Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
চেনা গল্প অচেনা মোচড়: আজ কপাল পুড়ল: মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়-এর

বেণীমাধব! আজ এত বছর পরে?

বহু বছর পর তোমার ফোন পেলাম বেণীমাধব। খুব অবাক হয়েছি। মোবাইলের ও-পারে তোমার গলা প্রথমে চিনতেই পারিনি। সময়ের ধুলো-ময়লায় চেহারা যতই বদলাক, সামনাসামনি দেখলে ঠিক চিনতে পারতাম। কিন্তু তোমার গলার স্বর?

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী।

মৃণালকান্তি সামন্ত
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

বহু বছর পর তোমার ফোন পেলাম বেণীমাধব। খুব অবাক হয়েছি। মোবাইলের ও-পারে তোমার গলা প্রথমে চিনতেই পারিনি। সময়ের ধুলো-ময়লায় চেহারা যতই বদলাক, সামনাসামনি দেখলে ঠিক চিনতে পারতাম। কিন্তু তোমার গলার স্বর? সেই কবে শুনেছি বলো তো! কত্ত বদলে গেছে! তা ছাড়া এত বছর পর যে তোমাকে মনে পড়তে পারে, এ কথা ভুলেও বিশ্বাস করতে পারিনি। স্বার্থ কেমন বালাই! কত কিছু যে সম্ভব করে দেয়! এই রে, এখনও তোমায় ‘তুমি’ বলে ফেলছি, বোধ হয় ‘আপনি’ই বলা উচিত। কিন্তু কিছুতেই তো আসছে না। ব্রিজের ধারে সন্ধেবেলায় তোমার সেই কথাটা ঘুরেফিরে সামনে ভাসছে। আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলেছিলে— ‘আপনি নয়, তুমি’, মনে পড়ে?

আচ্ছা, মাধুকে তোমার মনে আছে? আমার পরের বোন? তোমায় দেখলেই ওর ভুরু কুঁচকে যেত। তুমি চলে যাওয়ার পর বলেছিল, ‘খুব ভাল হয়েছে। ছেলেটা মোটেই ভাল না।’ সময় বুঝিয়ে দিয়েছে, ও-ই তোমায় একদম ঠিকঠাক চিনেছিল। আশ্চর্য! কোথায় যে মিলিয়ে গেল মেয়েটা! হদিশ পেলাম না। তোলপাড় করে খুঁজে বের করার লোকবল বা অর্থবল কোনওটাই আমাদের ছিল না। ফিরে এলেও অবশ্য সমস্যা কিছু কম হত না। ঘরছাড়া মেয়ের পাত্র জোগাড় করা কি কম কথা! রান্নাঘরের কোণে দু-একটা শেষ বিকেলে মা’র মুখ-লুকনো কান্না ছাড়া সারা বাড়িতে ওর জন্য কিছুই অবশিষ্ট রইল না।

আবারও এক বার এসেছিলে সুলেখাদের বাড়ি। মাঠ ভরা কাশফুল তখন। সন্ধের পুজো-প্যান্ডালের ভিড়ে দূর থেকে তোমায় লুকিয়ে দেখেছিলাম। সুলেখা ছাড়াও তোমার গা ঘেঁষে ছিল আর এক জন। ভীষণ সুন্দরী। সন্ধেকে দিন করে তোলা নিয়ন আলোকেও হারিয়ে দিয়েছিল। তোমার প্রেমিকা, বুঝেছিলামই। সুলেখার কাছ থেকে পরে জেনেছিলাম, ওকেই তুমি বিয়ে করবে। সুলেখাদের বাড়িতে আলাপ থেকে ব্রিজের ধারে লুকিয়ে দেখা করার স্মৃতি নিমেষে কান্না হয়ে উঠে এল আমার বুকে। তবে মন পুড়লেও মেনে নিয়েছিলাম, তোমার পাশে আমি নই, ওই মেয়েটাই ঠিকঠাক।

রাগ-অভিমানে নষ্ট মেয়ে হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। সত্যি সত্যিই তা হলে তোমার কিছুমাত্র এসে-যেত না, জানি। সিগারেটের ধোঁয়া আর তাপে একটুখানি নেশার মতো ব্রিজের ধারে তোমার ঠোঁট ছুঁয়েছিল আমার শরীর। তোমার কাছে এটা হয়তো বেশ একটা চালু খেলা। কিন্তু আমি ছিলাম সরল, বা বোকা, যা-ই বলো, আমার বুক তোলপাড় করা কচি মন ভুল করে তোমায় এঁকে ফেলেছিল একেবারে নিজের ভেবে। দুরুদুরু বুক আর কাঁপা-কাঁপা হাতে ভালবাসার সাদা কাগজে লিখেছিলাম প্রথম অক্ষর, আজও তা বুকের গভীরে ফসিল হয়ে আছে। সেলাই দিদিমণির চেয়ে জীবনে বেশি কিছু হয়তো হতে পারতাম, কিন্তু লড়াই করার জোশটাই তো কেড়ে নিয়েছিলে। বাকি দিনগুলোর জন্য এলোমেলো করে দিয়ে গেলে মনটাও।

বাবার শরীর ভাল যাচ্ছিল না। দোকানের কাজ ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সেলাই স্কুল চালিয়ে সংসার চলতে লাগল কোনও মতে। এই অন্ধকারের মধ্যেও জুটে গেল পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা এক ফালি সোনালি আলো। এক বিকেলে বাড়ি বয়ে এল খবরটা। এক বউ-মরা পাত্র নিজে থেকেই প্রস্তাব পাঠাল আমার জন্য। ব্লকের এগ্রিকালচার অফিসার। বয়স একটু বেশির দিকে। বড় এক ছেলে রয়েছে। তবু এমন প্রস্তাব লোভনীয় বইকী! তা ছাড়া গায়ের রং থেকে টাকাপয়সা— আমারই বা কোন দিকটা পজিটিভ?

বাবা-মা একজোট হয়ে পাত্র লুফে নিল। আমার আর আপত্তির জায়গা কোথায়? কিন্তু মন যে এক বেহিসেবি হতচ্ছাড়ার নাম। ঘুরেফিরে শুধু তোমার মুখখানা সামনে এসে দাঁড়াতে লাগল। যদিও জানি, সুলেখাদের বাড়ি থেকে পিছন ফেরার পর আমাকে বেমালুম ডিলিটই করে দিয়েছ।

প্রথম দিন থেকেই স্বামী-সন্তান সহ পুরো সংসারের দায়-দায়িত্ব কাঁধে। ছেলে বর্ধমান টাউন স্কুলে ক্লাস টেন-এর ফার্স্ট বয়। ভারী মিষ্টি নাম। আলাপচারণ। ওর মা রেখে গেছে। ছেলেটাকে এত ভালবেসে ফেললাম, নিজের রক্তের বাইরের বলে ওকে ভাবতেই পারলাম না কোনও দিন। ওরও সমস্ত কিছুই হয়ে উঠল আমি-নির্ভর। নিজের পেটের সন্তানের ভাবনা আর মনেই এল না। বরেরও আমার তুলনা হয় না। দুই আপনজন নিয়ে সংসার হয়ে উঠল একান্ত আমারই। এত সুখও আমার অপেক্ষায় ছিল! তোমার সঙ্গে সংসার হলে এমনটি পেতাম না। জৌলুসের ছটা বলো কিংবা স্টেটাস— কোনও দিকেই তোমার সঙ্গে মেলে না আমার। আন্তরিক বা মানবিকও নও তুমি। মাথা উঁচু করে বাঁচা তো দূরের কথা, করুণার পাত্রী হয়েই থাকতে হত জীবনভর। সেই হিসেবে পালিয়ে গিয়ে আমায় ঠিকঠাক মানুষের অধিকারে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছ। কৃতজ্ঞতা অবশ্যই পাওনা হয় তোমার।

আরজিকর থেকে ডাক্তারি পাশ করে জলপাইগুড়ি হাসপাতালে মেডিকাল অফিসারের চাকরি পেয়েছে আলাপ। বর রিটায়ার করল। ভাবছি আলাপের কাছেই চলে যাব দুজনে। ও ছাড়া পুরো বাড়িটাই খাঁ খাঁ করে।

তবে আলাপের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হতে পারলাম না। মোবাইলে অবশ্য সরাসরি ‘না’ বলতে পারিনি। তোমার চূড়ান্ত হিসেবি আর প্রতারক রক্ত আমার সুস্থ-সুন্দর আলাপের বংশের ধমনীতে চুঁইয়ে আসুক, মা হয়ে এ কখনও মেনে নিতে পারি!

mrinalkanti00@gmail.com

অন্য বিষয়গুলি:

Rabibashariya Phone Mrinalkanti Samonta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE