মুঙ্গেরের মামার পাশের বাড়ির বউদির বোনের ছেলে— এমন সব কুইজ-প্রশ্নের মতো সম্পর্কের লোকজন হামেশাই আসত আমাদের বাড়ি। এক দিন এক বেশ বৃদ্ধ, ঋজু ভদ্রলোক হাজির। আমরা তো তাঁকে চিনতে পারলামই না, এমনকী মা-ও ফেল। আমি মনে মনে ভাবছি, সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক পার্ট-২, আমাদের বাড়িতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন ঘর থেকে বাবা, জ্যাঠা এসে ভদ্রলোককে চিনে নিলেন। বাবাদের দূর সম্পর্কের দাদা। রিটায়ার করার পর অল্প খরচায় দেশ ঘুরে বেড়ান। কিন্তু তাঁর ক্লেম টু ফেম হচ্ছে স্বাধীনতার আগে তাঁর স্বদেশি যুগ।
আমাদের বাড়িটা চিরকাল বেশ মধ্যবিত্ত, এমনি এমনি। এ বাড়িতে কেউ না গিয়েছে শিকারে, না করেছে স্বদেশি, না কেউ পালিয়ে গিয়েছে— কিন্তু এই জ্যাঠার স্বদেশির পেডিগ্রি যা শুনলাম তাতে চোখ কপালে! ইনি সাহেব মেরেছেন। এক নয়, দুই নয়, তিন তিন জন। তাঁর স্বদেশি করার গল্প সব্বাই শুনতে চাইল। অনেক গা-ছমছমে গল্প বললেন। কী করে গা-ঢাকা দিতেন পুলিশের কাছ থেকে, কী করে অ্যাকশনের পরিকল্পনা হত! যখন বলছিলেন, ওঁর চোখ চিকচিক করছিল, গলা বুজে আসছিল।
এর পর এল সাহেব মারার গল্প। প্রস্তুতি বলতে সকালে ধুতি গুটিয়ে দৌড়, ডন-বৈঠক। রোজ। আর চলত লুকিয়ে টিপ প্র্যাকটিস। এক বার, দু-বার, আশি বার। বাজখাঁই গলায় বললেন, ‘টিপ, বুঝলি, টিপ, ওটাই আসল ছিল। টিপ মিস করলে আমার মাথাটা গরম হয়ে যেত। আমি ছিলাম পারফেকশনিস্ট। আসল সময় যদি হাত কাঁপে, তা হলে চলবে? একটা উন্মত্ততা ছিল। আমায় ওই টার্গেট ফিনিশ করতেই হবে। সে পাখি হোক বা বোতল বা সাহেব। আসলে টিপ ঠিক ঠিক লাগানোর মধ্যে নিজেকে সেলিব্রেট করার একটা ব্যাপার আছে।’ তার পর ঠিক কী কী ভাবে সাহেব তিন জনকে উনি এবং ওঁর বন্ধুরা গুলি করে মেরেছিলেন, সেই গল্প খুঁটিয়ে করতে শুরু করলেন। বুঝলাম সবার গায়ের লোম খাড়া। মন জাতীয়তাবাদে আপ্লুত।
শুধু আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। পেট গুলোতে লাগল। বুঝলাম, এত দিন পরে স্বাধীনতার সেই বুক মোচড়ানো আহ্বান আমায় উদ্বেল করে না। আমায় যা ভয়ংকর নাড়া দিচ্ছে, তা হল— আমি এমন একটা লোকের সামনে বসে রয়েছি যে খুন করেছে। সাহেবকে মারা মানে দেশের কাজ করা— এ যুক্তিতে অন্য কেউ আপ্লুত হতে পারে, আমি নয়। আমি ভিতু। একটা মানুষ চোখের সামনে মরে লুটিয়ে পড়বে আর আমি টার্গেট ডাউন করেছি বলে লাফাব, এ তো আমার ধর্ম নয়।
কয়েক বছর পর, পুজোর সময় বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানোর স্টলে গেছি অনেকে মিলে। আমি কয়েকটা পারলাম। বেশ কয়েকটা পারলাম না। ফের পরের রাউন্ড। ফেল। আবার পরের রাউন্ড। এ বার আমার নেশা চেপে গেল। সবাই বলছে, ঠাকুর দেখতে চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার রোখ চেপে গেছে, বেলুন ফাটাবই। পঞ্চম রাউন্ডে যখন মন-সংযোগ করছি, কানে ঝনাৎ করে একটা কথা এসে পড়ল— টিপ বুঝলি টিপ, ওটাই আসল ছিল। টিপ মিস করলে আমার মাথাটা গরম হয়ে যেত! আমার ভয়ে বুকটা শুকিয়ে গেল। বুঝলাম, জ্যাঠা যে বলেছিলেন নিজেকে সেলিব্রেট করার একটা ব্যাপার আছে, তা সত্যি। নিজের ভয়ংকরতাকে সেলিব্রেট করা এত উত্তেজক! আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি কি এতই খারাপ?
এর পর থেকে আর কোনও দিন বেলুন ফাটাইনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy