পসরা: শহরের রাস্তায় রঙিন বেলুন বাঁশি বল খেলনার ভ্রাম্যমাণ বেসাতি। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
রাস্তায় রাস্তায় জিনিস ফেরি করা যে কবে থেকে শুরু হয় তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। সম্ভবত চাষবাস-সহ বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদন করতে শিখে মানুষ যখন সমাজব্যবস্থার পত্তন করতে শুরু করে, বিনিময়প্রথার সেই উষালগ্নে দ্রব্য লেনদেন দিয়েই ফেরিওয়ালার যাত্রা শুরু। তাই ফেরিওয়ালার আবির্ভাবের বয়স প্রায় প্রাচীন সভ্যতাগুলির সমসাময়িক।
জাতকে গৌতম বুদ্ধকে আমরা সেরি রাজ্যের ফেরিওয়ালা সেরিবানরূপে দেখি, যে রাস্তায় রাস্তায় হাঁড়ি-কলসি ফেরি করে বেড়াত। ‘সহস্র এক আরব্যরজনী’-র আলাদিনের গল্পে পুরনোর বদলে নতুন প্রদীপ ফেরি করা ফেরিওয়ালার দেখা পাওয়া যায়। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তাঁর ‘কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ’-এ বলছেন, আলেকজান্ডার দুমা-র ‘দ্য ডিকশনারি অব কুইজ়িন’-এ আছে— আজকের কথা নয়, সেই সুদূর ত্রয়োদশ শতকে ‘মাস্টার্ড’ বা রাই-এর ফিরিওয়ালারা, ঠিক রাত্তিরে লোকরা খেতে বসার আগে প্যারিসের রাস্তায় অলিতে গলিতে চমৎকার ভাল ভিনিগার, মাস্টার্ড ভিনিগার, মাস্টার্ড সস, গার্লিক সস, স্ক্যালিয়ান সস, ভেরজুস সস বলে চিৎকার করে ছুটে ছুটে বেড়াত। সেই ডাক শুনে গিন্নিরা জানালা খুলে মাংসের সঙ্গে মেখে খাবার জন্যে পছন্দমতো রাই আর সস কিনতেন। প্যারিসের একটি বিখ্যাত পাড়া ‘ল্যে রু সাঁ জাক’-এর জীবনযাত্রা নিয়ে ‘লিমাজেরি প্যারিসিয়েন’ বলে পিয়ের লুই দুশার্ত আর রেনেসলনিয়ে যে বই লেখেন, তা থেকেই পুরনো প্যারিস আর কলকাতার ফেরিওয়ালা ফেরিওয়ালিদের মিল দেখা যায়।
বিলেত ইউরোপ আর মার্কিন দেশে রাস্তার ফেরিওয়ালারা অনেক দিন বিদায় নিয়েছেন। বিশিষ্ট ব্যারিস্টার ও প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শচীন চৌধুরী যখন ১৯২০ সালের কোঠায় লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তেন, তখন লন্ডনে পাড়ায় ‘পোটেটিজ, কিউকামবের, বেনেনা’ হাঁক দিয়ে ফেরিওয়ালারা ঠেলাগাড়ি করে আনাজ আর ফলমূল বিক্রি করত। তা ছাড়া ছিলো ‘মর্নিং পাইপার’ বলে খবরের কাগজওয়ালাদের হাঁক। এখন নিউজ স্ট্যান্ড আর কিয়স্কগুলো হয়ে তাঁরা বিদায় নিয়েছেন।
ইউরোপে ফেরিওয়ালার একটা খুব পুরনো ছবি ১৫৬৮-তে ছাপা হোস্ট আম্মান-এর ‘দ্য বুক অব ট্রেডস’ এ আছে। এই ফেরিওয়ালারা গলায় ঝোলানো গোল ট্রে থেকে বাঁশি, ঝুমঝুমি, মশলা, চিনি, ব্র্যান্ডি, আয়না, ঘণ্টা, চিরুনি, চুলের ফিতে, চশমা ইত্যাদি ফেরি করে বেড়ােতন। আঠারো শতকের লন্ডনের রাস্তার আওয়াজের বেশ কিছু খবর পাওয়া যায় ১৭১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর, ‘ট্যাটলার’ কাগজে অ্যাডিসনের লেখা ‘দ্য ক্রাইজ় অব লন্ডন’ প্রবন্ধটি থেকে। সেখানে লেখক বলছেন, সারা দিন যারা আলাদা আলাদা ডাক দিয়ে জিনিস ফিরি করত, তাদের মধ্যে ছিল দুধওয়ালি, চিমনি সাফাইওয়ালা, কয়লার কুচি, ভাঙা কাচ আর সুরকি কেনাবেচার লোক, ছুরি কাঁচি শানের লোক, হাপর সারানোর মিস্ত্রি ইত্যাদি।
কৃষ্ণভাবিনী দাস তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিলেত যান ১৮৮২ সালের সেপ্টেম্বরে। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা বই ‘ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা’। এই বইতে কৃষ্ণভাবিনীর বয়ানে বিলেতের ফেরিওয়ালাদের কথা বিস্তারিত জানা যায়। যেমন, ‘অনেক রাস্তায় যেখানে গাড়ির শব্দ কম সেখানে যত ফিরিওয়ালারা চুপড়ীতে কিম্বা হাতটানা গাড়ীতে করিয়া জিনিস লইয়া ক্রমাগত চীৎকার করিতে করিতে চলিতেছে।... তাহারা প্রাতঃকাল আটটা হইতে আরম্ভ করিয়া বিকালবেলা পর্যন্ত কখন বা রাত আট নয়টা অবধি রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়ায়। কিন্তু কি বলিয়া চীৎকাব করিতেছে তাহার মাতামুন্ডু কিছুই বুঝিতে পারি না। ক্রমে মাসকতক থাকিবার পর অনেকটা বুঝিতে পারা যায়— কোথাও বা “ম্যাক্রেল ম্যাক্রেল” বলিয়া ঠেলা গাড়ীতে করিয়া মাছ বেচিতেছে, কোথাও বা “টিনের জিনিস সারাবে”, “ছুরী কাঁচি সানাবে”... কেহ বা “কোল্ কোল্” বলিয়া পাথরে কয়লা বেচিতেছে কোথাও বা “চৌকী ও ছাতা সারাবে”... একজন য়িহুদী “ওল্ড ক্লোজ, ওল্ড ক্লোজ” বলিয়া পুরাণ কাপড় কিনিতে চাহিতেছে। কোন কোন রাস্তায় সন্ধ্যার সময় “আলু পোড়া, সব গরম” বলিয়া ঠান্ডায় লোকের মনে লোভ জন্মাইয়া দিতেছে।... সন্ধ্যার সময় কোন কোন রাস্তায় দেখিবে একজন লোক মাথায় একটী বাক্স করিয়া ঘণ্টা বাজাইতে বাজাইতে যাইতেছে। এ লোকটী চীৎকার করার পরিবর্তে ঘণ্টা বাজাইয়া জানাইতেছে যে সে মাফিন নামক আমাদের দেশের সিদ্ধ পিঠার মত একরকম দ্রব্য বেচিতেছে। এ দেশে অনেক গরীব ইটালীয় আসিয়া এক এক অর্গান লইয়া রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়ায় ঐ অর্গানের বাজনা ভাল বোধ করিয়া কেহ কেহ দু এক পেনী দেয়। ...এ দেশে ভিক্ষা করিবার আইন নাই।” পরবর্তী কালে রাধাপ্রসাদ বলছেন, “আমি যখন ১৯৭৭-এর গরমকালে একবার ফ্রান্স ও বিলেতে যাই তখন প্যারিস বা লন্ডনের কোনো অলিতেগলিতে ঘুণাক্ষরেও একটা ফিরিওয়ালা বা ফিরিওয়ালির ডাক শুনিনি। এর কারণ ইতিমধ্যে আইন করে রাস্তায় ফিরি করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
১৮৫৭ সালে ছাপা ‘দ্য মোসলেম নোবল’ বইয়ে মিসেস ইয়াং নামে এক জন মেমসাহেব মুম্বইয়ের ফেরিওয়ালিদের চমৎকার খবরাখবর দেন। বিংশ শতকের বিশের দশকে সেসিল এলজি মুম্বই ও পশ্চিম ভারতের সাপুড়ে, ধুনুরি, ভিস্তি ও নানা ফেরিওয়ালার ছবি এঁকেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি ইভলিন ব্যাটি-র লেখা ‘কস্ট্যুমস অ্যান্ড ক্যারেক্টার্স অব দ্য রাজ’ বইয়ে ১৯৮২-তে ছাপা হয়েছে। পার্সিভাল মার্গারেট স্পিয়ার-এর লেখা ‘ইন্ডিয়া রিমেম্বার্ড’ বইয়ের দ্বিতীয় ভাগে উনি তাঁদের দিল্লির বাড়ির দরজায় ১৯৩০-৪০’এর সময়ে সকাল থেকে সন্ধে অবধি যে সব জিনিসপত্র বিক্রি করতে আসা ফেরিওয়ালার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন।
কলকাতার ফেরিওয়ালিদের সম্বন্ধে যে দু’জন লিখেছেন, তাঁরা রসরাজ অমৃতলাল বসু ও ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র দত্তের কাকা, রায়বাহাদুর শশীচন্দ্র দত্ত। অরুণকুমার মিত্রের সম্পাদনায় ‘অমৃতলাল বসুর স্মৃতি ও আত্মস্মৃতি’ নামে তা বেরিয়েছে ১৯৮২ সালে। অমৃতলালের কথায়, কম্বুলেটোলায় রাস্তার ফেরিওয়ালার ডাক শুরু হত ‘কু-য়ো-র ঘ-টি তো-লা’ দিয়ে। এই ডাক কানে গেলে পাড়ার লোকজন বুঝতেন যে, আকাশ একেবারে ফরসা না হয়ে গেলেও ফরসা হব-হব করছে। অমৃতলাল বলছেন, এঁরা তখন প্রত্যেক গেরস্থর অতি পরিচিত ও প্রার্থিত অতিথি ছিলেন। কারণ তখন “পতিতপাবনী সুরধুনী পলতার বালুকাকুণ্ডে স্নান করতঃ অমলা হইয়া কলনলবাহিনীরূপে কলকাতাবাসীর গৃহে গৃহে প্রবেশ করেন নাই।” তখন সব বাড়িতেই এক বা একাধিক কুয়ো ছিল। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখাতেও পাওয়া যায়, রান্নাঘর, সদর ও ভিতরবাড়িতে তাঁদের মোট তিনটি কুয়ো ছিল। অমৃতলাল যে সব ফেরিওয়ালাদের কথা বলেছেন, তাঁরা হলেন সরাগুড়, তিলকুটো, সন্দেশ, মুকুন্দমোয়া বিক্রেতা। সঙ্গে থাকত বেদেনিদের হাঁক— ‘বাত ভালো করি, দাঁতের পকা বার করি, মিশি লেবে গো’ ইত্যাদি। আর মুসলমান ফেরিওয়ালাদের রিফুকর্ম, শাঁখা, সিন্দুর, মধু, ধনে, ‘সরষে লেবে গো’ ইত্যাদি। আনারপুরের প্রকাণ্ড ধামা মাথায় আসতেন দইওয়ালারা। যাঁদের হাঁক ছিল ‘চাই শুকো দই’, যা মালসা ওল্টালেও পড়ত না।
১৯৮২ সালের শারদীয়া ‘মহানগর’ পত্রিকায় অতুল সুর ‘সে এক রূপকথার কলকাতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমাদের ছেলেবেলায় মেয়ে ফিরিওয়ালার এক পরিচিত ডাক ছিলো “মিশি লেবে গো—” তখনকার বয়স্কা নারীরা সখ করে দাঁতে মিশি মাখতেন। কম্বুলেটোলায় বিকেলের দিকে অনেক মুসলমান ফিরিওয়ালা বিলিতি চুড়ি, কাঁচের খেলনা ও সাবান বিক্রি করত। এ ছাড়াও পুরোনো শিশিবোতল, কাগজ, পুরোনো লোহা, ছাতা, নেকড়াকানি বিক্রি, কাটাও শিল চাকতি জাঁতা, চাই মুংগ কি ডাল, হাঁসের ডিম, বিলিতি আমড়া, পাটবাদাম, ঘটিবাটি, ঘড়া, পিলসুজ, ভাঙ্গা বাসুন সারাতে আছে, বেল মোরোব্বা, হজমিগোলি, আম্বাচার, টোপাকুল, কাসুন্দি, মন্ডামেঠাই, রুটিবিস্কুট, নানখাট্টাই, গোলাপি রেউড়ি, নারকোলদানা, চানাচুর গরমাগরম ও বরফ ফেরি হতো।” ১৮৭০ সালে এক চানাচুর-বিক্রেতার এই মজার গানটির সন্ধান দিয়েছেন সে যুগের বিখ্যাত কবি ও লেখক অক্ষয়চন্দ্র সরকার— ‘ধরমচাঁদ কি চেনাচুর/ মজামে ভরপুর/ তু দেখেগা কেতনা সাধু কেতনা অবতার/ নীচ রংমে তেরা সামনে করেগা বিহার।’
মাইকেল তার ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় ‘চাই বেলফুল চাই বরোফ’ অর্থাৎ মালাইবরফের ডাকের উল্লেখ করেছেন। শচীন চৌধুরীর কথায়, “ইস্কুল থেকে ফিরলে শুরু হতো নানানরকমের মুখরোচক খাবারের ফিরিওয়ালাদের আসাযাওয়া। এদের মধ্যে ছিলো সাড়েবত্রিশভাজা। এর সাড়েটা হলো আধখানা লঙ্কা।” অমৃতলাল ও শশীচন্দ্রের মতে, সাড়ে বত্রিশ ভাজাওয়ালা হরিদাসের ছিল বিচিত্র পোশাক আর পায়ে ঘুঙুর। এ ছাড়াও ছিল অবাক জলপান, চটপটি, আলু কচালু, নকুলদানা, ঘুগনিদানার দল। শচীন চৌধুরীর লেখায় এক জন কুলফিওয়ালার কথা আছে, যিনি একটা লাল কাপড়ে ঢাকা বিরাট হাঁড়ি থেকে কুলফির টিন বার করে দু’হাতে চেপে ঘুরিয়ে কুলফি, পাতার উপর বার করে দিতেন: “সে কুলপীর স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।”
আমার ছোটবেলায় পূর্ব কলকাতায় গরমকালের সন্ধেয় এমন কুলফিওয়ালার কুলফি খেয়েছি যাঁর কাছে বড়দের জন্যে সিদ্ধি দেওয়া কুলফি থাকত। আর ছিল ম্যাগনোলিয়া আইসক্রিম। দু’হাতে কাঠের গাড়ি ঠেলে ঠেলে বিক্রি করতে আসত মাথায় পাগড়ি দেওয়া এক পঞ্জাবি সুপুরুষ। তাঁকে আমরা ‘বাঁধাকপি কাকু’ বলে খেপাতাম। তখন ১০ পয়সায় দুধের ও ৫ পয়সায় অরেঞ্জ আইসক্রিম মিলত। ভোর হলে গঙ্গামাটি বিক্রিওয়ালির ডাক শোনা যেত ‘মাটি লিবিগো’! তখনকার দিনে বাঙালি হিন্দুদের বাড়ি নানা কাজে শুচিতা বজায়, বিশেষত ‘হাতেমাটি’ করার জন্যে গঙ্গামাটি না হলে চলত না। হাতিবাগানে আমার পিসিমার বাড়ি ও আহিরীটোলায় মামাবাড়ির এক তলার স্নানঘরে আমি গঙ্গার ঘোলা জলের কল ও হাতেমাটির জন্যে গঙ্গামাটির ব্যবহার দেখেছি।
সারা দিনে আরও যে সব ফিরিওয়ালা আসতেন যেতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ‘মাদারিকা খেল দেখানেওয়ালা’রা আর অবাঙালি নাচুনি মেয়ে আর সঙ্গী গাইয়ে। মাদাম বেলনেস বর্ণিত বান্দারওয়ালা, ভালুকওয়ালা আর সাপুড়ে। এঁরা সব তাঁদের আসার কথা জানান দিতেন ঢোলক, বাঁশি, ডুগডুগি বাজিয়ে আর সেই সব আওয়াজ শুনলেই দেখতে দেখতে গলিতে ভিড় জমে যেত। ভারতে ২০১৮ সাল থেকে সার্কাস অথবা কোনও খেলায় জন্তু-জানোয়ারদের ব্যবহার আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাসনওয়ালার মতো আর এক জন মাঝে মাঝে আসতেন ‘বাসুনে নাম লেখাবে’ বলে হাঁক দিয়ে। আর আসতেন চাবিওয়ালা, বড় বড় চাবি লাগানো বিরাট একটা রিং নাড়িয়ে নাড়িয়ে শব্দ করে চাবি ফিরি আর তৈরি করে বেড়াতেন। তাঁরা এখনও আছেন। আর কখনও কখনও আসতেন ধুনুরি। রাধাপ্রসাদবাবু মজা করে বলছেন, “ধুনুরি যখন টংটং শব্দ করে বারবার তুলোগুলোকে ধুনে ধুনে মিহি করে পেঁজে তা দেখলে মেরে তুলো ধুনে দেবো কথাটার আসল মর্ম বুঝে শিউরে উঠতে হয়।” হুতোমের নকশায় পাচ্ছি এক চৈনিক ফেরিওয়ালাকে, যিনি বিক্রি করতেন চিনা সিল্ক। তাঁর জিনিস না কিনে বিদায় করতে চাইলে বলতেন “টেক টেক, নো টেক নো টেক, একবার তো সি!” অমৃতলালের লেখায় যে দাঁতের পোকা তোলা বেদেনিদের কথা পাওয়া যায়, এঁদের আমি ছোটবেলায় দেখেছি। দাঁতের যন্ত্রণায় কষ্ট পাওয়া লোকদের পোকা খাওয়া দাঁত থেকে তুলোয় করে সাদা সাদা পোকা বার করে বাড়ির সবাইকে এঁরা তাক লাগিয়ে দিতেন। বড় হয়ে বুঝেছি, সেটা একেবারেই বুজরুকি। অন্যান্য ফিরিওয়ালিদের মধ্যে ছিলেন চুড়ি বিক্রিওয়ালি, যাঁর ‘চুড়ি লিবি গো’ ডাক কানে যেন মধু ঢালত। কিন্তু শশীচন্দ্র লিখেছেন, এঁদের কদাকার ছিরি দেখলে সব কিছুই ভেস্তে যেত। কালীঘাটের পটের মতো বটতলার কাঠখোদাইতেও চুড়ি পরানোর অন্তরঙ্গতা ফুটে উঠতে দেখা যায়।
রাধাপ্রসাদ গুপ্ত বলছেন, “আমরা ছোটবেলায় কখনো কখনো মামার হাত ধরে শ্রীমানী বাজারে গিয়ে মাথায় উঁচু করে ডাঁই করে চুল বাঁধা খান্ডারনি মেছুনিদের দাপট দেখেছিলাম।” হুতোমের লেখা থেকেও পাওয়া যায়, “শোভাবাজারের রাজাদের ভাঙ্গা বাজারের মেচুনীরা প্রদীপ হাতে করে রাত্রে পাড়ায় পাড়ায় ওঁচা পচা মাচ আর লোনা ইলিস নিয়ে ক্রেতাদের— “ও গামচা কাঁদে ভালো মাচ নিবি?” ও “খেংরা গুপো মিন্সে চার আনা দিবি” বলে আদর কচ্চে...” বঙ্কিমচন্দ্রও ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ মেছুনির ‘খ্যাংরাগুপো মিন্সে’ এই মিষ্টি সম্বোধনের কথা বলেছেন। সন্ধেবেলার ফেরিওয়ালাদের বর্ণনা এ ভাবে হুতোমের লেখায় পাওয়া যাচ্ছে, “এ দিকে সহরে সন্ধ্যাসূচক কাঁশোর ঘণ্টার শব্দ থামলো। সকল পথের সমুদায় আলো জ্বালা হয়েছে। বেলফুল বরফমালাই চীৎকার শুনা যাচ্ছে।...” আবার এক জায়গায় পাচ্ছি, “দুপুর বেজ্যে গ্যালো, সূর্যের মৃদু তপ্ত উত্তাপে শহর নিমকীরকম গরম হয়ে উঠল... ফিরিওয়ালারা ক্রমে ঘরে ফিরে যাচ্ছে, রিপুকর্ম ও পরামানিকরা অনেকক্ষণ হোলো ফিরেচে, আলু পটোল! ঘি চাই! ও তামাকওয়ালা কিছুক্ষণ হোলো ফিরে গ্যাছে। ঘোল চাই মাখম চাই! ভয়সা দই! ও মালাইদইওয়ালারা কড়ি ও পয়সা গুন্তে গুন্তে ফিরে যাচ্চে, আ্যাখোন কেবল মধ্যে মধ্যে পাণিফল! কাগোজ বদল! পেয়ালা পিরিচ— বিলাতী খেলেনা বর্ত্তন চাই... ফিরিওয়ালাদের ডাক শোনা যাচ্ছে।”
বিশ্বায়ন আর প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের দৌলতে নব্বইয়ের দশক থেকে পাড়ার মুদির দোকানের আর ফেরিওয়ালাদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সাম্প্রতিক অতিমারি আমাদের জানান দিল, ফেরিওয়ালাদের গুরুত্ব এখনও শেষ হয়ে যায়নি। লকডাউনের বিভিন্ন পর্বে যখন দোকান বাজার শপিং মল বন্ধ, তখন কাজ হারানো বিভিন্ন পেশার মানুষ নেমে পড়লেন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ফেরিতে। এঁদের হাত ধরে ভ্যানরিকশা, সাইকেল, ঠেলাগাড়িতে করে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে গেল শাকসব্জি মাছ মাংস ডিম পাউরুটি ফলমূলের মতো আরও অজস্র রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। নতুন করে প্রমাণিত হল, মানুষের সভ্যতা যত দিন থাকবে, তত দিন আমাদের জীবনে থেকে যাবেন এই ফেরিওয়ালারাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy