Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ১

মায়া প্রপঞ্চময়

অনিকেতের লক্ষ্য এখন শতাব্দী-প্রাচীন বাওবাব গাছটা। হ্যাঁ, বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’-এর গা-ছমছমে বর্ণনায় সেই দৈত্যাকার গাছ। যার নাম শুনলেই আফ্রিকার সাভানায় রাজত্ব করা সেই মহীরুহের চেহারা পাঠকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পিছনে ফিরতে আর ইচ্ছে করে না ওর।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:২৯
Share: Save:

সন্ধে হয়ে গিয়েছে বেশ কিছু ক্ষণ আগে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। কিন্তু অনিকেতের চোখের সামনে চাপ চাপ অন্ধকার। দু’পাশ থেকে গাছগুলোর ক্যানোপি এমন ভাবে আকাশটাকে ঢেকে রেখেছে যে দু’হাত দূরের জিনিসও স্পষ্ট নয়। এখন মনে হচ্ছে গার্ডের কাছ থেকে একটা টর্চ নিয়ে এলেই ভাল হত। এখন শরতের শেষ, তাই সাপখোপের ভয়টাই বেশি। এখানে ব্ল্যাকমাম্বা বা র‌্যাটলস্নেক অবশ্যই নেই, কিন্তু চন্দ্রবোড়া, গোখরো আর দাঁড়াশ নেই, একথা পাগলেও বলবে না, এত ঝোপজঙ্গল চারপাশে!

অনিকেতের লক্ষ্য এখন শতাব্দী-প্রাচীন বাওবাব গাছটা। হ্যাঁ, বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’-এর গা-ছমছমে বর্ণনায় সেই দৈত্যাকার গাছ। যার নাম শুনলেই আফ্রিকার সাভানায় রাজত্ব করা সেই মহীরুহের চেহারা পাঠকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পিছনে ফিরতে আর ইচ্ছে করে না ওর। সাপের অস্তিত্ব মাথায় রেখেই সাবধানে পা ফেলে ও। আন্দাজ করে এগোতে গিয়ে হঠাৎই সামনে সাদা কাপড় পরা একটি মেয়ে আর তার সঙ্গে বাচ্চাকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। ডান দিকে ঝিলের জলে উপর চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে, তার কিছুটা প্রতিফলন অস্পষ্ট আলোআঁধারি তৈরি করেছে। তারই অন্ধকারতর অংশ থেকে যেন হাত-ধরাধরি করে বেরিয়ে আসছে মা-মেয়ে, ওর দিকে।

এক মুহূর্তের জন্য পা’দুটো অবশ লাগে। মনে পড়ে যায় এখানে কাজে জয়েন করার পরে অরণ্যদেবের মজ বুড়োর মতো দেখতে রিটায়ার্ড মাহুত বলিরামের শোনানো গল্পটা। এখন যেখানটায় ও দাঁড়িয়ে আছে তারই বাঁদিক ঘেঁষে অনেকখানি ভাঙাচোরা ধংসস্তূপ। দিনের আলোয় ও দিকে আঙুল দেখিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলিরাম শুনিয়েছিল, ‘বড়ি চুড়েল আউর ছোটি চুড়েল কি কহানি’। অনেক দিন আগে ঠিক ওই জায়গাটাতেই ছিল হাতিদের আস্তানা। কী কারণে একটা হাতি খেপে গিয়েছিল জানা নেই, তবে শিকল ছিঁড়ে পিলখানা থেকে বেরিয়েই দেহাত থেকে ঘুরতে আসা দুর্ভাগা মা-মেয়েকে সামনে পেয়ে একসঙ্গেই পিষে ফেলে সে। অপঘাতে মৃত্যু। ‘‘উন দোনো কি নাখুশ রুহ্‌ আজ ভি শাম কে ওয়ক্ত ভটকতি রহতি হ্যায়,’’ বলেছিল বলিরাম।

একবার মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে বাস্তবের মাটিতে এনে একা একাই হোহো করে হেসে ফেলে অনিকেত। সারাদিন চাপের মধ্যে কাজ করে মাথাটা এমনিতেই ভার হয়ে আছে। তার উপর আলোআঁধারি আর অবচেতনে বসে থাকা বুড়ো মজের বর্ণনা মিলে একেবারে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে গিয়েছে। পুজোর মরসুমে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে জনসচেতনতা বাড়াতে অনিকেত নিজেই পাবলিসিটি উইং-এ ছোট-বড় কিছু ফ্লেক্স ডিসপ্লে করতে বলেছিল, ঠিক মতো না টাঙানোর জন্য একপাশ থেকে খুলে গিয়ে দুটো ফ্লেক্স ওই রকম ভীতিপ্রদ আকার নিয়েছে। তবে ও জানে ভরসন্ধ্যায় কেউ একলা এখানে আসে না। নাইটগার্ডরাও না।

ভালুকের খাঁচা ক্রস করে যাওয়ার পরে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকায় ও বুঝতে পারে যে জলহস্তীগুলো কাছাকাছিই আছে। সব চেয়ে সামনের বড়টা অর্থাৎ প্রায় দেড় টন ওজনের মদ্দাটা হাঁচির মতো শব্দ করে উঠল। সন্ধের সময় ওরা পায়চারি করতে জল থেকে ওঠে, ওই রকম কুমড়োপটাশ মার্কা শরীর নিয়ে অল্প পাল্লার দৌড়ে ঘণ্টায় তিরিশ কিলোমিটার বেগে ছুটতেও পারে। স্বভাবে তৃণভোজী হলেও ওদের ধারেকাছে যাওয়া নিরাপদ নয় মোটেই। প্রায় ফুটখানেক করে লম্বা ছোরার মতো চারটে দাঁত উপর আর নীচের মাড়িতে। সেগুলো বাগিয়ে হাঁ করে যখন তেড়ে আসে, তখন আদৌ ওরা নিরামিষাশী কি না, ঘোরতর সন্দেহ দেখা দেয়।

গাছের ছায়ায় তৈরি অন্ধকার টানেলের শেষ দিকে এসে গিয়েছে ও, চাঁদের আলোয় সামনেটা ভেসে যাচ্ছে যেন। এক পা বাড়াতেই অসময়ে বজ্রপাতের মতো গুরুগম্ভীর আওয়াজে মাটি যেন কেঁপে ওঠে। একাধিক সিংহ ডাকতে শুরু করেছে প্রায় সমস্বরে। সামনেই বাওবাব গাছটা বেখাপ্পা চেহারা নিয়ে উজ্জ্বল চন্দ্রালোকে দাঁড়িয়ে আছে। মসৃণ ত্বক, বিশাল বোতলের মতো কাণ্ড, পাতাবিহীন ডালপালা। মনে হচ্ছে গাছটাকে কোনও দৈত্য যেন শিকড়সুদ্ধ উপড়ে আবার উল্টো করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছে।

এখানে এলে, বিশেষ করে রাতে, অনিকেতের মনটা কেমন অন্যরকম হয়ে যায়, বুড়ো ছাতিমগাছটার নীচে বসার একটা জায়গাও তৈরি করিয়ে নিয়েছে। চিড়িয়াখানার মধ্যে সন্ধের পরে অন্ধকারে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে প্রায়ই বসে। ছাতিম ফুলের তীব্র গন্ধে বাতাস মাতোয়ারা হয়ে আছে। আবার সিংহগর্জনে চারপাশটা যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে। কী হল ওদের আজ আবার কে জানে ?

ক’দিন আগেই দুর্গাপুজো শেষ হয়েছে, দূর থেকে এখনও বাজি-পটকার হালকা আওয়াজ ভেসে আসছে। মেন গেট ছাড়া এই কালীপুর চিড়িয়াখানায় রাতে আলো কোথাও জ্বলে না, কোনোও শব্দও কোথাও হয় না। চিড়িয়াখানার চৌহদ্দিতে সন্ধের পরে শব্দ করা বা আলো জ্বালানো নিষেধ। এখানে সব মিলিয়ে ১০৯ প্রজাতির সাড়ে বারোশোর বেশি জীবজন্তু আছে। সারাদিন ওদের নার্ভের উপর দিয়ে প্রচুর ধকল যায়। পুজোর ক’দিনেই দু’লক্ষের বেশি মানুষের ভিড় হয়েছিল চিড়িয়াখানায়। বিজয়া দশমীর দিনেই আশি হাজারের উপর। চিৎকার-চেঁচামেচি, পায়ে-পায়ে ধুলো ওড়া, অ্যানিমাল-টিজ়িংয়ের চেষ্টা— সব মিলিয়ে রাজ্যের সব চেয়ে বড় পশুশালায় না-মানুষদের কাছে সে এক অমানুষিক বিভীষিকা! বারো মাসই তাই এখানে সন্ধের পর থেকে বারো ঘণ্টা পর্যন্ত জঙ্গলের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। যাতে পর দিনের ম্যানমেড ঝড়ঝাপটা সামলানোর জন্য ওরা নিজেদের তৈরি করার সময় পায়। অবশ্য সপ্তাহে এক দিন ওরাও ক্যাজ়ুয়াল লিভ এনজয় করে! তবে সে ছুটি কাটা যায় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত, শীতের দেড় মাস পাবলিক ডিমান্ডে সব দিন চিড়িয়াখানা খোলা থাকে। দেশের মধ্যেও অন্যতম প্রাচীন জ়ুলজিক্যাল গার্ডেন হিসাবে কালীপুর চিড়িয়াখানার পরিচিতি ও আকর্ষণ আজও অটুট। অনিকেত অধিকর্তা হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে দর্শকসংখ্যা বছরে সাড়ে তেইশ লক্ষ থেকে বেড়ে তিরিশ লক্ষ হয়েছে। ওর বিশ্বাস, এর পরও প্রতি বছরে এক-দেড় লক্ষ দর্শনার্থী বাড়ার সম্ভাবনা আছে এখানে। অতিরিক্ত ভিড়ের দিনগুলোতে বিকেল পর্যন্ত সজাগ থাকতে হয় ডিরেক্টর থেকে চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী, সবাইকেই। কখন কী ঘটে যায় কে বলতে পারে! ক্যামেরা, মোবাইল...চুরি-ছিনতাই তো আছেই, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাচ্চা হারিয়ে যাওয়া, শ্লীলতাহানির সত্য-মিথ্যা অভিযোগ, নেশাখোরদের দৌরাত্ম্যও কি নেই?

চিড়িয়াখানার বড়বাবু কথা বলার সময় প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন এবং বেশ স্মার্টলি ভুল বলেন! দশমীর দিন অনিকেতের চেম্বারে সাড়ে বারোটা নাগাদ হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ‘‘স্যর, আর পারা যাচ্ছে না। চারিদিকে খালি হ্যাচিং আর হ্যাচিং। পোর্টের পুলিশ অফিসারের মিসেসের ভ্যানিটি ব্যাগটাও হ্যাচিং হয়ে গিয়েছে একটু আগে। কমপ্লেন লেখাতে এসে কী চোটপাট, স্যর! বলে কী, ‘আপনাদের চিড়িয়াখানায় সব চোর-ডাকাত পুষে রেখেছেন, আমার ব্যাগে আইডি কার্ড, এটিএম, প্যানকার্ড সব ছিল। এখন যদি ফেরত না পাই, দেখুন আমি কী করি! আপনাদের বারোটা যদি না বাজাই...’ আচ্ছা, বলুন তো স্যর, চুরি আটকানো কি আমাদের কাজ না ওঁর হাঁসব্যান্ডের... ইয়ে মানে পুলিশের? আর উনি কি এখানে জীবজন্তু দেখতে এসেছিলেন না চাকরির ইন্টারভিউ দিতে! সব আইকার্ড নিয়ে কেউ এখানে আসে? পুলিশের গিন্নির কী আক্কেল!’’

উনি একটানা বলে দম নেওয়ার জন্য থামতে অনিকেত কিছু ভাবার বা বলার সুুযোগ পায়। এমনিতেই সে সকাল থেকে ভিড় সামলাতে ব্যস্ত ছিল। সাপের খাঁচার সামনে এত ভিড় হয়েছিল যে একটা বাচ্চা মায়ের কোল থেকে পড়ে পদপিষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সে ঝড় সামলে এখন চাপমুক্ত হয়ে অনিকেত একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারল না, ‘‘বড়বাবু, হাঁসব্যান্ড বলে কোনও ব্যান্ড নেই, ওটা কিন্তু হাজ়বেন্ড হবে আর পাখিরা তো সব খাঁচায়, তা হলে এত ডিম পাচ্ছেন কোথায় যে সর্বত্র হ্যাচিং দেখছেন! তা ছাড়া ভ্যানিটি ব্যাগ হ্যাচিং হলে সেটা ফুটে কী হাঁসজারু বের হবে বলুন দেখি? আপনি কি স্ন্যাচিং বলতে চাইছেন?’’

অবসরের মুখে আসা বয়স্ক বড়বাবু গাল ফুলিয়ে বলেন, ‘‘আমি কী বলতে চাই সেটা আপনি ভালই বোঝেন স্যর। ভদ্রমহিলার কাছে দু’হাত তুলে সেলেন্ডার হয়ে এসেছি, আমাদের ডিরেক্টরের কাছে চলুন বলে...’’

অনিকেত অগত্যা হাত উল্টে বলে, ‘‘সিলিন্ডারের গ্যাসে হল না বলে একেবারে ট্যাংকারের কাছেই নিয়ে এলেন! নিয়ে আসুুন দেখি।’’ অনিকেত এই চিড়িয়াখানার এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর। ওর ঊর্ধতন চিফ ডিরেক্টর বজ্রকিশোর রায়চৌধুরী সমস্যা সমাধানে তেমন কোনও কাজে আসেন না। ওর নীচে তিন জন জয়েন্ট ডিরেক্টর আছেন বটে, তবে তাদের কাউকে দায়িত্ব দিলে সমস্যা আরও বেড়ে ঘুরে-ফিরে সেই অনিকেতের কাছেই আসবে, তাই ঝামেলা শর্টকাট করার জন্য অনিকেত একাই ঝক্কি সামলায়।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, চুরি ছিনতাই আটকানো যে পুলিশেরই কাজ সেটা ধৈর্য ধরে অভিযোগকারিনীকে বোঝাতে পারল সে! সেমসাইড হয়ে যাওয়ায় ভদ্রমহিলার ক্ষোভ এবার তাঁর স্বামীর দিকে।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy