ছবি: রৌদ্র মিত্র।
সরকারি চাকরির যাবতীয় গৌরব এবং সৌরভের এক ও সম্ভবত একমাত্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্বাচনে ডিউটি। যে ডিউটি চোখের জলে নাকের জলে সরকারি কর্মচারীদের মনে করিয়ে দেয় দুঃখ বিনা সুখলাভ অসম্ভব মহীতে। ভোটকেন্দ্রেও ভাই সবই হয়, ভাই সবই হয়, সব সত্যি! সব সত্যি!
পূর্বমেঘ
সরকারি দফতরে ভোটের ডিউটি আসার নাম ‘নেমন্তন্ন’। এক পাতার সাদা কাগজে নাম-ধাম লিখে প্রথমে আসে ফার্স্ট ট্রেনিংয়ের চিঠি। নির্ধারিত দিনে হাজির হতে হয় নির্দিষ্ট জায়গায়। স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে পর্দা টাঙিয়ে শুরু হয় ধারাবিবরণী। প্রথম ট্রেনিং হওয়ার পর বিপুল সংখ্যক ভোটকর্মী আশায় আশায় থাকেন নাম কেটে যাবে। প্রায় প্রতি ভোটের আগেই নির্বাচন পরিচালনা করার অফিসে তাঁদের চেনা কেউ বেরিয়ে আসে, সে নাকি বিষয়টা দেখছে আর নাম ঠিক কেটে যাবে। তাকে ঘিরে তৈরি হয় ছোট্ট বৃত্ত। আরও অনেকে আশা করে থাকেন, এঁর হাত ধরেই তীব্র গরমে এ বার রেহাই মিলবে। এই ভিড় সবচেয়ে বেশি বাড়ে পঞ্চায়েত ভোটের সময়, সিংহভাগেরই কোনও সুরাহা হয় না। দেখতে দেখতে চলে আসে পরের ডিউটির চিঠি। এ বার বাদবাকি সহযোগীদের নাম, আর কোথায় যেতে হবে তার একটা প্রাথমিক পরিচিতি। ট্রেনিং-এ পৌঁছে বাকিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় সেরে নেওয়ার মাঝেই সবাই সবাইকে মেপে নেন, অবধারিত ভাবে সবার ভাবনা ভোটের দিন অন্য জনের সক্রিয়তা কতটা হবে তা নিয়ে। ফোন নম্বর বিনিময় হয়ে যায়, তৈরি হয়ে যায় গ্ৰুপ। কেন্দ্র, রাজ্য যে বাহিনীই থাক, নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নিতে হবে— এ বিষয়ে শলা চলে।
মাইক হাতে যিনি এর পর ট্রেনিং-এর কথা বলতে শুরু করেন, তিনি সবাইকে অনুরোধ করেন শলা থামিয়ে একটু কথা শুনতে। তাঁর চোখে-মুখে তখন পরীক্ষা দেওয়ার টেনশন স্পষ্ট। সামনে বসে আছে পনেরো-কুড়ি বারেরও বেশি ভোট করে আসা এক-এক জন কর্মী। ভিভিপ্যাট, কন্ট্রোল ইউনিট, এজেন্ট ফর্ম ফিল-আপ করানোর মতো বিষয় শুনতে শুনতেও তাদের মুখের কোণে হাসি। ‘আপনাদের কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?’ বললেই ধেয়ে আসে বিচিত্র সব প্রশ্ন— “ভোটের দিন গোটা গ্রামের প্রায় সবাই কালো চশমা পরে এসে বলছে ক’দিন ধরে আবছা দেখছে, কাউকে নিয়ে ভোট দিতে গেলে ভাল। এতগুলো ফর্ম ফিল-আপ করাতে হবে ব্লাইন্ড বা অশক্ত ভোটারের?” বা “স্যর ‘দানা’, ‘ঘোড়া’, ‘খোকা’ এই টার্মগুলো নিয়ে যদি একটু আলোচনা করতেন!” হাতে-কলমে ট্রেনিং আর মাঠে ময়দানের ভোটে যে বিস্তর ফারাক, স্বীকার করে নেন ট্রেনিং দেওয়া থেকে ভোট করতে যাওয়া সব কর্মীই। তাঁদের ভান্ডারে লুকিয়ে আছে আশ্চর্য সব গল্প।
বেহুলা কখনও বিধবা হয় না
টিভিতে যুদ্ধের সিনেমা দিত, এখনও দেয়— স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবসে। ছুটির দিনের সেই সিনেমায় যুদ্ধে যাওয়ার আগে সেনাদের (সিনেমার নায়কদের) ছোটবেলা, প্রেম, মায়ের সঙ্গে কাটানো সময়কে যে ভাবে কোলাজের মধ্যে দেখানো হত, ভোটকর্মীদের অনেকে নিজেদের সে ভাবে দেখতে শুরু করেন। আর ক’দিন পরেই যেতে হবে অজানা, অচেনা যুদ্ধক্ষেত্রে। নির্বাচনের খবরে হিংসার কথা শুনলেই বাড়ির অন্যদের দুশ্চিন্তার পারদ বাড়তে থাকে। সরকারি কর্মীদের পাওয়াটুকু বলতে ডিএ, না পাওয়াও ডিএ। এর মাঝে নির্বাচন করতে যাওয়ার জন্য ধরে দেওয়া টাকাতেও মন ভরে না। মন না ভরলেও নির্বাচন কমিশনের অমোঘ ডাক, রেহাই নেই। মশার ধূপ থেকে অন্ধকারের টর্চ, সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে।
হুগলির পলাশবাবু যেমন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, প্রতি ভোটের ডিউটির আগেই দিন পনেরো খুব মন দিয়ে ব্যায়াম শুরু করে দেন। শারীরিক কসরতের উদ্দেশ্য, ভোটের সময় কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে যাতে খানিক লড়াই দিতে পারেন। পাড়ার ছেলেরা প্রতি বারই তাঁকে রাগায় (যদিও তাতে তিনি মনে মনে খুশি হন) এই বলে যে, “আপনার তো সে দিন বিশাল পাওয়ার, এক বার ‘ফায়ার’ বললে গুলি চলবে!”
বর্ধমানের অনমিত্রবাবুর প্রস্তুতিপর্বে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাঁর স্ত্রীর অদ্ভুত আবদার। প্রতি নির্বাচনের কাজের সময় তিনিও— অনমিত্রবাবু যেখানে যাবেন— তার কাছাকাছি গিয়ে থাকবেন। না হলে এমন দুশ্চিন্তা হবে যে, তাঁর পক্ষে বাড়িতে থাকাই অসহ্য হয়ে পড়ে। ভোটের ডিউটি তো আর হোটেল বা হোম-স্টে আছে এমন জায়গা দেখে আসে না। আসে এমন জায়গায়, যেখানে বাড়ির কাউকে রাখা তো দূরস্থান, নিজেদের থাকাই বিড়ম্বনা। প্রথমে ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে গিয়ে কোন এলাকায় ডিউটি এল জানতে পারা যায়, সেই জায়গায় কী ভাবে স্ত্রী আসতে পারবেন, সেখান থেকে স্ত্রীকে জানানোর পর তিনি রওনা দেন। এর মধ্যে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে স্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা খুঁজতে শুরু করেন ভদ্রলোক। গ্রামের মানুষও অবাক, এ রকম অভিনব ভোট নিতে আসা জুটি তারা দেখেনি। প্রতি বারই প্রায় আতিথেয়তার সঙ্গেই অনমিত্রবাবুর স্ত্রীর থাকার বন্দোবস্ত হয়ে যায়। পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকে এখনও ভয়ে আছেন অনমিত্রবাবু, দিঘি ঘেরা গ্রাম দেখে সে বার খুশি হয়েছিলেন, স্ত্রীও ছিলেন যথেষ্ট আপ্যায়নে। ভোটের দিন দুপুরে গ্রামের অন্যান্য মহিলার সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও এসেছিলেন ভোট দিতে। গ্রামের মহিলাদের আন্তরিকতা আর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি। মহিলাদের ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মাথায় গামছা বাঁধা লম্বা-চওড়া লোকগুলোকে দেখে অনমিত্রবাবুও বুঝেছিলেন, আন্তরিকতায় সাড়া না দিয়ে ভোট দিতে না এলে অন্য ব্যবস্থা নেমে আসবে তাঁর উপর।
নির্বাচনই শেষ কথা নয়
মহিলাদের ভোটের ডিউটি পড়েছে ছেলেদের স্কুলে। শৌচালয় খোলা আকাশ। চটজলদি ব্যবস্থা করতে যারা এসেছে, তারা গ্রামেরই মাতব্বর। ভোটকর্মীদের সমস্যার সুরাহা করে দেওয়ার বিনিময়ে ভোট করানোয় যদি খানিক সুবিধা পাওয়া যায়, তার জন্য সমানে চেষ্টা চলছে। ত্রিপল এনে, বালতি, অস্থায়ী কল, জল সব কিছু বন্দোবস্ত করার মাঝেই চলছে রাগী ম্যাডামদের খুশি করার চেষ্টা— “দিদি, বিকেলের দিকে একটু যদি বুথটা ছেড়ে দেন আমাদের, এমনিতে হাওয়া তো বুঝতেই পারছেন...”
হাওয়ায় তখন দুপুরের তাপ ফুরিয়ে আসছে, সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। এমনিতেই মাথা ঠিক রাখা কঠিন, তার মধ্যে তখন থেকে এরা একই কথা বলে যাচ্ছে। নতুন শৌচালয় বানানো দেখতে গ্রামের লোকজন, বাচ্চা সবাই ভিড় করেছে। ঘটিগরম, কুলফিওয়ালা এরাও কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছে। সেক্টর অফিসারকে ফোন করে বার বার একই উত্তর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, “একটু নিজেরা বুঝেশুনে সবটা সামলে নিন।”
এখানে বিরোধী পক্ষও শক্তিশালী। তাদের কাছে খবর গেছে এক পক্ষ চটজলদি শৌচালয় বানিয়ে ফেলছে, কাজেই চুপ করে বসে থাকা যায় না। হাতে সময় কম, তারা এসেই দাবি করল ভোটের আগের দিন বা ভোটের দিন কোনও পক্ষের থেকে সুবিধা নেওয়া যাবে না, তা হলে তারা যথাযথ জায়গায় অভিযোগ জানাবে। এখন উপায়? দ্রুত সিদ্ধান্ত হল, বিরোধী পক্ষও এ রকম একটা শৌচালয় বানিয়ে দেবে। দিদিমণিরা মোট চার জন, দু’জন-দু’জন করে ভাগ হয়ে ব্যবহার করবেন দুই পক্ষের শিবির। তা হলে ভোটকর্মীদের তরফ থেকে নিরপেক্ষতা বজায় থাকল। এত যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সবাইকে কাজ করতে দেখে গ্রামের মানুষ যারপরনাই বিস্মিত। তাঁদের একটাই কথা, “এর সামান্যও যদি এরা সারা বছর করত, তা হলে গ্রামের হুলিয়া বদলে যেত!”
লাভের গুড়
প্রিসাইডিং অফিসারকে এসে আগের রাতে এক দল বলে গেছেন সাবধানে থাকতে, কারণ এই স্কুলবাড়ির আশপাশেই মজুত রয়েছে অনেক পেটো। ভোটের সময়ও খুব বেশি সব দিকে তাকানোর দরকার নেই, এখানে নাকি এ ভাবেই সব হয়। সঙ্গে আসা পেটের সমস্যায় ভোগা এক জন লাঠিধারী পুলিশ। সারা রাত কেটেছে ভোট নিতে আসা টিমের প্রাণ হাতে করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার চিন্তায়, ভোটের সকাল থেকে বাইরে আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে, থমথমে মুখ সবার। অল্প যে ক’জন ভোট দিতে আসছে, তাদেরও ভোট দেওয়ার জায়গার পিছনের জানলায় দাঁড়িয়ে থাকা এক জন নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছে। বেলা বেশি গড়াতে পারেনি, আস্ত এক টিন চিটেগুড় ঢেলে দিল ভোটিং মেশিনের উপর তিন-চার জন মিলে এসে। মুহূর্তের মধ্যে বাইরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। মেশিন নিয়ে এখন কী করা যায়, ভাবতে হবে পোলিং পার্টিকেই। সেক্টরকে জানানোয় তার বক্তব্য নিজেরা বুঝে-শুনে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে, ঝামেলা বা ইভিএম-এর কথা রিপোর্ট করলে অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে। কিছু ক্ষণ সময় চেয়ে নিলেন পোলিং অফিসাররা। বাইরে তখন খণ্ডযুদ্ধ, লাঠিধারী পুলিশ ব্যাগ থেকে বার করলেন ছাতু, মুড়ি। সবাই ব্যাগ থেকে চামচ বার করে মেশিন থেকে চেঁছে নিতে শুরু করলেন গুড়। যতটা ওঠে আর কী, পেটে তো ছুঁচোয় ডন মারছে।
তোমাদের এই হাসি খেলায়
ভোট আসে ভোট যায়, গ্রামের স্কুলের পাশের রাস্তা জুড়ে চলে যেতে থাকে নতুন নতুন ক্লাস। কেউ গ্রাম পেরিয়ে অন্য গ্রাম, কেউ বা শহর। হেঁটে-যাওয়া রাস্তায় সাইকেলের প্যাডেল গড়ায়। ভোট নিতে যান নতুন নতুন লোক। এমনই সীমান্তবর্তী এক গ্রাম। তার ভোটকেন্দ্র হয় যে প্রাথমিক বিদ্যালয়, তার দেওয়ালে নানা ছবি আঁকা, ছোটদের জন্য লেখা ছড়া। ভোট খুবই শান্তিপূর্ণ ভাবে চলছিল, বাদ সাধল খানিক পরে আসা এক ভোটার। যার নামে ভোট দিতে আসা, সেই বৃদ্ধর বদলে সামনে দাঁড়িয়ে অন্য আর এক জন যুবক। এজেন্টদের কারও আপত্তি নেই, খানিক পরে ভোট যখন প্রায় হয়ে এসেছে, প্রিসাইডিং অফিসার কৌতূহল ধরে না রেখে জানতে চাইলেন যে, “আপনাদের এত শান্ত গ্রাম, এত সুন্দর ভোট হচ্ছে, শুধু ওই একটা হিসাব মিলছে না। বৃদ্ধ কি অসুস্থ বলে অন্য কেউ এসে ভোট দিয়ে গেল?”
তার পর যা জানা গেল তার সারমর্ম, এই গ্রাম আগে ঝামেলার জন্য কুখ্যাত ছিল। ভোটের সময় প্রচুর রক্ত ঝরেছে। এই গ্রামেরই এক মাস্টারমশাই ঝামেলা থামাতে গিয়ে মারা যান। তার পর থেকেই ভোল বদলে গিয়েছিল এই গ্রামের, আর কোনও রকম প্ররোচনাতেই গ্রামের মানুষ এককাট্টা হয়ে ঝামেলা হতে দেয়নি ভোটে। বছরের পর বছর এখানে যারা ভোটের ডিউটি করতে আসেন, তাঁদের কোনও রকম সমস্যা হয় না। গ্রামের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েই এক রকম জোর করেই মাস্টারমশাইয়ের নামও রেখে দিয়েছে ভোটার তালিকায়। কেউ অভিযোগ না করায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও কিছু জানেন না। আঠারো বছর হওয়া নতুন কোনও ভোটার আসেন মাস্টারমশাইয়ের স্মৃতি বয়ে।
হিংসা-হানাহানির বিপ্রতীপে ছোট্ট একটা গ্রামে ভিন্ন ছবি দেখেছিলেন ভোটকর্মীরা।
এ বারও গ্রামবাংলা জুড়ে অজস্র বুথে ভোটের আগের দিন সন্ধ্যায় নতুন লাগানো হলুদ আলোয় দেওয়াল জুড়ে পড়বে ভোটকর্মীদের গোল হয়ে বসে কাগজপত্র গুছিয়ে নেওয়ার ছায়া। রাত্তিরে বেঞ্চ টেনে, বাইরে কার্বলিক ছিটিয়ে কোনও রকমে চোখ বুজে নেওয়া। সকালে গণতন্ত্রের উদ্যাপন শুরু হবে, গ্রামের পথে তিরতির করে কাঁপতে থাকা দীর্ঘদেহী গাছের ছায়ায় গ্রীষ্মদুপুরে জুড়ানো ভোটারও মনে মনে জানবে, তার আঙুলের ছোঁয়ায় কেউ দিল্লি যেতে পারে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy