জুটি: ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’ (১৯৪২) ছবিতে হামফ্রে বোগার্ট ও ইনগ্রিড বার্গম্যান। —ফাইল চিত্র।
সময়টা ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর, স্থান মরক্কোর বন্দর-শহর ক্যাসাব্লাঙ্কা। জার্মান আগ্রাসন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতায় বিধ্বস্ত ইউরোপ থেকে পালাতে মরিয়া রিফিউজিদের পীঠস্থান। সেই শহরেই অবস্থিত প্রবাসী আমেরিকান রিক ব্লেন-এর কাফে ‘রিক’স কাফে আমেরিকান’। সমাজের সব স্তরের মানুষের আনাগোনা সেখানে। রিফিউজিদের যন্ত্রণা স্পর্শ করে রিক-কে, ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার তাকে ক্ষুব্ধ করে, কিন্তু সে-সব অনুভূতি সে প্রকাশ করে না। বরং তিক্ততা, জীবনের প্রতি বীতস্পৃহাকে বর্ম করে অতীতের দুঃখ ভোলার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
হঠাৎই কালবৈশাখী ঝড়ের মতো এক দিন রিক-এর কাফেতে উপস্থিত হয় তার প্রাক্তন প্রেমিকা ইলসা। তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার যে বিদ্রোহী নেতা ভিক্টর লাজ়লোকে গ্রেফতারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে নাৎসি বাহিনী, ইলসা তারই স্ত্রী। বিপ্লবী দম্পতির মুক্তির একমাত্র উপায় ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়া, তাতে রিকের প্রত্যক্ষ সাহায্য তাদের একান্ত প্রয়োজন।
স্থান-কালের সীমানা ছাড়িয়ে, ভাষা-সংস্কৃতির প্রাচীর ভেঙে বহু প্রজন্মের দর্শকমনে ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছে— বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এমন ছায়াছবি হাতেগোনা। ওয়ার্নার ব্রাদারস প্রযোজিত, মাইকেল কার্টিজ় পরিচালিত ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’ সেই বিরল সিনেমাদের মধ্যে অন্যতম। রোম্যান্স, ড্রামা ও সাসপেন্সের নিখুঁত মিশেলে নির্মিত এই চলচ্চিত্র বিগত দশকগুলোয় ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রি, আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও ‘টাইম’ ম্যাগাজ়িন অনুমোদিত সেরা সিনেমার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে অনায়াসে। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড-এর মঞ্চে পুরস্কার জেতা থেকে শুরু করে আমেরিকান পপ কালচার-এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠা—‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’-র প্রাপ্তির ঝুলি আজও বিস্ময়কর।
এ সব কিছুরই সূত্রপাত মারে বারনেট ও জোয়ান অ্যালিসন-এর যৌথ নাটক ‘এভরিবডি কামস টু রিক’স’ থেকে। অমঞ্চস্থ সেই নাটক পড়ে এতটাই মুগ্ধ হন ওয়ার্নার ব্রাদারস-এর স্টোরি এডিটর আইরিন ডায়মন্ড যে প্রযোজক হ্যাল ওয়ালিস-কে এক রকম বাধ্য করেন কুড়ি হাজার ডলারের বিনিময়ে তার সম্পূর্ণ স্বত্ব কিনে নিতে। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে জোরকদমে শুরু হয় সিনেমার কাজ। পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মাইকেল কার্টিজ়-কে। হাওয়ার্ড কখ, জুলিয়াস এপস্টাইন ও ফিলিপ এপস্টাইন-এর উপর ভার পড়ে নাটক অনুসরণে চিত্রনাট্য লেখার। নায়ক ও নায়িকার চরিত্রে বেছে নেওয়া হয় হামফ্রে বোগার্ট এবং ইনগ্রিড বার্গম্যান-কে, পার্শ্বচরিত্রদের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য ডাক পান পল হেনরিড, ক্লড রেনস, কনরাড ভেল্ট, ডুলি উইলসন প্রমুখ।
১৯৪২ সালের ২৬ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক শহরে আনুষ্ঠানিক প্রিমিয়ারের পর ১৯৪৩ সালের ২৩ জানুয়ারি আমেরিকা ও ইউরোপে সর্বসাধারণের জন্য মুক্তি পেল ক্যাসাব্লাঙ্কা। তখন প্রায় প্রতি মাসে নতুন সিনেমা আসত, কোনও মতে কয়েক সপ্তাহ চলার পরেই হারিয়ে যেত বিস্মৃতির অতলে। ফলে ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’-র ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি প্রত্যাশা নির্মাতাদের ছিল না। কিন্তু সবার হিসাব উল্টে দিল এই ফিল্ম, সাফল্যের ঝড় তুলল বক্স অফিসে। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন দুঁদে সমালোচকের দল, সিনেমার গল্প, চরিত্র, সংলাপের প্রশংসা মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল।
এর আগে ক্রাইম ও থ্রিলারধর্মী সিনেমায় ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ চরিত্রে অভিনয় করা হামফ্রে বোগার্ট-এর পক্ষে রোম্যান্টিক হিরোর জুতোয় পা গলানো সহজ ছিল না। নতুন ভূমিকায় দর্শক তাঁকে গ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল তাঁর। জনশ্রুতি রয়েছে, বোগার্ট-এর স্ত্রী স্বামীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, “যে পুরুষের দিকে ইনগ্রিড বার্গম্যান প্রেমের দৃষ্টিতে তাকায়, তাঁর আবেদন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না।” বাস্তবে হয়েওছিল তাই। শুধু অন্তর্ভেদী চোখ ব্যবহার করেও যে দুর্দান্ত অভিনয় করা যায়, তা প্রমাণ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম অস্কার মনোনয়ন এসেছিল ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’-র হাত ধরেই।
পিছিয়ে থাকেননি বার্গম্যান-ও, স্বাভাবিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি অনুচ্চকিত, মাপা অভিনয়ের জোরে প্রায় রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন আমেরিকা-র ‘হার্টথ্রব’ নায়িকা।
সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য ছিল নিখুঁত পরিকল্পনার ফসল, এ কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন স্বয়ং নির্মাতারাই। ইনগ্রিড বার্গম্যান-এর তুলনায় হামফ্রে বোগার্ট উচ্চতায় ছিলেন সামান্য খাটো। ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে নায়িকার পাশে নায়ককে যাতে বেমানান না লাগে, তাই শুটিং-এর সময় জুতোর নীচে তিন ইঞ্চি পুরু কাঠের ব্লক বাঁধতেন বোগার্ট। এই ছোট্ট কৌশল রিক ও ইলসা-র চুম্বনদৃশ্যের আবেদন বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল। শোনা যায়, শেষ দৃশ্য শুটিংয়ের আগে অবধি বার্গম্যানকে জানতে দেওয়া হয়নি, দুই নায়কের মধ্যে কার সঙ্গে তাঁর মিল হতে চলেছে। রিক ও লাজ়লো-র মধ্যে শেষ পর্যন্ত কাকে জীবনসঙ্গী রূপে বেছে নেওয়া উচিত, তা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব রুপোলি পর্দায় অনবদ্য ফুটিয়েছিলেন ইলসা-রূপী বার্গম্যান, তার পিছনে এই গোপনীয়তার ভূমিকা ছিল।
‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’-র ম্যাজিক পর্দায় ফিরিয়ে আনার একাধিক প্রয়াস পরবর্তী সময়ে হয়েছে, কিন্তু নানা কারণে সেগুলোর একটাও সাফল্যের মুখ দেখেনি। ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কাবোব্লাঙ্কো’— ল্যাটিন আমেরিকান পটভূমিতে ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’-র অক্ষম অনুকরণ। এটি সিনেমাহলে লোক টানতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়। ১৯৮৩-তে টেলিভিশন সিরিজ় হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’, কিন্তু সাড়া না মেলায় কয়েকটা পর্বের পরেই বন্ধ হয়ে যায়।
এ ছবির সংলাপও গুরুত্বপূর্ণ। চিত্রনাট্যকাররা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি, চরিত্রদের মুখে যে কথাগুলো তাঁরা বসাচ্ছেন, তা আগামী দিনে কিংবদন্তি হয়ে উঠবে। কাফেতে ইলসাকে দেখার পর রিকের স্বগতোক্তি— ‘অব অল দ্য জিন জয়েন্টস ইন অল দ্য টাউনস ইন অল দ্য ওয়ার্ল্ড, শি ওয়াকস ইনটু মাইন’ যেমন নিয়তির ছলনায় বিভ্রান্ত ব্যর্থ প্রেমিকের হতাশাকেই বাঙ্ময় করে তোলে, তেমনই প্যারিসে ইলসার সঙ্গে নিবিড় মুহূর্ত কাটানোর সময় উচ্চারিত ‘হিয়ার’স লুকিং অ্যাট ইউ, কিড’ প্রেমিকাকে চোখে হারানো রিকের অন্তরের আবেগকে দর্শকদের সামনে স্পষ্ট করে। ফিল্মের অন্তিমলগ্নে ফ্রেঞ্চ পুলিশ ক্যাপ্টেন লুই রেনো-র বলা ‘রাউন্ড আপ দ্য ইউজ়ুয়াল সাসপেক্টস’ এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, পাঁচ দশক পরে আমেরিকান নির্দেশক ব্রায়ান সিঙ্গার তাঁর সিনেমার নামই রাখেন ‘দ্য ইউজ়ুয়াল সাসপেক্টস’।
‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’-র ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের অভিঘাত এমনই যে, দেখার পরেও রেশ রয়ে যায় বহু ক্ষণ। রিকের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, বুকে পাথর রেখে ইলসাকে লাজ়লোর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার অবিস্মরণীয় দৃশ্য ভালবাসার মাহাত্ম্যকে অন্য মাত্রা দেয়। চোখে জল নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বিদেশগামী বিমানে ওঠে ইলসা। বাধা দিতে আসা নাৎসি মেজর স্ট্র্যাসারকে গুলি করে রিক, অপেক্ষা করে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার। কিন্তু ফিল্মের শেষ চমক হিসেবে দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশকর্মী রেনোর খোলস কেটে বেরিয়ে আসে এক জন বিবেকবান মানুষ, রিক-কে আইনের ফাঁস থেকে সে বাঁচিয়ে দেয় নির্দ্বিধায়। তারাভরা রাতের আকাশের নিচে রিক ও রেনোর বন্ধুত্বের উষ্ণ অঙ্গীকার দিয়ে শেষ হয় সিনেমা।
কবি শেলি লিখেছিলেন, ‘আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দোজ় দ্যাট টেল অব স্যাডেস্ট থটস’। ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’-য় রিক ও ইলসা-র প্রেম পূর্ণতা পায়নি, বিরহের করুণরসে সিক্ত হয়েছে। তাই হয়তো আশি বছর পেরিয়েও এই সিনেমা আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় অমলিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy