ঐতিহাসিক: জম্মু কাশ্মীরে প্রাপ্ত অষ্টম শতকের সিংহবাহিনী গজলক্ষ্মী।
দেবী সিংহবাহিনী মানেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার ছবি। আমাদের পরিচিত লক্ষ্মীর রূপ তার থেকে অনেকটাই আলাদা। উত্তর ভারতে তিনি ধনলক্ষ্মী বা গজলক্ষ্মী, আর বাংলায় তিনি দুর্গার সন্তান, নিজের ঘরের মেয়ে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, লক্ষ্মীও একদা সিংহবাহিনীই ছিলেন, তখনও তিনি বিষ্ণুপদসেবিকা হয়ে ওঠেননি।
আধুনিক হিন্দু দেবমণ্ডলীতে সবচেয়ে প্রাচীন মূর্তিরূপ যে দেবীর, তিনি লক্ষ্মী। মহিষমর্দিনীর মূর্তিরূপের আবির্ভাব লক্ষ্মীর কয়েক শতাব্দী পরে। লক্ষ্মীর আদিতম মূর্তিরূপ দেখা যায় বৌদ্ধ ভাস্কর্যে, সাঁচী আর ভারহুতের বৌদ্ধ স্তূপগুলির প্রাচীরগাত্রে ও তোরণে। এই লক্ষ্মী গজলক্ষ্মী এবং পদ্মফুলের উপর তাঁর অবস্থান। কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়মে যে ভারহুতের প্রাচীরগুলির অবশেষ আছে, সেখানে তাঁর এই রূপেরই দেখা মেলে— দু’টি হাতি তাদের শুঁড়ে কুম্ভ নিয়ে দেবীর জলাভিষেক করছে। এই নিদর্শনগুলি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে প্রথম শতকের মধ্যবর্তী সময়ের, সাতবাহন ও শুঙ্গ রাজাদের সমসাময়িক। লক্ষ্মীর এই মূর্তিরূপ ধীরে ধীরে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, সপ্তম শতাব্দীর পর থেকে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ হিন্দু মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরে এই গজলক্ষ্মীর চিত্র অঙ্কন বা খোদাই প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল। কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের প্রাচীন হিন্দু মন্দিরেও গজলক্ষ্মী ছিলেন। এই লক্ষ্মীরূপ আজও প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় প্রচলিত আছে, এখনও তাঁর এই গজাভিষিক্তা পদ্মাসীনা রূপ হিন্দুশিল্পে দেখা যায়। ২২০০ বছর ধরে এক জন দেবতার প্রায় একই রূপ প্রচলিত থাকা, ভারত তথা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অবশ্যই সেই সঙ্গে নতুন নতুন লক্ষ্মীরূপের সংযোজন হয়েছে, আবার তাঁর অনেক রূপ বিলুপ্তও হয়ে গিয়েছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে।
ঋগ্বেদে লক্ষ্মীর উল্লেখ এক বার পাওয়া যায়, দশম মণ্ডলের একাত্তর নং সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রে— ‘ভদ্রৈষাম্ লক্ষ্মীর্নিহিতাধি বাচী’ অর্থাৎ তাদের বাক্যে ভদ্রা লক্ষ্মী যেন নিহিত থাকেন। অথর্ববেদে লক্ষ্মীর একাধিক উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন সপ্তম কাণ্ডের ১১৫তম সূক্তে একশত লক্ষ্মীর মধ্যে পাপী ‘অজুষ্টা’ লক্ষ্মীদের বিতাড়ন করে পুণ্যলক্ষ্মীর আবাহনের কথা বলা হয়েছে। তবে তাঁকে পাথরের উপর প্রথম মূর্তিরূপ প্রদানের কৃতিত্ব অবশ্যই বৌদ্ধদের।
গজলক্ষ্মীর পাশাপাশি তাঁর আর একটি রূপ জনপ্রিয় হয় গুপ্তযুগে। সেটা হল সিংহবাহিনী লক্ষ্মীর রূপ। গুপ্তসম্রাটদের মুদ্রাগুলিতে এক পিঠে থাকতেন রাজা স্বয়ং, কখনও একা, কখনও রানির সঙ্গে, আর অন্য পিঠে এক জন দেবতা। লক্ষ্মীকেই বেশি দেখা যেত, কখনও পদ্মাসনা, কখনও সিংহবাহিনী, কখনও এক সঙ্গে দুটিই। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তর ‘সিংহবিক্রম’ শ্রেণির মুদ্রাগুলিতে এক পিঠে রাজা সিংহ দমন করছেন, অন্য পিঠে লক্ষ্মী বসে আছেন সিংহের উপর। প্রথম কুমারগুপ্তর মুদ্রায়ও তা-ই। এক দিকে কুমারগুপ্তর সিংহ দমনের দৃশ্য, অন্য দিকে সিংহের উপরে দেখা যায় পদ্মফুলের আসন, তার উপর বসে আছেন লক্ষ্মী। তাঁর পায়ের নীচেও পদ্ম। দেবীর নাম লেখা আছে, ‘শ্রী’।
কুষাণ সম্রাট কণিষ্কর রাজদেবী ছিলেন সিংহারূঢ়া ব্যাক্ট্রিয়ান দেবী ‘ননা’। গুপ্ত সাম্রাজ্যের মুদ্রাগুলিতে কুষাণ মুদ্রার প্রভাব ছিল। তাই কণিষ্কের সিংহবাহিনী ‘ননা’ থেকে গুপ্তদের সিংহবাহিনী লক্ষ্মীর অনুপ্রেরণা আশ্চর্যের নয়। সিংহ ছিল রাজতন্ত্র বা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক। সিংহের সঙ্গে রাজতন্ত্রের এই যোগ আমরা দূর অতীতেও দেখতে পাই। অশোক সম্পূর্ণ ভারতের উপর আধিপত্য বিস্তার করে তাঁর রাজশক্তির পরিচায়ক হিসেবে নির্মাণ করেন অনেকগুলি সিংহস্তম্ভ। চারটি সিংহ তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে চার দিকে, এটিই সিংহস্তম্ভের রূপ। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে এই অশোকস্তম্ভকেই বেছে নেওয়া হয়। এই সিংহের ইতিহাস কিন্তু আরও দূর অতীতে মিশে আছে। ইরানের আকিমিনিড সাম্রাজ্যের অনুকরণে অশোক তৈরি করেন সিংহস্তম্ভগুলি। কুষাণ সম্রাট বিম কদফিসেসের মুদ্রায় রাজব্যবস্থার প্রতীকরূপে সিংহাসন দেখা যায়। রাজশক্তি আর সিংহ ছিল সমার্থক। তেমনই যার আশীর্বাদ রাজার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়, সেই দেবী ছিলেন লক্ষ্মী। তাই লক্ষ্মীর সিংহারূঢ়া হয়ে ওঠা ছিল অবশ্যম্ভাবী। লক্ষ্মী, রাজশক্তি আর সিংহ যেন একে অপরের সমার্থক। গুপ্তসম্রাটদের মুদ্রার সিংহ-নিয়ন্ত্রণের দৃশ্য তাঁদের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতারই পরিচয় বহন করে।
গুপ্তসম্রাটদের সব মুদ্রায় দেবীর নাম থাকত না, তবে সাধারণ ভাবে তাঁদের মুদ্রার পদ্মাসনা দেবীকে ‘শ্রী’ বলে ধরা হয় কিছু মুদ্রালিখনের ভিত্তিতে। প্রথম কুমারগুপ্তর সিংহবাহিনী মুদ্রাটিতে ‘শ্রী’ নাম আমরা দেখেছি। এ ছাড়া, সিংহবাহিনী দেবীকে মুদ্রায় দেখা যেত পদ্মফুল এবং প্রাচুর্যশৃঙ্গ-সহ, আর এই অনুষঙ্গবস্তুগুলো তাঁকে ‘শ্রী’ বা লক্ষ্মী হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রাচুর্যশৃঙ্গ বা কর্নুকোপিয়া হল, ফলমূলে পরিপূর্ণ মোষের শিং, যাকে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে দেখা হত। এর সঙ্গে আধুনিক যুগের লক্ষ্মীর ঝাঁপির তুলনা করা যায়। মুদ্রায় সিংহের উপর অর্ধপর্যঙ্ক মুদ্রায় দেবীর বসার ভঙ্গিমাও ইঙ্গিত দেয় তিনি লক্ষ্মী। অর্ধপর্যঙ্কমুদ্রায় দেবী এক পা আসনের উপর রেখে হাঁটু মুড়ে বসেন, অন্য পা থাকে মাটিতে। সাঁচীর গজলক্ষ্মীকেও এই মুদ্রাতেই দেখা যায়। এ ছাড়া স্কন্দগুপ্তের শিলালেখগুলোতে লক্ষ্মীর বিভিন্ন উল্লেখ থেকে বোঝা যায় গুপ্তসম্রাটরা লক্ষ্মীর অনুমোদনেই রাজা হতেন। তাঁর জুনাগড় শিলালিপিতে আছে: ‘ব্যপেত্য সর্বান্ মনুজেন্দ্রপুত্রান্ লক্ষ্মী স্বয়ং যং বরয়াঞ্চকার’— সব মনুজেন্দ্রপুত্রদের (রাজপুত্রদের) পরিত্যাগ করে লক্ষ্মী তাঁকেই বরণ করলেন। তবে সিংহবাহিনী আর লক্ষ্মীর একীকরণ যেখানে সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যায়, সেটা হল উত্তর প্রদেশের বিলসড়ে আবিষ্কৃত গুপ্তযুগের একটি স্তম্ভগাত্রে। দেবী সিংহের উপরে বসে, হাতে পদ্মের মৃণাল, দু’দিক থেকে তাঁর জলাভিষেক করছে দু’টি হাতি। অর্থাৎ একই ভাস্কর্যে তাঁর দুটি রূপের প্রকাশ। গজলক্ষ্মীই এখানে সিংহবাহিনী।
দুই লক্ষ্মীর যৌথ রূপ ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দীর আরও কিছু মূর্তিতে দেখা যায়, বিশেষ করে জম্মু-কাশ্মীর ও হিমাচলে। নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজ়িয়ম অব আর্টে সংরক্ষিত জম্মু-কাশ্মীর থেকে প্রাপ্ত একটি মূর্তিতে দেখা যায় পদ্মের উপর দেবী অর্ধপর্যঙ্কমুদ্রায়, উপরে অভিষেক করছে দুটি হাতি, পদ্মের নীচে দুটি সিংহ, দেবীর পায়ে প্রস্ফুটিত পদ্ম, হাতে প্রাচুর্যশৃঙ্গ।
সিংহবাহিনী লক্ষ্মীর রূপ যোদ্ধৃরূপ নয়। তাঁর হাতে অস্ত্র নেই। সাধারণ ভাবে তাঁর হাতে প্রাচুর্যশৃঙ্গ বা পদ্মফুলই দেখা যেত। যোদ্ধা না হলেও তিনি সিংহরূপী রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্তা। তিনি ক্রুদ্ধ নন, অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত নন, শান্ত ভাবে তিনি রাজশক্তির অধিষ্ঠাত্রী হয়ে আছেন।
গজলক্ষ্মী ও সিংহবাহিনী লক্ষ্মীর পাশাপাশি লক্ষ্মীর আর একটি মূর্তিরূপের বিকাশ গুপ্তযুগের শেষ দিকে হচ্ছিল, বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী। বিষ্ণুর অনন্তশায়ী রূপের বিকাশ ঘটতে দেখা যায় গুপ্তযুগে। মধ্যপ্রদেশের বিদিশার নিকটবর্তী উদয়গিরি গুহামন্দিরে এখনও অবধি প্রাপ্ত প্রাচীনতম অনন্তশায়ী বিষ্ণুর মূর্তি আছে। এটি পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিককার। এখানে লক্ষ্মী অনুপস্থিত। আরও পরে পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগে উত্তরপ্রদেশের দেওগড়ে অবস্থিত দশাবতার মন্দিরে বিষ্ণুর পায়ের কাছে এক জন পদসেবিকা নারীর উপস্থিতি দেখা যায়। তবে এই নারীমূর্তিতে আলাদা করে কোনও দেবীলক্ষণ দেখা যায় না, তাই তিনি লক্ষ্মী কি না স্পষ্ট ভাবে বলা সম্ভব নয়। সপ্তম শতাব্দীতে কর্নাটকের বাদামিতে অনন্তশায়ী বিষ্ণুর পদসেবিকার উপস্থিতি দেখা যায়, আবার মহাবলিপুরমে তার অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ বিষ্ণুর পদসেবিকা হিসাবে লক্ষ্মীর আবির্ভাব আরও পরবর্তী কালে, ধারণা করা যায় সপ্তম শতাব্দীর পরে। আবার দশম শতাব্দীর খাজুরাহোতে লক্ষ্মীকে বিষ্ণুর বক্ষলগ্নাও দেখা যায়। তবে এটা অনস্বীকার্য, একটা সময়ের পর স্বতন্ত্ৰা লক্ষ্মীদেবীকে বিষ্ণুপদসেবিকার রূপ নিতে হয়েছিল।
কুষাণ আর গুপ্তযুগে যত মহিষমর্দিনীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে, তাতে কুষাণযুগের একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সিংহের অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীতে কর্নাটকে চালুক্যদের রাবণফাড়ি গুহামন্দিরে, আইহোলের দুর্গামন্দিরে, আর পল্লব রাজাদের মহাবলিপুরমের মহিষাসুরমর্দিনী গুহায় একের পর এক সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনীর রূপ প্রকট হতে শুরু করল। লক্ষ্মীকে তাঁর সিংহবাহিনী রাজকীয় রূপ পরিত্যাগ করতে হয়েছিল বিষ্ণুপ্রিয়া হতে গিয়ে। কিন্তু তাঁর সেই ক্ষাত্রগুণগুলিকে স্থানান্তরিত করার প্রয়োজন হয়েছিল অন্য দেবীর মধ্যে। মহিষমর্দিনী, অম্বিকা, চণ্ডী— এই দেবীদের মধ্যে বেঁচে রইলেন সিংহবাহিনী।
হস্তীর দ্বারা অভিষিক্তা লক্ষ্মী আর সিংহবাহিনী লক্ষ্মী, দুটিই ছিল স্বতন্ত্রা নারীর রূপ। গজলক্ষ্মী রইলেন, মুদ্রাব্যবস্থায়ও লক্ষ্মীর ধারাবাহিকতা রইল, কিন্তু সিংহবাহিনী লক্ষ্মীর অস্তিত্ব মুছে গেল। কেন এমন হল? ধারণা করা যায়, এটি গুপ্ত-পরবর্তী যুগের সামাজিক বিবর্তন আরনারীর সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তনেরই ফলশ্রুতি। লক্ষ্মীর গার্হস্থ রূপের সঙ্গে সিংহবাহিনীকে মেলানো গেল না, সেই কারণেই তাঁকে বিষ্ণুসেবিকার রূপ দিতে হল।
বাংলার লক্ষ্মীরূপ অনেকটাই বাঙালির নিজস্ব ভাবনাসম্ভূত। বাংলায় লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা। বাহন হিসেবে পেঁচার উৎস স্পষ্ট জানা নেই, তবে উলূকবাহিনী যোগিনী বা গরুড়বাহিনী লক্ষ্মী এর উৎস হতে পারে। বাংলার লক্ষ্মীর মধ্যে বিষ্ণুপত্নীরূপটি বরং গৌণ। বরং স্বতন্ত্রা দেবী এবং দুর্গার কন্যা হিসেবেই তাঁকে দেখা হয়। তাঁর হাতের ধানের ছড়া, গাছকৌটো আর ঝাঁপি বাঙালির কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পরিচায়ক। গুপ্তযুগের মতো রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক না হলেও বাংলার লক্ষ্মীর মধ্যে এক সমৃদ্ধিদায়িনী নিয়ন্ত্রীরূপ দেখা যায়।
তথ্যসূত্র: আনন্দ কে কুমারস্বামী-‘আর্লি ইন্ডিয়ান আইকনোগ্রাফি’ (প্রথম খণ্ড), ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়- ‘শক্তির রূপ: ভারতে ও মধ্য এশিয়ায়’, জন অ্যালান- ‘ক্যাটালগ অব দ্য কয়েনস অব দ্য গুপ্ত ডাইন্যাস্টিস অ্যান্ড অব শশাঙ্ক, কিং অব গৌড়’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy