পড়ার টেবিলে নন্টে-ফন্টের ছবি আঁকছেন —নিজস্ব চিত্র।
বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হয়ে কে ‘বজ্রনুলো’ উপাধি পাবে, সেই নিয়ে চরম উত্তেজনা। নন্টে-ফন্টে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চায় না। অথচ বক্সিংয়ে নামিয়ে দুটো পাঞ্চ মারার ইচ্ছায় কেল্টুদা ওদের প্রতিযোগিতাতে নামাবেই। তবে সুপারিনটেনডেন্ট স্যরকে তেল মেরে নন্টে-ফন্টেকে বক্সিং রিংয়ে নামিয়েও কেল্টুই শেষ পর্যন্ত স্যরের কাছে মার খেল, আর ফন্টে পেল ‘বজ্রনুলো’ উপাধি। অন্য একটি কমিকসে দেখা যাচ্ছে, সুপারিনটেনডেন্ট স্যরকে জপিয়ে স্কুলের নাটক ‘লঙ্কাকাণ্ড’-তে সেরা পার্ট পেয়েও শেষ দৃশ্যে স্যরের হাতে কেল্টুর জুটল ফুলদানি-ছোড়া মার।
পাতায় পাতায় মজায় ঠাসা নারায়ণ দেবনাথের নন্টে-ফন্টের কমিকস দেখতে দেখতে পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল। শিশুদের কি শুধুই মজার গল্পই শুনিয়েছেন নারায়ণবাবু? না কি চরিত্রগুলোর মধ্যে হাস্যরসের মাধ্যমে গভীরতর কোনও অর্থ বলতে চেয়েছেন? নীতিশিক্ষা দিয়ে বলতে চেয়েছেন, কেল্টু যতই তেল মারুক আর নালিশ করুক, শেষ বেলায় তাকেই অপদস্থ হতে হয়। কপালে জোটে ফুলদানি ছুড়ে মার অথবা বেতের বাড়ি। অথবা স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট স্যর পাতিরাম হাতির কেল্টুর প্রতি বেশির ভাগ সময়ে পক্ষপাতিত্ব দেখানোর পরেও কেল্টুর জন্য তাঁকে কমিকসের শেষ দৃশ্যে অনেক সময়ই নাজেহাল হতে হয়। তখন সুপারিনটেনডেন্ট স্যরকে উদ্ধার করার দায়িত্ব সেই নন্টে আর ফন্টের। কে ভাল, কে খারাপ, কে ওপরচালাক, কে নালিশবাজ, কে পক্ষপাতদুষ্ট— নন্টে-ফন্টে কমিকসের মধ্যে মজার ছলে এ সব শিখে নেওয়ার কৌশলই কি শিশুদের শিখিয়ে দিয়েছেন নারায়ণবাবু?
শিবপুর রোডে শিবপুর হিন্দু গার্লস স্কুলের কাছে একটা দোতলা বাড়ির একতলা। ছোট্ট বসার ঘরে পড়ার টেবিলে সকাল দশটা নাগাদও জ্বলছিল টেবিল ল্যাম্প। পড়ার টেবিলে বসে ছিলেন নায়ারণবাবু। এখন কোনও কিছু পড়তে গেলে বই বা কাগজের উপর একটু বেশি আলো লাগে তাঁর, সেই কারণেই দিনের বেলাতেও জ্বলছে টেবিল ল্যাম্প। পঁচানব্বই বছর বয়সি নারায়ণবাবুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে সামনে গিয়ে একটু জোরে কথা বলতে হয়। প্রশ্ন শুনে হেসে বললেন, “অত কিছু ভেবে তো লিখিনি। প্রকাশকের দাবি ছিল, নতুন কমিকস দাও। সেই মতোই মজার কিছু চরিত্র তৈরি করে লিখতে শুরু করেছি। তা সেখান থেকে কেউ যদি নীতিশিক্ষা পায়, তা হলে তো খুব ভাল।”
শিল্পী: যৌবনে নারায়ণ দেবনাথ।
নারায়ণ দেবনাথের অনবদ্য তিন সৃষ্টি— বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা-ভোঁদা আর নন্টে-ফন্টের মধ্যে সব থেকে সিনিয়র হাঁদা-ভোদা। ২০১২ সালেই হাঁদা-ভোঁদা ৫০ বছর পার করেছে। হাঁদা-ভোদা আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৯৬২ সালে। এর পর আসে বাঁটুল। তার আত্মপ্রকাশ ১৯৬৫ সালে। সেও পঞ্চাশ পেরিয়েছে ২০১৫ সালে। এ বার পালা নন্টে-ফন্টের। ১৯৬৯ সালে প্রথম কমিকসের পাতায় আবির্ভাব তাদের। নারায়ণবাবু জানালেন, এই দামাল চরিত্রগুলো এখন আর তাঁর কাছে আসে না। “এই বয়সে আর ওদের নিয়ে গল্প লেখার মতো চিন্তাশক্তি নেই। ওই দামালরা এখন কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে।”
নারায়ণবাবুর ছোট্ট বসার ঘরের আলমারিতে নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল আর হাঁদা-ভোঁদার নানান কীর্তি ছড়ানো। হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল-সহ আরও নানান কমিকস লিখে ও ছবি এঁকে যত পুরস্কার পেয়েছেন, রাখা আছে সে সব। পুরস্কারের স্মারকেও নন্টে-ফন্টের ছবি। সেই আলমারির দিকে মুখ করে পড়ার টেবিলে বসে খবরের কাগজ পড়েন নারায়ণবাবু।
তবে নিজের সৃষ্টি করা প্রিয় চরিত্রদের নিয়ে সে রকম আলোচনা করতে চান না তিনি। শুধু বাইরের লোকের সঙ্গেই নয়, ঘরের মানুষদের সঙ্গেও এখন হাসিখুশি মনখোলা মানুষটা কেমন যেন চুপচাপ, বলছিলেন নারায়ণবাবুর ছোট ছেলে তাপস দেবনাথ। “বাবা এখন বেশির ভাগ সময় শুয়েই থাকেন। অথচ উনি আগে গল্প করতে খুব ভালবাসতেন। এলাকার সবার সঙ্গে মিশতেন। পাড়ার ছোট ছোট বিচ্ছু ছেলেগুলোও ওর বন্ধু ছিল। হাঁদা-ভোঁদার গল্প তো শিবপুরের পাড়ার গলির বিচ্ছু ছেলেদেরই গল্প।” নারায়ণ দেবনাথের জীবন ও কাজ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করছেন দমদমের শান্তনু ঘোষ। তিনিও বললেন, “কাছের মানুষদের সঙ্গে গল্পগুজব, আড্ডা মারতে খুব ভালবাসতেন উনি। আমরা কত যে গল্প করেছি ওঁর সঙ্গে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা! এখন আর ওঁর কাছে বিশেষ কেউ যান না। পাড়ার লোকেরাও খোঁজ নেন না তেমন। উনি সে দিন বলছিলেন, ‘আমি কি হারিয়ে গেলাম? একলা হয়ে গেলাম?’ একটা অভিমান কাজ করে।”
নারায়ণবাবুর বাবার সোনা-রুপোর দোকান ছিল। সেই দোকানে গিয়ে মাঝেমধ্যে বসতেন নারায়ণবাবু। বসে বসে দেখতেন পাড়ার ছেলেদের কাণ্ডকারখানা। ‘হাঁদা ভোঁদার কাণ্ডকারখানা’য় উঠে এসেছিল সে সবই। হাঁদার পুরো নাম হাঁদারাম গড়গড়ি, ভোঁদার— ভোঁদা পাকড়াশী। সঙ্গে আছেন তাঁর পিসেমশাই, বেচারাম বকশি। নারায়ণ দেবনাথের হাঁদা-ভোদার প্রথম গল্পের নাম ছিল ‘হাঁদা ভোদার জয়’। গল্পের বিষয়বস্তু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ। শুরুতে কিন্তু হাঁদা-ভোদার চেহারা অনেকটাই আলাদা ছিল। তবে গবেষক শান্তনুবাবু জানাচ্ছেন, হাঁদা-ভোঁদার জন্ম নারায়ণবাবুর হাতে হয়নি। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, ১৯৫০-এর দশকে হাঁদা-ভোঁদার নামে একটি কমিকস ‘শুকতারা’য় বেরোত অনিয়মিত ভাবে। সেই কমিকসে ‘ছবি ও কথা’র জায়গায় ছিল একটি বোলতার ছবি। ওই বোলতা আসলে তখনকার দিনের প্রখ্যাত শিল্পী প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে ১৯৬২-তে নারায়ণবাবু হাঁদা-ভোঁদাকে পরিমার্জন ও সংশোধন করে নিয়মিত লিখতে শুরু করেন।
পূর্বসূরি: ‘পরিবর্তন’ বইয়ের জন্য নারায়ণ দেবনাথের করা অলঙ্করণ। এই সব মজার ঘটনা ও চরিত্রের ছায়া এসে পড়েছে তাঁর নন্টে-ফন্টে কমিকসে
১৯৬৫ সালে ‘শুকতারা’ পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করে বাঁটুল। গোলাপি রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি পরা, সঙ্গে কালো রঙের হাফপ্যান্ট। খালি পা। বাঁটুলের সঙ্গে থাকে তার দুই ভাগ্নে, ভজা ও গজা। প্রথম দিকে বাঁটুল তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও পরে অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। ষাটের দশকে ভারত-পাকিস্তানের যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধের পটভূমিকায় বাঁটুলকে এনে ফেলেন নারায়ণবাবু। মহাশক্তিমান বাঁটুলকে দেখা যায় শত্রু সেনার যুদ্ধজাহাজ, প্লেন, ট্যাঙ্কার ধ্বংস করতে। যুদ্ধের পটভূমিকায় বাঁটুলের কমিকস উত্তরোত্তর জনপ্রিয় হতে থাকে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই কমিকসের চলার পথে বাঁটুলের চেহারাতেও বদল এসেছে। বাঙালি সুপারহিরোর কোমর আর পা আরও সরু হয়েছে। বেড়েছে বুকের ছাতি।
১৯৬৯ সালে ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করে নন্টে-ফন্টে। ‘শুকতারা’র হাঁদা-ভোঁদার পাল্টা কমিকস চালু করতে ওদের মতোই দুই বিচ্ছু ছেলের চরিত্র নন্টে আর ফন্টেকে সৃষ্টি করেন নারায়ণ দেবনাথ। এমন দুই কিশোর, যারা প্রায়ই একে অন্যের পিছনে লাগে, মজা করে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নন্টে-ফন্টে কমিকসের চরিত্র ছিল অনেকটা হাঁদা-ভোদার মতোই। ১৯৭২ সালে এসে নন্টে-ফন্টে কমিকস পাল্টে যায় অনেকটা। এ বার যোগ হয় নন্টে-ফন্টের হোস্টেল জীবন, হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট আর কেল্টুদার মতো চরিত্র।
এই পাল্টে যাওয়ার পিছনেও গল্প আছে। কমিকস লেখা ও ছবি আঁকার পাশাপাশি প্রচুর বই ও পত্রপত্রিকার অলঙ্করণের কাজও করেছেন নারায়ণ দেবনাথ। শিল্পী হিসাবে বইবাজারে যথেষ্ট সুনাম ছিল তাঁর। ১৯৭২ সালে একটি গল্পের বইয়ের অলঙ্করণের কাজে হাত দেন তিনি। বইয়ের নাম ‘পরিবর্তন’, লেখক মনোরঞ্জন ঘোষ। এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। বাংলা চলচ্চিত্রও হয়েছিল এই বই থেকে। পরে সেই চলচ্চিত্রের হিন্দি রূপান্তর হয়, ‘জাগৃতি’ নামে হিন্দি চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে। বাংলা বইটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অনেক পরে ১৯৭২ সালে বইটি যখন পুনর্মুদ্রিত হয়, সেই বইয়ের অলঙ্করণ করেন নারায়ণ দেবনাথ। অলঙ্করণের সময় তিনি দেখতে পান, গল্পে রয়েছে দুই বালকের হোস্টেল-জীবনের কথা। রয়েছে হোস্টেলের এক মোটাসোটা সুপারিনটেনডেন্টের কথা, যিনি খেতে খুব ভালবাসেন; বা হোস্টেলের এক রাঁধুনির কথা, যার রান্নাঘর থেকে মাঝেমধ্যেই খাবার চুরি হয়। এই সব মজার দৃশ্য আঁকতে আঁকতেই তাঁর মনে হয়, এমন মজার ঘটনা নন্টে-ফন্টের কমিকসে নিয়ে এলে কেমন হয়? এর পরেই ১৯৭৩ সালে নন্টে-ফন্টের গল্পে যোগ হয় হোস্টেল, সুপারিনটেনডেন্ট স্যর, রাঁধুনি এবং বিখ্যাত চরিত্র কেল্টুরাম।
তিন ডাকসাইটে কমিকসের মধ্যে তাঁর প্রিয় সন্তান বাঁটুল, জানালেন নারায়ণবাবু। এও জানালেন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কমিকস ‘টম অ্যান্ড জেরি’। তবে এখন আর কমিকস পড়েন না। গল্পের বই মাঝেমধ্যে উল্টেপাল্টে দেখেন, জানালেন তাঁর ছেলে তাপসবাবু। সঙ্গে যোগ করলেন, “বাবা খেতে খুব ভালবাসতেন। কিন্তু এখন তো শুধুই ডাক্তারের চার্ট অনুযায়ী তৈরি করে দেওয়া খাবার। সে সব একদম পছন্দের নয় ওঁর। মশলাদার খাবারই এখনও পছন্দ। রেস্তরাঁ থেকে বিরিয়ানি বা মটন কষা এলে বাবা চেখে দেখতে খুব ভালবাসেন।”
শুধু খেতে নয়, বাজার করাও প্রিয় ছিল নারায়ণ দেবনাথের। তাপসবাবু জানান, তিনি বাবাকে সে ভাবে কোনও সাংসারিক কাজ করতে দেখেননি। তবে বাজারটা নিজের হাতে করতেন। শিবপুর বাজার থেকে নানা ধরনের মাছ, আনাজপাতি আনতেন। বিশেষ করে বড় ইলিশ মাছ বাজারে এলে বাড়ি নিয়ে আসা ছিল ধরাবাঁধা। বাজার করে এসেই পড়ার ঘরে ডুবে যেতেন লেখালিখি আর অলঙ্করণের কাজে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত তাঁর লেখা ও ছবি আঁকা। তখন তাঁকে বিরক্ত করা যাবে না। বাড়িতে প্রায়ই আসতেন প্রকাশক, গল্প লেখকেরা। এখন সে সব বন্ধ, দর্শনার্থীও খুব কম। নিজে বাজার করা দূরের কথা, বাড়িতেও অনেক সময় হাঁটতে হলে সাহায্য লাগে। মাস কয়েক আগে বাড়িতে পড়ে গিয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল।
নারায়ণ দেবনাথের কাজ নিয়ে গবেষণা করা শান্তনুবাবুর দাবি, এই শিল্পী যে ভাবে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একা হাতে কমিকসের ছবি এঁকেছেন, সঙ্গে লিখেছেনও— বিশ্বের কমিকসে এমন উদাহরণ আর ক’টা আছে? এর যোগ্য সম্মান কি তিনি পেয়েছেন? নারায়ণবাবু অবশ্য এ সব নিয়ে ভাবিত নন। প্রশ্ন করলে শুধু মুচকি হেসে বলেন, “মানুষের ভালবাসা পেয়েছি অফুরন্ত। আমার চরিত্র বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাঠকদের কাছে প্রিয়। এটা কম না কি? এই ভালবাসা ক’জন পায়?”
সাক্ষাৎকার শেষ। খবরের কাগজে মন দেন আবারও। তাঁর পড়ার টেবিলে তখন টেবিল ল্যাম্পের আলোর সঙ্গে সকালের রোদ্দুরও এসে মিশছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy