মাছ ধরতে গিয়ে বোমা বিস্ফোরণ! মাউন্টব্যাটেনের মৃত্যুতে জাতীয় শোক পালিত হয় স্বাধীন ভারতে
তাঁর আসল নাম লুইস ফ্রান্সিস অ্যালবার্ট ভিক্টর নিকোলাস মাউন্টব্যাটেন। ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:১৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে ভারতের ইতিহাসের যোগ নিবিড়। তিনিই ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয়। তাঁর আমলেই ভারত স্বাধীন হয় এবং ঘটে দেশভাগের মতো ঘটনা। এই ব্রিটিশ অভিজাতের কর্মজীবন বিচিত্র। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর ঘটনাও কম রোমহর্ষক নয়। ৭৯ বছর বয়সে ছুটি কাটাতে গিয়ে আততায়ীদের বোমার আঘাতে মৃত্যু হয় তাঁর। কে বা কারা তাঁকে হত্যা করল? এ নিয়ে মানুষের কৌতূহল আজও অমলিন।
ছবি: সংগৃহীত।
০২১৯
তাঁর আসল নাম লুইস ফ্রান্সিস অ্যালবার্ট ভিক্টর নিকোলাস মাউন্টব্যাটেন। ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু স্বাধীনতার আড়ালে দেশ বিভাজন তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। সেই সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। দাঙ্গার জন্য তাঁকেই দায়ী করেন ভারতীয় ইতিহাসবিদদের একাংশ। হাজারো ক্ষোভ সত্ত্বেও ভারতে তাঁকে কোনও শারীরিক আক্রমণের মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু ৭৯ বছর বয়সে আততায়ীদের আক্রমণেই শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারাতে হয়েছিল এই ইংরেজ প্রশাসককে। অন্য এক ভূমির স্বাধীনতাকামী মানুষের হাতে।
ছবি: সংগৃহীত।
০৩১৯
মাউন্টব্যাটনের মা ছিলেন প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়া অফ হেস অ্যান্ড বাই রাইন। তিনি ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যা ছিলেন। আর পিতা প্রিন্স লুইস ছিলেন এক জার্মান রাজপরিবার ব্যাটনবার্গের সদস্য। তাঁদের সন্তান হওয়ার সুবাদে ব্রিটিশ এবং জার্মান, দুই রাজপরিবারের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন মাউন্টব্যাটন।
ছবি: সংগৃহীত।
০৪১৯
সম্পর্কের সুবাদে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের তুতো ভাই। ছোটবেলা থেকেই সেনাবাহিনীর কর্মপদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। যৌবনে যোগ দেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান পদেও উন্নীত হয়েছিলেন তিনি।
ছবি: সংগৃহীত।
০৫১৯
রাজপরিবারের সদস্য হলেও তাঁকে কখনই সেই পরিবারের কাছাকাছি আসতে দেওয়া হয়নি বলে শোনা যায়। তাই প্রথমে নৌবাহিনীর শীর্ষ পদে, পরে ভারতের ভাইসরয় করে পাঠানো হয়। শোনা যায়, তাঁকে রাজপরিবারের একাংশ পছন্দ করলেও অন্য অংশের নেকনজরে ছিলেন না তিনি।
ছবি: সংগৃহীত।
০৬১৯
আয়ারল্যান্ডের ক্লিফিয়া গ্রামের ক্লাসিবঙ্ক ক্যাসেলে সপরিবার ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন মাউন্টব্যাটেন। মাছ ধরার নেশা ছিল তাঁর। সেখানে গেলেই একটি ছোট বোটে করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাছ ধরতেন তিনি। সে বারও ছুটি কাটাতে এসে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন।
ছবি: সংগৃহীত।
০৭১৯
দিনটা ছিল ১৯৭৯ সালের ২৬ অগস্ট। কাছের মুলঘামোর গ্রামে মাছ ধরতে গিয়ে আবহাওয়া-জনিত সমস্যার মুখে পড়েছিলেন তিনি। সাদা এবং সবুজ রঙের যে বোটটিতে মাউন্টব্যাটেন মাছ ধরতে গিয়েছিলেন, তার নাম ছিল ‘শ্যাডো-ভি’। খারাপ আবহাওয়ায় সমস্যার কারণে মাছ ধরায় সমস্যা হওয়ায় ঠিক করেন, পরের দিন আবারও মাছ ধরতে আসবেন। তাই বোটটি সমুদ্রের কিনারায় বেঁধে রেখে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন বর্ষীয়ান মাউন্টব্যাটেন।
ছবি: সংগৃহীত।
০৮১৯
পর দিন সকালে বোটে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যান মাউন্টব্যাটেন-কন্যা প্যাট্রিসিয়া এবং তাঁর স্বামী জন। সঙ্গে ছিলেন জনের মা ডোরেন। এ ছাড়াও ছিল প্যাট্রিসিয়ার দুই যমজ ছেলে নিকোলাস আর টিমোথি। পল ম্যাক্সওয়েল নামে স্থানীয় একটি ১৫ বছরের বালক ছিল তাঁদের সঙ্গে। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ তাঁরা মাছ ধরার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
ছবি: সংগৃহীত।
০৯১৯
বেলা পৌনে ১২টা নাগাদ বোটটি খানিক এগোতেই জোরে বোমা বিস্ফোরণ হয়। ঘটনাস্থলেই তিন জনের মৃত্যু হয়। মৃতদের মধ্যেই ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ওই বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় তাঁর যমজ নাতির একজন নিকোলাস এবং স্থানীয় বালক পল ম্যাক্সওয়েলের। পরে হাসপাতালে মারা যান লর্ডের জামাতার মা ডোরেনও।
ছবি: সংগৃহীত।
১০১৯
ওই সময় ব্রিটিশ রয়্যাল সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা আধিকারিকরা কাছের রাস্তায় নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলেন। তাঁরা সেখান থেকেই মাউন্টব্যাটেনের গতিবিধির উপর নজর রাখছিলেন। বিস্ফোরণে তাঁরাও হকচকিয়ে যান।
ছবি: সংগৃহীত।
১১১৯
এ ছাড়াও আইরিশ পুলিশের গোয়েন্দা কেভিন হেনরি নিজের গাড়িতে বসেই দেখছিলেন লর্ডের বোটের গতিবিধি। কেভিন পোলিশ নামে আরও এক পুলিশ আধিকারিক দূরবিন দিয়ে বোটের উপর নজর রাখছিলেন। কিন্তু আচমকাই ঘটে বিস্ফোরণ। কাছে থাকা পর্যটকদের একটি বোট সেখানে গিয়ে উদ্ধারের কাজে হাত লাগায়। বিস্ফোরণের পর মাউন্টব্যাটেনের দেহ চেনা যাচ্ছিল না। নদীর জলে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়েছিল একটি নিথর দেহ। পরনে আটকে থাকা নীল রঙের জার্সি দেখে তাঁর মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়।
ছবি: সংগৃহীত।
১২১৯
পরে জানা যায়, আততায়ীরা ২৬-২৭ অগস্টের মধ্যবর্তী রাতে মাউন্টব্যাটেনের বোটে একটি প্যাকেট লুকিয়ে রেখে আসেন। তাঁরা কাছের কোনও একটি জায়গা থেকে নজর রাখছিলেন মাউন্টব্যাটেনের বোটের গতিবিধির উপরে। সমুদ্রে বোটটি সুবিধাজনক জায়গায় আসতেই রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে বিস্ফোরণ ঘটনা হয়। মূলত ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকার কারণেই মাউন্টব্যাটেনকে হত্যা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছিল আইরিশ রিপালিকান আর্মি (আইআরএ)।
ছবি: সংগৃহীত।
১৩১৯
আইরিশ রিপালিকান আর্মি (আইআরএ) জঙ্গি গোষ্ঠী মাউন্টব্যাটেনের হত্যার ঘটনার দায় নেয়। সঙ্গে তারা জানিয়ে দেয়, ‘‘ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে দর কষাকষি চালানো আর সম্ভব নয়। এ ভাবেই তাদের বার্তা দিলাম। তাই আমরা রাজপরিবারের এক জন সদস্যকে এ ভাবে হত্যা করলাম।’’
ছবি: সংগৃহীত।
১৪১৯
ওই দিন ব্রিটেনে আরও দু’টি বিস্ফোরণ হয়েছিল। মারা গিয়েছিলেন ১৮ জন। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি চেয়েছিল আয়ারল্যান্ডের পূর্ণ স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা আনতে এক বৃদ্ধ ও ২ শিশুকে হত্যা করতেও তাদের হাত কাঁপেনি।
ছবি: সংগৃহীত।
১৫১৯
ঘটনার পর আইরিশ রিপালিকান আর্মি (আইআরএ) নামের এই গোষ্ঠীর সদস্যদের ধড়পাকড় শুরু হয়। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের হত্যার ঘটনায় টমাস ম্যাকমাহন এবং ফ্রান্সিস নামে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। টমাসকে ১৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলেও, ফ্রান্সিসকে প্রমাণের অভাবে খালাস করে দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালে তিনি একটি ট্র্যাক্টর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
ছবি: সংগৃহীত।
১৬১৯
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এ কথা সত্যি যে, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় রাজপরিবারের সদস্যদের মতোই। টিভিতে সেই অন্ত্যেষ্টির সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। তখন সদ্য রঙিন টিভির চল শুরু হয়েছিল। সেই প্রথম বার রঙিন টিভিতে কোনও ব্যক্তির শেষকৃত্য সম্প্রচারিত হয়েছিল।
ছবি: সংগৃহীত।
১৭১৯
সেই সময় ভারতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছিল। মাউন্টব্যাটেনের প্রয়াণে সাত দিনের জন্য ভারতে জাতীয় শোক পালন করা হয়েছিল।
ছবি: সংগৃহীত।
১৮১৯
আয়ারল্যান্ডকে এক করতে করে চেয়ে আইরিশ রিপালিকান আর্মি (আইআরএ) তাদের আন্দোলন শুরু করে। পরে সেই আন্দোলনই জঙ্গি চেহারা নেয়। তারা ইংল্যান্ডে কয়েকটি হামলার ঘটনাও ঘটিয়েছিল।
ছবি: সংগৃহীত।
১৯১৯
দুই আয়ারল্যান্ডকে এক করে স্বাধীনতা লাভের দাবিতে আইরিশ জঙ্গিরা তাঁর ওপর হামলা চালাতে পারে, এমন সতর্কবার্তা পুলিশ ও প্রশাসনের তরফে মাউন্টব্যাটেনকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে বিশেষ আমল দেননি তিনি। সেই সাবধানবাণীই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়।