সতর্কতা: নরেন্দ্র মোদী ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। আলিঙ্গন নয়, হৃদ্যতা বিনিময় এ বার দূর থেকে। ছবি: গেটি ইমেজেস
বিখ্যাত জমিদার শঙ্করনারায়ণ রায়চৌধুরী পরিবারের নবম-পুরুষ প্রতাপনারায়ণ রায়চৌধুরী ওরফে প্যাট আমেরিকার বস্টন শহরে তাঁর অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্টে আজ মায়ের পারলৌকিক কাজ করবেন। কিন্তু মন্ত্র লেখা ডায়েরি হাতে পুরোহিতের ভূমিকায় বসা বন্ধু অনুষ্ঠান আরম্ভ করতে পারছেন না, যত ক্ষণ না একটি বিড়াল জোগাড় হচ্ছে। বংশের রীতি, যে কোনও অনুষ্ঠানে বিড়াল বেঁধে রাখতে হবে। বহু কালের ব্যবধানে রায়চৌধুরী পরিবার ভুলে গিয়েছেন যে, এক সময় গ্রামের জমিদার বাড়িতে গণ্ডা গণ্ডা বিড়ালের উপদ্রব ছিল। যে কোনও অনুষ্ঠান শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে বিড়ালগুলো বেঁধে রাখতে হত। এই ভাবে নেহাতই প্রয়োজনের ফলে উদ্ভূত এক রীতি বারংবার অনুষ্ঠিত হতে হতে ঐতিহ্যে পরিণত হয়। তখন আর কার্যকারণ ব্যাখ্যা দরকার হয় না।
আমরা মন্দিরে প্রবেশ করি জুতো খুলে, গির্জায় লোকে জুতো পরেই ঢোকে, কিন্তু শ্রদ্ধা প্রদর্শনে মাথার টুপিটি খুলে রাখে। আবার একই দেশের দুই প্রান্তে একই ক্ষেত্রে পৃথক রীতি দেখা যায়। যেমন, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের মন্দিরে পুরুষদের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয়, অথচ উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ-বদ্রীনাথ মন্দিরে অত্যন্ত ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে পূজারি গরম জামা ও পাগড়ি পরেন। দেশ এক, ধর্মও এক, রীতি ভিন্ন ভিন্ন।
নানা জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে রয়েছে অভিবাদনের হরেক রকম প্রথা। নিউজ়িল্যান্ডের মাওরি জনজাতির মানুষ অতিথির নাকে নাক ঘষে স্বাগত জানান, ইথিয়োপিয়ায় কাঁধে কাঁধ স্পর্শ করে। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর অধিবাসী পুরুষরা পরস্পরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে অভিবাদন জানান। জাপান ও অন্যান্য কয়েকটি এশীয় দেশে ঝুঁকে অভিবাদন জানানোই রীতি, যাকে ‘বাও’ করা বলে। তাইল্যান্ডে ‘বাও’-এর মতোই দেহ ঝুঁকিয়ে হাতের তালু মাথায় চেপে ধরে, মুখে বলে ‘সাওয়াদ্দী’— এর নাম ‘ওয়ে’।
ভারতে হাতজোড় করে নমস্কার ও বড়দের পা ছুঁয়ে প্রণাম করার রীতি। আরব দেশগুলোতে পুরুষরা মহিলাদের সঙ্গে করমর্দন করেন না, তবে আলিঙ্গন ও গালে গাল ছুঁয়ে মুখে চুম্বনের শব্দ করে অভিবাদন জানান। চুম্বনে ফরাসিরা অগ্রণী ভূমিকায়। চেনা-অচেনা সব অতিথিকেই চুম্বন দান করেন তাঁরা। বাঙালিদের মধ্যে বিজয়া দশমীর বিশেষ পর্বে পুরুষদের পরস্পরকে আলিঙ্গন প্রথা আছে, যার নাম কোলাকুলি। তর্জনী ও মধ্যমা দ্বারা ‘ভি’ চিহ্ন দেখানো ছিল প্রাচীন ইউরোপে অভিবাদনের আরেক প্রথা। শোনা যায়, আগিনকোর্টের যুদ্ধে (২৫ অক্টোবর, ১৪১৫) ফরাসি সৈন্যরা ইংরেজ সৈন্যদের তিরন্দাজি রুখে দিতে তাদের তর্জনী ও মধ্যমা কেটে নেয়। যে সৈন্যরা নিজেদের বাঁচিয়ে পালাতে পেরেছিল, তারা ফরাসি সৈন্যদের কাঁচকলা দেখানোর জন্য চালু করল এই ‘ভি চিহ্ন’ অভিবাদন।
লিবেরিয়ানরা আঙুলে তুড়ি মেরে অভিবাদন করেন। তুভালুর অধিবাসীরা অতিথি যখন প্রথম বার আসেন, বা তুভালু থেকে বিদায় নেন, তাঁদের গালে নাক ঠেকিয়ে নস্যি নেওয়ার মত জোরে শোঁকেন, এর নাম ‘সোগি’।
বিশ্ব জুড়ে এই নানা অভিবাদনের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত রীতি হল করমর্দন। সব রীতির মতো করমর্দন বা হ্যান্ডশেক-এর নেপথ্যেও আছে ইতিহাস। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে অ্যাসিরিয়ার সম্রাট তৃতীয় শালমানেসার, ব্যাবিলনের শাসকের সঙ্গে সিংহাসনের অধিকার সংক্রান্ত চুক্তি করেন। উভয়ে করমর্দন করেছিলেন, অ্যাসিরিয়ান সম্রাটের সিংহাসনে এটি খোদিত হয়েছিল। তবে করমর্দনের ইতিহাস তারও আগেকার। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিসে এই প্রথার উদ্ভব, ‘ডেক্সিওসিস’ নামে যার সাক্ষ্য মেলে বার্লিনের পারগেমন মিউজ়িয়ামে সংরক্ষিত একটি সমাধি-প্রস্তর ফলকে— প্রজ্ঞার দেবী আথেনার সঙ্গে করমর্দনরত জ়িউসের স্ত্রী হেরা। মাথা ঝুঁকিয়ে অথবা অন্য ভাবে অভিবাদন না করে হাতে হাত মেলানোর এই প্রথার উদ্ভব মূলত এটি প্রমাণ করতে যে, ‘আমরা উভয়েই নিরস্ত্র, অতএব পরস্পরের বন্ধু হয়ে একত্রে আহার করতে পারি।’
কিন্তু ঠান্ডার দেশে লম্বা কোট, গাউন বা ট্রাউজ়ারের পকেটে লুকিয়ে রাখা গুপ্ত অস্ত্র বাঁ দিকেও তো থাকতে পারে? বিশেষত, বিভিন্ন প্রস্তর ফলক ও মুরালে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে বাঁ হাতে ঢাল কিম্বা বল্লম জাতীয় কিছু, ডান হাত করমর্দনে অগ্রসর। তাই কয়েকটি ইউরোপীয় যোদ্ধা সম্প্রদায় ও স্কাউটদের মধ্যে বাঁ হাতে করমর্দনের প্রথা চালু হয়, বাঁ হাতে সুরক্ষা ঢাল নেই, তা প্রমাণ করবার জন্য।
রকমফেরে করমর্দনের হরেক নাম পাই, ‘ফিস্ট বাম্প’ (পরস্পরের মুঠো স্পর্শ করা), ‘হাই ফাইভ’ (লাফিয়ে পরস্পরের হাতের করতলে তালি দেওয়া), খেলোয়াড়দের মধ্যে এটি জনপ্রিয়। এ ছাড়াও প্রাচীন কাল থেকেই জনপ্রিয় ছিল স্যালুট, টুপি খুলে অভিবাদন ইত্যাদি। কিন্তু শরীর নোয়ানো অথবা মাথার টুপি খোলায় রাজা-রাজড়াদের আত্মসম্মানে বাধত। তাই করমর্দন চালু হল, এ কথাও অনেক ইতিহাসবিদ বলেন। এখানে উভয় পক্ষ সমান সমান। কেউ ছোট কেউ বড় নেই।
অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, করমর্দনকে সপ্তদশ শতকের কোয়েকার সম্প্রদায়ই ব্যাপক ভাবে নিত্যদিনের অভিবাদন রীতিতে শামিল করেছে, পরে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে রোমে করমর্দন সংক্রান্ত নির্দেশিকা (এটিকেট ম্যানুয়াল) লিপিবদ্ধ হয়।
তিব্বতিদের মধ্যে রয়েছে অভিবাদনের এক অদ্ভুত প্রথা। তারা পরস্পরকে জিভ বার করে দেখায়। এরও নেপথ্যে আছে ইতিহাস। নবম শতকে তিব্বতে এক অত্যাচারী রাজা ছিলেন, নাম লাং দারমা। তাঁর জিভের রং ছিল কালো। লাং দারমার পুনর্জন্মে বিশ্বাসী তিব্বতিরা অতিথির জিভের স্বাভাবিক রং দেখে নিঃসংশয় হতে চান। আগন্তুকের দেহে লাং দারমার আত্মা থাকলে তার জিভের রং হবে কালো, তা না হলে অতিথি স্বাগত।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে লক্ষ করা যায়, প্রত্যেক প্রথা উদ্ভাবনের নেপথ্যে থাকে বিশেষ কোনও আর্থ-সামাজিক অথবা ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট। আলিঙ্গন, চুম্বন, করমর্দন সবই মানুষের সুবিধার্থে। আজ বিশ্ব জুড়ে অতিমারি হয়ে উঠেছে কোভিড-১৯। এই রোগ এতটাই সংক্রামক যে, মানুষকে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হচ্ছে নিরাপত্তার স্বার্থে। আলিঙ্গন-চুম্বনের তো প্রশ্নই নেই, করমর্দনের হস্ত-স্পর্শও আজ নিরাপদ নয়। খুব সম্ভবত ভারতীয় নমস্কারই হয়ে উঠবে আগামী দিনে অভিবাদনের সর্বজনীন রীতি। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ মনে আছে? সেই ‘পাঁচ ভাই একসাথ, মারছে ঘুসি খাচ্ছে ভাত/ আরও পাঁচ সাথে তার, কেমন আছেন, নমস্কার!’— করজোড়ে নমস্কারের মাধ্যমে এই ধাঁধা হয়তো এ বার ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে।
করমর্দন প্রথার ইতিহাস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, আগন্তুক অতিথির প্রতি অবিশ্বাস ও ভয় থেকেই তার উদ্ভব। সে দিক থেকে, দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু জনজাতি গোষ্ঠীর আদর্শ আমাদের শিক্ষণীয়। অতিথির অভিবাদনে তাঁরা বলেন, ‘সউবোনা’— এর আক্ষরিক অর্থ হল, ‘তোমার ভালমন্দ সব কিছু-সহ তুমি যেমনটি, আমি ঠিক তেমন ভাবেই তোমাকে গ্রহণ করলাম, আমার কাছে তুমি আদরণীয়, আমি তোমার কদর করি।’ উত্তরে অতিথি বুকে হাত দিয়ে ঝুঁকে বলবেন, ‘শিবোকা’, অর্থাৎ, ‘আমি জেনে নিশ্চিন্ত হলাম যে আমি তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য
ও আদরণীয়।’
আশ্চর্যের বিষয় হল, ইতিহাস সর্বদা বিজয়ীদের গল্প, বিজিতদের কথা সেখানে থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইতিহাসে জংলি, আদিম, বর্বর, অসভ্য ও অশিক্ষিত বিশেষণে যে সমস্ত জাতিকে অপমান করা হয়েছে, বাস্তবিক তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ‘সউবোনা’ সম্বন্ধে বিশ্ববাসী প্রথম ওয়াকিবহাল হয় ’৯০-এর দশকে, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিটার সেঞ্জ-এর লেখা ‘দ্য ফিফ্থ ডিসিপ্লিন: দি আর্ট অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব দ্য লার্নিং অর্গানাইজ়েশন’ বইয়ে। জুলু উপজাতির মানুষ কী ভাবে পরস্পরের সঙ্গে আচরণ করে ও সমস্যার সমাধান করে তার বর্ণনা দিয়েছেন পিটার। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি হাত মেলায়, জিজ্ঞেস করে, ‘হ্যালো, হাউ আর ইউ?’ কিন্তু আগন্তুক অতিথি সত্যিই কেমন আছেন, তা জানার সময় ও মানসিকতা কোনওটাই এই সম্ভাষণে থাকে না, তা নেহাতই কথার কথা। জুলুদের মধ্যে এমন হয় না। তাঁরা অতিথি অভ্যর্থনার সময় তার চোখের দিকে অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, অনুভব করতে শেখেন উল্টো দিকে থাকা মানুষটির অন্তর, তাঁর দুঃখ-বেদনা-সমস্যা। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেক ব্যক্তি ভাল হয়েই জন্মায়। বিশেষ কোনও পরিস্থিতি বা মানসিক অবস্থা তাকে খারাপ কাজ করতে বাধ্য করে। তাই, তাঁদের গোষ্ঠীতে যদি কেউ অন্যায় কাজ করে, নিয়ম হল, ওই ব্যক্তিকে গ্রামের মাঝখানে হাজির করাতে হবে এবং সমস্ত গ্রামবাসী দু’দিন ধরে ঐ অপরাধীকে ‘সাপুবন’ (তুমি ভাল মানুষ) সম্বোধন করে ক্রমাগত ও সমস্বরে তার ভাল গুণ, তার পুরনো ভাল কাজগুলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে স্মরণ করাবে, যাতে তার মধ্যে শুভবোধ জেগে ওঠে, সে আবার ঠিক পথে চালিত হয়।
মানুষকে নিয়েই তো গোষ্ঠী তথা সমাজ। জুলুদের বিশ্বাস— ‘সমাজের কাছে আমি গ্রহণীয়, আমি মানুষের ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য’— এই বোধের উপরেই নির্ভর করে আমাদের সামাজিক অস্তিত্ব। তাই তাঁদের মতে ভুল করে ফেলা ব্যক্তিটিকে ক্ষমা করে দেওয়াই উচিত।
সংস্কৃতি হল সভ্যতার চিহ্ন, তার নানা দিককে এক কথায় ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। সভ্যতা ও সংস্কৃতির মাপকাঠিতে চিরস্থায়ী বা ধ্রুবক বলে কিছু হয় না। নিয়ম মানুষের জন্য, মানুষ নিয়মের জন্য নয়। তাই বর্তমান করোনাভাইরাস পীড়িত বিশ্ব সংক্রমণের আতঙ্কে বহুলপ্রচলিত করমর্দনের রীতি বাতিল করে দিয়ে হয়তো নিয়ে আসবে আর-এক নতুন রীতি। কিন্তু যে রীতিই আসুক, মানুষ মানুষের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে, এটাই কাম্য। নিরাপত্তার খাতিরেই আপাতত বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে একে অপরের থেকে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, বিচ্ছিন্নতা যেন কোনও
ভাবে শরীরের সীমা অতিক্রম করে
মনে গিয়ে না পৌঁছয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy