আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি কার্যকর করলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আসবে বড় পরিবর্তন। অনেকেরই ধারণা, এতে প্রায় ১০০ বছর পিছিয়ে যাবে দুনিয়ার অর্থনীতি। কারণ, বেছে বেছে বন্ধু বা শত্রু দেশের উপর এই ‘পারস্পরিক শুল্ক’ চাপাবেন না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সে ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন বা ডব্লিউটিও) তৈরি করা সমস্ত নিয়ম ভেঙে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনায় ক্ষতবিক্ষত হতে পারে ভারতের অর্থনীতি। ইতিমধ্যেই স্টক সূচকের রক্তক্ষরণে মিলেছে তার প্রমাণ। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রায় ২০০ পয়েন্ট পড়ে যায় সেনসেক্স। নিফটি নেমেছিল ১০০ পয়েন্ট। এ ছাড়া ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এ দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি? কোনও দেশ পণ্য আমদানির সময়ে যে কর নিয়ে থাকে আর্থিক পরিভাষায় তাকেই বলে শুল্ক। উদাহরণ হিসাবে বেনারসি শাড়ির কথা বলা যেতে পারে। আমেরিকা এটি ভারত থেকে আমদানি করে থাকে। কিন্তু, মার্কিন বাজারে প্রবেশের সময়ে এ দেশের বেনারসি শাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে কর বা শুল্ক দিতে হয়। আর সেই কারণে শুল্ক বাড়লে চড়তে থাকে আমদানি করা পণ্যের দাম।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কাঁটা হল এই শুল্ক। এর জন্যই ব্যয়বহুল হয় পণ্য। শুধু তা-ই নয়, শুল্কের জন্য শ্লথ হতে পারে ব্যবসার গতি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত বাণিজ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে বিশ্ব। কারণ শুল্কবিহীন অবাধ বাণিজ্যকে পারস্পরিক ভাবে লাভজনক বলে মনে করে বিশ্বের সমস্ত শিল্পোন্নত দেশ।
কিন্তু মুক্ত বাণিজ্য মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিকাশশীল বা উন্নয়নশীল দেশগুলির সমস্যা রয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলির পক্ষে শিল্পোন্নত দেশের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা সম্ভব নয়। মুক্ত ও অবাধ বাণিজ্য থাকলে সেখানকার বাজার কিছু দিনের মধ্যেই পুরোপুরি চলে যাবে দুনিয়ার মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশের কব্জায়। এই কথা মাথায় রেখেই পরবর্তী কালে বিশ্ব বাণিজ্যের নিয়ম তৈরি করা হয়।
১৯৪৭ সালে স্বাক্ষরিত হয় শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ চুক্তি (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ্স অ্যান্ড ট্রেড বা গ্যাট)। এর ৪৮ বছর পর (পড়ুন ১৯৯৫ সাল) আত্মপ্রকাশ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শুল্ক নীতি তৈরিতে এর বড় ভূমিকা রয়েছে। আইন তৈরির সময়ে গ্যাট ও ডব্লিউটিওর কর্তা-ব্যক্তিরা একটি বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। তা হল উন্নয়নশীল দেশগুলি এ ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা পাবে।
প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্যই এই নিয়ম চালু করে ডব্লিউটিও। সেখানে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলি (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) বিকাশশীল রাষ্ট্রের (যেমন ভারত) থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কম শুল্ক আরোপ করবে। তবে এ ক্ষেত্রে কোনও সুনির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ, উন্নত দেশ ইচ্ছা করলে এই নিয়ম না-ও মানতে পারে।
এত দিন পর্যন্ত এটিকে ধ্রুব সত্য ধরে নিয়ে চলছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। এই নিয়মে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর চড়া শুল্ক চাপিয়ে থাকে নয়াদিল্লি। ফলে ভারতের ঘরোয়া বাজারে বিদেশি পণ্য সব সময়েই বিক্রি হয় চড়া দামে। অন্য দিকে সস্তা দরে পাওয়া যায় ঘরোয়া সামগ্রী। আর এ ভাবেই দেশীয় শিল্প এবং কৃষিপণ্যকে মুক্ত বাণিজ্যের কবলে পড়ে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার থেকে রক্ষা করে আসছে নয়াদিল্লি।
কিন্তু এই নিয়মের বদল করতে চাইছেন ট্রাম্প। তাঁর বলা ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি চালু হলে, যে দেশ মার্কিন পণ্যের উপর যতটা কর নেবে, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র থেকে সম পরিমাণ আমদানি শুল্ক আদায় করবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও। অর্থাৎ, মার্কিন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত ন’শতাংশ শুল্ক নিলে আমেরিকাও এ দেশের পণ্যের উপর সমপরিমাণ, অর্থাৎ ন’শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে। বর্তমানে এর পরিমাণ মাত্র তিন শতাংশ।
ট্রাম্প একে একটা দুর্দান্ত ব্যবস্থা বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এটা হলে শুল্কের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার করা হবে। কে আমাদের পণ্যে বেশি আর কারা কম শুল্ক নেয়, সেটা আর আমাদের ভাবতে হবে না।’’ বিষয়টি কী ভাবে হিসাব করা হবে, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সূত্রের খবর, এই শুল্ক নীতির রূপরেখা তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ।
ট্রাম্পের এই ধরনের পদক্ষেপের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। নির্বাচনী প্রচারে আমেরিকাকে ফের ‘মহান’ দেশে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। কুর্সিতে বসেই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ঘাটতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন তিনি। আর তাই একের পর এক দেশের বিরুদ্ধে শুল্ক-যুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।
অন্য দিকে ঘরোয়া বাজারে মার্কিন পণ্য সস্তা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে ডলারের তুলনায় আরও দুর্বল হতে পারে টাকা। আবার এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে লাভবান হতে পারে দেশের অর্থনীতি। কারণ এর ফলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাড়বে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠতা, যা ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে সাহায্য করবে।
বিশ্লেষকদের দাবি, ট্রাম্পের ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতিতে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খাবে দেশীয় শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর স্বপ্ন। তবে এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আমেরিকার অর্থনীতিও। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই নীতির জন্য ইউরোপ-সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ ধীরে ধীরে ওয়াশিংটনের দিক থেকে ফেরাতে পারে মুখ।
বর্তমানে কম শুল্কের জন্য সাধারণ আমেরিকাবাসী সস্তা দরে বিদেশি পণ্য কিনতে পারে। ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতির হার। ট্রাম্প অবশ্য বিদেশি শিল্পপতিদের যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য উৎপাদনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ক’জন এ ব্যাপারে আগ্রহী হবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
চলতি বছরের ১৩ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা সফর করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও সেরেছেন তিনি। সেখানে দু’টি দেশই তাদের বাণিজ্য দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই অবস্থায় ওয়াশিংটনের পক্ষে নয়াদিল্লির পণ্যের উপর মোটা অঙ্কের শুল্ক চাপানো কঠিন বলেই মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy