Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা মারা গিয়েছিলেন ৭০ বছর আগে। কিন্তু তাঁর দেহকোষ এখনও বেঁচে আছে। দুনিয়াসুদ্ধ ল্যাবরেটরিতে, মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানিতে। মুনাফা হচ্ছে বিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রদীপের নীচেই যে অন্ধকার!
Cell

Henrietta Lacks: এক পাপের প্রায়শ্চিত্ত

গবেষণার পরতে পরতে কত কাহিনি, লুকোনো ইতিহাস!

ক্ষতিগ্রস্ত: হেনরিয়েটা ল্যাকস। পরীক্ষার জন্য তাঁকে না বলেই নেওয়া হয়েছিল তাঁর দেহের কোষ।

ক্ষতিগ্রস্ত: হেনরিয়েটা ল্যাকস। পরীক্ষার জন্য তাঁকে না বলেই নেওয়া হয়েছিল তাঁর দেহের কোষ।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২১ ০৮:৫৭
Share: Save:

পাপের প্রায়শ্চিত্ত? আর কী-ই বা বলা যায় একে? খবরে দেখলাম, আমেরিকার বিখ্যাত হাওয়ার্ড হিউজেস মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট (এইচএইচএমআই) মোটা অঙ্কের ডলার দান করেছে হেনরিয়েটা ল্যাকস ফাউন্ডেশনকে। কত ডলার, তা জানায়নি এইচএইচএমআই। তবে, সংস্থার প্রেসিডেন্ট এরিন ও’শিয়া জানিয়েছেন, দান ছ’অঙ্কের। মিলিয়ন ডলার-টলার হবে। ও’শিয়ার কথায়, বহু দিন আগেকার এক অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে এটুকু আমাদের করারই ছিল। গবেষণা এবং চিকিৎসায় সুবিচার পেতে আমাদের এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে।

কী অন্যায়? কী অবিচার? তা হলে বলতে হয় হেনরিয়েটার কাহিনি। তিনি এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। পাঁচ সন্তানের জননী। বয়স ৩১। ১৯৫১ সালে তাঁর পেটে ব্যথা। তখন পঞ্চম সন্তান গর্ভে। প্রথমে তিনি ভাবলেন, ব্যথা বুঝি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণে। কিন্তু প্রসবের পরেও ব্যথাটা গেল না। পেটের মধ্যে কোথাও যেন একটা গিঁট। এর মধ্যে আর এক উপদ্রব। প্যান্টিতে মাঝে মাঝে রক্তের দাগ। হেনরিয়েটা ভয় পেলেন। গাইনেকোলজিস্টের কাছে ছুটলেন। রেফার টু স্পেশালিস্ট। ইমিডিয়েট অ্যাকশন ওয়ার‌্যানটেড।

তা মিলবে কোথায়? হেনরিয়েটার গায়ের রং যে কালো। তাই তাঁকে যেতে হবে ৩০ কিলোমিটার দূরে। বাল্টিমোর শহরে জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে। ওখানে কালা আদমিদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড। আলাদা বাথরুম। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে হেনরিয়েটা গেলেন সেখানে। দেখালেন গাইনেকোলজি ওয়ার্ডে। হেনরিয়েটার সারভিক্স (গর্ভগ্রীবা, জরায়ুর মুখের অংশ)-এ একটা ক্ষতচিহ্ন। যেন কোনও কিছুতে ঘষা লেগে ছড়ে গেছে। সাইজ়? তা একটা ২৫ সেন্টের মতো। মসৃণ, উজ্জ্বল এবং প্রায় লাল রঙের। হাসপাতালে গাইনেকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান রিচার্ড টেলিন্ডে রোগী দেখে বললেন, ক্ষতচিহ্ন আসলে সারভাইক্যাল ক্যানসারের অগ্রদূত। ডায়াগনোসিস নির্ভুল। বায়োপ্সি করা হল। ‘কারসিনোমা অব দ্য সারভিক্স’। স্টেজ ওয়ান।

কারসিনোমা। ক্যানসার। অনিয়মিত উচ্ছৃঙ্খল কোষ বিভাজন। মানুষ বা যে কোনও প্রাণীর দেহে অর্বুদ-নির্বুদ কোষের পাহাড়। প্রাণী ছোট থেকে বড় হয়, তার দেহে কোষের সংখ্যা বেড়ে বেড়ে। কোষ এক থেকে দুই হয়। দুই থেকে চার। কোষের মোটামুটি ভাবে দুই অংশ। সাইটোপ্লাজ়ম এবং নিউক্লিয়াস। সাইটোপ্লাজ়ম কাজ করে চলেছে দিনরাত সর্বক্ষণ। কী কাজ? এনজ়াইম, শর্করা অণু কোষের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা-নেওয়া করা, জল খাদ্য বা অক্সিজেন কোষের বাইরে থেকে ভেতরে আনা, চর্বি বা প্রোটিন যোগানো। নিউক্লিয়াসকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখা। আর নিউক্লিয়াস? সে যেন কোষের কাজকর্মের নির্দেশদাতা। নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে প্রতিটি জিন-মানচিত্র। ওই মানচিত্র বলে দেয়, কখন শেষ এক থেকে দুই হবে। জীবদেহ ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তাও দেখে নিউক্লিয়াস। কাজ বলতে, হৃৎপিণ্ড ফুসফুস চালু আছে কি না, তা দেখা। দেহকোষ এক থেকে দুই হওয়ার পথে একটা মাত্র ভুল গোলমাল করে দিতে পারে সব কিছু। একটা এনজ়াইম সক্রিয় হয়ে উঠল, অথবা একটা প্রোটিন, অমনি কোষের বেড়ে ওঠায় গোলমাল। তখন তা অনিয়ন্ত্রিত, উচ্ছৃঙ্খল, মানে, কোষ হু-হু করে বাড়ে— ক্যানসার।

সারভিক্সের ক্যানসার দু’রকমের হয়। ইনভেসিভ আর নন-ইনভেসিভ। ইনভেসিভ ক্যানসার সারভিক্সের উপরিতল থেকে শুরু হয়ে নীচের স্তর অবধি পৌঁছে যায়। আর, যে ক্যানসারে তা যায় না, সেটা হল নন-ইনভেসিভ। এ ধরনের ক্যানসারে রোগটা সারভিক্সের উপরিতলে একটা পাতলা আস্তরণ হিসেবে থাকে। হেনরিয়েটার যা হয়েছে, তা ইনভেসিভ ক্যানসার। ১৯৫১ সালে চিকিৎসকরা মতামতে দ্বিধাবিভক্ত। এক দল মনে করেন, নন-ইনভেসিভ ক্যানসার মারাত্মক নয়। আর এক দল মনে করেন, নন-ইনভেসিভ ক্যানসার ইনভেসিভের আগের পর্যায়। নন-ইনভেসিভই এক দিন মারাত্মক হয়ে ওঠে। টেলিন্ডে দ্বিতীয় দলের সমর্থক। সে জন্য তিনি যে যে মহিলাদের সারভাইকাল ক্যানসার হয়েছে, তাঁদের চিকিৎসায় কড়া দাওয়াই প্রয়োগ করেন। কেটে বাদ দেন জরায়ু, ডিম্বাশয়, যোনি। এ কাজে তিনি সিদ্ধহস্ত। মরক্কোর রানি অসুস্থ হলে রাজা অপারেশনে রাজি হন শুধু টেলিন্ডে তা করবেন বলে।

স্বামী ডেভিড বহুগামী। অনেক মহিলার সঙ্গে রাত কাটান। হেনরিয়েটা জানেন সব। তাই প্রথমে ভেবেছিলেন তাঁর সিফিলিস হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক খেলে সেরে যাবে। যখন দেখলেন, তাঁর ব্যাধি আরও মারাত্মক, তখন কাউকে কিছু বললেন না। শুধু ডেভিডকে অনুরোধ করলেন, তাঁকে আর এক বার হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তিনি চিকিৎসার জন্য ভর্তি হবেন।

৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫১। ডেভিড হেনরিয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে এলেন। ভর্তি হওয়ার আগে হেনরিয়েটাকে দরখাস্তে সই করতে হল। দরখাস্তে লেখা ছিলঃ ‘আমি এতদ্দ্বারা জনস হপকিন্স হাসপাতাল কর্মীদের সম্মতি দিচ্ছি, ওঁরা যা ভাল মনে করবেন, সে ভাবেই স্থানীয় বা সারা দেহ অবশ করে চিকিৎসা প্রক্রিয়া চালাবেন।’ নীচে সই করতে হল হেনরিয়েটাকে। তার নীচে সাক্ষীর সই।

তাঁর রেডিয়াম ট্রিটমেন্ট হবে। রেডিয়াম উনিশ শতকে যখন আবিষ্কৃত হয়, তখন একে সর্বরোগহারক আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এটা গ্যাসের কাজ করতে পারে, বিদ্যুতের কাজও করতে পারে। ঘড়ির ডায়াল অন্ধকারে যাতে দেখা যায়, সে জন্য ডায়ালে দেওয়া হল রেডিয়াম। ডাক্তারবাবুরা রেডিয়াম ধাতুর গুঁড়ো ঘষতে দিলেন কানের রোগে। আমেরিকান ডাক্তার হাওয়ার্ড কেলি ফ্রান্সে গিয়ে দেখা করলেন রেডিয়ামের আবিষ্কর্তা পিয়ের এবং মাদাম কুরির সঙ্গে। ওঁরা ওঁকে দিলেন কিছুটা রেডিয়াম। কোটের বুকপকেটে কেলি সেই রেডিয়াম নিয়ে এলেন আমেরিকায়। আরও নানা জায়গা থেকে কেলি সংগ্রহ করতে লাগলেন রেডিয়াম। সব সময় রেডিয়াম থাকত তাঁর বুকপকেটে। ডাক্তারবাবুরা তুচ্ছ যে সব রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করছিলেন রেডিয়াম, সে সব রোগী মারা গেলে কারণ খোঁজা শুরু হল। দেখা গেল, মৃত্যুর উৎস রেডিয়াম, রেডিয়াম তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। তেজস্ক্রিয়তার উপাদান কণা এবং শক্তিশালী আলো। সে সবের ধাক্কায় কোষের নিউক্লিয়াসে থাকা ডিএনএ পরিবর্তিত হয়। কোষ তখন ক্যানসারের পথে এগিয়ে যায়। সাধারণ ভাবে রোগ নিরাময়ে রেডিয়াম যা করে, তা হল কোষকে ধ্বংস করা। চিকিৎসায় রেডিয়ামের ব্যবহার ওই কানে। রেডিয়াম রোগগ্রস্ত কোষকে মেরে ফেলে। কিন্তু, তার পাশাপাশি বিপদও ডেকে আনতে পারে। ক্যানসারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

হেনরিয়েটার সারভিক্সের ক্যানসার-আক্রান্ত কোষ রেডিয়াম দিয়ে ধ্বংস করতে চাইলেন চিকিৎসক লরেন্স হোয়ারটন। সে জন্য তিনি যোনিপথে রেডিয়াম ঢুকিয়ে দিলেন হেনরিয়েটার সারভিক্সে। কিন্তু, তার আগে কেটে নিলেন মহিলার সারভিক্সের দু’জায়গা থেকে খানিকটা করে কোষ। একটা, সারভিক্সের যে অংশ ক্যানসার ছড়ায়নি, সে জায়গার কোষ। আর, যে অংশে ক্যানসার ছড়িয়েছে, সে জায়গারও। হেনরিয়েটা জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে যখন ভর্তি হলেন, তখন তাঁকে সস্মতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হলেও, তাঁর সারভিক্সের দু’জায়গা থেকে ডা. হোয়ারটন কোষ সংগ্রহ করার সময় কিন্তু মহিলাকে জানানোর প্রয়োজনটুকু বোধ করলেন না। অনুমতি নেওয়া তো দূরের কথা!

কেন তা করলেন না? বাঃ রে, ১৯৫১ সালে সে রকম কোনও নিয়ম তো ছিল না! সুতরাং, আইন যখন নেই, তখন অপরাধের প্রশ্ন নেই। কেন নেওয়া হল হেনরিয়েটার সারভিক্সের দুই জায়গার কোষ? পরীক্ষার জন্য। ক্যানসার যে কোষে হয়নি, আর যে কোষে হয়েছে, দু’জায়গায় কোষ কী হারে বাড়ছে, তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। পরীক্ষা করা হবে অন্য এক বিভাগে। সেই বিভাগে চলে গেল হেনরিয়েটার টিস্যু স্যাম্পল। রেডিয়াম ট্রিটমেন্ট হয়ে যাওয়ার দু’দিন পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন হেনরিয়েটা। ডা. হোয়ারটন লগবুকে লিখলেন, ‘রোগী চিকিৎসা ভাল ভাবে সহ্য করেছে। ভাল অবস্থায় অপারেশন থিয়েটার ছেড়েছে। ...হেনরিয়েটা ল্যাকস... সারভাইকাল টিস্যুর বায়োপ্সি... টিস্যু দেওয়া হল ডা. জর্জ গাই-কে।’

বাড়ি ফিরে সন্তানদের কিচ্ছু জানালেন না হেনরিয়েটা। যেন কিছুই হয়নি তাঁর। কেবল সব খুলে বললেন স্বামী ডেভিডকে। দিন গড়িয়ে চলল। হেনরিয়েটার ব্যাধি ক্রমশ বাড়তে লাগল। নানা উপসর্গ নিয়ে বারকয়েক ভর্তিও হলেন জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে। সেপ্টেম্বর, ১৯৫১। হেনরিয়েটার ক্যানসার সারভিক্স থেকে পৌছে গেল ফুসফুসে। তাঁকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করলেন ওখানকার ডাক্তারবাবুরা। সারা দেহে অসহ্য যন্ত্রণা। মরফিন দেওয়া হচ্ছে। কখনও জ্ঞান আছে, কখনও নেই। এর মধ্যে এক বার হেনরিয়েটার তুতো-বোন স্যাডি হাসপাতালে দেখতে এলেন ওঁকে। স্যাডিকে হেনরিয়েটা বললেন, আমার যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। ডেভিডকে বোলো ছেলেমেয়েদের দেখতে। বাড়ি ফিরে স্যাডি ফোন করলেন ডেভিডকে। হেনরিয়েটার অন্তিম ইচ্ছে জানাতে। ফোনে স্যাডির গলা ভারী। ৪ অক্টোবর, রাত সোয়া বারোটা। সব শেষ।

মৃত্যু কী? জীবন কাকে বলে? তা যদি হয় জীবদেহে কোষের কাজকর্ম চালু থাকা, তা হলে হেনরিয়েটার মৃত্যু হয়নি। পার্থিব মৃত্যুর ৭০ বছর পরেও তিনি অমর। হ্যাঁ, তাঁর ক্যানসার-আক্রান্ত কোষ এখনও বেঁচে রয়েছে। পৃথিবীসুদ্ধ ল্যাবরেটরিতে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ওষুধ কারখানায়। মানুষের পরিচর্যার প্রথম অমর জীবকোষ হিসেবে। ডা. হোয়ারটন হেনরিয়েটার সারভিক্সের ক্যানসার-আক্রান্ত যে কোষ জমা দিয়েছিলেন ডা. জর্জ গাই এবং তাঁর স্ত্রী মার্গারেট গাই-কে, সে কোষ এখনও বেঁচে আছে। হেনরিয়েটা ল্যাকস-এর দেহ থেকে সংগৃহীত কোষ বলে, ডা. হোয়ারটন টেস্টটিউবের লেবেল দিয়েছিলেন ‘হে লা’। ওই নামেই বিজ্ঞান গবেষণার জগতে এখনও পরিচিত ওই কোষ।

হাতে পাওয়ার পর গাই দম্পতি হে লা কোষের কীর্তিকলাপ দেখে অবাক হয়ে যান। দেখেন, উপযুক্ত খাদ্য (যে সব রাসায়নিক পেলে জীবকোষ তাজা থাকে, সংখ্যায় বাড়ে) পেলে, হে লা কোষ বাঁচে। আগে কখনও এমনটা দেখা যায়নি। বরং যা দেখা গেছে, তা হল বড়জোর কয়েক দিন টিকে থেকেছে জীবকোষ। তার পর মরে গেছে। মানে, কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া (এক থেকে দুই, দুই থেকে চার...) স্তব্ধ। কিন্তু, হে লা কোষ অন্য রকম। ল্যাবরেটরিতে দেখা গেল, দিনের পর দিন কাটলেও, হে লা কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া চালিয়ে গেল। প্রত্যেক ২৪ ঘণ্টায় সংখ্যায় দ্বিগুণ হল।

কেন? অচিরে জানা গেল তা-ও। গবেষকরা দেখলেন, একটা কোষের মধ্যে বিভাজন প্রক্রিয়া কখন বন্ধ করতে হবে, সেই ‘সুইচ’ হে লা কোষে নেই। কোষ তো আর সমানে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারবে না। একটা সময় সে কাজ বন্ধ করতেই হয়। নইলে তো যে কোনও জীবই বেড়ে বেড়ে বিশাল বপুর হয়ে যেত। বেড়ে ওঠা কখনও না কখনও বন্ধ করতেই হয়।

বিভাজন প্রক্রিয়া বন্ধের সুইচ না-থাকা আশীর্বাদ না অভিশাপ? আশীর্বাদই বটে। যে হেতু হে লা কোষ না-মরে বেঁচে থাকল, তাই এই গ্রহের কোণে কোণে ল্যাবরেটরিগুলোয় তা ছড়িয়ে পড়ল। জীবকোষ বিষয়ে গবেষণা? হে লা কোষ তো আছে। এক ল্যাবরেটরি চালান করল অন্য ল্যাবরেটরিতে। অবশ্যই নগদ অর্থের বিনিময়ে। সারা পৃথিবীতে হে লা কোষের মোট পরিমাণ কত? অনুমান, ছ’কোটি টন হবে। যদিও একটা কোষের ওজন প্রায় নেই বললেই চলে। এক বিজ্ঞানী গণনা করে বলেছেন, ওই পরিমাণ হে লা কোষ যদি পর পর সাজানো যায়, তা হলে সে মালা দিয়ে পৃথিবীকে প্রায় চার বার বেল্ট পরানো যাবে। প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার কিলোমিটার। শুধু পৃথিবীতে নয়, অন্তরীক্ষেও পৌঁছেছে হে লা কোষ। নভশ্চরেরা পৌঁছে দিয়েছেন রকেটে করে। মহাকাশে, যেখানে গ্র্যাভিটি নেই, ফলে সব কিছু ভারহীন, সেখানে জীবকোষে প্রভাব লক্ষ করতে। আর চিকিৎসা? কত গবেষণায় যে কাজে লাগছে হে লা কোষ, তার বুঝি ইয়ত্তা নেই। জীবের জিন মানচিত্র বানাতে, নকল তৈরিতে, কেমোথেরাপিতে, বস্তুত আধুনিক চিকিৎসা গবেষণায় অনেক কিছুতেই হে লা কোষ অপরিহার্য। হারপিস, লিউকোমিয়া, হিমোফিলিয়া, পারকিনসন’স ডিজ়িজ়, অ্যাপেন্ডিসাইটিসের মতো রোগের চিকিৎসায় পথ দেখিয়েছে হে লা কোষ। পথ দেখিয়েছে এডস-এর ওষুধ তৈরিতে। জোনাস সক যখন পোলিয়ো ভ্যাকসিন প্রস্তুত করেন, তখন তিনি সাহায্য নিয়েছিলেন হে লা কোষের। হাল আমলের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন, সে ক্ষেত্রেও ভূমিকা ছিল হে লা কোষের। চিকিৎসা এখন বিলিয়ন ডলার বিজ়নেস। বায়োরিলায়েন্স বা ইনভিট্রোজেন-এর মতো বায়োটেকনোলজি কোম্পানিগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাচ্ছে হে লা কোষ বিক্রি করে। অথচ, প্রদীপের নীচে অন্ধকার। হেনরিয়েটা ল্যাকসের পরিবার এত দুঃস্থ যে, প্রয়াতা মহিলার নাতি-নাতনিদের মেডিকেল বিমাও জুটছিল না। এ হেন বৈপরীত্য!

হেনরিয়েটার কাহিনি নিয়ে লেখা হয়েছে দুটো বই। ১৯৮৬ সালে বিজ্ঞান-সাংবাদিক মাইকেল গোল্ড লিখেছিলেন ‘আ কনস্পিরেসি অব সেলস: ওয়ান উওম্যানস ইমর্টাল লেগ্যাসি অ্যান্ড দ্য মেডিক্যাল স্ক্যান্ডাল ইট কজ়ড।’ এক মহিলার গপ্পো বলতে গিয়ে গোল্ড শেষমেশ শোনান এক কোষবিজ্ঞানীর কথা। ওয়াল্টার লেনসন-রিস। যিনি দেখেছিলেন, পিলপিল করে বাড়তে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে কী ভাবে হে লা কোষ অন্য কোষকে বাড়তে দিচ্ছে না। ও বইতে বেশি কিছু জানা যাবে না হেনরিয়েটা বা তাঁর পরিবার সম্পর্কে। সে সব জানতে গেলে পড়তে হবে আর একটি বই। ‘দ্য ইমর্টাল লাইফ অব হেনরিয়েটা ল্যাকস।’ যা ২০১০ সালে লেখেন রেবেকা স্ক্লুট। ওই বই হেনরিয়েটার সামগ্রিক আখ্যান। বইখানি বেস্টসেলার। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। অনুবাদ হয়েছে কুড়িটি ভাষায়। বইটিকে নিয়ে ফিল্ম হয়েছে। অভিনয় করেছেন ওপরা উইনফ্রে এবং রোজ বায়ার্ন।

অমানবিক: টাসকিগি সিফিলিস স্টাডি। কালো মানুষদের ওষুধ না দিয়ে দেখা হয়েছিল রোগটি কী ভাবে বাড়ে

অমানবিক: টাসকিগি সিফিলিস স্টাডি। কালো মানুষদের ওষুধ না দিয়ে দেখা হয়েছিল রোগটি কী ভাবে বাড়ে

এ বইতে রেবেকা জানিয়েছেন বই লেখার বৃত্তান্ত। কবে তিনি প্রথম শুনেছিলেন হেনরিয়েটার নাম? ১৯৯৮ সালে এক দিন। ষোলো বছর বয়সি রেবেকা বসেছিলেন কলেজের বায়োলজি ক্লাসে। সামনে প্রফেসর পায়চারি করছেন। তিনি বোঝাচ্ছেন জীবদেহে কোষ বিভাজন। কখন সে কাজে গোলমাল হয়, গোলমালের পরিণাম ইত্যাদি। বোঝাতে গিয়ে প্রফেসর বলেন, এ সব আমরা জানতে পেরেছি এক জন মহিলার সূত্রে। তাঁর নাম হেনরিয়েটা ল্যাকস। প্রফেসর আরও বলেন, ‘হেনরিয়েটা সারভিক্সের ক্যানসারে মারা যান। মৃত্যুর আগে এক জন শল্যচিকিসক তাঁর ক্যানসার-আক্রান্ত কোষ নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করেন। কিন্তু তাঁরা সফল হচ্ছিলেন না। হেনরিয়েটার ক্যানসার কোষ অন্য জাতের। চব্বিশ ঘণ্টায় ওই কোষের নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়। ওই কোষ হেনরিয়েটার দেহে বেঁচে ছিল যে ক’দিন, তার চেয়ে বেশি দিন বেঁচে আছে ওঁর দেহের বাইরে। আমরা যদি এখন পৃথিবীর যে কোনও জায়গার কোষ নিয়ে গবেষণার ল্যাবরেটরিতে যাই, তা হলে সেখানকার ফ্রিজ খুললে দেখতে পাব, তার মধ্যে রয়েছে হেনরিয়েটার কোষ। ওটা কোষ গবেষণার গিনিপিগ বা ইঁদুর। গত একশো বছরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে ক’টি উল্লেখযোগ্য জিনিস মিলেছে, তার মধ্যে স্থান পাবে ওই হে লা কোষ।... হেনরিয়েটা ল্যাকস ছিলেন এক জন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা।’

বায়োলজি ক্লাস শেষ। ছাত্রছাত্রীরা প্রফেসরের সঙ্গে ঘরের বাইরে চলে যায়। শুধু একা রেবেকা ক্লাসঘরে রয়ে যান। ভাবতে থাকেন হেনরিয়েটার কথা। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর অবদান অসামান্য, কেমন ছিলেন সেই নারী? তাঁর সংসার? জীবন? রেবেকাকে জানতে হবে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন প্রফেসরকে। তিনি আর কিছু জানেন না হেনরিয়েটা সম্পর্কে।

বাড়ি ফিরে বায়োলজি পাঠ্যবই খুঁজলেন রেবেকা। তাতে প্রফেসরের বলা কথার চেয়ে বেশি কিছু নেই। এনসাইক্লোপিডিয়ায় হেনরিয়েটার উল্লেখ পর্যন্ত নেই। বায়োলজির ডিগ্রি নেওয়ার পর রাইটিং কোর্সে ভর্তি। লেখালিখির কেরিয়ার। রেবেকা ঠিক করলেন, তাঁর প্রথম বইয়ের বিষয় হবেন হেনরিয়েটা।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হে লা কোষ নিয়ে কিছু লেখা সংগ্রহ করলেন রেবেকা। এক দিন খবর পেলেন, আটলান্টার মুরহাউস স্কুল অব মেডিসিন আয়োজন করছে এক আলোচনাচক্র। ‘হে লা ক্যানসার কন্ট্রোল সিমপোজ়িয়াম।’ মুরহাউস স্কুল অব মেডিসিন বহু পুরনো মেডিক্যাল কলেজ। কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য গড়া। সেই কলেজের গাইনেকোলজি বিভাগের প্রফেসর ডা. রোনাল্ডো পাটিলো ওই সিমপোজ়িয়ামের উদ্যোক্তা। পাটিলোর অন্য পরিচয় তিনি ডা. জর্জ গাই-এর একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র। সুতরাং, হেনরিয়েটার ব্যাপারটা জানেন। নিজে কৃষ্ণাঙ্গ বলে বিশ্বাস করেন, এক দিন ওই মহিলার প্রতি অবিচার হয়েছিল। মোট কথা, পাটিলো হেনরিয়েটার স্মৃতির প্রতি সহানুভূতিশীল। রেবেকা ভাবলেন, পাটিলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি।

যোগাযোগ করতে গিয়ে রেবেকা টের পেলেন পাটিলোর মানসিকতা। কৃষ্ণাঙ্গ মানসিকতার ব্যাপারে কট্টরপন্থী তিনি। রেবেকা ওঁর সাহায্য চাইতে বললেন, ‘আমি আপনাকে সাহায্য করব কেন আমাকে বোঝান।’ অর্থাৎ, কৃষ্ণাঙ্গরা যে আমেরিকায় নানা ভাবে অবিচারের শিকার, সেটা শ্বেতাঙ্গ রেবেকা কতটা উপলব্ধি করেন, তা যাচাই করা পাটিলোর উদ্দেশ্য। যাচাই করতে পাটিলো ফোনে ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউই নিয়ে নেন রেবেকার। প্রশ্ন করেন, ‘বিজ্ঞান গবেষণা এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?’

রেবেকা পাটিলোকে বলেন টাসকিগি সিফিলিস স্টাডির কথা। হ্যাঁ, ওই সমীক্ষাও চিকিৎসা গবেষণার ইতিহাসে কুখ্যাত। কালা আদমিদের পরিবার সিফিলিসের আঁতুড়ঘর— এই বিশ্বাস থেকে ১৯৩০-এর দশকে আলাবামা প্রদেশের শহরের টাসকিগি ইনস্টিটিউটের গবেষকরা আমেরিকার সরকারি মদতপুষ্ট এক সমীক্ষা চালান। কী সমীক্ষা? কালো মানুষদের সিফিলিস সংক্রমণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ওষুধ না-দিয়ে দেখা। রোগটা কী ভাবে বাড়ে। রোগ নিরাময় গবেষণায় গিনিপিগ দরকার। সব সময়। রোগমুক্তির সময় বাহবা পান বিজ্ঞানীরা। কেউ মনে রাখে না গিনিপিগদের কথা। এক্ষেত্রে কালা আদমিরা হন গিনিপিগ। গবেষকদের— যাদের সবাই ছিলেন সাদা মানুষ— একটুও বিবেকে বাঁধে না ওরকম ঘৃণ্য গবেষণায়। ১৯৭০-এর দশকে টাসকিগি সমীক্ষার খবর জানাজানি হলে পড়ে শোরগোল। রেবেকা পাটিলোকে সেই বৃত্তান্ত জানান। পাটিলো সন্তুষ্ট হন না। ভাবেন, ওই সমীক্ষা এত কুখ্যাত যে, তার কথা সবাই জানে। রেবেকার ওটা জানার মধ্যে বিশেষত্ব প্রমাণিত হয় না। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন রেবেকাকে, ‘আর কিছু জানেন আপনি?’ রেবেকা এবার তাঁকে বলেন, মিসিসিপি প্রদেশে হতভাগ্য কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের কথা। যাঁদের জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল। যাতে তাঁরা গর্ভবতী না-হয়ে কালা আদমিদের সংখ্যা না-বাড়ান। আর, শ্বেতাঙ্গ ডাক্তারবাবুরা যাতে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়ার শল্যচিকিৎসায় পারদর্শী হন। মিসিসিপির ওই স্ক্যান্ডাল টাসকিপি শহরের সিফিলিস সমীক্ষার মতো বহুশ্রত নয়। রেবেকা তার খবরও রাখেন বলে খুশি হন পাটিলো। তিনি রেবেকাকে দেন হেনরিয়েটার মেয়ে ডেবোরা-র ফোন নম্বর।

হেনরিয়েটার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে রেবেকা টের পান, ওঁরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। ক্ষোভের কারণ আছে। এক দিকে হে লা কোষ নিয়ে এত কারবার, ও দিকে ওঁরা কিছু জানেন না। এক দিকে হে লা কোষ নিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যবসা, ও দিকে ওঁরা চরম দারিদ্রে। রেবেকার লেখা বই বেস্টসেলার হলে, বিক্রির ডলার থেকে তিনি গড়েন এক ফাউন্ডেশন (HenriettaLacksFoundation.org)। হেনরিয়েটার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য। ফাউন্ডেশনের এক জন সদস্যা অবশ্যই রেবেকা। আর আছেন হেনরিয়েটার পরিবারের লোকজন।

২০১৩ সালে এক ঘটনায় ওই ফাউন্ডেশন সামনে আসে। জার্মানির হাইডেলবার্গের ইউরোপিয়ান মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবরেটরির এক বিজ্ঞানী ‘জিনস জিনোমস জেনেটিক্স’ জার্নালে একটি পেপার ছাপেন, হে লা কোষের জিন বিশ্লেষণ করে। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মূলত রেবেকা প্রতিবাদ করেন— ‘কারও জিন গঠন তো প্রাইভেট ইনফরমেশন। ব্যক্তিগত ব্যাপার। তা এ ভাবে প্রকাশ করা যায় না কি?’ উত্তেজনা প্রশমিত করতে হেনরিয়েটার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এর ডিরেক্টর ফ্রান্সিস কলিন্স। তিনি ওঁদের বোঝান প্রাইভেট ইনফরমেশন বনাম বিজ্ঞানে অগ্রগতির গুরুত্ব। হেনরিয়েটার পরিবারের সদস্যেরা রাজি হন— হে লা কোষের জিন-মানচিত্র কী ভাবে লাগছে, তা জানার পর গবেষণার অনুমতি দেবেন।

দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে হেনরিয়েটা জন্মেছিলেন ১৯২০ সালে। সেই সুবাদে তাঁর জন্মশতবর্ষ গেছে গত বছর। কিন্তু হেনরিয়েটার জন্মের একশো বছর পরেও আমেরিকায় জাতিবিদ্বেষ কমেনি। প্রমাণ মিনেসোটা প্রদেশের মিনিয়াপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামে কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে পুলিশের হত্যা। প্রতিবাদে গোটা দেশ উত্তাল। বিচারের দাবিতে ‘ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার’ আন্দোলন। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হেনরিয়েটা ল্যাকস ফাউন্ডেশনকে হাওয়ার্ড হিউজেস মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর তরফে অর্থসাহায্য বিশেষ তাৎপর্য
বহন করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-ও হেনরিয়েটাকে সম্মান জানিয়ে বলেছে, এত দিন ধরে ভুল করা হয়েছিল।

অন্য বিষয়গুলি:

Cell Research Black lives matter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy