কেউ হাত-পা ছড়িয়ে বসে, কারও চোখে জল — নিউ আলিপুরে কয়েক ঘণ্টার আগুনে ছারখার অনেক কিছু। নিজস্ব চিত্র।
কিছু নেই! কিস্যুটি নেই...
পড়ে আছে পোড়া ফোটোগ্রাফ। কেউ একজন সেই সব ছবিই এক জায়গায় জড়ো করে বিছিয়ে রেখেছেন যত্ন করে। পোড়া বিছানা, আসবাব। গলে যাওয়া বাসন। পোড়া বই। পুড়ে যাওয়া নথিপত্র। কিছুই আর ফেরত আসবে না। কয়েক ঘণ্টার আগুন জীবনের সব কিছু ছারখার করে দিয়ে গেল শনিবার। রবির সকালে দক্ষিণ কলকাতার নিউ আলিপুরে ডিরোজ়িও সেতু (চেনা নামে দুর্গাপুর সেতু)-র নীচে জ্বলে যাওয়া বস্তির অবশেষের মধ্যে গিয়ে দেখা গেল— কেউ হাত-পা ছড়িয়ে উদাস হয়ে বসে, কারও চোখে জল চলে আসছে বার বার, কেউ তখনও খুঁজে চলেছেন— যদি কিছু একটা অন্তত পাওয়া যায়... কিছু একটা যদি...!
নিমা হালদার থেকে পূর্ণিমা রায়চৌধুরী, সবার জীবনেই ঘন অন্ধকার নেমে এল শনির সন্ধ্যায়। যা হোক একটা কিছু ছিল। কারও একটু বেশি, কারও একটু কম। আগুন সব একাকার করে দিল। বস্তিবাসী নিমা এক পোড়া ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলছিলেন, “ওটাই আমাদের ঘর। আমাদের সব কিছু ওখানেই ছিল। সব গেছে, সব জ্বলে গেছে। এখন কোথায় যাব? এখানে যদি নতুন করে কিছু করা না-হয়, আমরা কোথায় আশ্রয় নেব?” উত্তর কারও কাছেই নেই। স্থানীয় বাসিন্দা সুদীপ দাস আগুন দেখে ছুটে গিয়েছিলেন শনিবার। ঘটনাস্থলে। রবিবারও সব হারানো মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁকে দেখা গেল। বলছিলেন, “আমি এই বস্তিতে বসবাস করি না । কাছেই একটি বাড়িতে থাকি। কাল সন্ধেবেলা যে ভাবে আগুন লেগেছিল তাতে মনে হচ্ছিল গোটা এলাকা জ্বলে যাবে। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা বস্তিবাসীদের পাশে থেকে আগুন নিভিয়েছি, প্রশাসনকে সাহায্য করেছি।”
শনিবার যাঁরা ঘরহারা হলেন, তাঁদের জন্য স্থানীয় ৮১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জুঁই বিশ্বাস একটি স্কুলে অস্থায়ী ভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। বস্তিবাসীদের রাতের খাওয়া এবং পরদিন সকালে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করা হলেও, তাঁদের মনের ভাঙা স্বপ্নের কোনও সান্ত্বনা নেই। মাথার ছাদ হারিয়ে ফেলা পূর্ণিমার গলায় একটিই প্রশ্ন, “আবার আমাদের ঘর তৈরি হবে তো? আবার আমরা এখানে ঘর বাঁধতে পারব তো?”
শুধু ঘর তো নয়, হারিয়ে গিয়েছে বহু মূল্যবান নথি। পরিচয়পত্র, হাসপাতালের চিকিৎসার কাগজপত্র কিছুই অবশিষ্ট নেই। বই, খাতা, স্কুলব্যাগও পুড়ে ছাই। আগুনের ক্ষত শুধু শরীর-মনে নয়, লেগেছে ভবিষ্যতেও। এক ঝুপড়িবাসী মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন। বলছিলেন, “আমার মেয়ের পরীক্ষা শুরু হবে পরের সপ্তাহে। সব বই-খাতা পুড়ে গিয়েছে। ও কী ভাবে পড়াশোনা করবে জানি না।” শনিবার রাতের আগুন শুধু ঝুপড়ি নয়, ছাই করে দিয়েছে অনেকগুলো পরিবারের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ এবং আশা। ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষগুলোর চোখে এখন শুধুই অনিশ্চয়তা।
শনিবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ আগুন লাগে। কী ভাবে, এখনও স্পষ্ট নয়। ১৬টি দমকলের ইঞ্জিন কাজ করে। বস্তিবাসীদের অনেকের অভিযোগ, দমকল বাহিনী সঠিক পন্থায় কাজ করেনি। যখন সেতুর নীচে আগুন ছড়াচ্ছিল, তখন স্থানীয়েরা তাদের নীচে নেমে কাজ করতে অনুরোধ করলেও দমকল কর্মীরা তা করেননি। বরং সেতুর উপর থেকেই জল ঢালতে থাকেন। অনেকে অবশ্য এ-ও মনে করছেন, মাথার উপরে সেতু থাকায় সেখান থেকে জল দেওয়াটাই ছিল সবচেয়ে কার্যকর। দমকলের আগেই এলাকাবাসীরা অনেকে এগিয়ে গিয়েছিলেন আগুন নেভাতে। কাছের মিলিটারি ক্যাম্প থেকে সেনা জওয়ানরাও ছুটে যান। সেনার আধুনিক পদ্ধতি, বিশেষত জলের গোলক নিক্ষেপ করে আগুন নেভানোর প্রক্রিয়া এলাকায় আলোচিত হচ্ছে। তবে এই প্রযুক্তিও যে পরিস্থিতি পুরোপুরি সামাল দিতে পারেনি, তা-ও স্পষ্ট।
রবিবার সকালে ডিরোজ়িও সেতুর উপর থেকে দেখা গেল, বস্তির পাশের আবাসনের গায়েও আগুনের শিখা আর কালো ধোঁয়ার তাজা কালো ছোপ। এই ছাপ হয়তো কিছু দিনেই মুছে যাবে। কিন্তু বস্তিবাসীদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে গড়াবে? এই মানুষগুলোকে পুনর্বাসন দেওয়ার দায়িত্ব কে নেবে? শনিবার আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে যান মেয়র এবং মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, স্থানীয় বিধায়ক এবং মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, বিধায়ক এবং মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার। ফিরহাদ জানিয়েছিলেন, এই ঝুপড়ি রেলের জমিতে। স্থানীয় প্রশাসন কি কোনও ব্যবস্থা নেবে? এই মুহূর্তে তাঁদের আশ্রয় চাই। খাবার চাই। নথিপত্র পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন। প্রত্যেকের মুখেই কাতর আবেদন, “আমাদের মাথার ছাদ ফিরিয়ে দিন। আমাদের বাঁচান। আমাদের বাঁচতে দিন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy