অমিতাভ চন্দ্র।
যে ঘূর্ণিঝড় বাংলার বুকে শত শত বছর ধরে কয়েক বছর অন্তর, ইদানীং প্রায় প্রতি বছর আছড়ে পড়ে নিয়ম করে, তার ঠিকানা বঙ্গোপসাগরে। আবহবিদরা দেখেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের দাপট বেশি অক্টোবরে। ১২৮১-তে জাপানের টাইফুন ‘কাসিকাজে’ থেকে ২০০৮-এ মায়ানমারে ‘নার্গিস’ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাতশো বছরে যে ৩৬টা সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে প্রলয়ঙ্কর তকমা পেয়েছে, তার মধ্যে ২৬টার জননী বঙ্গোপসাগর।
ইংরেজরা কলকাতায় বসতি স্থাপনের পর প্রথম যে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ প্রত্যক্ষ করেছিল, তা হল ১৭৩৭-এর ১১-১২ অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড়, যার আর এক নাম ‘কলকাতা সাইক্লোন’। তারিখটা নিয়ে একটু ভুল বোঝাবুঝি আছে। তখনও ব্রিটিশরা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করত না, যা এখন ব্যবহার করা হয় সারা বিশ্বে। সে জন্য অনেকে তারিখটাকে ৩০ সেপ্টেম্বর বলে উল্লেখ করেছেন।
পলাশির যুদ্ধের দু’দশক আগের ঘটনা। ‘সেই রাতের মতো ভয়াবহ দৃশ্য আমি জীবনে কখনও দেখিনি বা শুনিনি... প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করছিলাম শহরের সবচেয়ে মজবুত যে বাড়িটায় বাস করতাম, ভেঙে পড়বে যে কোনও সময়। ভীষণ ভয় পেয়ে সপরিবারে নেমে গেলাম নীচে। শ্রীমতী ওয়াসটেন তাঁর সন্তানদের নিয়ে চলে এসেছিলেন আমাদের আশ্রয়ে। তাঁর বাড়ির জানলা-দরজাগুলো খুলে বেরিয়ে এসেছিল দেওয়াল থেকে। সকালে উঠে শহরটাকে দেখে মনে হয়েছিল গোটা শহর ধ্বংস হয়ে গেছে শত্রুর বোমার আঘাতে’— লিখেছিলেন বিলেতের বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অলিভার ক্রমওয়েলের প্রপৌত্র স্যর ফ্রান্সিস রাসেল, যিনি ঘটনাচক্রে কলকাতা শহরে ছিলেন ১৭৩৭-এর ১১ অক্টোবর রাতে। বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে সৃষ্টিনাশা প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলির মধ্যে গণ্য করা হয় এই ঘূর্ণিঝড়কে। এটা ছিল ইতিহাসে প্রথম ঘূর্ণিঝড় যার প্রলয়নাচনে সঙ্গত করেছিল ভূমিকম্প। অনেকের মতে, ইতিহাসে নথিভুক্ত প্রথম সুনামি।
তখন কলকাতার জমিদার টমাস জোশুয়া মুর তাঁর রিপোর্টে লেখেন, ‘ঝড় ব্ল্যাক টাউনের হাজার মানুষকে ফেলেছে অশেষ দুর্গতিতে, খুব বেশি হলে গোটা কুড়ি খড়ের বাড়ি কোনও রকমে দাঁড়িয়েছিল পরের দিন। কোম্পানির ৩২টা বাড়ির মধ্যে ২৪টাই মেরামতের বাইরে।’ লন্ডন ম্যাগাজ়িন লিখেছিল, ১১ ও ১২ অক্টোবর রাতে গঙ্গার মোহনায় ভয়াবহ হারিকেন ওঠে। সঙ্গে প্রবল ভূমিকম্পে মুখ থুবড়ে পড়ে প্রায় দু’শো বাড়ি। ভেঙে পড়ে চার্চের চুড়ো। জাহাজ, নৌকো, স্লুপ মিলিয়ে কুড়ি হাজার জলযান হয় ধ্বংস হয়েছিল, নয়তো ডুবে গিয়েছিল নদীতে। গঙ্গার জল মাথা তুলেছিল চল্লিশ ফুট উচ্চতায়।
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির বহর দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন কলকাতার কোম্পানির কর্তারা। ঘূর্ণিঝড়ের পর ২৬ অক্টোবর জমিদার টমাস জোশুয়া মুর কোম্পানির কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে বসলেন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করতে। দেখা গেল, শহরে মৃত্যু হয়েছে তিন হাজার মানুষের, প্রাণ হারিয়েছে বহু সংখ্যক গবাদি পশু। ভেঙে পড়েছে সরকারি কাছারি বাড়ি, কোম্পানির ৩২টা ইমারত, শহরের প্রাচীর, ২২টা গেট এবং বেশ কিছু সেতু। ১৭৩৭-এর ঘূর্ণিঝড়ের সময় চার্লস ওয়েস্ট ছিলেন ছ’বছরের। তিনি পরে স্মরণ করেন, সেন্ট অ্যানের গির্জার চুড়ো ভেঙে পড়ায় তাঁরা বেরিয়ে এসেছিলেন ঘর ছেড়ে। ১৭৩১-এ তৈরি পঞ্চান্ন মিটার উঁচু নবরত্নের মন্দিরের চুড়োও আছড়ে পড়েছিল মাটিতে।
‘দি জেন্টলম্যান্স ম্যাগাজ়িন’ প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ করে। ১৭৩৮-এর জুনে পত্রিকাটি বিগত বছরের ঘূর্ণিঝড়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিল, পাঁচশো টনের দুটো ব্রিটিশ জাহাজ নদীবক্ষ থেকে উড়ে গিয়ে ৩০৯ মিটার দূরে গিয়ে পড়েছিল একটা গ্রামের কাছে। ষাট টনের দুটো ছোট পালতোলা জাহাজের ঠাঁই হয়েছিল দশ কিলোমিটার দূরে একটা গাছের মাথায়। নদীর তীরে নোঙর করা একটা জাহাজের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ভেঙে গিয়েছিল তিনটে জাহাজ। সে কালে ঝড়ের গতি মাপার উন্নত প্রযুক্তি ছিল না এ কালের মতো। ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা থেকে অনুমান করতে পারেন আবহবিদরা। বিদেশি পত্রিকাগুলো ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিতে গিয়ে অবশ্য অতিরঞ্জন করে ফেলেছিল। তারা ঝড়ে কলকাতায় তিন লক্ষ প্রাণ বিনষ্টির কথা লেখে। হিসেবটায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন টেনহিল। তাঁর মতে, ওটা শুধু কলকাতার হিসেব নয়, গোটা দক্ষিণবঙ্গের। অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়েছিল কলকাতা-সহ বাংলার বড় একটা অংশ।
ভূমিকম্প ১৭৩৭-এর ঘূর্ণিঝড়ের দোসর হয়েছিল কি না, এ প্রশ্নে দু’-এক জনের সন্দেহ থাকলেও অনেকেই লিখেছেন ভূমিকম্পের কথা। এই প্রসঙ্গে কোম্পানির নথিপত্র নীরব থাকলেও তখন জাহাজের যে ক্যাপ্টেনরা জাহাজ নিয়ে কলকাতা বন্দর ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিলেন, তাঁরাও উল্লেখ করেছেন ভূমিকম্পের বিষয়টি। পরে বহু বিদেশি আবহবিদ এই ঘূর্ণিঝড়ের পরিচয় দিলেও প্রখ্যাত ব্রিটিশ নাবিক-বিজ্ঞানী হেনরি পিডিংটনের (১৭৯৭-১৮৫৮) বর্ণনা বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে কারণ, তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি ১৭৩৭-এ ঘূর্ণিঝড় এবং ভূমিকম্প, এই জোড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের একই সঙ্গে সংঘটনের কথা লিখেছেন। ১৮৬৪ সালে কলকাতা এবং সুন্দরবন অঞ্চলে যে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে কিন্তু এমন তথ্য মেলে না যে, ১৭৩৭-এর মতো গঙ্গার জল ফুলে উঠেছিল চল্লিশ ফুট পর্যন্ত। এই অস্বাভাবিক ঘটনার জন্য দায়ী সম্ভবত সুনামি। একই সময়ে ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের সমাপতন বিরলতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
যাই হোক, ১৭৩৭-এর ঘূর্ণিঝড় কলকাতার এক জনের অশেষ উপকার করেছিল। তিনি কলকাতার তৎকালীন ডেপুটি কালেক্টর গোবিন্দরাম মিত্র। ১৭৫২ সালে হলওয়েল সায়েব কালেক্টর পদে যোগ দিয়ে গোবিন্দরামের দুর্নীতি ধরে ফেলে সব হিসেবপত্র দাখিলের হুকুম দিলেন। গোবিন্দরাম নিপাট মিথ্যে বললেন, ১৭৩৭-এর ঝড়ে উড়ে গেছে কাগজপত্র। ঝড়ে সারা শহর ওলট-পালট, গির্জের মাথা কুপোকাত, নবরত্ন মন্দিরের চুড়ো মাটিতে গড়াগড়ি, সে ঝড়ে পলকা কাগজপত্র থাকবে কী করে! কাউন্সিল অগ্রাহ্য করতে পারেনি তাঁর যুক্তি।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রিয় সখা জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস অনিবার্য নির্বন্ধ, যা প্লাবিত করে উপকূলবর্তী অঞ্চল, ভেঙে দেয় বাঁধ। এ সমস্যা শুধু এ কালের নয়। আবুল ফজল তাঁর ‘আকবরনামা’-য় উপকূলরেখাকে বলেছেন ‘ভাটি’, অর্থাৎ যে নিম্নভূমি ভেসে যায় জোয়ারের জলে। ডুবে যায় হাজার হাজার একর বনভূমি।
বঙ্গোপসাগরে ফুঁসে ওঠা ঘূর্ণিঝড় বহু বার তছনছ করেছে বাংলাকে। এখনও করছে এবং করবেও। কয়েক ঘণ্টা ধরে যে প্রলয়নাচন দেখিয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়, তার পরিণতি যে কী ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৮৬৪-র ৫ অক্টোবরের সাইক্লোনের পরিচয় পাই শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘আত্মচরিত’-এ। লিখেছেন, ‘অদূরে রাণী রাসমণির কাছারি বাড়ি দেখা যাইতেছে... সেই কাছারিতে গিয়া আশ্রয় লঞা যাউক... কাছারি বাড়ির নিকটস্থ হইতে না হইতে সমগ্র বাড়ি ভূমিসাৎ হইল। চারিদিকের প্রাচীর পর্যন্ত ধরাশায়ী হইয়া সমভূম হইয়া গেল।’
বিগত শতকে চরম নাশিকা ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম হল ১৯৭০-এর ‘ভোলা’ সাইক্লোন এবং ১৯৯৭-এর ঘূর্ণিঝড়। শোনা যায় দ্বিতীয়টির গতি ছিল ঘণ্টায় ২৩০ কিলোমিটার। তবে মৃত্যুর সংখ্যার নিরিখে ১৯৭০-এর ভোলার ভয়াবহতা ছাপিয়ে গিয়েছিল সমস্ত ঘূর্ণিঝড়কে। মৃত্যু হয়েছিল আনুমানিক পাঁচ লক্ষ মানুষের।
হংকং, ম্যানিলার মতো উপকূলবর্তী এশীয় শহরগুলিতে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে যে তথ্য উঠে এসেছিল, তার প্রেক্ষিতে জানানো হয়েছিল কলকাতার বিপজ্জনক অবস্থানের কথা। যে কোনও বড় রকমের ঘূর্ণিঝড়ে কুপোকাত হবে কলকাতা। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণ মানুষের অসাধ্য, তার রোষের মুখে দাঁড়াতে পারে একমাত্র সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। কিন্তু আমরা এখন কালিদাস। সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে ব্যুৎপত্তির নিরিখে নয়— গাছের যে ডালে বসে আছি, নির্বিচারে তাকে কেটে ফেলার দূরদর্শিতায়। প্রকৃতি কেন আমাদের ক্ষমা করবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy