্নান করানো। তাদের কেউ বদ্ধ উন্মাদ, কারও সর্বাঙ্গে খোস–পাঁচড়া। এ বারও শশীকলা চোখের পলক অবধি ফেললেন না। ষষ্ঠ দিনে একটি জড়বুদ্ধি শিশুর দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হল।

জানতেন না, কী ভাবে এ ধরনের শিশুর যত্ন করতে হয়। নিখাদ আন্তরিকতা দিয়ে ভরিয়ে দিলেন না-জানার ফাঁক। পর দিন হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল গজ–কাপড় আর তুলোর ট্রে। এক সিস্টার এক অসুস্থ মানুষের পচে যাওয়া ঘা ড্রেসিং করলেন। ট্রে হাতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হল শশীকলাকে। মনে মনে মাদারকেই ডাকছিলেন। বলছিলেন, শক্তি দাও, শ্রদ্ধা দাও। তোমার কাজ যেন ঠিক ভাবে করতে পারি, সেই নিষ্ঠা দাও।

অষ্টম দিন। জরুরি তলব এল। নর্দমা থেকে তুলে আনা হয়েছে এক জনকে, তাঁর শুশ্রূষা করতে হবে। দৌড়ে গেলেন। মাদার সুপিরিয়র তখন নিজের হাতে লোকটির পায়ের ব্যান্ডেজ খুলছেন। খুলতেই বেরিয়ে এল পচা–গলা ঘা, রক্ত, পুঁজ। সাদা সাদা পোকা বেরিয়ে এল ঘা থেকে। এমন ভয়ংকর ক্ষত আগে কখনও দেখেননি শশীকলা। মনে হল, অজ্ঞান হয়ে যাবেন!‌ চোখ পড়ল বাকি সিস্টারদের দিকে। সবার মুখ নড়ছিল নিঃশব্দ প্রার্থনায়। দেখে শক্তি পেলেন শশীকলা। তাঁরও বিশ্বাস জন্মাল প্রার্থনার শক্তিতে।

আর কোনও দ্বিধা রইল না। যখনই আশ্রম থেকে ডাক আসত, দৌড়ে যেতেন। আর্ত মানুষের সেবা করতে করতে মনে হত, ঘুচে যাচ্ছে তাঁর সব গ্লানি, হতাশা। ক্রমশ মুক্ত হচ্ছেন অতীতের অপরাধবোধ থেকে। সংসার, স্বামী, মেয়েদের ছেড়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে গিয়েছিলেন। গিয়েই বুঝেছিলেন, ভুল করেছেন। অমানুষিক অত্যাচার করত নতুন প্রেমিক। শরীরে, মনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। উন্মাদিনীর মতো এসে দাঁড়িয়েছিলেন বম্বের রাস্তায়। ভিখারিনিদের সঙ্গে ঘুমোতেন রাতের ফাঁকা রেল স্টেশনে। কাঙালিভোজনের কাতারে পাত পাড়তেন। হঠাৎ এক দিন দেখা পরিচালক মহেশ দেশাইয়ের সঙ্গে। মহেশের ছবি ‘সত্যবান সাবিত্রী’–তে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন শশীকলা। মহেশেরই পরামর্শে যোগ দিলেন ‘বিপাসনা’ ধ্যানাভ্যাসে। ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেন। ফিরলেন সংসারে। বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আবার আদরে বুকে টেনে নিল তাঁকে। যে ইন্ডাস্ট্রি ১১ বছরের মেয়েটার নাচ আর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে ২৫ টাকা গুঁজে দিয়েছিল হাতে। অভিনেত্রী শশীকলার প্রথম পুরস্কার! পরে টানা পাঁচ বছর বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন-এর সেরা সহ–অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন। পর পর দু’বছর ‘ফিল্ম ফেয়ার’। কিন্তু ওই ২৫ টাকাটা ছিল বহু দিন অভুক্ত থাকার পর গরম ভাতের মতো।

তখন বাবার সঙ্গে ঘুরতেন স্টুডিয়োর দরজায় দরজায়। যদি কেউ একটা সুযোগ দেয়। শোলাপুরে সবাই বলত, ‘বেবি’কে বম্বে নিয়ে যাও, ওকে এত সুন্দর দেখতে! নৌটঙ্কির দলে বালগোপাল সেজে কী চমৎকার নাচে!‌ যদিও নাচে কোনও প্রথাগত তালিম ছিল না। কিন্তু বাবা অনন্তরাও জাওয়ালকর ভাবলেন, দেখাই যাক। অন্য উপায়ও ছিল না। পারিবারিক কাপড়ের ব্যবসা ফেল মেরেছে। মন দিয়েই ব্যবসা করছিলেন, খেয়াল চাপল, ভাইকে বড় মানুষ বানাবেন। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে লন্ডন পাঠালেন। ব্যবসার আয়ের প্রায় পুরোটাই খরচ হত ভাইয়ের বিদেশে থাকা আর পড়াশোনায়। বাড়ির বাকিদের আপত্তি ছিল। অনন্তরাও বোঝাতেন, ভাই ফিরলে সুদিনও ফিরবে।

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে ফিরে এল ভাই। তার জন্য নতুন অফিস করে দিলেন অনন্তরাও। মহা ধুমধামে বিয়ে দিলেন ভাইয়ের। তার পর ভাই বলল, সে এত লোকের দায়িত্ব নেবে না, তার নিজের সংসার হয়েছে। কাপড়ের ব্যবসা তত দিনে লাটে উঠেছে। অনন্তরাওয়ের স্ত্রী, ছেলে–মেয়েদের দিন কাটছে আধপেটা খেয়ে। কোনও দিন শুধু জল!‌ একমাত্র ‘বেবি’ শশীকলা নৌটঙ্কির দলে নাম লেখানোর পর রোজ ভরপেট খেতে পায়। যেখানেই যায়, নাচ দেখে খুশি হয়ে লোকে আদর করে ডেকে নিয়ে যায়, ভালমন্দ খাওয়ায়। আর আট–দশ দিন পর পর শশীকলা কিছু রোজগার করে বাড়ি ফিরলে বাকিদের খাওয়া জোটে।

তাই মেয়ের ওপরেই ভরসা করেছিলেন অনন্তরাও। সপরিবার বম্বে এসে সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশ্রয় নিলেন দূরসম্পর্কের আত্মীয়–বন্ধুদের বাড়ি। সেখানে গতরে খাটলে খাওয়া জুটত। বাজার করা, ঝাড়পোঁছ, বাসন মাজা, গা হাত–পা টেপা। এত কিছু সহ্য করেও বাবার হাত ধরে মেয়ে ঘুরত স্টুডিয়োপাড়ায়, যদি কোনও কাজ জোটে। এক দিন নূরজাহানের চোখে পড়ে গেলেন শশীকলা। বিখ্যাত অভিনেত্রী, হিন্দি ছবির রানি নূরজাহান। তাঁকে নায়িকা করে ‘জিনাত’ বলে একটা ছবি বানাচ্ছিলেন তাঁর স্বামী শওকত হুসেন। নূরজাহানের ছোটবেলার চরিত্রের জন্য এক সুন্দরী কিশোরীর খোঁজ চলছিল। শশীকলাকে দেখে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই মনে হল, এই তো, পেয়ে গেছি!‌

কিন্তু শশীকলা মুখ খুলতেই বিপদ। মেয়ে ঠেট মারাঠি জানে শুধু, হিন্দিও বলতে পারে না। কিন্তু ‘জিনাত’ ছবির সংলাপ শুধু হিন্দিই নয়, বেশ উর্দু-ঘেঁষা। অথচ সুন্দরী মেয়েটিকে ছেড়ে দিতেও মন চায়নি হুসেন সাহেবের। তাই শশীকলার জায়গা হল ছবির এক কাওয়ালির দৃশ্যে। কচিকাঁচা মেয়েদের উৎসাহ দিতে শওকত হুসেন বললেন, যে সবচেয়ে ভাল নাচবে, সে ২৫ টাকা ইনাম পাবে। সেই ১৯৪৪ সালে ২৫ টাকা মানে অনেক টাকা!‌ এমন নেচেছিলেন শশীকলা, আর কেউ সে পুরস্কারের দাবিদার হতে পারেনি। সেই টাকায় বাড়ির সবার জন্যে উপহার কেনা হয়েছিল। খাবার, মিষ্টি, আতশবাজিও।‌ বহু বছর পর জাওয়ালকর পরিবারে সে দিন অকাল দিওয়ালি হয়েছিল। মেয়ের জন্যে এক জোড়া নাগপুরি পাটল শাড়ি কিনেছিলেন অনন্তরাও।

শশীকলা নিয়মিত কাজ পেতে শুরু করলেন। শওকত আর নূরজাহান নিজেদের মেয়ের মতোই খেয়াল রাখতেন। রোজগার বাড়তে বাড়তে মাসে ৪০০ টাকা হল। এর পর স্বাধীনতা, দেশভাগ। শওকত হুসেন আর নূরজাহান পাকিস্তান চলে গেলেন। মাথার ওপর থেকে ছাতাটা সরে গেল। বাকি পরিবার শশীকলার মুখের দিকেই তাকিয়ে। আবার হন্যে হয়ে কাজ খোঁজা। ১৯ বছর বয়সে বিয়ে করাটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হল না। ওমপ্রকাশ বিখ্যাত কে এল সায়গলের পরিবারের লোক, কিন্তু নিজের যোগ্যতায় কিছু করার মুরোদ নেই। বউকে নায়িকা করে সিনেমা বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। তত দিনে শশীকলা হতাশার দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বিবাহিতা, দুই মেয়ের মা। এমন কাউকে নায়িকা করার উদারতা বা নির্বুদ্ধিতা কোনও প্রযোজক–পরিচালক দেখাতে চাইছেন না। ছবির নায়ক নবাগত কিশোরকুমার। সঙ্গীতের দায়িত্বে আর এক নবাগত সুরকার জুড়ি শঙ্কর–জয়কিষেণ। ছ’বছর লাগল ছবি শেষ হতে!‌ কিশোরকুমার তত দিনে প্রতিষ্ঠিত গায়ক, বিখ্যাত শঙ্কর–জয়কিষেণ জুটিও। এ দিকে ও পি সায়গলের ঘিয়ের ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছে, শশীকলারও ছ’বছর বয়স বেড়েছে।

সংসার চালাবার দায় তাঁর ঘাড়েই চেপে বসল। পাগলের মতো কাজ— সকাল দশটা থেকে সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত শুটিং, রাত ন’টা থেকে আবার। ভোর চারটেয় উঠে চার ঘণ্টা নাচের তালিম। এমনও হয়েছে, টানা ১০–১২ দিন স্টুডিয়োতেই থেকে গেছেন, বাড়ি ফেরা হয়নি। এ রকমই একটা দিন শ্রান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে মেয়েদের আয়ার মুখোমুখি। বিস্তর অভিযোগ, মা দেখে না বলে মেয়েরা অসভ্য, বেচাল হয়ে গেছে, এই বদমায়েশি করেছে, ওই দুষ্টুমি.‌.‌.‌ শুনতে শুনতে মাথার ঠিক থাকেনি। বেধড়ক পিটিয়েছিলেন মেয়েদের, যারা অত দিন পর মা’কে দেখে আদর কাড়তে দৌড়ে এসেছিল।

দুই মেয়েকেই এর পর পঞ্চগনির এক আবাসিক স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শশীকলা। রাগে নয়, নিজের প্রতি তীব্র ধিক্কার আর অনুশোচনায়। আবার যদি কখনও অমন করে ফেলেন, সেই ভয়ে। প্রথম যে দিন মাদার টেরিজার মুখোমুখি হলেন শশীকলা, জড়িয়ে ধরে খালি হাউহাউ কেঁদেছিলেন। বলতে পারেননি কিছু। তাঁর কেবলই মনে পড়েছিল মেয়েদের কথা, মার খেয়ে মেয়েদের গায়ে দাগড়া দাগড়া কালশিটের কথা। মাদারও কিছু বলেননি, শুধু গায়ে–মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। যে আদর শশীকলা নিজের ছোটবেলায় কখনও পাননি, নিজের মেয়েদের দিতে পারেননি কোনও দিন।

তার পর থেকে শশীকলার জীবনে শুধু মাদার। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৭, টানা ন’বছর কাজ করেছেন মিশনারিজ অব চ্যারিটির জন্য। অভিনয় থেকে বহু দূরে, হাততালি, বক্স অফিস, সব মোহ কাটিয়ে তখন শুধুই সেবিকা শশীকলা। কলকাতা, আসানসোল, সুরাট, গোয়া, পুণে, মুম্বই— মাদার যেখানে চেয়েছেন, দৌড়ে গেছেন। নির্মল হৃদয় আশ্রমে মৃত্যুপথযাত্রীদের হাত ধরে বসে প্রার্থনা করতেন। বড় মেয়ে রেখা ক্যান্সারে মারা গেল, একই ভাবে পাশে থেকেছেন। মেয়ে শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে মা’কে বলে গেছে, তোমার ওপর রাগ নেই আর।

১৯৯৭ সালে মাদারের প্রয়াণের পর মিশনারিজ অব চ্যারিটি ছেড়েছেন শশীকলা জাওয়ালকর সায়গল। সঞ্জীবনী মন্ত্র তো তিনি পেয়েই গিয়েছিলেন! ’৯৭ সালে ফের ক্যামেরার সামনে যিনি ফিরলেন, তিনি এক অন্য শশীকলা। কষ্ট আর ত্যাগের আগুনে পুড়ে শুদ্ধ এক মানুষ। ফিল্মি ভ্যাম্পের চরিত্রের আড়ালে যার নাগাল কেউ পায়নি।

সাফল্যের মতো, জীবনে স্বীকৃতিও এসেছে দেরিতে। ২০০৭-এ ‘পদ্মশ্রী’, ভি শান্তারামের নামাঙ্কিত জীবনকৃতি সম্মান ২০০৯-এ। ২০১৫-তে মহারাষ্ট্র সরকারের দেওয়া ‘রাজ কপূর লাইফটাইম কন্ট্রিবিউশন অ্যাওয়ার্ড’। শশীকলা তখন ৮৩।

বছরের বেশ কিছুটা সময় এখন আমেরিকায় কাটে, নাতনির মেয়ের সঙ্গে খেলা করে। দেশের ঠিকানা মুম্বইয়ে ছোট মেয়ে শৈলজার ফ্ল্যাট। এখনও চেষ্টা করেন নিজের কাজ নিজে করতে। মাদার শিখিয়ে গিয়েছেন যে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE