ব্রাজিলের ঘরবাড়ি, সংস্কৃতি, খাবারদাবার— কোনও কিছুর সঙ্গেই ভারতের বিরাট কোনও মিল নেই। কিন্তু, মাঝখানে এত সাগর-দেশ থাকা সত্ত্বেও, কিছু কিছু জায়গায় সাও পাওলো আর কলকাতার মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। এই দুই শহরের মানুষই খুব আন্তরিক। কথায় বলে, সাও পাওলোর মানুষ ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ মিনিটে পরকে আপন করে নিতে পারে। কলকাতায় এসে ঠিক একই রকম আতিথ্য পেয়েছি আমি। কোনও বাড়িতে প্রথম বার যদি দু’মিনিটের জন্যও যাই, একটু জলখাবার না খাইয়ে, বাড়ির খোঁজখবর না নিয়ে কিছুতে ছাড়বেই না! যেন তারা আমায় কত দিন ধরে চেনে!
তবে এমনিতেও আমার এখানে নিজেকে বিদেশি মনে হওয়ার কথাই তো নয়! সেটা ফুটবল বিশ্বকাপের সময় বোঝা যায়। প্রত্যেক পাড়া, প্রত্যেকটা বাড়ি ব্রাজিলের সাপোর্টার! ক্লাবে ক্লাবে ব্রাজিলের পতাকা উড়ছে! বোধহয় কেউ ব্রাজিলকে সাপোর্ট না করলে তাকে তক্ষুনি একঘরে করে দেওয়া হবে! অবশ্য আর্জেন্টিনাও এখানে খুবই জনপ্রিয়, তবুও ব্রাজিলের দিকেই যে টানটা বেশি, সে আমি বেশ বুঝতে পারি। তাই টিভিতে যখন খেলা দেখতে বসি, আশপাশের প্রচণ্ড হইহই ও ব্রাজিলের জন্য গলা-ফাটানো উল্লাস শুনে ও দেখে মনে হয়, একদম আমার বাড়িতেই রয়েছি! এই যে লাতিন আমেরিকার ফুটবল ঘরানাকে এতটা পাগলের মতো ভালবাসে বাংলার লোকজন— খেলায় শক্তির, পেশির প্রদর্শনের চেয়ে স্কিলকে, কারুকাজকে এত সম্মান দেয়, তাতেই আমার মনে হয় আপনজনের মধ্যেই রয়েছি।
ব্রাজিলের বিখ্যাত গ্রেমিয়ো অ্যাকাডেমিতে অনেক দিনই ছিলাম আমি। ক্লাব ফুটবলও খেলেছি। তার পর দেশের বাইরে বেরোলাম। জাপানে খেলেছি খুব। মালয়েশিয়ায় খেললাম, ভারতের আর একটা শহর মুম্বইতেও খেললাম। আর তার পর কলকাতা এসে, একেবারে মায়ার বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেলাম। এমন তো আর কোথাও দেখিনি। আর কোথাও যেতেই পারলাম না।
এই শহর আমাকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। এখানে এসেই আমি ‘সবুজ তোতা’ হয়েছি। আমার নামে ফ্যান ক্লাব হয়েছে। কী হইচই করে আমার জন্মদিন পালন করেন সমর্থকরা! আমার বুক ভরে যায়। এর দাম আমি কখনওই চোকাতে পারব না, কিন্তু প্রতিদানে কিছু একটা করতে চাই এই শহরের মানুষের জন্য। গোয়াতে আমি আর বেটো মিলে একটা ফুটবল অ্যাকাডেমি করেছি। কলকাতাতেও করার খুব ইচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে একটা, জায়গাই তো পাচ্ছি না।
আমি তো মোহনবাগানের ছেলে। যদ্দিন এই শহরে রইলাম, বেশির ভাগ সময়টাই কাটিয়েছি সবুজ-মেরুন তাঁবুতে। প্রচুর বন্ধু হয়েছে আমার ময়দানে। তাদের সঙ্গে আড্ডা-খানাপিনা চলে খুব। এই খানাপিনার সময় অবশ্য আমি ইস্টবেঙ্গল। মানে, ইলিশ মাছ ভাজা আমার হট ফেভারিট।
আর আমার ফেভারিট হচ্ছে থ্রিলার, ডিটেকটিভ সিনেমা। দেখতে দেখতে আমার গায়ে কাঁটা দেয়! এমনিতে ইংরেজি আর হিন্দি সিনেমাই দেখি। বাংলা সিনেমা দেখে তো বুঝতেও পারব না ডায়ালগ-গুলো। কিন্তু বন্ধুদের কাছে শুনি, বাংলায় নাকি এখন দারুণ দারুণ সব থ্রিলার সিনেমা হচ্ছে। সেগুলোর ইংরেজি সাবটাইটেল দেওয়া ডিভিডি পাওয়া যায়। হয়তো দেখে তার নেশায় পড়ে যাব! বাংলা আরও একটা ভালবাসার জিনিস আমার দিকে বাড়িয়ে দেবে!
আর, বাংলার গানে মজে গেছি আমি। এগুলোরও কথা বুঝতে পারি না অবশ্য। তাতে কী! এ সব গানের সুর এত সুন্দর! আরে বাবা, আমরা তো রিদ্ম-এর দেশের লোক। যদি ঠিক-ঠিক তাল পাই, ঝলমলে সুর থাকে, আমাদের রক্তে তার স্বীকৃতি আছে, তার মজা শুষে নেওয়ার পুরো ক্ষমতা আছে।
বাংলার মানুষের আর একটা বড় গুণ আমার চোখ ও মন টেনেছে। এখানে মনীষীদের খুব সম্মান দেওয়া হয়। তাঁদের মূর্তিগুলো এখানে প্রায়ই সাজানো হয়। হয়তো বিশেষ বিশেষ দিন সেগুলো। জানা নেই ঠিক। তেমনই সবাইকে চিনতেও পারি না। তবে, নেতাজি, টেগোর, বিবেকানন্দর ছবি বা মূর্তি দেখলে চিনতে পারি। এই মানুষগুলোর প্রতি বাঙালির শ্রদ্ধা দেখে, নিজেকেও শিখিয়েছি, বড় বড় মানুষকে কী ভাবে শ্রদ্ধা করতে হয়।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy