বিজ্ঞানের জোরেই ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭৯-তে পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত বা স্মলপক্সকে মুছে ফেলার কথা বলা হয়েছিল। তা বলে ‘মায়ের দয়া’, এই প্রচলিত কথাটা মুছে যায়নি, বরং বাঙালির স্মৃতি-সত্তা-বর্তমানের সঙ্গেও তার নিত্য যোগাযোগ। এই কথার সূত্রে বাঙালি এক সময় বসন্ত রোগকে বুঝত। আর এই মা হলেন দেবী শীতলা। তাঁর পুজো বছরভর বিভিন্ন জায়গায় হলেও, মূলত চৈত্রে তা বাংলা তো বটেই, সারা দেশেই হয়ে থাকে। শীতলার এমন কদরের সূত্রেই বোধহয় তারাপদ রায় কবিতায় বলেছেন— “তুমিও ঈশ্বর মানো, তবে কি ঈশ্বর সর্বভুক/... মারীকালে গর্দভের বোঝা/ মা শীতলা, ওলাবিবি—...” (‘কোনো প্রাক্তন বিপ্লবীকে’)
দেবীর আরাধনা মূলত লোকায়ত সমাজে প্রচলিত। এই দেবীর মূর্তিকল্পনা, তাঁর উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যাখ্যা, আরাধনাস্থলের বৈচিত্র, দেবীকেন্দ্রিক সাহিত্য, সবই বিভিন্ন ধারায় বহমান।
‘পিচ্ছিলাতন্ত্র’ অনুযায়ী শীতলা শ্বেতবর্ণা, দিগম্বরী, তাঁর মাথায় কুলো, এক হাতে ঝাঁটা এবং কাঁখে পূর্ণ কলস। তিনি গর্দভবাহনা। এক কথায়, এমন ‘তুচ্ছ’ জিনিসে সাজানো হওয়ায় পুরো প্রতিমারূপের কল্পনাটিই বেশ আশ্চর্যজনক। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। দেবী দিগম্বরী কারণ, তিনি দশ দিকে পরিব্যাপ্ত, সর্বায়ত। গাধা, এই শব্দটির মাধ্যমে আমরা প্রায়ই উপহাস, হাসি-ঠাট্টা করি বটে, কিন্তু ভেবে দেখলে, এই প্রাণীটিই যাবতীয় জিনিসপত্র বহন করে। তার পিঠে কোন সামগ্রী রয়েছে, সে দিকে তার লোভ, নজর কিছুই নেই। গাধা আসলে তাই নিষ্কাম-নিঃস্বার্থ কর্মসাধনা, ত্যাগের প্রতীক, যা আদতে সাত্ত্বিক গুণেরই প্রতিচ্ছবি। সুতরাং, দেবীর কৃপা পেতে গেলে আমাদের সত্ত্বগুণের অধিকারী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই কৃপাটি মুখ্যত, ‘মসুরিকা’ (অর্থাৎ যে রোগে মুসুর ডালের মতো গুটি বেরোয়, বসন্ত) থেকে মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা। আর কুলোর তাৎপর্য হল, এর সাহায্যে আমরা যেমন শস্য থেকে আবর্জনা দূর করি, তেমনই দেবীর কৃপা পেলে ‘মসুরিকা’রূপ আবর্জনা মুক্ত হয়ে জীবন সুস্থ থাকবে। ঝাঁটার মাধ্যমে যাবতীয় স্থানকে শুদ্ধ করা হয়, তাই সেটি শুচিতার প্রতীক।
এ হেন দেবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত ধারণাতেও মিশেছে বিভিন্ন ধারা। কাঁখের কুম্ভে থাকা শীতল জলের মাধ্যমে দেবী রোগের উপশম করেন বলে বিশ্বাস। এই কলস উর্বরতা, উৎপাদনশীলতারও প্রতীক। ‘জল’, এই সূত্রেই শীতলার বৈদিক তাৎপর্য রয়েছে। বেদের এক দেবতা হলেন ‘অপ্’, যার অর্থ জল। আবার, ‘বিশ্বকোষ’ রচয়িতা নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে, অথর্ববেদে যে ‘তক্মন্’ শব্দটি রয়েছে, সেটিরই অর্থ শীতলা। যদিও অনেকে এই শব্দের অর্থ হিসেবে জ্বররূপ দৈত্যের প্রতিমূর্তিও বলেছেন। বেদের এই অপ্-ই ‘স্কন্দপুরাণ’ ও ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ শীতলা। শাস্ত্র অনুসারে, যজ্ঞাগ্নি থেকে তাঁর উদ্ভব। আবার অন্য একটি সূত্রে দেবী হলেন ব্রহ্মার মেয়ে, কাত্যায়নীর রূপ। বহু পণ্ডিত আবার বৌদ্ধ হারিতী, পর্ণশবরীর সঙ্গেও শীতলার মিল খুঁজে পেয়েছেন।
দেবীর উৎপত্তি যে ভাবেই হোক না কেন, এঁর আরাধনাস্থল কিন্তু প্রকৃত অর্থেই সর্বায়ত। বাংলায় শীতলার বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। আবার, মধ্যপ্রদেশের মধখেড়া এবং গুজরাতের মধেরার সূর্যমন্দির, রাজস্থানের যোধপুর, বারাণসী— নানা জায়গার মন্দিরে শীতলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। উত্তরপ্রদেশে ‘শীতলাভবানী’, মধ্যপ্রদেশে ‘মারই’, ওড়িশায় ‘ঠাকুরানি’, মহারাষ্ট্রে ‘মাতা-মা’, অসমে ‘আই-অটোয়া’ প্রভৃতি বিভিন্ন নামে গোটা দেশ জুড়েই শীতলা পুজো প্রচলিত। জেমস টড-এর ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ় অব রাজস্থান’ বইতেও দেখা যায় উদয়পুরে রাজস্থানের রমণীদের শীতলামন্দিরে পুজো দেওয়া, মঙ্গলগীত, নৃত্য পরিবেশন করার দৃশ্য। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সেই দিনটি মেবারের রানা ভীমসিংহের জন্মতিথিও বটে।
আবার এই বাংলাতেই লোকায়ত সমাজের আরাধ্য হিসেবে কখনও মাটির হাতি বা স্রেফ কাঠ, পাথরখণ্ডকেও দেবী রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর আরাধনা হয় বট, নিম প্রভৃতি গাছের তলায়। বস্তুত এখানেই শীতলা-মহিমার বিস্তৃতিও। মেদিনীপুর, বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি-সহ বাংলার নানা প্রান্তে তিনি গ্রামদেবতা হিসেবেও আরাধ্য। এর নেপথ্যে বোধহয় শুধু বসন্ত বা জ্বরের উপশমকারী দেবী, এমন ধারণাটি নেই। বরং, অনেক ক্ষেত্রেই শীতলা হলেন বাংলার কৃষিসভ্যতা, সমৃদ্ধিরও প্রতীক। দেবীমূর্তির সঙ্গে থাকা কুলো, ঝাঁটা কিন্তু ফসল ওঠার পরেও দরকার হয়। শীতলা পুজোর উপকরণও সামান্য— বেলপাতা, সিঁদুর, যে কোনও লাল ফুল, চাঁদমালা প্রভৃতি।
এই সূত্রে কবিশেখর কালিদাস রায়ের ‘মায়ের দেশে’ কবিতাটির কথা মনে পড়তে পারে। সেখানে বাঙালির মাতৃত্বের বন্দনা করেছেন কবিশেখর। ফুটিয়ে তুলছেন গ্রাম-বাংলার ছবি— “ষষ্ঠী অশথ তলে পাতায় ঢাকা/ বটতলে মা শীতলা সিঁদুর মাখা।” বস্তুত, এমন যে দেবীর মহিমা, তাঁকে নিয়ে বাংলার কবিরা নীরব কোনও দিনই নন। খোদ মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’-এ, ‘দুরন্ত বসন্ততাপে তাপিত শরীর’ জুড়োনোর জন্য শীতলার আগমনকে চিত্রিত করেছেন। বাংলা মঙ্গলকাব্যের ধারাতেও রয়েছে ‘শীতলামঙ্গল’। এই ধারার প্রধান কবিরা হলেন কৃষ্ণরাম দাস, নিত্যানন্দ চক্রবর্তী, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, দ্বিজ দুর্গারাম, মাণিকরাম গঙ্গোপাধ্যায়-সহ আরও অনেকেই। আবার, প্রায় গোটা বাংলা জুড়েই শীতলার বন্দনামূলক গীত, ব্রতকথার ছড়াছড়ি। বাংলায় যা শীতলার গীত, মায়ের গান, সয়লা গান ইত্যাদি নামে প্রচলিত, অসমে সেটাই ‘আইনাম’ নামে পরিচিত।
এমন সর্বায়ত এক দেবী-চরিত্রের সামাজিক ও শাস্ত্রীয় দিক নিয়ে ‘শিক্ষিত’ বাঙালি একটা সময় আগ্রহী হলেও, বর্তমানে কিছু ব্যতিক্রম বাদে, সেই চর্চা যেন ম্লান। এই ‘দূরে সরিয়ে রাখা’র সংস্কৃতি ভাবিয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও। তাই একদা শ্রীনিকেতনের উৎসবে বিষয়টি অনুধাবন করে তিনি বলছেন, “...যারা মা-ষষ্ঠী মনসা ওলাবিবি শীতলা... পুরুতের আওতায় মানুষ হয়েছে তাদের থেকে আমরা খুব বেশি উপরে উঠেছি তা নয়; কিন্তু দূরে সরে গিয়েছি, পরস্পরের মধ্যে ঠিকমত সাড়া চলে না। তাদের ঠিকমত পরিচয় নেবার উপযুক্ত কৌতূহল পর্যন্ত আমাদের নেই।” (‘পল্লীসেবা’)
তথ্যসূত্র: ‘দেবদেবী ও তাঁদের বাহন’: স্বামী নির্ম্মলানন্দ, ‘শীতলামঙ্গল সমগ্র’ ‘দশদিশি’ (সম্পা: অতনুশাসন মুখোপাধ্যায়), ‘রিলিজয়ন, ডিভোশন অ্যান্ড মেডিসিন ইন নর্থ ইন্ডিয়া: দ্য হিলিং পাওয়ার অব শীতলা’: ফাব্রিসিয়ো এম ফেরারি প্রভৃতি।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)