Syria war fall of Damascus a big setback of Russia and victory for US say experts dgtl
Syria War
আমেরিকার জিত, হার রাশিয়ার! গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত সিরিয়ার ‘হট কেকে’ ছুরি চালাবে কোন কোন দেশ?
সিরিয়ার বাশার-আল-আসাদ সরকারের পতনকে অনেকেই আমেরিকার সাফল্য এবং রাশিয়ার পরাজয় হিসাবে দেখছেন। দামাস্কাস বিদ্রোহীদের দখলে যাওয়ায় ‘লাভের গুড়’ খেতে পারে ইজ়রায়েল এবং তুরস্ক।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:০৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৩
এ যেন আমেরিকার হাতে রাশিয়ার পরাজয়! পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গনে প্রতিটা চাল যেন পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের মর্জিমাফিক। আপাতত সেখান থেকে ‘ল্যাজ গুটিয়ে’ পালানো ছাড়া মস্কোর সামনে দ্বিতীয় রাস্তা খোলা নেই। ইরানের অবস্থাও তথৈবচ। অন্য দিকে, এই পরিস্থিতিতে ‘লাভের গুড়’ কতটা খাওয়া যায়, তার হিসাব কষতে শুরু করেছে ওয়াশিংটন।
০২২৩
সিরিয়ায় বাশার-আল-আসাদ সরকারের পতনকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের দাবি, বিদ্রোহীদের দামাস্কাসে ঢুকে পড়া আসলে আমেরিকারই জিত। এ বার অতি সহজেই ‘হট কেকে ছুরি চালানোর’ মতো করে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে ‘রাজত্ব’ করতে পারবে ওয়াশিংটন।
০৩২৩
শুধু তা-ই নয়, আসাদ সরকারের পতনে সিরিয়া থেকে রুশ সেনাছাউনি সরাতে বাধ্য হবে মস্কো। এত দিন ভূমধ্যসাগরের তীরে ছিল সেগুলির অবস্থান। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সিরিয়ার রুশ সেনাঘাঁটিগুলিকে সমঝে চলছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনাও। দামাস্কাসের দখল বিদ্রোহীদের হাতে যাওয়ায় সে দিক থেকেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আমেরিকা।
০৪২৩
তবে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে বিদ্রোহীরা ক্ষমতায় আসায় সবচেয়ে প্যাঁচে পড়েছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের ‘পয়লা নম্বর দুশমন’ এই শিয়া মুলুকটি এত দিন সিরিয়াকে বাফার রাষ্ট্র হিসাবে ব্যবহার করছিল। দামাস্কাসের মাটির উপর দিয়েই লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হিজ়বুল্লা’র কাছে পৌঁছচ্ছিল তেহরানের উন্নত ও সেরা হাতিয়ার।
০৫২৩
ইজ়রায়েলের একেবারে উত্তর দিকে লেবাননের অবস্থান। দীর্ঘ দিন ধরেই সেখানে হিজ়বুল্লার বাড়বাড়ন্ত রয়েছে। ইরানের মদতে প্রায়ই শিয়াপন্থী এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ইহুদিভূমিতে আক্রমণ শানিয়ে থাকে। তেহরানের হাতিয়ার আসা বন্ধ হলে সেই পরিকল্পনা থেকে পিছু হটতে হবে তাঁদের।
০৬২৩
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, সিরিয়ার সঙ্কটে পোয়া বারো হতে পারে ইজ়রায়েল এবং তুরস্কের। দুই রাষ্ট্রর কাছেই পশ্চিম এশিয়ার দেশটির বেশ কিছুটা জমি হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে এক দিকে যেমন ‘গ্রেটার ইহুদিভূমি’ তৈরির স্বপ্নপূরণের দিকে এক কদম এগোবে তেল আভিভ, অন্য দিকে তেমনই আরবে আধিপত্য বাড়বে আঙ্কারার।
০৭২৩
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা আবার দামাস্কাসের পতনকে আমেরিকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে আরব দুনিয়া থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হলেন তিনি। এর ফলে আগামী দিনে পশ্চিম এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব ওয়াশিংটন যে কয়েক গুণ বাড়িয়ে নিতে পারবে, তা বলাই বাহুল্য।
০৮২৩
২০১১ সালে প্রথম বার সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে মদত দেওয়া শুরু করে আমেরিকা। সেখানে ‘আইএস’ জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্ত রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘নেটো’ ফৌজ একাধিক বার হামলাও চালিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে সঙ্কট মেটাতে ক্রমাগত সিরিয়া বিভাজনের জিগির তুলে গিয়েছে আটলান্টিক-পারের ‘সুপার পাওয়ার’।
০৯২৩
কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকায় আসাদ সরকারের পতন ছিল একরকম অসম্ভব। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’-এর সূচনা করে মস্কো। আর ঠিক তখনই পশ্চিম এশিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপের ‘বাদামি ভালুক’কে তাড়ানোর সুবর্ণসুযোগ চলে আসে আমেরিকার হাতে।
১০২৩
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিরক্ষা কার্যালয় পেন্টাগনের পদস্থ জেনারেলরা বুঝেছিলেন হাতিয়ার সরবরাহ চালু রাখলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে ইউক্রেন দখল খুব সহজ হবে না। এই সুযোগে নেটোভুক্ত দেশ তুরস্ককে দলে টেনে আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহীদের পিছন থেকে মদত জুগিয়ে গেলে কেল্লাফতে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
১১২৩
সমর বিশেষজ্ঞদের কথায়, আসাদ সরকারের কফিনে দ্বিতীয় পেরেকটি পুঁতেছে ইরান ও হিজ়বুল্লা। গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) ৭ অক্টোবর হঠাৎ করেই ইজ়রায়েলে ঢুকে হত্যালীলা চালায় তেহরানের মদতপুষ্ট প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হামাস’। তাঁদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
১২২৩
গত বছরের অক্টোবর থেকে হামাসের গড় প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় একের পর এক হামলা চালিয়েছে ইহুদি ফৌজ। তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে আসরে নামে হিজ়বুল্লা। লেবাননের দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইরান মদতপুষ্ট ওই স্বশস্ত্র গোষ্ঠী। ফলে দ্বিতীয় মোর্চাতেও প্রত্যাঘাতের রাস্তায় হাঁটতে হয়েছে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্সকে (আইডিএফ)।
১৩২৩
যুদ্ধের মাঝেই ইহুদি গুপ্তচরেরা বুঝে যান হিজ়বুল্লাকে হাতিয়ার সরবরাহ করতে সিরিয়াকে ব্যবহার করছে ইরান। অবিলম্বে তা বন্ধ করার হুমকি দিয়ে প্রেসিডেন্ট আসাদকে সতর্ক করে তেল আভিভ। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় সেখানে বিমানহানা চালায় আইডিএফ।
১৪২৩
ইজ়রায়েলি যুদ্ধবিমানের ঝটিকা আক্রমণে বড়সড় লোকসান হয় সিরিয়ার সরকারি সেনাবাহিনীর। তাঁদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোকে নিশানা করেন বিদ্রোহীরা। গত ৫ ডিসেম্বর তাঁদের হাতে পতন হয় সামরিক দিক থেকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হামার। এর পর রাজধানী দামাস্কাসে ঢুকে পড়ে বিদ্রোহী সেনার দল।
১৫২৩
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দামাস্কাস বিদ্রোহীদের দখলে আসতেই দেশ ছেড়েছেন প্রেসিডেন্ট আসাদ। সিরিয়ার সেনাকর্তারা জানিয়েছেন, বিমানে উঠেছেন তিনি। তবে আসাদ কোথায় পালিয়েছেন, তা জানা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তিনি প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ গাজ়ি জালালি।
১৬২৩
গত ১৩ বছর ধরে চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আমেরিকার যে সমস্ত স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের দাবি, এই অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারেন আসাদ। ঠিক যেমনটা ২০১৩ ও ২০১৭ সালে করেছিলেন তিনি।
১৭২৩
আমেরিকার গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, দেশে ছেড়ে না পালিয়ে গুপ্ত রাসায়নিক অস্ত্রভান্ডারে আশ্রয় নিয়েছেন আসাদ। হাল না-ছেড়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শেষ অবলম্বন হিসাবে এ বার ওই হাতিয়ার ব্যবহার করবেন তিনি। ২০১৩ সালে তাঁর নির্দেশে হওয়া কুখ্যাত ঘৌটা রাসায়নিক হামলায় প্রাণ হারান তিন শতাধিক সাধারণ নাগরিক।
১৮২৩
২০১৭ সালের খান শেখুন রাসায়নিক আক্রমণ ছিল আরও মারাত্মক। ওই ঘটনায় নিহত কয়েকশো নিরীহ সিরিয়ান নাগরিকের একটা বড় অংশই ছিল শিশু। দু’টি ঘটনাতেই রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের প্রমাণ মিলেছে বলে স্পষ্ট করে রাষ্ট্রপুঞ্জ।
১৯২৩
দ্বিতীয়ত, জানুয়ারিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কুর্সিতে বসার পর ওয়াশিংটনের সিরিয়া নীতিতে বড় বদল দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলেছেন ট্রাম্প। আর তাতে স্বস্তি পেয়েছে মস্কো।
২০২৩
যুক্তরাষ্ট্রের হবু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ‘‘সিরিয়ার পরিস্থিতি খুব ঘাঁটা। কিন্তু ওরা আমাদের বন্ধু নয়। এই গৃহযুদ্ধে আমেরিকার কিছু করার নেই। এটা আমাদের লড়াই নয়। ওখানে যা হচ্ছে, হোক। আমরা এর মধ্যে নাক গলাব না।’’
২১২৩
অন্য দিকে, রাশিয়া ও ইরান— দু’টি দেশের তরফেই পাশে থাকার আশ্বাস পেয়েছেন ‘পলাতক’ প্রেসিডেন্ট আসাদ। বিদ্রোহীদের থেকে আলেপ্পো পুনর্দখল করতে সেখানে বিমানহানা চালিয়েছে মস্কো। পাশাপাশি দামাস্কাসের পতন বাঁচাতে ‘শিয়া মিলিশিয়া’ পাঠিয়েছে ইরান।
২২২৩
২০০০ সালের জুলাইয়ে হাফেজ় আল আসাদের মৃত্যুর পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন তাঁর পুত্র বাশার। দামাস্কাসের প্রধান সেনাপতিও (কম্যান্ডার-ইন-চিফ) তিনি। প্রথম থেকেই তাঁর মাথার উপরে রয়েছে রাশিয়ার হাত। ২০১৫ সালে আলেপ্পো হাতছাড়া হলে মস্কোর কাছে সাহায্য চান তিনি। এর পর রুশ বিমানহানাকে সম্বল করে ২০১৬ সালে আলেপ্পো পুনর্দখল করেন বাশার।
২৩২৩
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, সিরিয়ার বিদ্রোহী দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’র সঙ্গে কুখ্যাত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আল কায়দার’ দহরম মহরম রয়েছে। ফলে লম্বা সময় ধরে ওয়াশিংটনের পক্ষে তাঁদের সমর্থন করে যাওয়া এক রকম অসম্ভব। রাশিয়া সেই সুযোগ কাজে লাগালে পশ্চিম এশিয়ার মাটি যে ফের রক্তে ভিজবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।