ঐতিহ্যস্মৃতি: অট্টালিকার সামনের দিক। উঁচু থামে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঠামো এবং ত্রিভুজাকৃতি শীর্ষদেশ। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস)
এক সময় তাঁদের জমিদারি সুনাম অর্জন করেছিল হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের প্রতি অগাধ ভালবাসার জন্য। তখন সন্ধে হলেই এই রাজ-অট্টালিকা সেজে উঠত আলোর মালায়, বাতাসে ভেসে বেড়াত গুণী শিল্পীদের তানকর্তবের রেশ। মনোমুগ্ধকর পরিবেশে নাটক মঞ্চস্থ হত দোলের সময়। বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষের পদধূলি পড়েছিল এই রাজবাড়িতে। তখন রাজবাড়ির প্রতিটি অংশে ছড়িয়ে ছিল আনন্দ, উল্লাস, রোশনাই। সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এই জমিদারবাড়ির সুনাম ছিল সর্বত্র।
আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগে গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরীর উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের নিমতিতায় নির্মিত হয় এই জমিদার বাড়ি। নিমতিতা এলাকায় চৌধুরীদের জমিদারি শুরু হয় ১৮৫৫ সাল নাগাদ। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে চৌধুরী পরিবারের উদ্যম ও প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ইটালিয়ান ধাঁচের এই স্থাপত্যকীর্তি। এই বাড়িটি ছিল পাঁচটি উঠোন এবং প্রায় দেড়শো ঘর বিশিষ্ট একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থাপত্য, যা বিশালতায় প্রায় বড় রাজপ্রাসাদেরই সমতুল্য। মুর্শিদাবাদ জেলার সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ শারদোৎসব পালিত হত এই বাড়িতেই। তাঁদের গৃহদেবতা ছিলেন গোবিন্দজিউ। তাঁর পুজো চলত সম্বৎসর। বসন্তের দোলপূর্ণিমায় রাজবাড়ি আনন্দোৎসবে ভরপুর হয়ে উঠত। আজ সে সব শুধুই ইতিহাস।
এক সময় নাটকের আঁতুড়ঘর ছিল এই নিমতিতা রাজবাড়ি। এই মঞ্চে এক সময় বহু নাটক অভিনীত হয়েছে। ১২৫ বছরেরও কিছু বেশি আগে, ১৮৯৭ সালে দ্বারকানাথ চৌধুরীর পুত্র মহেন্দ্রনারায়ণই এখানে প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু থিয়েটার রঙ্গমঞ্চ। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর উপস্থিতিতে এখানে মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আলমগীর’ নাটকটি, যেখানে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করেন স্বয়ং মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। তাঁদের প্রয়াস উদ্দীপিত করে নাট্যাচার্যকে। এর ঠিক পরের দিন ওই নাটকেই ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শিশিরকুমার ভাদুড়ী নিজেই। নবনির্মিত এই রঙ্গমঞ্চে ‘আলমগীর’ ছাড়াও মঞ্চস্থ হয় সে কালের নানা উল্লেখযোগ্য নাটক— ‘শঙ্করাচার্য’, ‘মেবার পতন’, ‘শাজাহান’, ‘রঘুবীর’, ‘রামানুজ’, ‘প্রতাপাদিত্য’ ইত্যাদি। ১৯৪৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় ভেঙে পড়ে এই বিখ্যাত রঙ্গমঞ্চ, সেই থেকেই ভাঙনের শুরু।
১৯০২ সালে নিমতিতার জমিদার বাড়িতে কলকাতার পেশাদারি থিয়েটার দল গিয়েছিলেন সে কালের জমিদারতনয় জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ উপলক্ষে। তাঁরা অভিনয় করেন ‘চৈতন্যলীলা’, ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘সাবিত্রী’। নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ নিমতিতা জমিদার বাড়িতে বসেই বহু নাটক রচনা করেন। এই রাজবাড়িতে পদধূলি পড়েছিল কালাজ্বরের ঔষধ আবিষ্কারক বাঙালি বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, মুর্শিদাবাদ জেলার তৎকালীন জেলাশাসকশিশু সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, লীলা মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, দাদাঠাকুর প্রমুখ কৃতী মানুষজনের। এমনকি এই রাজবাড়িতেই নিউ জ়িল্যান্ডের বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার ব্রায়ান ব্রেক তরুণী অপর্ণা সেনকে নিয়ে ‘মনসুন ইন ইন্ডিয়া’ নামে ফোটোস্টোরি শুট করেছিলেন তাঁর ‘লাইফ’ ম্যাগাজ়িনে স্থান দেওয়ার জন্য।
বহু বিশিষ্ট মানুষের আগমনধন্য হলেও নিমতিতার এই রাজবাড়ির কথা বহু দিন পর্যন্ত খুব বেশি মানুষ জানতে পারেননি। বাড়িটির ঐতিহ্য ইতিহাস ও বিশালতার কথা সীমাবদ্ধ ছিল সারস্বত-সমাজের মধ্যেই। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ সিনেমার মাধ্যমেই নিমতিতা রাজবাড়ি প্রচারের আলোয় আলোকিত হয়। সেই ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন উস্তাদ বিলায়েত খান সাহেব। প্রখ্যাত সানাই-বাদক বিসমিল্লাহ খান ও হিন্দুস্থানি ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী বেগম আখতার অভিনয়ও করেন ‘জলসাঘর’ সিনেমায়। এর ফলে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় নিমতিতা রাজবাড়ির।
সত্যজিৎ রায় নিমতিতা রাজবাড়িতে ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং করেছিলেন ১৯৫৭ সালে। সে যুগে তিনি ‘জলসাঘর’ সিনেমার শুটিংয়ের জন্য বহু স্থান ঘুরে, বিভিন্ন রাজবাড়ি দেখেও তাঁর পছন্দ মতো লোকেশন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বহু লোকেশন বাতিল করার পর তিনি লালগোলার এক চায়ের দোকানে শুনতে পেলেন নিমতিতা রাজবাড়ির কথা। তার পর এখানে এসে জায়গাটিকে পছন্দ করে ফেলেন। সত্যজিৎ রায় ফিরে এলেন কলকাতায়, এসে ‘জলসাঘর’ ছোটগল্পের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, “ব্যানার্জি, আমরা আমাদের শুটিং স্পট খুঁজে পেয়েছি।” সত্যজিৎ রায় শুধুই যে এখানে ‘জলসাঘর’-এর শুটিং করেছিলেন তা কিন্তু নয়, এর পর ১৯৫৯ সালে ‘দেবী’ এবং তার পর ১৯৬০ সালে ‘সমাপ্তি’ ছবির শুটিংও করেছিলেন এখানে। সত্যজিৎ রায়ের এই তিনটি ছবির ফ্রেমে আজও বেঁচে রয়েছে নদীর পার্শ্বস্থিত নিমতিতা রাজবাড়ির জৌলুস।
এই নিমতিতা রাজবাড়ির দুর্গাপুজো প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। এই বিখ্যাত পুজো সে সময় শুরু করেছিলেন দ্বারকানাথ চৌধুরী। ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসে তিনি এই পুজোর প্রচলন করেন। সে সময় এই এলাকায় তেমন কোনও পুজো ছিল না। সেই অতীতেও ১০৮টি ঢাকের বাদ্য সহযোগে ও চাঁদির ছাতা মাথায় করে গঙ্গা থেকে ঘটে জল এনে পুজোর শুভারম্ভ ঘটত। মহালয়ার দিন থেকেই গোটা এলাকায় তখন এক আনন্দোৎসবের সূচনা হত, শারদোৎসবে মেতে উঠত এলাকার সবাই। চৌধুরী বংশের বর্তমান প্রজন্ম এখন কলকাতার নাগরিক। পুজোর সময় তাঁরা ঘরে ফেরেন আনন্দ করতে। বাপ-ঠাকুরদার আমলের দুর্গোৎসব তাঁরা এখনও নিষ্ঠাভরে পালন করে চলেছেন। সেখানে নির্মিত হয় আগের মতোই একচালার প্রতিমা, একই বংশের প্রতিমাশিল্পীরা ঠাকুর তৈরি করেন। এই রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে পুজোর দিনগুলিতে একত্রিত হন নিমতিতাবাসীরা। এই স্থানে বারোয়ারি পুজোর জৌলুস ক্রমে বাড়লেও যেন আজও রাজবাড়ির প্রতিমা দর্শন না করলে নিমতিতাবাসীদের মন ভরে না।
তবে দীর্ঘশ্বাস যতই গভীর হোক, নিমতিতা রাজবাড়ির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও বৈভব আজও জীবিত। এই রাজবাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেঁচে আছে অতীতগৌরব। তবে এলাকাবাসীর দাবিকে স্বীকৃতি দিয়ে, এই ইতিহাস-বিজড়িত রাজবাড়িকে উপযুক্ত সংস্কার করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। রাজবাড়ির যে ঝাড়বাতিটি সর্বত্র আলোকিত করে রাখত বিষণ্ণতাকে দূরে ঠেলে, সেটিও আজ নিভে গেছে, হয়তো বা আর নেইও। বাইজিদের পায়ের নূপুরও আর তাল তোলে না, আতরের সুগন্ধিও মিলিয়ে গিয়েছে, রঙিন জলের ফোয়ারাও আর মনকে ভেজায় না, নিমতিতা জমিদারবাড়ির ইতিহাস ধীরে ধীরে গ্রাস করতে নদীও এগিয়ে আসছে। ‘জলসাঘর’ ছবির শেষে পুত্রশোকে যন্ত্রণাবিদ্ধ জমিদার বিশ্বম্ভর রায় ঘোড়া চালিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন নদীর দিকে। সে দিন পাওয়ার পর বিশ্বম্ভর আর উঠতে পারেননি। এই নিমতিতা রাজবাড়িও যেন ক্রমাগত ছুটে চলেছে অন্ধকার সময়ের পিঠে সওয়ার হয়ে, সময়ে সচেতন না হলে তার পরিণতিও হতে পারে মর্মান্তিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy