Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: সরস্বতীর হাঁস

তোরা শিক্ষিত? হাঁস্যকর!

আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: সরস্বতীর হাঁস

সরস্বতীর হাঁস, এখন যেমন। পালক আঁচড়ে আসতে বলায়, তেড়ে ঠোকরাতে এসেছিলেন।

সরস্বতীর হাঁস, এখন যেমন। পালক আঁচড়ে আসতে বলায়, তেড়ে ঠোকরাতে এসেছিলেন।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

প্রতিবেদক: আপনি এত রেগে রয়েছেন, এ তো অ্যাংগ্রি বার্ড-এর মতো, ‘অ্যাংগ্রি ডাক’ খেলার লোগো!

সরস্বতীর হাঁস: দ্যাখ, এমনিতেই আমি সবচেয়ে ফরসা, সুন্দর আর পড়াশোনা-জানা বলে অন্য বাহনগুলো রাতদিন টিজ করছে। তার ওপর ক’দিন আগে মদন মিত্র দুম করে শুধিয়ে বসলেন, এসএসকেএম-এর রাজহাঁসগুলোর খবর কী? ব্যস, যায় কোথায়! কেউ বলছে, কী রে, তুই আর তোর জাতভাইরা কার পয়সায় গেঁড়ি-গুগলি ভাজছিস? কেউ জিজ্ঞেস করছে, কোন ফান্ড থেকে এতখানি পালকে সাদা কলপ করছিস?

প্রতি: তা আপনাকে এতখানি র্যাগ করছে, আপনি সরস্বতীকে নালিশ করে দিন!

হাঁস: ওঁর তো ডিপ্রেশন চলছে!

প্রতি: তাই!

হাঁস: চলবে না? একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পুলিশ ডেকে ছাত্র ঠ্যাঙাচ্ছে। আবার ছাত্ররা পালটা দিতে ‘তোমার মাথায় উকুন হোক’, ‘যত্রতত্র ভিসি করিবেন না’ মার্কা বদরুচিময় হিংস্র স্লোগান লিখে তুড়ুক নাচছে। বিদ্বজ্জনে পিঠ চাপড়াচ্ছে। একটা ইস্কুলে হেডমাস্টার বলেছিলেন, নিয়ম মেনে অ্যাপ্লিকেশন ফিল-আপ করতে হবে। শুনে অভিভাবকরা তাঁকে চুল ধরে হিড়হিড় টেনে, জমিয়ে জুতোপেটা করছে। কোথাও আন্দোলন চলছে, ক্লাসে হাজিরা দেব না, কিন্তু কলেজ ইলেকশনে ভোট দেব, পরীক্ষায় তো বসবই। টুকলির অধিকার নিয়েও নিশ্চয় গার্ডকে কিলিয়ে কাঁটাল পাকানো হচ্ছে, কাল জানা যাবে।

প্রতি: সরস্বতী কি এগুলো তলিয়ে দেখেছেন? না ওপর-ওপর একটা আইডিয়া করে কনজার্ভেটিভ মনখারাপ করছেন? অনেকেই কিন্তু এই অস্থির রগচটা সময়ের মধ্যে বিপ্লব চিনতে পারছেন।

হাঁস: তলিয়ে দেখেছেন কি না জানি না, নিজে তলিয়েছেন বুঝতে পারি। আমার হয়েছে মুশকিল। আগে বলে দিতেন, এতটার সময় ওইখানে যাব, তৈরি থাকিস। বাকি সময়টা আমার মতো ভেসে বেড়াতাম। এখন কোনও মতিস্থির নেই। এক বার বলছেন, সংস্কৃত টোলে নিয়ে চল, ওখান থেকেই ফের শুরু করতে হবে। আবার তক্ষুনি হাঁউমাউ কেঁদে বলছেন, না না, আই-টি সেক্টরেই আমার আরাধনা। তার পরেই মনে হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো ঢুঁ মারতে হবে, কারণ প্রতিটি মোড়েই তো একটা করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সংখ্যাকে ইগনোর করলে চলবে না। আমার এই আচমকা ব্রেক কষে কষে আর চকিত ইউ-টার্ন নিয়ে নিয়ে ডানায় স্পন্ডি ধরে গেল!

প্রতি: তা আপনারা আসলে কী চান? ছাত্ররা শুধু মুখ বুজে নিয়ম মেনে চলবে? তারা প্রতিবাদের শিক্ষাটা পাবে না?

হাঁস: শোন, যাবৎ আমরা কাজ করে আসছি, শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানম্-কে স্টাটির্ং পয়েন্ট ধরে চলেছি। এই শ্রদ্ধা কিন্তু সিনিয়র বা কর্তাকে প্রশ্নহীন শ্রদ্ধা নয়, এর মানে নিজের কাজটার প্রতি, নিজের শাস্ত্রটার প্রতি শ্রদ্ধা। নিজের প্রতিবাদটার প্রতি যদি শ্রদ্ধা থাকে, তবে তার পথটায় লাগাতার বিষথুতুয়া অপমান আর ইতর টিটকিরির ল্যাম্পপোস্ট লাগিয়ে গন্তব্য হাসিল করার চেষ্টা চলতে পারে না। যাকে তুই বলছিস বিপ্লব, তার মধ্যে অনেকটা করে জিঘাংসা, অশালীনতা, আর ‘দ্যাখ কেমন লাগে’-র চোখ-মারা আমোদ জগমগাচ্ছে। আদর্শপরায়ণতার চেয়ে, ঠাটিয়ে থাপ্পড় মারতে পারার আনন্দটা এখানে বেশি। সেটা ভাল ঠেকছে না।

প্রতি: লক্ষ্য মহৎ হলে অমন একটু-আধটু বেনো জল ছলছলায়, মাথা ঘামালে চলে না।

হাঁস: সে-ই তো কথা। শিক্ষার সঙ্গে মাথা-ঘামানোর বিয়োগ হয়ে গেলে হাতে পড়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গ। আর, উপায় নীচ ছিল বলে এ দেশের এক নেতা মহত্তম লক্ষ্যের আন্দোলনও ফটাস করে থামিয়ে দিয়েছিলেন। সে যাক, আমি যে টগবগে ক্বাথের কথা বলছি, তা তো একটা-দুটো আন্দোলনের ডেকচিতে আটকে থাকার জিনিস নয়, উপচে পড়তে বাধ্য। প্রত্যেক দিন, রোজ, তোদের কোনও না কোনও কলেজে ছাত্র ইউনিয়নদের মধ্যে বেধড়ক্কা মারপিট। আর সেটা বন্ধুদের মধ্যে নিছক লড়াই নয়, একেবারে নৃশংস, পৈশাচিক ঝাড়! কোন কলেজে শিক্ষিকা আছেন, বিরোধী পার্টির নেতার মেয়ে। ব্যস, তাঁকে হ্যারাস করো, একটা দিনও ছেড়ো না। বিরোধী পার্টির শিক্ষককে করিডরে ক্যান্টিনে নাগাড়ে চাপা খিস্তি মেরে যাও।

প্রতি: ও, এই শাসক-পার্টির দিকে আপনার আঙুল!

হাঁস: আঙুল আমার নেই, তবে ছ্যাৎরানো পালক আছে, মাল্টি-তিরচিহ্নের মতো অনেকগুলো দিকে প্যাঁট ফোটায়। আমি খুব ভাল জানি, আজ যারা হ্যারাস্ড হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় থাকার সময় কী অসম্ভব উল্লাসে ও নৈপুণ্যে অন্য-পার্টির শিক্ষকদের হ্যারাস করত। সেই পার্টির ছাত্র সংসদের ছেলেরা অন্য দলের ছাত্র সংসদের ছেলেদের হকিস্টিক দিয়ে পেটাত, এল-সি’র গুন্ডা আনিয়ে ভোটের দিন কলেজে হিটলারি রাজ নামাত। কিন্তু তোদের তাবৎ তর্কের ছাঁচটাই হয়ে গেছে, ‘ওদের অন্যায় ভার্সাস আমাদের অন্যায়।’ ও অধম হলে তুই উত্তম হওয়ার দায় তো অনুভব করিসই না, বরঞ্চ ‘রিভেঞ্জে অধমাধম কষাব না কেন’ এই খারটাই তেজের সঙ্গে দাবড়াস। ওর নীচতাই তোর ডবল-নীচতার জাস্টিফিকেশন হয়ে দাঁড়ায়। এটাই অবিদ্যা।

প্রতি: তার মানে কী দাঁড়াল? আমাদের পড়াশোনা হবে না, কারণ আমাদের মধ্যে পলিটিক্স ঢুকে গেছে?

হাঁস: আরে, পড়াশোনা হবে না কেন? ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট হবে। আমার কথার মানে দাঁড়াল: শিক্ষার আন্দোলনকে শিক্ষিত আন্দোলন হতে হবে— এই জোয়ালটা যেই ঝেড়ে ফেলেছিস, শিক্ষা যে সত্যাশ্রয়ের জ্যোতিটা দেয়, তা থেকেও নির্বাসিত হয়ে গেছিস। যখন ছাত্র থাকবি, নীতি-ফিতির তোয়াক্কা না করে লড়াই জিতে হুর্রে মানাবি। আবার যখন টিচার হবি, ছাত্রীর যৌন নিগ্রহের কমপ্লেন লুকিয়ে ডাস্টবিনে চালান করে দিবি। অবশ্য হবে না কেন, শিক্ষাব্যবস্থা তো সমাজজীবনেরই একটা সাব-সেট। সবাই গণধোলাই এনজয় করবে, আর জুনিয়র ডাক্তাররা ধোলাই-মার্ডার করলে তোদের মনন চড়কগাছ হয়ে যাবে, এ তো হয় না।

প্রতি: ধুর, আপনার ডাক তো ‘প্যাঁক’, তারই দায়ে, গুণগুলো ওভারলুক করে, গৌণ ত্রুটিগুলো নিয়ে লাফাচ্ছেন।

হাঁস: হতে পারে। তবে কিনা, ইতিহাসগত ভাবে বঞ্চিতদের জন্য কোটা-র ব্যবস্থা করলে তোরা খাড়ুস গ্যাঁজলা তুলে ‘কী কোটা? কেন কোটা? মেরিটের ভিত্তিতে সব হবে’ চিল্লিয়ে আন্দোলন করিস, আর যেই কোনও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলে, ‘শুধু মেরিটের ভিত্তিতে ভর্তি নেব’, তক্ষুনি নিজেদের সুবিধেজনক কোটা কেন কুটে দেওয়া হল তা নিয়ে খেঁকুরে আন্দোলন শুরু করিস— এতে তোদের মূল প্রবণতাটাও অনেকটা স্পষ্ট।

প্রতি: সেটা কী?

হাঁস: সেটা হল: না-ভাবা প্র্যাকটিস। স্বার্থে চিমটি পড়লেই অটোমেটিক দুর্বিনয় ছটকে উঠছে, এর সঙ্গে মস্তানের রিফ্লেক্স অ্যাকশনের তফাত নেই। ভাবনার ব্যবচ্ছেদ-আওতায় যে নিজেকে রাখে না: অশিক্ষিত।

প্রতি: বাব্বা, আপনার চঞ্চুর ডগায় তো প্রচুর নীতিকথা!

হাঁস: হবে না? হাঁসের আর এক নাম তো ‘মরাল’!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE