উৎসব: চার্লস ডিকেন্সের ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’। তৎকালীন সংস্করণ।
বাঙালি হুজুগে জাতি। হুজুগ পেলেই তারা মেতে ওঠে। সে হুজুগের উৎস বা ইতিহাস নিয়ে কেউ আর বিশেষ মাথা ঘামায় না। বড়দিনও এই রকম একটি হুজুগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনটা এলেই কেক খাওয়া, কেনা-কাটা করা, পাঁচজনে মিলে পার্ক স্ট্রিটে আলো দেখতে যাওয়া, হয়তো বা বাড়িতে বাচ্চা থাকলে তাদের জন্য ক্রিসমাস ট্রি সাজানো ইত্যাদি। নানা হুজুগ। কিন্তু কবে থেকে শুরু হল বড়দিন পালনের প্রথা?
যদিও জিশুখ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল প্রায় ২০০০ বছর আগে, আজকাল বড়দিন বলতে আমরা যা যা বুঝি সেই সব প্রথার উদ্ভব কিন্তু আরও অনেক পরে। আধুনিক বড়দিনে পালিত বেশির ভাগ রীতি, রেওয়াজ, ঐতিহ্যের শুরু উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ। তার আগে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে বড়দিন পালিত হত ঠিকই, কিন্তু সেই সব উৎসবে সাধারণ মানুষের ভূমিকা ছিল নগণ্য। ১৮২০-৩০ নাগাদ সেই ধারার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। বড়দিন সেই সময়ের পর থেকে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের পারিবারিক এবং সামাজিক অনুষ্ঠান।
এই ক্রমোৎকর্ষের মূলে ছিল বিলেতের শিল্প বিপ্লব থেকে উ???ৎপন্ন তিনটি ঐতিহাসিক ধারা। এক দিকে নগরায়নের বর্ধিত গতির দ্বারা পুরনো গ্রাম্য সামাজিকতা ভেঙে তৈরি হচ্ছিল নতুন শহুরে সামাজিকতা। অন্য দিকে শিল্প-বিপ্লবের আঁচল ধরে গণ-উৎপাদন-আশ্রিত নতুন এক পণ্য- সংস্কৃতি বাস্তবায়িত হচ্ছিল। এই সবেরই সঙ্গে সঙ্গে আবার বৃদ্ধি পাচ্ছিল সাক্ষরতার হার। এই তিনটি ধারার সমন্বয়েই উনিশ শতকের বিলেতে গড়ে উঠল আধুনিক বড়দিনের ঐতিহ্য।
জর্জ ডার্বির আঁকা ক্রিসমাস কার্ড; দেশীয়দের বড়দিন পালনের ছবি সেই প্রথম। কার্ডে ব্যান্ড পার্টি ও নেড়ি কুকুর
এই তিনটি ধারা একত্রিত হল বিলেতের নানা ছাপাখানায়। চাকরিজীবী শহুরে মানুষের ধর্মীয় উৎসবের সময় কিছুটা অবসর মেলে। তাই তারা আপিস থেকে ছুটি পেয়ে বিনোদনের উপাদান খোঁজে। স্বাক্ষরতা বৃদ্ধির ফলে সেই বিনোদনের সামগ্রী প্রায়শই হয়ে দাঁড়ায় ছাপা গল্পের বই। এই সামান্য সত্যটি বুঝে ফেলতে দেরি হয়নি ইংরেজ প্রকাশক কিংবা লেখকদের। তাঁরা তাই ১৮৪০ নাগাদ সাল থেকে বড়দিনের সময় ভূরি ভূরি সঙ্কলিত গল্পের বই প্রকাশ করতে থাকেন। এগুলোকে বলা হত ‘ক্রিসমাস অ্যানুয়াল’ অর্থাৎ বড়দিনের বার্ষিকী, অথবা ‘ক্রিসমাস নাম্বার’ বা বড়দিন সংখ্যা। এই বড়দিন সংখ্যাগুলোই সম্ভবত আমাদের বাঙালি ‘পূজা সংখ্যার’ পূর্বসূরি। এমন সব বড়দিন সংখ্যাতে লিখেই বিখ্যাত হন চার্লস ডিকেন্সের মতো যুগান্তকারী ইংরেজ সাহিত্যিকরা। এই সব বড়দিন সংখ্যাই আবার তাদের গ্রাহকদের মধ্যে গড়ে তোলে বড়দিন সম্বন্ধে নতুন সব ধ্যানধারণা। এমনকি ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর ধারাটি পর্যন্ত তৈরি হয় এই বড়দিন সংখ্যার প্রভাবের ফলে।
তবে এই ক্রমবিকাশ অবাধে হয়নি। মহারানি ভিক্টোরিয়ার অনেক প্রজাই এই ক্রমবিকাশের প্রতি উৎসাহী ছিলেন না। এক দিকে যেমন স্কটল্যান্ডের জনতা ধর্মীয় কারণেই এই নতুন বড়দিনের হুজুগ থেকে কিছুটা সরে দঁড়িয়েছিলেন, অন্য দিকে অনেক ইংরেজও এ বিষয়ে সংশয়গ্রস্ত ছিলেন। একে তো তারা চিন্তিত ছিলেন যে, এই ধরনের সমরূপিতায় হারিয়ে যাবে বিলেতের নানা আঞ্চলিক এবং লৌকিক প্রথা, আবার বার্ষিকীগুলির দ্বারা তাড়িত উগ্র বাণিজ্যিকীকরণ নিয়েও তাদের যথেষ্ট দ্বিধা ছিল। তবু এই সমস্ত দ্বিধা ও সংশয় অতিক্রম করেই আধুনিক বড়দিনের ঐতিহ্য দানা বাঁধতে থাকে।
এই নতুন ধারা শীঘ্রই সমুদ্র লঙ্ঘন করে চলে আসে ঔপনিবেশিক ভারত তথা বাংলায়। দেশছাড়া প্রবাসী ইংরেজরা কলকাতার মতো সমস্ত শহরে নিয়ে আসেন নতুন রীতিতে পালিত নতুন এক উৎসব। এই নবাগত বড়দিন-সংক্রান্ত সব রীতির মধ্যে অন্যতম ছিল বড়দিন উপলক্ষে আত্মীয়স্বজনদের ক্রিসমাস কার্ড পাঠানো। বন্ধুবান্ধবদের থেকে বহু দূরে থাকা প্রবাসী ইংরেজদের কাছে এই রীতি ছিল খুব প্রিয়। উৎসবের দিনে এই কার্ড আদানপ্রদানের দ্বারাই তাঁরা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মানসরাজ্যে মিলিত হতেন।
তখনকার নিউ মার্কেট। কার্ডগুলো ছেপেছিল থ্যাকার, স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি
তবে এই ক্রিসমাস কার্ড বস্তুটিও ছিল নতুন বড়দিনের রীতিগুলির একটি। এই ধরনের কার্ডের প্রথম পরিকল্পনা করেন স্যর হেনরি কোল নামধারী বিলেতের এক সরকারি অফিসার। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে কোল সাহেবের প্রয়াসেই বিলেতে প্রথম চালু হয় ‘পেনি পোস্ট’। এর দ্বারা সাধারণ মানুষ মাত্র এক পেনির একটি ডাকটিকিট লাগিয়ে চিঠি পাঠাতে পারতেন। এর আগে পর্যন্ত ডাকমাশুল নির্ভর করত চিঠির বহর এবং প্রেরিত দূরত্বের উপর। তাই বড়লোকেরা ছাড়া খুব একটা কেউ ডাকে চিঠি পাঠাতেন না। ‘পেনি পোস্ট’-ই প্রথম ডাকে সাধারণ চিঠি পাঠাবার উপায় করে দিল দেশের মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য। কিন্তু এই ব্যবস্থা হওয়ার পরও কোলসাহেব লক্ষ করলেন, অনেকেই এই নতুন ডাক মাশুলের সুবিধে নিচ্ছেন না। তাই তিনি তাঁর এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন এক পরিকল্পনা করলেন। বন্ধু জন হর্সলি ছিলেন চিত্রশিল্পী। তাঁর সঙ্গে মিলে কোলসাহেব ঠিক করলেন যে, চিত্তাকর্ষক ছবি আঁকা একটি কার্ড তৈরি করবেন। সেই কার্ড, পোস্টকার্ডের মতো এক পেনি ব্যয় করেই প্রবাসী আত্মীয়-বন্ধুদের পাঠানো যাবে। যে হেতু ঠিক এই সময়ই বড়দিন সংখ্যাগুলির প্রভাবে বড়দিন উৎসবও জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল, কোলসাহেবের পরিকল্পনা আশাতীত ভাবে সাফল্য পেল। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ছাপা সেই ক্রিসমাস কার্ডের দাম ছিল মাত্র এক শিলিং। ছাপা হয়েছিল প্রায় দু’হাজার কার্ড। ২০০১ সালে কোল সাহেবের সেই দু’হাজারটি কার্ডের মধ্যে একটি নিলামে উঠলে তা বিক্রি হয় প্রায় বিশ হাজার পাউন্ডে!
তবে কোল সাহেবের সেই কার্ড বাংলাদেশে এসেছিল কি না, তা আমরা জানি না। ভারতে ক্রিসমাস কার্ডের বিজ্ঞাপন দেখতে পাই ১৮৬০-এর দশক থেকে। আমার দেখা কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ক্রিসমাস কার্ডের বিজ্ঞাপনটি ১৮৬৬ সালে ‘জর্জ ওয়াইমান অ্যান্ড কোম্পানি’ দ্বারা মুদ্রিত। তাঁরা জানিয়েছেন যে, বড়দিনের অন্যান্য নানা ব্যবহার্যের সঙ্গে তাঁদের কাছে বিক্রির জন্য রয়েছে কিছু ক্রিসমাস কার্ডও। কার্ডগুলিতে এম্বস করে ‘আ মেরি ক্রিসমাস’ আর ‘আ হ্যাপি নিউ ইয়ার’ লেখা ছিল। তবে কার্ডগুলিতে কোনও ছবি ছিল কি না, তা জানা যায় না। এও জানা যায় না যে কার্ডগুলি কোথায় তৈরি, বাংলায় না বিলেতে? এই কার্ডগুলির মূল্যও আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গিয়েছে। তবে এর কয়েক বছর পরে, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের একটি বিজ্ঞাপন থেকে ক্রিসমাস কার্ডের মূল্যের একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ১০ নং এসপ্ল্যানেড রোডে স্থিত ‘জি সি হে অ্যান্ড কোম্পানি’-র একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, তাঁরা ক্রিসমাস কার্ড বেচতেন ডজন দরে। কার্ডের মান অনুযায়ী এক ডজনের দাম ছিল এক, দুই, তিন বা চার টাকা।
এই সব পুরনো কার্ডেরই একটা অন্য রকম দিক ছিল। যদিও এগুলো বিক্রি হত কলকাতায়, তার উপরে আঁকা ছবিগুলো তুলে ধরত বিলেত বা অন্য কোনও শীতপ্রধান ইউরোপীয় দেশের দৃশ্য— তুষারাবৃত গ্রাম, বিলিতি ফুলের গাছ, রবিন পাখি ইত্যাদি। এমনকি ১৮৮১ সালের একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানতে পারি যে, চৌরঙ্গীর বিখ্যাত কেক-বিক্রেতা পেলিটি-র দোকানে নতুন এক ধরনের ক্রিসমাস কার্ড পাওয়া যাচ্ছিল এবং তাতে সুদূর আল্পস পর্বত থেকে আনা (শুকনো) ফুল সাঁটা ছিল! জিশুর জন্মদৃশ্য দেখাতে গিয়ে যে সব চরিত্র আঁকা হত, তারাও হতেন দেখতে প্রায় খাঁটি ইংরেজদের মতো। যদিও খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী জিশু ছিলেন প্যালেস্তিনীয়। অর্থাৎ তাঁর ও তাঁর পরিবারের লোকের গায়ের রং হওয়া উচিত আরবদের মতো বা কিঞ্চিৎ গৌরবর্ণ বাঙালিদের মতো।
ইংরেজ সাহেবদের মতো কোনও মতেই নয়। আসল কথা হল যে, যে হেতু আধুনিক বড়দিনের পুরো ভাবনাটাই রূপ নিয়েছিল আধুনিক বিলেতে, সেই ধারণাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল এক ধরনের ইংরেজিয়ানা।
এ দিকে কলকাতায় যারা এই সব কার্ড কিনতে বা বড়দিন উদ্যাপন করতে আগ্রহী ছিলেন, তখন তাঁদের অনেকেরই বিলেতের সঙ্গে তেমন কোনও অন্তরঙ্গ যোগাযোগ ছিল না। অনেক এমন ইংরেজ কলকাতায় বাস করতেন, যাঁরা বংশানুক্রমে এই দেশে বা এই শহরেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এবং কখনওই তাঁদের পূর্বপুরুষদের জন্মভূমির মুখদর্শন করেননি। এ ছাড়াও আবার ছিলেন বহুলসংখ্যক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তাঁদেরও মাতৃভূমি এই দেশেই। বিলেতের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক বেশ ম্লান। তা ছাড়াও ছিলেন এমন কিছু সংখ্যক খ্রিস্টধর্মীয় মানুষ, যাঁদের ইংরেজদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না— যেমন আরমানি, ফিরিঙ্গি, ফরাসি, ওলন্দাজ ইত্যাদি। সর্বোপরি ছিলেন বহু খ্রিস্টধর্মাবলম্বী বাঙালি। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা রেভারেন্ড লালবিহারী দে ছাড়াও ছিলেন বহু সাধারণ বাঙালি, যাঁরা খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বড়দিন উদ্যাপন করতেন। কিন্তু ইংরেজদের সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্বন্ধ ছিল না। এ সবের পরেও এমন মানুষও ছিলেন, যাঁরা খ্রিস্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী না হয়েও বড়দিনকে গ্রহণ করেছিলেন সামাজিক উৎসব হিসেবে। এই সমস্ত মানুষই ক্রিসমাস কার্ড কিনতেন, কিন্তু সেই কার্ডের ছবিতে তাঁদের জগতের কোনও প্রতিবিম্ব থাকত না।
এই ধারার পরিবর্তনে যাঁরা সচেষ্ট হন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম জর্জ ডার্বি। দুঃখের বিষয়, জর্জ ডার্বি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে তিনি যে কলকাতার লোক ছিলেন এবং শহরটিকে মনেপ্রাণে ভালবাসতেন, তা নিশ্চিত। স্বদেশি যুগে তিনি কলকাতায় ছাপা বেশ কিছু ক্রিসমাস কার্ডের ছবি আঁকেন। কার্ডগুলো প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার সে যুগের বিখ্যাত প্রকাশক ‘থ্যাকার, স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি’ থেকে। যদিও থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি মূলত বই এবং পোস্টকার্ড প্রকাশক রূপেই পরিচিত, এরা ক্রিসমাস কার্ডও বিক্রি করত। এরই মধ্যে আছে জর্জসাহেবের আঁকা কার্ডগুলো। কার্ড ছাড়াও, এই একই প্রকাশকের কিছু বইয়ের অলঙ্করণও করেন জর্জসাহেব।
এ ছাড়াও তিনি প্রকাশ করেছিলেন নিজের একটি ছোট্ট, দশ পাতার বই। বইটির নাম ‘ক্যালকাটা কিউরিয়োসিটিজ়’। বইটির দশটি পাতাই ভর্তি কলকাতার দৈনন্দিন জীবনের নানা কৌতুকপূর্ণ খণ্ডচিত্রে। প্রতিটি ছবিতেই যেমন কৌতুকের ছোঁয়া মেলে, আবার তারই সঙ্গে শিল্পীর সহানুভূতি এবং স্নেহেরও আভাস মেলে পরিষ্কার। এই বইটিই স্বাক্ষর বহন করছে শিল্পীর শহর কলকাতার ও তার নাগরিক জীবনের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার। বইয়ের প্রথম পাতায় একটি পুরনো কবিতার কয়েক ছত্রের মাধ্যমে জর্জ জানিয়েছেন যে, এই বইয়ের মধ্যে তিনি তুলে ধরেছেন এমন সব দৃশ্য যা আমরা শতবার দেখেও দেখি না।
সব ছবিই কিছুটা ব্যঙ্গচিত্র ধরনের। তাঁর ক্রিসমাস কার্ডের ছবিগুলোও তাই। কিন্তু তাঁর ব্যঙ্গে কর্কশ বিদ্রুপ ছিল না, বরং তাঁর চিত্রে ধরা পড়েছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত এবং গরিব বাঙালির বড়দিনের আনন্দ। প্রতিটি ছবিতেই ধরা পড়েছে কলকাতার বড়দিনের এমন এক-একটি আন্তরিক দৃশ্য, যার মাধ্যমে শিল্পী বড়দিনের উৎসবটিকে একটি খাঁটি দেশীয় রূপ দিয়েছেন। একটি কার্ডে যেমন দেখানো হয়েছে বড়দিনে লোকে লিন্ডসে স্ট্রিটের পৌরবাজারে বাজার করছে। যদিও ক্রেতাদের সকলেরই পরনে রয়েছে তৎকালীন ইউরোপীয় পরিচ্ছদ, কিন্তু তাদের অনেকেরই গায়ের রং বেশ চাপা। তবে এই সব হ্যাট-কোট পরিহিত ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলাদের পাশেই কিন্তু দেখা যাচ্ছে শ্যামবর্ণ উলঙ্গ একটি শিশুকেও। শিশুটি নিজের মনে আহ্লাদ করে একটি ছোট্ট পতাকা নাড়াচ্ছে। তারও তো বড়দিন!
আর-একটি কার্ডে আমরা দেখতে পাই এক ব্যান্ড কোম্পানির কিছু গরিব বাজনদারকে। তাঁরা নিজেদের তালে নিজেদের মতো করে বড়দিনের বাজনা বাজাচ্ছেন। তাঁদের শ্রোতাও কোনও কেউকেটা সাহেবসুবো নয়। বরং তাঁদেরই সমগোত্রীয় কিছু গরিব মানুষ ও একটি ছোট কালো দেশি কুকুর। কলকাতার সাহেব বা অ্যাংলো পাড়ায় যাঁরাই বড় হয়েছেন, তাঁদের হয়তো মনে থাকবে যে, ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকেও বড়দিনের আগের সন্ধ্যায় গরিব খ্রিস্টধর্মীয় ব্যান্ডপার্টির কর্মীরা আসতেন এবং প্রতিটি বাড়ির সামনে কিছু ক্ষণ বড়দিনের নানান গান বাজিয়ে যৎসামান্য টাকা বা পুরনো কাপড়চোপড় চেয়ে নিতেন। জর্জসাহেবের ছবিটি সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁর ছবিতে কেউ হাত পেতে নেই। বাজনদাররা নিজেদের বাজানোয় নিজেরাই আত্মহারা। আরও দু’টি কার্ডে চিত্রিত হয়েছে বড়দিনের জন্য কেনা নানান মালপত্রের আনা-নেয়া। এক ছবিতে একটি গরুর গাড়িতে চাপিয়ে মালপত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আর অন্যটিতে একটি ছেকড়া গাড়ি করে।
জর্জসাহেবের প্রত্যেকটি ছবিতেই রয়েছে দারিদ্র এবং দৈন্যের ছাপ। ক্রিসমাস কার্ডে যেখানে বেশির ভাগ সময়ই থাকে অলীক কোনও ইংরেজ গ্রামের অবাস্তব সৌন্দর্য, সেখানে জর্জবাবু আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ঔপনিবেশিক কলকাতার সাধারণ, শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্রপীড়িত কঠোর বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু সেই দৈন্য-দারিদ্রের মধ্যেই তিনি খুঁজে বার করেছেন তাদের বড়দিনের আনন্দ, উল্লাসকে। দারিদ্র তাই করুণার অজুহাত হয়ে দাঁড়ায়নি তাঁর আঁকায়, বরং সেই ছবি রেখে গিয়েছে সহমর্মিতার স্বাক্ষর। আমাদের সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, ঔপনিবেশিক কলকাতায় বড়দিন যেমন শুধু লাট, ছোটলাটের উদ্দীপনার উৎসব ছিল না, তেমনই ছিল না বহু দূরের কোনও ভিনজাতির জাতীয় উৎসব। আর পাঁচটা পালাপার্বণের মতো, বড়দিনও কলকাতার দেশি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার উৎসব।
প্রতিটি ছবির তলায়ই রয়েছে সই: ‘জিও ডি’। অর্থাৎ জর্জ ডার্বি। যদিও জর্জবাবুর পরিচয় আজ অনেকটাই কুয়াশাচ্ছন্ন, তবু তাঁর ছবির মধ্যে দিয়ে আজও আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই স্বদেশি যুগের কলকাতার এক শিল্পীর বড়দিনকে একান্ত আপন করে নেওয়ার ইচ্ছেটুকু। এত ইতিহাস না জেনেও যখন প্রতি বছরের মতো হাজারও বাঙালি আবার এ বছর পার্ক স্ট্রিটে বড়দিনের হুজুগে মাতবে, তখন তারাও কিন্তু জর্জবাবুর সেই এক শতাব্দীরও বেশি আগে আঁকা ছবিতে ফুটে ওঠা ইচ্ছেরই শরিক হবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy