ছবি: কুনাল বর্মণ।
ছ
ুটির সকালের চা-টা একটু সময় নিয়ে খেতেই পছন্দ করি আমি। কলকাতার ভাড়াবাড়িতে একা-একা দিন-কাটানো গরিব ব্যাচেলর মাস্টারের ওই একটিই শৌখিনতা। আজও সেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় সদরের ঘণ্টি বাজল। বুঝতে পারলাম কে। আমার রবিবার মানে যে শ্রীহরিদাস পালেরও রবিবার, এই সরল সত্যটা খেয়াল ছিল না।
নতুন করে দু’কাপ জল চাপিয়ে দরজা খুলতে যাই। হরিদাসের মুখে এই প্রখর গ্রীষ্মেও শ্রাবণের ঘন মেঘ। কপালে গভীর ভ্রুকুটি। “আচ্ছা চন্দনদা, কোনও বাপ জেনেশুনে তার ছেলের নাম হরিদাস রাখে, বলো? যেখানে পদবি পাল!” বহু বার করা প্রশ্নটা আবারও করে হরিদাস।
হরিদাসরা শান্তিপুরের দীক্ষিত বৈষ্ণব বংশ। শুনেছি বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকেই ওদের বিরাট ব্যবসা। হরিদাস অবশ্য প্রহ্লাদকুলে দৈত্য হয়ে অখাদ্য-কুখাদ্য সবই খায়, বংশের প্রথা ভেঙে আমেরিকান কোম্পানিতে চাকরি করে। ওদের বাড়ির সব ছেলেদের নামই হরি দিয়ে। ঠাকুরদা হরিপদ, বাবা হরিচরণ। হরিদাসের নিজের নাম নিয়ে ফ্যাসাদটা শুরু হয়েছিল ভাল রেজ়াল্ট করে কলকাতা শহরের কো-এড কলেজে পড়তে এসে। হ্যান্ডসাম ও ব্রিলিয়ান্ট, এ-হেন কম্বিনেশন স্বাভাবিক ভাবেই বেশ ম্যাগনেটিক। কিন্তু হরিদাসের দুর্ভাগ্য, নাম শুনেই চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা কর্তিতকুন্তলা সহপাঠিনীরা একেবারে হেসে লুটোপুটি খেতে শুরু করল। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। এবং হরিদাসের ট্র্যাজেডিও।
হৃদয়ে হানা তরুণীদের নিদারুণ শেল ছাড়াও আরও যা কিছু সমস্যা হরিদাসের, সবেরই মূলে ঠাকুরদার রাখা ওই নাম। অন্তত ওর নিজের মতে। আসলে বেচারা একটু কবিতা-টবিতা লিখতে ভালবাসে, কিন্তু হরিদাস পাল নাম নিয়ে নাকি আর যা-ই হওয়া যাক, কবি হওয়া যায় না।
“কেন, সেই যে কী যেন একটা ছদ্মনাম নিয়েছিলি? মধুপর্ক না কী? ওই নামেই বেশ লিখছিলিও তো...” দু’কাপ চা টেবিলে রাখতে রাখতে বলি আমি।
“মধুছন্দ, মধুছন্দ। ও বাবা, সে নামের কথা আর বোলো না।”
“কেন? বেশ তো নামটা। কী সুন্দর কাব্যিক।”
“আর কাব্যিক। প্রতিজ্ঞা করেছি দাদা, ও নাম আর নয়। কবিতাও নয়।”
“খুলে বল তো, শুনি। কেমন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি যেন।”
“খুলে আর কী বলব চন্দনদা, এ সব আমার কপালেই ঘটে।”
“আহা বলই না শুনি।”
হরিদাস উদাস মুখে পা নাচায় কিছু ক্ষণ, “বেশ লিখছিলুম, জানো। তার পর... এক দিন একটা চিঠি এল।”
“চিঠি? কার? কোনও সুন্দরী কবিতাভক্ত পাঠিকার বুঝি?”
“আরে দুত্তোর পাঠিকা। শুনবে তো আগে পুরোটা।”
“আচ্ছা, আচ্ছা শুনছি। বল তুই...” ছোকরার সঙ্গে রসিকতাও করা যাচ্ছে না আজকাল। ব্যাপার সত্যিই গুরুচরণ।
একটা মোটামুটি বিখ্যাত পত্রিকার নাম করে হরিদাস।
“এক দিন, বুঝলে তো, চিঠি এল তার সম্পাদকের কাছ থেকে। প্রপার ডাকে চিঠি। খামের ওপর ইংরেজিতে আমার নাম, মানে ওই ছদ্মনামই, ভেতরে ‘প্রিয় কবি’ বলে সম্বোধন। এর আগে এক বারই ছেপেছিল ওরা আমার লেখা, সেখানে নামের বানানটা ভুল ছিল। বড় পত্রিকায় লেখা ছাপার আনন্দে নামের শেষে একটা আ-কার থাকা-না-থাকা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। গন্ডগোল যে ওখানেই পেকেছিল সে কি আর তখন বুঝেছি। চিঠিতে আহ্বান, আমার কবিতা সম্পাদকের খুব পছন্দ, শারদীয়ায় ছাপবেন, আমি যেন অমুক দিনে অমুক সময়ে ছ’-সাতটা কবিতা নিয়ে তাঁর অফিসে দেখা করি। মুখোমুখি কথাও হবে, তিনি লেখাও নিজে বেছে নেবেন।”
“গেলি?”
“গেলুম। পিওনের হাতে স্লিপ দিলুম। সে চোখ বুলিয়ে সম্পাদকের ঘরে পাঠিয়ে দিল। ঢুকে দেখি মাঝবয়সি লোক একটা, খুব সেন্ট মেখেছে, ঘরে ভুরভুর করছে গন্ধ। একাই বসে আছে, টেবিলে দু’জনের মতো চায়ের সরঞ্জাম সাজানো। নমস্কার করলুম। তিনি দেখি আমার পেছনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কাকে যেন খুঁজছেন। খানিক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললুম, ‘কবিতা আনতে বলেছিলেন শারদীয়ার জন্য, সেগুলো কি রেখে যাব না এখনই দেখবেন?’
“কেমন ভুরু কুঁচকে তাকাল, বুঝলে? লেখাগুলো নিল। তার পরে যা বলল, আমার মাথায় বজ্রাঘাত!
“বলে, ‘মধুছন্দা দেবী আসেননি?’
“‘আজ্ঞে?’
“‘কবিতাগুলো তো মধুছন্দা পালের লেখা। তাঁকেই ডাকা হয়েছিল। তিনি আসেননি? আপনার হাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন বুঝি?’
“আমি অনেক কষ্টে তুতলিয়ে বললুম, ‘আজ্ঞে, মধুছন্দা নয়, মধুছন্দ। আমার নাম। আমারই কবিতা।’
“সে যা তাকাল না, কী বলব। তার পর ফোনটায় কী সব খুটখাট করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
“‘এই মেলটা আপনারই করা?’
“দেখলুম, হ্যাঁ। মাথা নাড়লুম।
“‘এই নীচের নামটাও আপনার?’
“তখনই বুঝেছি কী হয়েছে। চিঠির বয়ান বাংলায়, কিন্তু নীচে নামটা লিখেছি ইংরিজিতে। অফিশিয়াল মেল লিখে লিখে অভ্যেস হয়ে গেছে, নাম লিখতে গেলেই ইংরিজি চলে আসে। সে এইচ পালই লিখি, আর মধুছন্দ পালই লিখি। এ বার তাকে তো মধুছন্দও পড়া যায়, মধুছন্দাও।”
“কেলেঙ্কারি। তার পর?”
“সে কী বাঘা আওয়াজ বের করল চন্দনদা, কী বলব। বলে, ‘এগুলো কবিতা হয়েছে? অ্যাঁ? কবিতা এগুলো? আপনি কোথাকার কোন হরিদাস পাল মশাই যে, যা লিখে নিয়ে আসবেন তা-ই ছাপতে হবে? আমাদের পত্রিকার একটা স্ট্যান্ডার্ড নেই?’
“আমি আর কী বলব, মিনমিন করে বললুম, ‘আজ্ঞে, অরিজিনালি শান্তিপুরের, তবে এখন রাজারহাট।’
“‘মানে?’ লোকটা তোড়ে বলে যাচ্ছিল, হকচকিয়ে থেমে গেল।
“‘মানে মধুছন্দা, ইয়ে ওই মধুছন্দ আমার ছদ্মনাম। বাপ-মায়ের দেওয়া নাম যেটা আপনি এইমাত্র বললেন।’
“এর পর আর বেশি কিছু বলার নেই। আসল নাম না জানিয়ে ছদ্মনামে লেখা পাঠিয়ে আমি যে কত বড় অন্যায় করেছি সেই নিয়ে একটা বক্তৃতা শুনতে হল, মিথ্যা পরিচয়ে লেখা পাঠানোর অপরাধে এই পত্রিকা থেকে আমাকে চিরতরে নির্বাসিত করা হচ্ছে, সে কথাও জানানো হল। আমি তবু একটু চেষ্টা করেছিলুম বলতে যে কত বড় বড় সাহিত্যিকই তো ছদ্মনামে লিখতেন, এখনও লেখেন। আমি হরিদাস পাল কী এমন দোষ করলুম? তিনি গম্ভীর গলায় সংক্ষেপে বললেন, ‘সম্পাদকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আসুন।’ হয়ে গেল।”
দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে হরিদাস।
“আচ্ছা, তোর এত সুন্দর জিম করা লম্বাচওড়া চেহারা, এত ভাল একটা চাকরি করিস, এগুলোর কোনও দাম নেই? ওই এক হরিদাস পালেই আটকে রইলি?” এই একই কথা যে কত বার বলেছি হতভাগাকে তার লেখাজোখা নেই। যদিও লাভ হয় না, তবু বলি। হাজার হোক ছোকরা আমার এক কালের ছাত্র, এখন হাফ-বন্ধু হাফ-ভাই। একটা কর্তব্য তো আছে।
“আটকাই কি সাধে? অফিসে তো এইচ পাল দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছি, আদ্ধেক লোকে জানেও না পুরো নামটা। কিন্তু কেঠো চাকরির জায়গাতেও বন্ধুবান্ধব ছাড়া কি টেকা যায়? যন্ত্র তো নই চন্দনদা।”
বান্ধব বলল বটে, কিন্তু খেদোক্তিটা যে আসলে বান্ধবী সংক্রান্ত, সে কথা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
“কারও সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতা হব-হব করলেই ওই হরিদাস পাল এসে বাগড়া দেয়। ‘সত্যি সত্যি তোমার নাম হরিদাস পাল? হি-হি।’ ফেসবুকে অবধি নিজের নামের অ্যাকাউন্টকে লোকে ভাবে ফেক।”
“তা হলে একটা ফেক নাম দিয়েই অ্যাকাউন্ট খোল এ বার।”
ইয়ার্কি করে বলা কথাটার যে এ রকম ফলাফল হবে ভাবিনি।
সত্যিই এক দিন একটা মেসেজ এল ইনবক্সে, “চন্দনদা, নতুন অ্যাকাউন্টের রিকো পাঠাচ্ছি, বাহুবলী। অ্যাকসেপ্ট করে নিয়ো।”
আমি সোশ্যল মিডিয়ায় তেমন একটা অ্যাক্টিভ নই। আছি, এই পর্যন্তই। তবু অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছিলাম। দুর্ধর্ষ একটা ছবি দিয়েছিল, আধো আলোছায়ায় খোলা গায়ে লোহালক্কড় নিয়ে ব্যায়াম করছে। গ্রিক মূর্তির মতো লাগছিল প্রায়। মনে মনে হাসলাম, এ বার আর বান্ধবীর অভাব হবে না হরিদাসের।
আজকাল বোধহয় অফিসের চাপ বেড়েছে হরির, অনেকগুলো রোববার অ্যাবসেন্ট। বেশ ক’হপ্তা পার করে যে দিন এল, বেশ গম্ভীর। যথারীতি চা-বিস্কুট নিয়ে এসে বসলাম। সে দেখি সুড়ুৎ-সুড়ুৎ চায়ে চুমুক দেয়, কুটুর-কুটুর বিস্কুটও চিবোয়, কিন্তু কথা আর বলে না।
আমারই মনে পড়ল হঠাৎ।
“হ্যাঁ রে, তুই কি নতুন অ্যাকাউন্টটা ডিঅ্যাক্টিভেট করেছিস না কি? দেখতে পাই না তো!”
হরিদাস জবাব না দিয়ে গোঁজ হয়ে বসে রইল খানিক।
“কী রে, হলটা কী তোর? মুখচোখ অমন কেন? অফিসে বসের সঙ্গে ঝামেলা? দেশের বাড়িতে সব ঠিক তো? মেসোমশাইয়ের শরীর ভাল? মাসিমা? ভুলো কুকুর? তোর বোনের বেড়াল?”
“আমায় বোধহয় এ বার সুইসাইডই করতে হবে চন্দনদা।” আমার প্রশ্নমালা অগ্রাহ্য করে যেন পারমাণবিক বোমা ফেলে হরি।
“অ্যাঁ?” আমি আঁতকে উঠি।
“হ্যাঁ। ওই একটি ফেক আইডির জন্য আমায় পুলিশে ধরবে, পাড়ার লোকে গায়ে থুতু দেবে, বাবা আমায় ত্যাজ্য করবে। করবেই।”
“কী সব বলছিস, খুলে বলবি?” আমি খুব ভাল করে লক্ষ করতে থাকি হরিদাসকে। সবই তো স্বাভাবিক লাগে। তবে?
“তুমি আমার আইডি-টা ভাল করে দেখেছিলে? ডিপি-টা?”
“হ্যাঁ, দেখেছি তো। ছবিটা সাঙ্ঘাতিক ভাল উঠেছে তোর। পুরো ফিটনেস মডেল।”
“ওই ছবিই আমার কাল হল।”
“মানে?”
“মানে আমার ইনবক্স ভরে যে কী সব মেসেজ আসতে শুরু করল ওই ডিপি দেখে, ভাবতে পারবে না। আমি নিজেও ভাবিনি কখনও।”
“কী মেসেজ? মেয়েরা প্রেম নিবেদন করছে? ভালই তো। তোর তো দুঃখ ছিল মেয়েরা পাত্তা দেয় না। পরে কেস একটু ভাল মতো জমলে না-হয় বলে দিবি যাহা বাহুবলী তাহাই হরিদাস!” আমি সুপরামর্শ দিই।
“শুধু মেয়েরা প্রেম নিবেদন করলে তো তাও এক রকম ছিল...” কী যেন বলতে গিয়ে আটকে যায় হরিদাস। মুখ ক্রমশ টকটকে লাল হয়ে ওঠে।
“প্রেম নিবেদন অবধি সহ্য করেছিলাম চন্দনদা। আমি যে সটান সোজা পথের পন্থী, তাও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলাম ইনবক্সে। কিন্তু ব্যাপারটা যে আরও কত দূর গড়াতে পারে সে আমার কল্পনাতেও ছিল না... জানো,আমার ওই মুখ আড়াল করা ওয়ার্কিং আউটের ছবি দেখে লোকে আমায় ইয়ের অফার দিচ্ছে? রেট-ফেট জিজ্ঞেস করছে!” হরিদাস বিস্কুটে একটা হিংস্র কামড় বসায়।
আমি তখনও হাঁ করেই থাকি।
“উফ চন্দনদা। আর কত ভেঙে বলব? হয় লোকে আমার সার্ভিস চাইছে, নইলে সার্ভিসের ব্যবস্থা করিয়ে দিতে বলছে।”
“কিসের সার্ভিস? এক্সারসাইজ় শেখানোর?” ছেলেটার কথা মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
“হ্যাঁ। এক্সারসাইজ়। দারুণ এক্সারসাইজ়। বিয়ে-ফিয়ে করোনি তো বুঝলাম, স্বাভাবিক ইয়ে-টিয়েও কি লোপ পেয়েছে তোমার? সোজা কথাও বুঝছ না? আরে বাবা এসকর্ট সার্ভিস। টয়বয়। শরীর ভাড়া খাটানো। বুঝেছ এ বার?” হরিদাস খিঁচিয়ে ওঠে আমার নির্বুদ্ধিতায়।
“তু-ত্তুই কী বললি?”
“অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে পালিয়েছি। তুমি ভাবো, ওই সব কথাবার্তার স্ক্রিনশট যদি কোনও রকমে পুলিশের হাতে পড়ে, আমার বাড়ির লোক জানতে পারে, আমার পাড়ার লোক শোনে, কী অবস্থাটা হবে? উফ।”
“শোন বাবা হরিদাস, এ সব ছদ্মনাম-টাম ছাড় বরং এ বার। বোঝাই তো যাচ্ছে নামের বদল তোকে সুট করছে না। প্রত্যেক বারই একটা না একটা বিড়ম্বনায় পড়ছিস। বাপ-মায়ের দেওয়া নামটা নিয়েই চল বাবা, ওর থেকেও খারাপ নাম নিয়ে তো কত জন চালিয়ে যাচ্ছে।”
“নিজের হলে বুঝতে চন্দনদা, নিজের হলে বুঝতে। বত্তিরিশ বছরের ছয়ফুটিয়া হাট্টাকাট্টা পুরুষ, চেহারা সলিড, চাকরি সলিড, রোয়াবে বাইক হাঁকাচ্ছে, তার নামখানা কী? না হরিদাস পাল।”
সেই যে নিদারুণ ক্ষুব্ধ হয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল হরিদাস, তার পর অনেক দিন আর সাড়াশব্দ নেই। প্রথমে ভাবলাম রাগ হয়েছে বুঝি। তার পর মনে হল কী জানি হয়তো শরীর-টরির খারাপ। যা দিনকাল।
কিন্তু না, ফাল্গুনের শেষাশেষি এক সোনালি রোববারের সকালে আবার চেনা সুরে দরজায় ঘণ্টি। বুঝলাম, শ্রীহরিদাসের পুনরাগমন।
হাসিমুখে দরজা খুলে আমি হাঁ।
হরিদাসই, কিন্তু তার পাশে আরও এক জন। যে-সে এক জন নয়, শাড়ি-পরা ছোট্টখাট্টো টুকটুকে মেমসাহেব এক। সোনালি চুলে আলতো ঘোমটা। গলায় তুলসীমালাও দেখলাম যেন।
“তোরা, মানে তুই...”
“হরে কৃষ্ণ...” অতি বিনীত হয়ে নমস্কার করে হরিদাস। পাশ থেকে আরেকটি মেয়েলি ‘হরেকৃষ্ণ’-ও ভেসে এল মনে হল যেন।
“অ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ। হরে কৃষ্ণ হরে রাম। জয় জয় শিবশঙ্কর। দুগ্গা-দুগ্গা।” আমি ঘেঁটে ঘ!
“বিয়েটা করেই ফেললাম চন্দনদা... কই গো, এ দিকে এসো। এই সেই চন্দনদা। আমার ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যান্ড গাইড। প্রণাম করো...” বিগলিত হাসে হরিদাস।
“আহা থাক থাক। এসো, মানে আসুন, ভেতরে আসুন। ইয়ে, গ্ল্যাড টু মিট ইউ।”
“ওকে আবার আপনি-আজ্ঞে কেন চন্দনদা?” চেয়ার টেনে বসতে-বসতে বলে হরিদাস।
মেমের নীল চোখে হাসি চিকচিক করে। আমার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে সে।
“নোমোস্কার। আমি বাংলা জানি। ইসকনে দীখশা নিয়েচি। শিরিচাইটন্যিয়াকে নিয়ে গোবেষণা করচি তো।”
“ওর নাম জেনি ম্যাকগ্রেগর, মানে ছিল। যখন ও বস্টনের ছিল আর কী। এখন তো হরিদাসী। হরিদাসী পাল।” গর্বিত হাসি দেয় হরিদাস।
“বেশ মিল হয়েছে তো তোদের নামে-নামে?” তাড়াতাড়ি টিন থেকে বিস্কুট বার করে প্লেটে রাখতে-রাখতে বলি আমি। আসলে কী যে বলব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না ঠিকঠাক।
“হরিদাস নামটা কিচ্ছু খারাপ নয়, বুঝলে চন্দনদা?”
সত্যিই, বিয়ে মানুষকে আমূল পালটে দেয়। হরি তার সাক্ষাৎ প্রমাণ। এ কথা এ জীবনে হরির মুখে শুনব বলে ভাবিনি।
“কিন্তু, তোদের আলাপটা হল কোথায়? কিছুই তো জানলাম না।”
“আরে ওই ফেসবুকেই গো। আমি তো সেই বাহুবলী কেসের পরে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম, ‘মেঘলা আকাশে একলা পাখি’। তোমাকে আর রিকো পাঠাইনি। চেনাজানা কাউকেই পাঠাইনি। নতুন আইডি, নতুন ফ্রেন্ড লিস্ট।”
“অ্যাঁ? ওটা তোর আইডি?”
“ও রকমই চলে আজকাল, তুমি খবর রাখো না। জেনি, মানে হরিদাসীর আইডি কী ছিল বলো তো? শুনলে বিশ্বাস করতে পারবে না। ‘একলা পাখির বাসা’। বুঝলে চন্দনদা, একেই বলে ডিভাইন কানেকশন, রাজযোটক, দৈবী ইশারা।”
হরিদাস উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। আমি তাড়াতাড়ি বিস্কুটের প্লেটটা হাতের নাগালে এগিয়ে দিই।
“তার পর?”
“তার পর আস্তে আস্তে আলাপ হল, ইয়ে বাড়ল। ও রিসার্চের জন্য মায়াপুরে থাকছিল। সাহায্য করার জন্য আমাকেও মাঝে মাঝেই মায়াপুর যেতে হচ্ছিল, বুঝতেই পারছ।”
“তাই তোকে এত দিন দেখিনি!”
“ওই আর কী। তার পর যা হয়। ভেবে দেখলুম যে হরিদাসের সঙ্গে হরিদাসী ছাড়া আর কিছুই মানায় না, কেউই মানায় না। তাই জয়গুরু বলে মালাবদলটা করেই ফেললুম। আর ছদ্মনাম-টামেরও চক্কর নেই, ফেক আইডিরও ঝকমারি নেই। ফেসবুকেও এখন আমি স্বনামেই জ্বলজ্বল করছি, স্টেটাস ম্যারেড। ঠাকুরদা নামটা ভালই রেখেছিলেন, আমিই আসলে এত দিন মাহাত্ম্যটা বুঝতে পারিনি। সবই গোবিন্দের ইচ্ছা চন্দনদা, সবই বিধির লিখন।”
ঢুলুঢুলু চোখে বিস্কুট কামড়ায় শ্রীহরিদাস পাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy