সুড়ঙ্গের ভিতরে শ্রমিকেরা আটকে পড়ার কয়েক দিন পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ওয়াকিটকি। সুড়ঙ্গের ভিতরে তাঁরা কেমন অবস্থায় আছেন ওয়াকিটকির মাধ্যমে জানা যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সুড়ঙ্গের ভিতরের দৃশ্য দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। ২১ নভেম্বর প্রথম বার সুড়ঙ্গের ভিতরে ক্যামেরা পাঠানো হয়। আর তার মাধ্যমেই সুড়ঙ্গের ভিতরের দৃশ্য, শ্রমিকদের অবস্থা প্রথম প্রকাশ্যে আসে।
একটি পাইপের মধ্যে দিয়ে উঁকি মারছেন হেলমেট পরা এক শ্রমিক। সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে প্রথম এই দৃশ্যটি প্রকাশ্যে আসে। আর এই দৃশ্য প্রকাশ্যে আনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ‘এন্ডোস্কোপিক’ ক্যামেরা। আমাদের শরীরের ভিতরের কোনও অঙ্গের সমস্যা ধরতে এই ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। এ বার চিকিৎসার পাশাপাশি নয়া ভূমিকায় ব্যবহার করা হল এই চিকিৎসা সরঞ্জাম। যার জেরে আটকে থাকা শ্রমিকদের মুখদর্শন সম্ভব হল।
উত্তরকাশীর এই অভিযানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে অগার যন্ত্র। উদ্ধারকাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই চর্চায় এই খনন যন্ত্র। উত্তরকাশীর এই উদ্ধার অভিযানে এই যন্ত্রটিকে ‘সঞ্জীবনী’ বলেই মনে করছেন উদ্ধারকারীরা। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, এটি এক ধরনের ড্রিলিং মেশিন। ঘরের কাজের জন্য যে ড্রিল মেশিন ব্যবহার করা হয়, অগার হল সেই যন্ত্রের বড় রূপ।
কেমন ভাবে কাজ করে এই যন্ত্র? যেখানে ড্রিল করার প্রয়োজন সেখানে বিশাল আকৃতির এই যন্ত্রটিকে বসানোর জন্য একটি বেস তৈরি করতে হয়। যাতে ড্রিলিংয়ের সময় যন্ত্রটি কম্পনের কারণে হেলে না যায়। যন্ত্রের মধ্যে বড় বড় ধারালো মজবুত ব্লেড লাগানো থাকে। সেই ব্লেডগুলিই পাথর কেটে এগোতে থাকে। ব্লেডগুলির উপরে লাগানো পাইপও তার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকতে থাকে। যত ক্ষণ না ড্রিলিং পুরোপুরি শেষ হচ্ছে, তত ক্ষণ এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ড্রিলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই গর্তে পাইপ ঢোকাতে ঢোকাতে এগিয়ে চলে যন্ত্রটি।
কী ভাবে কাজ করে এই ‘আন্ডারওয়াটার কমিউনিকেশন সিস্টেম’? ৫০, ৯০ কিংবা ১৫০ মিটার একটি তারের সঙ্গে হাইড্রোফোন জুড়ে দেওয়া হয়। এই হাইড্রোফোন সঙ্গে নিয়ে জলের নীচে ডুবুরিরা নামেন। জলের নীচে কী ঘটছে, কী দেখতে পাচ্ছেন, তা এই ফোনের মাধ্যমে জলের উপর থাকা কন্ট্রোল রুমকে সরাসরি জানাতে পারেন। উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গের ভিতরে ওয়াকিটকির সিগন্যাল খুব দুর্বল থাকায়, উদ্ধারকারীরা এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগান।
সুড়ঙ্গের ভিতরে আটকে থাকা শ্রমিকদের ভিডিয়ো প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২১ নভেম্বর। অগার যন্ত্র দিয়ে ড্রিল করে ৬ ইঞ্চির একটি পাইপ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢোকানো হয়েছিল। তার পর সেই পাইপের মধ্যে দিয়ে ‘এন্ডোস্কোপিক ফ্লেক্সি’ ক্যামেরা পাঠিয়ে শ্রমিকদের দেখার চেষ্টা করা হয়। এবং সেই প্রক্রিয়া সফলও হয়। ওই প্রথম বার আটকে থাকা শ্রমিকদের ভিডিয়োয় দেখা যায়। এই ক্যামেরায় ‘চিপ অন টিপ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। যার ঠিক উপরে একটি এলইডি আলো লাগানো থাকে। ফলে অন্ধকারেও এই ক্যামেরায় পরিষ্কার ছবি ধরা পড়ে।
এন্ডোস্কোপিক ক্যামেরা, হাইড্রোফোন ছাড়াও শ্রমিকদের সঙ্গে অনবরত যোগাযোগ রাখতে রোবটেরও ব্যবহার করা হচ্ছে উদ্ধারকাজে। ডিআরডিওর রোবটকে সুড়ঙ্গের ভিতরের হালহকিকত পরখ করতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তাতেও সাফল্য মেলে। একটি রোবটের কাজ হল সুড়ঙ্গের ভিতরে কোন জায়গায় ড্রিল করতে হবে, তা চিহ্নিত করা। আর দ্বিতীয়টির কাজ হল, সুড়ঙ্গের ভিতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্ধারকারীদের তথ্য দেওয়া। এনএইচআইডিসিএল-এর অধির্কতা অংশ মণীশ খলখো জানিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপ এবং ভেজা মাটির কারণে রোবট সুড়ঙ্গের ভিতর ঠিক মতো নড়াচড়া করতে পারছে না।
এই কৌশলের মাধ্যমে দুর্গম জায়গাতেও ড্রোন পাঠিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি জানা সম্ভব হয়। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কোথায় পাথর, কোথায় লোহার রড রয়েছে তা চিহ্নিত করে উদ্ধারকারীদের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে। আর সেই অনুযায়ী অগার যন্ত্রের মাধ্যমে ড্রিলিং করে এগোনো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারীরা। কী ভাবে কাজ করে এই ড্রোন? উদ্ধারকারীরা জানিয়েছেন, ড্রোনের মধ্যে জিয়োফিজ়িক্যাল সেন্সর লাগানো আছে। এই সেন্সর স্ক্যান করে জানিয়ে দেয়, কোন জায়গায় পাথর, লোহার রড রয়েছে।
কিন্তু কখন ওই ৪১ জন কর্মীকে উদ্ধার করা যাবে? সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নয় প্রশাসন। শুক্রবার সকালেই উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, রাতের মধ্যে সুড়ঙ্গের ধসের বাধা পেরিয়ে বার করে আনা যাবে আটকে থাকা শ্রমিকদের। সেই মতো উদ্ধার প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে হঠাৎই উদ্ধারকারীরা জানিয়ে দেন, শুক্রবার রাতে ওই শ্রমিকদের সুড়ঙ্গ থেকে বার করে আনার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শুক্রবার রাতে এই ঘটনার খবর পাওয়ার পর ঘটনাস্থল যান মুখ্যমন্ত্রী ধামী। পরে তিনি জানান, ‘‘পরিস্থিতি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। শেষ পর্যায়ে অনেক বেশি সাবধান হতে হবে। অনেক বেশি দ্রুততার সঙ্গেও কাজ করতে হবে।’’
গত ১২ নভেম্বর উত্তরকাশী জেলার ব্রহ্মতাল-যমুনোত্রী জাতীয় সড়কের উপর সিল্কিয়ারা এবং ডন্ডালহগাঁওের মধ্যে নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গের একাংশ ধসে পড়ে। সুড়ঙ্গটি সাড়ে আট মিটার উঁচু এবং প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ। ভাঙা সুড়ঙ্গের ভিতরেই প্রায় ৬০০ মিটার ধ্বংসস্তূপের পিছনে আটকে পড়েন সুড়ঙ্গে কর্মরত ৪১ জন কর্মী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy