Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
তবু এ শহরের সঙ্গে তাঁর যোগ গভীর বেদনার। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তাঁর পুত্র ওয়াল্টার চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসেন। সেই সূত্রেই এক গভীর ক্ষত তৈরি হয় সাহিত্যিকের জীবনে, যা কখনও নিরাময় হয়নি।
Bengali Story

চার্লস ডিকেন্স কখনও কলকাতায় আসেননি

ওয়াল্টার যখন ভারতে এলেন, তখন এ দেশের চার দিকে সিপাহি বিদ্রোহের দামামা। ওয়াল্টার যোগ দিলেন ছাব্বিশ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টে।

আত্মজ: ওয়াল্টার ডিকেন্স। ডান দিকে, ভবানীপুর সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়েছিল তাঁকে

আত্মজ: ওয়াল্টার ডিকেন্স। ডান দিকে, ভবানীপুর সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়েছিল তাঁকে

সুখেন্দু দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২২ ০৬:৩৩
Share: Save:

বিশ্বখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের চতুর্থ সন্তান এবং দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডর ডিকেন্স, পরিবারের সকলের আদরের ‘ওয়ালি’। ওয়াল্টার ডিকেন্সের জন্ম ১৮৪১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ওয়াল্টারের জন্মের পর এক জমজমাট পার্টি দেন মা ক্যাথরিন হগার্থ ও বাবা চার্লস ডিকেন্স। সেন্ট মেরি লেবনের গ্রাম‍ীণ চার্চে ১৮৪১ সালের ৪ ডিসেম্বর ছেলের নামকরণ করেন ডিকেন্স। ডিকেন্সই তাঁর এই পুত্রের নাম রেখেছিলেন তাঁর প্রিয় কবি এবং বন্ধু ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডরের নামে।

মাত্র ষোলো বছর বয়সে ওয়াল্টার কলকাতায় আসেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে। তখন ১৮৫৭ সাল। সাদাম্পটন থেকে জলপথে ভারতের উদ্দেশে যখন তিনি যাত্রা করেন, সে দিন বন্দরে চার্লস ডিকেন্স নিজে উপস্থিত থেকে ছেলেকে বিদায় জানিয়েছিলেন তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করে। বাবার সঙ্গে সে দিন ওয়াল্টারের বড় ভাই চার্লিও ছিল। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ওয়াল্টার এ দেশে আসেন। পিছনে পড়ে থাকে জন্মভূমি, প্রিয়জনেরা। ছেলেকে দূরে পাঠিয়ে ডিকেন্স নিজেও বেশ কিছু দিন মনমরা হয়ে পড়েছিলেন। এক বার ওয়াল্টার সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্নেহপ্রবণ পিতা ডিকেন্স এক চিঠিতে কবিবন্ধু ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডরকে লেখেন, “ওয়াল্টার ইজ় আ ভেরি গুড বয় অ্যান্ড কাম্স হোম ফ্রম স্কুল উইথ অনারেব্‌ল কমেন্ডেশন্স, হি নেভার গেট্স ইনটু ট্রাব্‌ল ফর হি ইজ় আ গ্রেট ফেভারিট উইথ দ্য হোল হোম অ্যান্ড ওয়ান অব দ্য মোস্ট অ্যামিয়েব্‌ল বয়েজ় ইন দ্য বয়-ওয়ার্ল্ড।”

ওয়াল্টার যখন ভারতে এলেন, তখন এ দেশের চার দিকে সিপাহি বিদ্রোহের দামামা। ওয়াল্টার যোগ দিলেন ছাব্বিশ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টে। তাঁর কাজের শুরু হয় বিয়াল্লিশ হাইল্যান্ডার বাহিনীতে। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। ওয়াল্টার সেনাবাহিনীর চাকরিতে আগ্রহী ছিলেন না মোটেই। তাঁর ইচ্ছে ছিল বাবার মতো লেখক হওয়ার। কিন্তু বাবা ছেলেকে লেখকজীবনের অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিতে চাননি। তিনি ওয়াল্টারকে সেনাবাহিনীর ক্যাডেটে ভর্তি করে দেন। আর পাঁচ জন সাধারণ বাবার মতো লেখক-বাবাও ভেবেছিলেন, সেনাবাহিনী কিংবা প্রশাসনিক বিভাগে চাকরি করলেই ছেলের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ এবং নিশ্চিন্ত হয়ে উঠবে। শুধু সুরক্ষিত ভবিষ্যতের চিন্তাই নয়, অন্য কারণও ছিল। সেটা হল, ওয়াল্টার ছিলেন খুবই বেহিসেবি এবং অমিতব্যয়ী। লেখক হতে গেলে যে কষ্ট এবং সহিষ্ণুতার পরীক্ষা দিতে হয়, তা ছেলের মধ্যে খুঁজে পাননি বাবা। তিনি তাই চেয়েছিলেন, শ্রমের মর্যাদা উপলব্ধি করে ছেলে নিজে উপার্জন করে অর্থের মূল্য বুঝুক।

বাস্তবে বাবার সে আশা পূর্ণ হয়নি। ছেলে কলকাতায় এসেও তাঁর বেহিসেবি খরচের অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বরং খরচের হাত বেড়েই চলল। বাড়ল ঋণের বোঝা। অনিয়মিত অসংযত জীবনযাত্রার দোসর হল অসুস্থতা। চার্লস ডিকেন্স বুঝেছিলেন, ওয়াল্টারের মধ্যে কাজ করছিল তাঁর বাবা, অর্থাৎ ওয়াল্টারের ঠাকুরদাদার জিন। ডিকেন্সের বাবাও প্রচুর ঋণ করে শোধ দিতে না পেরে কারাগারে গিয়েছিলেন। সেখানেই মারা যান। সেই আদলেই ডিকেন্স গড়েছিলেন ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ উপন্যাসে উইলকিন্স মিকবার-এর চরিত্রটি।

বেহিসেবির মাশুল হিসেবে কলকাতায় ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করল ওয়াল্টার ডিকেন্সের শরীর। ১৮৬৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর ব্যারাকের অফিসাররা ব্যস্ত ছিলেন বর্ষবরণের পার্টিতে। ওয়াল্টার যোগ দিতে পারেননি শরীরের জন্যই। কিন্তু তাঁর মন ছিল আনন্দে উৎফুল্ল। কারণ তাঁর শরীরের কথা ভেবে তাঁকে পাকাপাকি ভাবে সেনাবাহিনী থেকে ছুটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। আর কয়েক দিনের মধ্যেই সে ফিরবে ইংল্যান্ড, তার জন্মভূমি আর প্রিয়জনদের কাছে। মাত্র তেইশ বছরের যুবকের আনন্দ সে দিন যেন বাধ মানতে চাইছিল না। ক্যালকাটা হসপিটালে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অত্যধিক আনন্দ আর উত্তেজনাই তাঁর কাল হল। দুর্বল হৃৎপিণ্ড তীব্র আনন্দের ভার সইতে পারল না। হৃৎপিণ্ডের ধমনী অতিরিক্ত স্ফীত হয়ে ফেটে গেল, চিকিৎসার পরিভাষায় যে রোগটির নাম ‘অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজ়ম’। মুহূর্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ভলকে ভলকে রক্ত। চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বাঁচানো গেল না তাঁকে।

বন্ধু-সহকর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তাঁকে সকলে বলত, ‘ইয়াং অফিসার অব দ্য গ্রেটেস্ট প্রমিস’। তাঁরাই ওয়াল্টারকে সমাহিত করেন ভবানীপুরের মিলিটারি সেমেট্রিতে।

ওয়াল্টার চলে গেলেন ১৮৬৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে। আর চার্লস ডিকেন্স সে খবর পেলেন ১৮৬৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি, ঠিক এক মাস সাত দিন পর। সঙ্গে পেলেন ছেলের বিলাসব্যসনের পরিণামে জমা, পরিশোধ না-হওয়া মোটা অঙ্কের প্রচুর বিল। ঘটনাচক্রে সে দিনই চার্লস ডিকেন্সের বাহান্নতম জন্মদিন। বাড়িতে অনুষ্ঠানের আয়োজন। দুঃসংবাদের তীব্রতায় সব বন্ধ হয়ে গেল। শোকে ভেঙে পড়লেন সন্তানহারা পিতা।

ওয়াল্টারের মৃত্যু সম্পর্কে প্রকাশক চার্লস নাইটকে ১৯৬৪ সালের ১ মার্চ লেখা এক চিঠিতে ডিকেন্স জানিয়েছিলেন, “মাই পুয়োর বয় ওয়জ় অন হিজ় ওয়ে হোম ফ্রম অ্যান আপকান্ট্রি স্টেশন অন সিক লিভ। হি হ্যাড বিন ভেরি ইল, বাট ওয়জ় নট সো অ্যাট দ্য টাইম। হি ওয়‌জ় টকিং টু সাম ব্রাদার অফিসার্স ইন দ্য ক্যালকাটা হসপিটাল অ্যাবাউট হিজ় প্রিপারেশন্স হোয়েন হি সাড্নলি বিকেম এক্সাইটেড! হ্যাড আ রাশ অব ব্লাড ফ্রম হিজ় মাউথ অ্যান্ড ওয়জ় ডেড।”

ওয়াল্টারের সমাধিটি ভবানীপুর সমাধিক্ষেত্রে রয়ে গেলেও ভগ্ন সমাধির ফলকটি অত্যুৎসাহীরা পার্ক স্ট্রিটের সমাধিস্থলে এনে রেখেছেন। সমাধি যেখানে, সেখানেই ফলকটি থাকলে ইতিহাস বিভ্রান্ত হত না।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story Bhawanipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy