সশস্ত্র: রামনবমীর শোভাযাত্রা। ব্রহ্মজিজ্ঞাসু রামচন্দ্র দেখলে কী ভাবতেন?
রাজমহিষী হওয়া সত্ত্বেও অহল্যা শেষ অবধি ইন্দ্র নামে এক লম্পট ব্রাহ্মণ তরুণের প্রেমে পড়লেন! এই অহল্যা গৌতম ঋষির স্ত্রী নন, রাজরানি। ইন্দ্র নামের সেই তরুণ সুযোগ পেয়ে রানির সঙ্গে রতিরঙ্গে মেতে উঠল। এবং রানিও তার পর থেকে কাজে, কথায় সব কিছুতেই লজ্জাশরমের বালাই হারালেন। স্বামী রাজা, কিন্তু রানির কিছু যায়-আসে না। জগৎ তখন তাঁর কাছে ইন্দ্রময়।
রাজা সব জানতে পেরে প্রেমিক-প্রেমিকাকে শীতের রাতে জলাশয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাতেও কিছু হল না, বরং দু’জনে খিলখিল করে হাসতে থাকল। রাজা আরও রেগে গেলেন। রানি ও তাঁর প্রেমিককে গরম তেলের কড়াইয়ে ফেলে দেওয়া হল, হাত-পায়ের আঙুল কেটে নেওয়া হল। অলজ্জ প্রেমিক-প্রেমিকারা তবু একে অন্যের সঙ্গসুখ থেকে থামল না।
লম্পট ব্রাহ্মণতনয় তখন রাজাকে বোঝাল, ‘‘আমি বা রানি, আমরা তো মন ছাড়া আর কিছু নই। কেন না, মনই জগতের প্রকৃত কর্তা। এই দৃশ্যমান দেহও মনেরই মায়াময় প্রকাশ। আশীর্বাদ, অভিশাপ ও শাস্তিতে তার কিছু যায় আসে না।’’ আরও বললেন, ‘‘মন দিয়ে যা করা যায়, সেটিই যথার্থ কৃত। আর শরীর দিয়ে যা করা হয়, সেটি অযথার্থ। যার দেহ-ভাবনা নেই, সে কখনও দেহধর্মে বাধ্য হয় না। যোগীরা যেমন! অন্তর্দৃষ্টির কারণেই তাঁদের আত্মদেহে সুখদুঃখের বোধ থাকে না।’’ ব্রহ্মজ্ঞানী এই দুশ্চরিত্র তরুণের কথা রামচন্দ্রকে শুনিয়েছিলেন মহামুনি বশিষ্ঠ।
এই নশ্বর শরীর ও জগৎ তাই মায়ায় আবৃত, অনিত্য এক সত্তা! ‘‘বৎস রামচন্দ্র, স্বর্গ-মর্ত-পাতালের এই ত্রিজগৎ মনের কল্পনাতেই নির্মিত। তুমি যদি তাই জগতের অনিত্যতাকে উপলব্ধি করতে পার, তোমার আত্মা প্রশান্ত হবে। মনে রেখ, রাগদ্বেষাদিতে দূষিত চিত্তকেই সংসার বলা হয়,’’ উপদেশ দিয়েছেন বশিষ্ঠ।
হরিশচন্দ্রের বংশধর লবণ রাজার কথাও বশিষ্ঠের থেকে জেনেছেন রামচন্দ্র। লবণ এক দিন সিংহাসনে বসে আছেন, এক জাদুকর এসে হাজির। তিনি রাজাকে ইন্দ্রজাল দেখাবেন। রাজা সম্মত হলে জাদুকর প্রথমে একটা ময়ূরের পালক ঘোরাতে লাগলেন। দর্শকদের মনে হল, অজস্র রঙিন, তেজোময় ময়ূরপুচ্ছ তাঁদের সামনে ঘুরছে।
সেই অবসরে সভায় হাজির এক অশ্বপাল। তেজোদৃপ্ত সুন্দর এক ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে তিনি রাজাকে বললেন, ‘‘এটি ইন্দ্রের বাহন উচ্চৈঃশ্রবার থেকে কম নয়। আমাদের রাজা এটি আপনাকে উপহার পাঠিয়েছেন।’
প্রবল পরাক্রান্ত রাজা সেই ঘোড়াকে দেখে চুপ, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। জ্বরাক্রান্ত রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘‘আমি কোথায়?’’ সবাই শান্ত করলেন তাঁকে, রাজা একটু বাদে তাঁর অভিজ্ঞতা বলতে শুরু করলেন।
রাজা নাকি ঘোড়ায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটতে শুরু করেছিল। বহু নদী, পাহাড় পেরিয়ে এক ঘন জঙ্গল। শুখা এলাকা— ঘাস, জল কিছুই নেই।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নামল। নিকষ, কালো রাত্রি। পেঁচা, বাদুড় ও শকুনের তীব্র আর্তনাদ। রাজা একটা গাছে উঠে পড়লেন, ঘোড়াটাও এই অবসরে কোথায় যেন ছুটে পালিয়ে গেল।
এক সময় ভোর হল। গাছ থেকে নেমে জঙ্গলে হাঁটতে লাগলেন রাজা, কিন্তু কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। দুপুরশেষে রাজার চোখে পড়ল, ময়লা জামাকাপড় পরা, শ্যামবর্ণা এক বালিকা অন্নপাত্র নিয়ে তাঁরই দিকে এগিয়ে আসছেন। রাজা দীনভাবে সেই বালিকাকে গিয়ে বললেন, ‘‘বড় খিদে পেয়েছে। আমাকে একটু খেতে দাও।’’ কিন্তু বালিকা উত্তর না দিয়ে, অন্নপাত্র নিয়ে চলতে লাগল।
ক্ষুধার্ত রাজা আর পারলেন না। কোনও ক্রমে শরীরটাকে টানতে টানতে সেই বালিকার সামনে। মেয়ে জানাল, ‘‘আপনি জানেন না, আমি চণ্ডালী। ইষ্টসিদ্ধি না করে দিলে আমাদের মতো লোকের কাছ থেকে উপকার পাওয়া যায় না। যা হোক, এই খাবারগুলি আমার বাবার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনি যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হন, খাবারের ভাগ দিতে পারি।’’
খিদে পেলে কে আর বর্ণ, ধর্ম, কুলমর্যাদার বিচার করে! রাজা চণ্ডালীর কথায় রাজি। তাদের ঘরে কাক ও বানরের খণ্ড খণ্ড মাংস। চণ্ডাল এসে জামাতা বাবাজিকে নিয়ে মদিরা সহযোগে উল্লাস করলেন। ক্ষত্রিয় রাজা চণ্ডালীপ্রেমে বশীভূত, হরিশচন্দ্রের বংশধর ক্রমশ দিনকে দিন চণ্ডাল বনে গেলেন। উচ্চবর্ণরা তাঁকে দেখলে দূরে সরে য়ায়, কিন্তু রাজা শিকার করে প্রাণীর মাংস চণ্ডালপল্লিতে বেচতে যান। কালে কালে এই চণ্ডাল দম্পতির একাধিক পুত্রকন্যাও হল।
বহু বছর পরে চণ্ডালভূমিতে আচমকা দুর্ভিক্ষ। ক্লান্ত রাজা স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাঁচার আসায় দেশ ছেড়ে চলতে লাগলেন। এক গাছের নীচে সবাই আশ্রয় নিলেন। কিন্তু ছোট ছেলেটি শুধুই কাঁদতে লাগল, ‘‘মাংস দাও।’’ অসহায় বাবা ভাবলেন, নিজের মাংসই শিশুকে খেতে দেবেন। কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বাললেন। তার পর চিতায় বসামাত্র ফের এই রাজসভা। সব যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গিয়েছে! জাদুকরকেও কোথাও আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সে কি ‘সংসার এ রকমই মায়া’ বোঝাতে রাজসভায় এসেছিল?
রাজা লবণের সেই সভায় বশিষ্ঠ স্বয়ং ছিলেন। তিনি এ বার জানালেন, ‘‘হে রাম, অজ্ঞানতা বশত বিষয়ের আকাঙ্খা জন্মায়। এটাই বাসনার প্রথম অঙ্কুর। এখান থেকে মোহ জন্মায়, চিৎ আপন পূর্ণতা বিস্মৃত হন। রামচন্দ্র, চিত্তকে অখণ্ডিত অদ্বৈতে পরিণত করো। এই নিখিল জগৎ অদ্বৈত ব্রহ্মের প্রকাশ।’’
অদ্বৈত ব্রহ্মের তত্ত্বজিজ্ঞাসু এই বইটিও রামায়ণ। ‘যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’ নামেই প্রসিদ্ধ। কথাসরিৎসাগর বা আরব্য রজনীর মতোই একটা গল্পের পেটে আর একটা গল্প, ক্রমশ খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে প্রতিভাত হয় ব্রহ্মজিজ্ঞাসা। উপনিষদেই ব্রহ্মজিজ্ঞাসার সূত্রপাত, তার পর অবশ্যই শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত তত্ত্বের প্রভাব পড়েছে এই বইয়ে। বাল্মীকিও এই বইয়ের রচনাকার হিসাবে পরিচিত। রামায়ণকার বাল্মীকি কি না, বাল্মীকি এক জনই কি না, সে প্রশ্ন আপাতত অবান্তর আজ। রামনবমীর দিন এই দেশে মিছিল-টিছিল হবে, রামভক্তির অজুহাতে অনেকেই হয়তো গরমাগরম কথা বলবেন, কিন্তু ব্রহ্মজিজ্ঞাসু রামচন্দ্রের কথা কেউ মনে রাখবেন না। এটাই ট্রাজেডি!
আসলে, অযোধ্যার রাজা, রাক্ষসজয়ী মহাবীর ইত্যাদি এক এবং একটিমাত্র পরিচয়ে রামচন্দ্রকে কখনই বাঁধা যায় না। ‘নাম জীহঁ জপি জাগহিঁ জোগী..’ এই জগতে অসংসক্ত থেকে বৈরাগ্যযুক্ত যোগী রামনামকে জপ করে জেগে থাকেন আর নাম ও রূপবিরহিত অনুপত ব্রহ্মসুখানুভূতি লাভ করেন,’ লিখছেন তুলসীদাস। তাঁর ‘রামচরিতমানস’ এ ভাবেই সেতু বেঁধেছে নির্গুণ ও সগুণ ব্রহ্মের মধ্যে। বাংলার কৃত্তিবাস ওঝার কথাও ভাবা যেতে পারে। তিরবিদ্ধ রাবণ মারা যাচ্ছেন, রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে বললেন, ‘‘আমরা তো বনেজঙ্গলে ঘুরেছি। রাজনীতির কিছু জানি না। তুমি যাও, রাবণ শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে তাঁর থেকে রাজনীতিবিদ্যা শিখে এসো।’’ মুমূর্ষু রাবণ আবার লক্ষ্মণকে শেখাবেন না, তিনি রামচন্দ্রকে ডেকে আনতে বললেন।
রাবণ কী শেখালেন রামচন্দ্রকে? ‘পরে করব বলে কোনও কাজ ফেলে রাখতে নেই। এই তো ভেবেছিলাম, মানুষের সুবিধার জন্য স্বর্গ অবধি সিঁড়ি তৈরি করে দেব, করছি-করছি করে আর হয়ে ওঠেনি।’ এ সব কৃত্তিবাসী উপদেশ সত্ত্বেও অলস বাঙালি সেই তিমিরেই রয়ে গেল।
দেব বনাম দানব যুদ্ধ তাই সব নয়। আমাদের রামায়ণী ঐতিহ্যে রামও মৃত্যুপথযাত্রী রাবণের কাছে শিক্ষা নিতে যান। ক্ষত্রিয়-চণ্ডাল আর সতী-অসতী বিভেদ যে মায়ার বিভ্রম, সে নিয়ে শিক্ষা নেন। অস্ত্রমিছিলকে যাঁরা রামনবমীর বৈশিষ্ট্য মনে করেন, তাঁরা আসলে রামচন্দ্রের ঐতিহ্যই জানেন না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy