স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ছবির দৌলতে জার্মান ব্যবসায়ী অস্কার শিন্ডলারকে চেনেন না, এমন মানুষ কম। শিন্ডলার মদ্যপ, লম্পট, ব্যবসা বাড়ানোর স্বার্থে নাৎসিদের সঙ্গে হাতও মিলিয়েছিলেন। কিন্তু এই জার্মান ব্যবসায়ী সকলের অলক্ষ্যে ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন জাতিগত বিদ্বেষ। হলোকস্টের সময়ে স্বোপার্জিত অর্থে শিন্ডলার গ্যাস চেম্বারের ভবিতব্য থেকে বাঁচিয়েছিলেন প্রায় বারোশো ইহুদিকে। পরে আক্ষেপ করেছেন, ইস! তাঁর নাৎসি পার্টির সোনার ব্যাজ বিক্রি করে যদি আরও দুই ইহুদিকে বাঁচাতে পারতেন!
ছিলেন স্যর নিকোলাস জর্জ উইনটনও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি বাহিনীর আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ৬৬৯ শিশুকে খুঁজে দিয়েছিলেন ব্রিটেনের নিরাপদ আশ্রয়। শিন্ডলারকে কেউ ভোলেনি। ভোলেনি নিকোলাসকেও। কিন্তু মানুষ যাঁকে মনে রাখেনি, তিনি জাপানের চিউনে সুগিহারা। তিনিও বাঁচিয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বহু ইহুদিকে।
সুগিহারার বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক। কিন্তু সুগিহারাকে টানত সাহিত্য। ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করে বিদেশ মন্ত্রকের বৃত্তির পরীক্ষা দেন। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে ইমপিরিয়াল আর্মিতে কাজ করেন কোরিয়া ও জাপানে। পরে পান জাপানের বিদেশ মন্ত্রকের চাকরি। কর্মসূত্রে রপ্ত করেন রুশ ও জার্মান ভাষা।
১৯৩৯ সালে লিথুয়ানিয়ার কওনাসে জাপানের ভাইস কনসাল নির্বাচিত হন সুগিহারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে। জার্মানি, ইতালি, হাঙ্গেরি, রোমানিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধে জাপানও শামিল লড়াইয়ে। সুগিহারার কাজ ছিল সোভিয়েত ও জার্মান বাহিনীর গতিবিধির উপরে নজর রাখা। সোভিয়েত রাশিয়া জার্মানির উপরে আক্রমণের ষড়যন্ত্র করছে কি না, তার খুঁটিনাটি বার্লিন ও টোকিয়োয় জানানোর ভারও ছিল তাঁর উপরেই।
চারপাশে তখন হিংসা, প্রতিশোধের আগুন। ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে বা গুলি করে মারা হয়ে উঠেছিল দস্তুর। ঘটনাচক্রে সুগিহারার কাছে এসে হাজির হয়েছিলেন পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার বহু মানুষ। সবাই ইহুদি। তাঁদের দরকার হিটলারি রাজত্ব ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য এক্সিট ভিসা। সুগিহারা ভিসা দেওয়ার জন্য নিজের দূতাবাসে অনুমতি চান, পর পর তিন বার। বিদেশ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, ভিসা দেওয়া সম্ভব নয়।
এক দিকে অসংখ্য মানুষের আশ্রয়প্রার্থনা, অন্য দিকে পরিবারের সুরক্ষা, নিজের নিরাপত্তা। সুগিহারা তাঁর স্ত্রী ইউকিকোর সঙ্গে আলোচনার পরে ঠিক করলেন, প্রয়োজনে নিজের সরকারের বিরোধিতা করবেন। ১৯৭৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘দিনের পর দিন জানালা দিয়ে দেখতাম, আমাদের বাড়ির সামনে ভিড় করেছেন হাজার হাজার মানুষ!’’ দিন পেরিয়ে রাত গড়িয়ে যেত, সুগিহারা অবিরাম লিখে যেতেন ভিসা। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরে লিথুয়ানিয়ায় জাপান দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ায় সুগিহারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। বাড়িতেই নিয়ে এলেন ভিসা লেখার স্ট্যাম্প, কাগজ। শুধুমাত্র নিজের নামের সঙ্গে জাপান সরকারের আইনি স্ট্যাম্প থাকার সুবাদে লিখে চললেন একের পর এক ভিসা। দিনে প্রায় ১৮-২০ ঘণ্টাও ভিসা লিখেছিলেন তিনি! অবিরাম কাজ করে হাতে যন্ত্রণা হত, তবু থামেননি। স্ত্রী ইউকিকো রাতে মালিশ করে দিতেন হাতে। সুগিহারার স্বাক্ষরে প্রায় ৬০০০ ভিসা হয়েছিল। একটা ভিসার জোরে একটা গোটা পরিবার জীবন বাঁচাতে পাড়ি দিত অজানার উদ্দেশে। অনুমান, প্রায় ৪০ হাজার মানুষ সে যাত্রায় বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন সুগিহারার সৌজন্যে।
শেষে চলে যেতে হল সুগিহারাকেও। এক শরণার্থীকে দিয়ে যান কনসুলেটের স্ট্যাম্প, যা থেকে আরও ভিসা সই করানো সম্ভব। ট্রেনে উঠে জানালা দিয়ে ছুড়ে দেন ভিসার কাগজপত্র। মানুষ যদি তা কুড়িয়ে নিতে পারেন, এই আশায়। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধশেষে সুগিহারা সপরিবার জাপানে ফিরে আসেন। অকালে হারান সাত বছরের সন্তান হারুকিকে। চাকরি নেই, দিন কাটাত দুর্দশায়। দরজায় দরজায় বাল্ব বিক্রি করতেন। পরে রাশিয়ান ভাষা জানার দৌলতে চাকরি পেয়েছিলেন রফতানি সংস্থায়।
সুগিহারার কথা জানাই যেত না, যদি না ১৯৬৮ সালে জোশুয়া নিশরি খুঁজে পেতেন তাঁকে। যুদ্ধের সময়ে সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া নিশরিকে পোল্যান্ড থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন তিনি। নিশরি পরে টোকিয়োর ইজ়রায়েলি দূতাবাসে চাকরি করাকালীন খুঁজে পান তাঁকে।
সুগিহারার জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। হলোকস্টে নিহতদের সম্মানে জেরুসালেমে তৈরি এক মিউজ়িয়মের বাগানে রয়েছে সুগিহারার নামে গাছও। সুগিহারাই এক এবং একমাত্র ‘শত্রু’, যিনি জাপানি হওয়া সত্ত্বেও ইজরায়েল তাঁকে দিয়েছে সম্মান!
সুগিহারার ছেলে নোবুকির কথায়, ‘‘বাবা সাধারণ মানুষ ছিলেন। পড়তে ভালবাসতেন, বাগান তৈরি করতে পছন্দ করতেন। আর ভালবাসতেন শিশুদের। ওঁর বরাবর মনে হত, উনি যা করেছেন, তা মনে রাখার মতো কোনও ঘটনা নয়।’’ ১৯৮৬ সালে মারা যান সুগিহারা। ’৮৫-র এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন ঝুঁকি নিয়ে, নিজের চাকরির মায়া না করে ইহুদিদের সাহায্য করেছিলেন? উত্তর এসেছিল, ‘‘শরণার্থীদের জলভরা চোখের দিকে তাকালে যে কোনও লোকেরই ওই অনুভূতি হত।’’
কিন্তু যদি কেউ অভিযোগ করত? ঝুঁকিও তো ছিল!
উত্তরটা দিতে এক মুহূর্তও থামেননি মহাযুদ্ধের আমলের জাপানি ভাইস কনসাল। ‘‘একটা ব্যাপারে বরাবর বিশ্বাস করি। যেখানে মানুষের প্রাণ বাঁচানোটা ইস্যু, সেখানে ভুল বলে কিছু হয় না।’’
এই না হলে অমৃতের পুত্র!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy