মৃত্তিকাশিল্প: হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুর ব্লকে সিংটি পিরের বহু শতকপ্রাচীন মেলায় লক্ষ্মীর ভান্ডার এবং নানা খেলনা, পুতুল
গরুর গাড়ি কুমোরপাড়ার পরিচয়চিহ্ন। ঠিক গাড়িটা নয়। তাতে কলসি-হাঁড়ি বোঝাই থাকতে হবে। কবিগুরুর দান এই পরিচয়। তবে অনেকে বলতে পারেন, কুমোরের চাক বা কুম্ভকারচক্রই কুমোরপাড়ার নির্ভুল পরিচায়ক। ডকুমেন্টারি জাতীয় ছবিতে আমরা প্রায়ই দেখেছি, ঘূর্ণ্যমান চাকার উপর এক তাল নরম মাটি ফেলে দেওয়া হল, তার পর কুম্ভকারের আঙুলের কায়দায় গড়ে উঠল নিটোল হাঁড়ি কিংবা কলসি কিংবা আর কিছু।
তার আগে বলি, চাক আবার অন্য চক্রে চলতে না-ও পারে। তাঁদের কাছে গুরুত্ব পাবে মাটি। সে কথায়ও যুক্তি আছে। কলকাতার কুমোরটুলি গেলে আর ক’টাই বা কুমোরের চাক দেখা যায়! তা হলে আর একটু ভেবেচিন্তে বলা যেতে পারে, মাটি ছাড়া কুমোরপাড়া অচল। মাটির শিল্পকর্ম করেন বলেই কুম্ভকারেরা মৃৎশিল্পী। কুমোরপাড়ায় জমে থাকা মাটির তালের কারণে কোনও গ্রামের নামকরণ হয়েছে, এমন মতও রয়েছে।
আসলে গরুর গাড়ি-চাক-মাটি কাউকে বাদ দিয়েই কুমোরপাড়া নয়। তিনটিই এই মহল্লার পরিচয়চিহ্ন। কিন্তু তিনটি ধাপের। মূল কিন্তু মাটি। কুমোরপাড়ায় গরুর গাড়ি ঢোকার অবকাশ আর নেই। কালের নিয়মে চালু হওয়া অন্য গাড়িও ঢোকে না। কারণটা সেই মাটি। মাটির টানে মৃৎশিল্পীরা।
বেশ কয়েকটা কুমোরপাড়ায় খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। মাটির জোগান পেতে সমস্যা বেশির ভাগ জায়গাতেই। সেই কারণেই বহু পাড়ায় চাক বন্ধ। আক্ষরিক অর্থেই শিকেয় উঠেছে চাক। হাওড়ার বাগনান-১ ব্লকের বাকসিতে নদীর কাছেই কুমোরপাড়া। দু’-এক জন উঠে এসেছেন মূল রাস্তার ধারে। মাটির জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখেন ঘরের সামনে। এঁদের এক জনের চাক রয়েছে। কিন্তু তিনি সেটা বিক্রি করে দিতে লোক খুঁজছেন। কারণ মাটি পাচ্ছেন না। নদীর কাছে বাস হলেও মাটি নেওয়া নিষেধ। নদীর মাটিতে কাজ ভাল হয়। এখানকার কুমোরপাড়ার বেশির ভাগ লোকজন কাজ ছেড়েছেন। এঁরা দু’-এক ঘর দু’-এক রকম জিনিস তৈরি করেন। বেশির ভাগটাই কেনা বাইরে থেকে। বাকসির মাটির জিনিসের আগে বেশ নাম ছিল।
একই ছবি হাওড়ার জগৎবল্লভপুর ব্লকের নরেন্দ্রপুর পালপাড়ায়। এখানে চাকের কাজ বন্ধ বহু দিন। মাটির টানাটানিতেই। চাকের কাজে ভাল মাটি লাগে। আগে তাঁরা চাষের জমি থেকে মাটি নিতেন। কিন্তু এখন জমির মালিকেরা নিতে দেন না। মাটির কারবারিদের থেকে কিনতে হয়। পুকুর, ডোবা কাটানোর খবর পেলে ছুটে যান। যাঁরা মাটি কাটেন তাঁদের দেখিয়ে দেন, কোন মাটি লাগবে। পুকুরের উপরের, গভীরের দু’রকম মাটিই লাগে। এই মাটি দিয়ে হাতে চাপড়ে তৈরি করা যায়, এমন সব জিনিসপত্র তৈরি করেন।
জগৎবল্লভপুরেরই পাতিহালে মাটির কাজ প্রায় শেষ হতে বসেছে। চাকের কাজও আর হয় না প্রায়। বাইরে থেকে মাটি কিনে কাজ চালান ছোট ও বড় পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। শঙ্করহাটির এক মৃৎশিল্পী মাটি কেনেন ডায়মন্ড হারবার থেকে। নদীর মাটি। ফোনে বরাত দিলে লরি করে মাটি আসে। এক লরি মাটির দাম ৪০ হাজার টাকা। এত দাম দিয়ে একা কোনও মৃৎশিল্পীর পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। এক সঙ্গে অনেকের বরাত মিললে মাটি আসে। লরি থেকে প্রয়োজন মতো কেটে নামিয়ে দিয়ে যান। শঙ্করহাটির একদম কাছেই কৌশিকী বা কানা নদী। আগে নদীর বুক থেকে মাটি নিতেন কুমোররা। এখন এখানকার মৃৎশিল্পীদের অনেকেই মাটির কাজ ছেড়েছেন। দু’-এক জন যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা আর নদী থেকে মাটি নিতে পারেন না। সংস্কারের পরে মাটি নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কিছু জায়গায় মাটির ছবিটা একটু অন্য রকম। বাকসির বছর পঁচাত্তরের মৃৎশিল্পী জানিয়েছিলেন, তাঁরা মাটির জিনিসপত্র কেনেন বাইনান, আঁকলে, দেওড়ার মৃৎশিল্পীদের থেকে। ওই জায়গায় কি মাটির অভাব নেই? হাওড়ার সিংটির মৃৎশিল্পীরা গ্রীষ্মকালে গ্রামেরই পুকুর থেকে মাটি পেয়ে যান। শুধু মজুর লাগিয়ে কাটিয়ে নিতে হয়। বাইরে থেকেও কিছু মাটি কেনেন। এখানে খানছয়েক ঘরে চাক ঘোরে। তবে মাটির কাজ কমছে। সেটা অবশ্য অন্য কারণ।
কিন্তু মাটির অভাব বেশির ভাগ কুমোরপাড়ায়। এতগুলো জায়গার মৃৎশিল্পীরা যদি ঠিকঠাক মাটি পেতে পারতেন, তা হলে কী হত? কুমোরপাড়ার চাকগুলো সচল থাকত। তৈরি হত ভাঁড়, গ্লাস। সাধারণ এবং কারুকাজ করা। তাতে প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেকটাই কমানো যেত। ধরা যাক, পাড়ার কোনও দোকানে দিনে ১০০ কাপ চা বিক্রি হয়। আর এর বেশির ভাগটাই বিক্রি হয় প্লাস্টিকের কাপে। কিছু খদ্দের মাটির ভাঁড় চান। কিন্তু প্লাস্টিকের কাপে লাভ বেশি থাকে বলে অনেকেই রাখেন না ভাঁড়। প্লাস্টিক নিষেধের কড়াকড়ি আর মাটির ভাঁড় ব্যবহারে উৎসাহে পরিবেশ অনেকখানি ক্ষতিকর জঞ্জালমুক্ত হবে।
এখন তন্দুরি চায়ে আগ্রহ বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় দোকান হয়েছে। বেশ ভিড়। ভ্লগারদেরও আনাগোনা দেখা যায়। তন্দুরি চায়ে মাটির ভাঁড় লাগে। এই ভাঁড় কিন্তু চাকে তৈরি হয়। তন্দুরি চায়ের ভবিষ্যৎ আছে বলে মনে হয়। পাহাড় থেকে নেমে মোমোর সমতল জয়ের মতো না হলেও, আছে। চা বেশি চললে ভাঁড় বেশি লাগবে। কুম্ভকারেরা কাজ বেশি পাবেন। সাধারণ চায়ের দোকানগুলোয় মাটির ভাঁড়ই চলবে, এমনটা আশা করলে অবশ্য চাকের রমরমা হতে পারে।
সমস্যা আরও আছে। মৃৎশিল্পীরা হাঁড়ি-কলসি-ভাঁড়ের সঙ্গে তৈরি করেন পুতুলও। নানা ধরনের পুতুল। হাওড়ার বিভিন্ন পুতুলপাড়ায় ঘোরার অভিজ্ঞতায় দুটো সমস্যার কথা মনে হয়েছে। এক, মাটির কাজ কমছে। মাটির কারণে এবং পরবর্তী প্রজন্ম আগ্রহী না হওয়ায়। যে কারণে নরেন্দ্রপুরে মাটির সমস্যা না থাকলেও চাক কমছে। মাটির কাজ কমছে। দুই, বাজার। মাটির পুতুলের বাজার হারিয়ে যাচ্ছে প্লাস্টিক ও অন্য পুতুলের গ্রাসে। মাটির পুতুল কিন্তু লোকশিল্প। আমাদের গৌরব। এই শিল্প বাঁচানো দরকার। কিন্তু কী ভাবে?
এই শিল্পের পাশে দাঁড়ানো যেতে পারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাজার তৈরি করে। বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও স্বাগত, প্রয়োজনও। কিন্তু লোকশিল্পের দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে বাজার তৈরি করতে হবে। কুমোরপাড়াগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাটির পুতুলে আদিম সারল্যের একটা ছাঁদ থাকে। বৌ পুতুল, মেয়ে পুতুল, ছেলে পুতুল যেমন। এগুলো সাধারণত টেপা পুতুল নামে পরিচিত। তৈরি হয় হাতি, ঘোড়া, নৌকা। কিছু ক্ষেত্রে চাকা লাগানো থাকে। এগুলো বেশির ভাগই পোড়ামাটির রঙেই বিক্রি হয়। খদ্দের চাইলে রং করে দেন মৃৎশিল্পীরা। ঝাঁ চকচকে-র যুগে পোড়ামাটির রঙের পুতুল অনেকের পছন্দ না-ও হতে পারে। বিশেষ করে যে সময়ে বিদেশি পুতুলের নামে হলিউডে সিনেমা তৈরি হয়, আর তা পুরস্কারও জেতে। চাকচিক্যে এবং বিপণন কৌশলে বাংলার মৃৎশিল্পীরা স্বাভাবিক ভাবেই এঁটে উঠতে পারবেন না বিদেশি মেয়ে পুতুল বা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ভালুকের সঙ্গে।
মৃৎশিল্পীদের পুতুলের চাকচিক্য বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এখন নানা জিনিসের উপরে পটচিত্র আঁকার চল হয়েছে। এতে উপার্জন বেড়েছে পটশিল্পীদের। পুতুল শিল্পীরা নিজেদের পদ্ধতিতে রং করে থাকেন। কিন্তু পটচিত্র শিল্পীদের রং নিয়েই কারবার। টেপা পুতুলে রং করানো যেতে পারে। মৃৎশিল্পীদের রানি পুতুল অনন্য শিল্পকর্ম। এগুলোও রং করানো যেতে পারে। এখনও কুমোরপাড়ায় ছোটদের খেলার জন্য হাঁড়ি, কলসি, উনুন, বালতি ইত্যাদি তৈরি হয়। এগুলোয় পটের ছবি আঁকালে বাচ্চাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। আবার সংগ্রহ করার মতোও হতে পারে। সংগ্রহের বিষয়ে একটি প্রসঙ্গ। বহু বছর আগের কথা। বাংলা নববর্ষে বাঙালিয়ানায় ভোজের ব্যবস্থা করেছিল এক রেস্তরাঁ। খেতে দেওয়া হয়েছিল মাটির থালায়। সেই থালার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে এক ক্রেতা এঁটো থালা ধুয়ে দিতে বলেছিলেন রেস্তরাঁ কর্তৃপক্ষকে। সংগ্রহে রাখবেন বলে। অর্থাৎ মাটির জিনিসে শুধু ঐতিহ্য বা ব্যবহারিক নয়, শৈল্পিক দিকটিও জড়িত।
মাটির জিনিসে পটুয়াদের রঙে আন্তঃশিল্প সংযোগ গড়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহ পেতে পারে মৃৎশিল্প ও পটশিল্প— দু’টিই। পটচিত্র শিল্পীরা কিন্তু বেসরকারি উৎসাহেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, পটের কাজ ছেড়ে দেওয়া অনেকেই ফিরেছেন পারিবারিক পরম্পরায়। ফিরছে নবীন প্রজন্মও। বেশির ভাগ পরম্পরাগত শিল্পের ক্ষেত্রে শোনা যায়, নতুন প্রজন্ম বাপ-ঠাকুরদার পেশা চালিয়ে যেতে রাজি নন। এর কারণ, পেট চলে না। পটচিত্র শিল্পে কিন্তু এই আক্ষেপ অনেকটাই কমেছে। কিন্তু মৃৎশিল্পীদের পাড়ায় পাড়ায় এমন আক্ষেপ জোরদার।
তবে পটশিল্পীদের এমন পুনরুজ্জীবনে শৈল্পিক সংঘাতের সুরও রয়েছে। বাজার ধরতে গিয়ে পটচিত্র লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে, বলে থাকেন কেউ কেউ। বিশেষ করে পট দেখিয়ে গান করার বৈশিষ্ট্য কমছে। কিন্তু এটা তো মানতে হবে, বহু লোকের জীবিকার সংস্থান হয়েছে। তাঁরা শিল্পের মর্যাদা পেয়েছেন। জাতীয় পুরস্কার প্রাপক শিল্পী পটুয়া পাড়াগুলোয় একাধিক। বিদেশে পট নিয়ে গিয়েছেন কেউ কেউ। পরিবর্তন স্বীকার করে নিয়েও বলা যায়, মূল শিল্পটা কিন্তু বেঁচে গিয়েছে। পরিবর্তনে যদি মৃৎশিল্পীদের হাতের কাজের কদর বাড়ে, কাজের সুযোগ-সংস্থান বাড়ে, তা হলে ক্ষতি কী!
মাটির কাজ কমলেও এখন বহু মৃৎশিল্পী রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। পড়াশোনা করেও কিছু সুবিধা করতে না পেরে পারিবারিক শিল্পকেই আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হয়েছেন, এমন নবীন প্রজন্মও রয়েছেন। সংখ্যায় কম হলেও। এ যুগের বাচ্চাদের আকর্ষণ করতে তাঁরা কিছু আধুনিক খেলনাও তৈরি করছেন। যেমন মাটির গ্যাস সিলিন্ডার। এঁদের কথা ভাবা দরকার। পরিবেশের ক্ষতি না করে কী ভাবে এঁদের মাটির জোগান সহজ করা যায়? পরিবেশের ক্ষতি রুখতে মাটির জিনিস খুবই উপযোগী। বহু বছর আগে বর্ধমান জেলায় মাটির জালার জল শোধক দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাতে নল লাগানো। বিদ্যুতের বালাই নেই। গরমে ফ্রিজ থেকে বার করেই জল গলায় ঢালা যায় না। জালার জলে কিন্তু সেই সমস্যা নেই। পানে নিজের তৃপ্তি। পরিবেশের জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে মুক্তি। বিয়েবাড়িতে মাটির ‘কটোরা’ ফিরলে ভালই তো হবে।
কুমোরদের পুরনো পদ্ধতির চাক বেশ ভারী। চালানো শ্রমসাধ্য। এখন কিন্তু যন্ত্রচালিত চাক পাওয়া যায়। তাতে শ্রম হয় কম, উৎপাদন বেশি। জায়গাও লাগে কম। এমন চাকের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকার উদ্যোগী হলে মৃৎশিল্পীদের উন্নয়নের রূপরেখা পেতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। মৃৎশিল্পীদের নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ করেছেন বহু অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
মৃৎশিল্পে মেয়েদেরও অবদান রয়েছে। ঘরের কাজ সামলে তাঁরা নানা জিনিস তৈরি করেন। পুতুল, মালসা বানান। তৈরি করেন বোকা ভাঁড়। পয়সা জমানোর এই ভাঁড় মাছ, শাঁখ নানা রূপের। আবার আদি রূপের লক্ষ্মীর ভান্ডারও তৈরি করেন। পটচিত্রীদের দিয়ে আঁকিয়ে, সরকারি উৎসাহে বিপণনের ব্যবস্থা করে বোকা ভাঁড়কে ‘পিগি ব্যাঙ্ক’-এর প্রতিদ্বন্দ্বী করা যায় না? যদি তা সম্ভব হয়, সেটা হবে বাংলার বহু মেয়ে-বৌয়ের নিজের উপার্জনে তৈরি লক্ষ্মীর ভান্ডার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy