তরুণ সৌরদীপ
৯৬ বছর আগে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে যাঁরা এ দেশে সাদরে বরণ করেছিলেন, তাঁদের পুরোভাগে ছিলেন বাঙালিরা।
আর একশো বছর পর আইনস্টাইনের সেই আপেক্ষিকতাবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতে যাঁরা বিজ্ঞান সাধনায় মগ্ন, তাঁদের মধ্যেও প্রথম সারিতে রয়েছেন এক ঝাঁক উজ্জ্বল বাঙালি ব্যাক্তিত্বই।
তাঁদের কেউ পদবি বর্জন করেছেন। কেউ রয়েছেন পুণে বা বেঙ্গালুরুতে, কেউ-বা রয়েছেন মুম্বই, আমদাবাদ, কলকাতা বা নৈনিতালে। যে যে নামেই থাকুন, যে যেখানেই থাকুন, সেই সব কৃতী বাঙালি যে ‘গঙ্গোত্রী’তে গিয়ে মিশেছেন, তার নাম- সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ। বা, বৃহত্তর অর্থে, তাঁদের সকলকেই একই ঘাটে মিলিয়ে দিয়েছেন আইনস্টাইন। যেন তিনি নিজেই সেই ‘স্ট্রং গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ’ বা অত্যন্ত শক্তিশালী মহাকর্ষীয় তরঙ্গ! যে ক্ষেত্রে তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এখনও ‘অকেজো’, কিছুটা অর্থহীনও!
মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশের সেই উত্তরসূরিরা এ দেশে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে চলেছেন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে। আইনস্টাইনের যুগান্তকারী তত্ত্ব দিয়ে যাতে ব্র্হ্মাণ্ডের সব কিছুকেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়, সেই তাগিদে।
সেই প্রেক্ষিতেই বাঙালি বিজ্ঞানীদের অন্যতম লক্ষ্য আপাতত, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা ‘গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ’কে সরাসরি চাক্ষুষ করা। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদই ওই তরঙ্গের কথা বলেছিল। ঘটনাচক্রে, যে প্রকল্পের কর্ণধার এক জন বাঙালি মহাকাশবিজ্ঞানী। বেঙ্গালুরুতে ‘আয়ুকা’র আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহাকাশবিজ্ঞানী তরুণ সৌরদীপ (ঘোষ)।
সেই তরঙ্গ এ বার ভারতে বসেই কয়েক বছরের মধ্যে দেখা সম্ভব হতে পারে বলে আশা করছেন আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে গবেষণারত পুরোধা বাঙালি বিজ্ঞানীদের অন্যতম, পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (আয়ুকা) অধিকর্তা সোমক রায়চৌধুরীও।
একটা পুকুরে বড় ঢিল ফেললে যেমন বড় তরঙ্গের সৃষ্টি হয় আর তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে পুকুরের পারে পৌঁছে যায়, মহা-বিস্ফোরণ বা ‘বিগ ব্যাং’-এর পরেও তেমনই অত্যন্ত শক্তিশালী একটি তরঙ্গের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ১৪০০ কোটি বছর আগে। সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এখনও রয়েছে ব্র্হ্মাণ্ডে। যেহেতু ব্রহ্মাণ্ড এখনও বেড়ে চলেছে আড়ে ও বহরে, তাই সেই তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে আরও দূরে, বহু দূরে।
সৌমিত্র সেনগুপ্ত ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়
সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে এই তরঙ্গের কথা বলা হলেও এখনও তাকে সরাসরি দেখা যায়নি। মহাকাশে ঘুরতে ঘুরতে দু’টি পালসারের কক্ষপথ কী ভাবে একে অন্যের কাছাকাছি চলে আসে, কোন জোরালো টানে, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে সত্তরের দশকে পরোক্ষে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। তার জন্য দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাল্স ও টেলরকে নব্বইয়ের দশকে দেওয়া হয় নোবেল পুরস্কার।
যাতে ভারতে বসেই প্রথম চাক্ষুষ করা যায় সেই তরঙ্গ, ব্রহ্মাণ্ডের কোন দিক থেকে সেটা আসছে, তা যাতে বুঝতে পারা যায়, সে জন্য এ দেশে বাঙালি বিজ্ঞানীরাই নিয়েছেন মূল উদ্যোগ। আমেরিকার সহযোগিতায় হাজার কোটি টাকার সেই ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর, ‘আয়ুকা’র আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহাকাশবিজ্ঞানী তরুণ সৌরদীপ জানাচ্ছেন, ‘‘মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে দেখার জন্য চার কিলোমিটার লম্বা ‘লাইগো-ডিটেক্টর’ বসানো হবে ভারতে। তার জন্য প্রাথমিক ভাবে রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও মধ্যপ্রদেশে কয়েকটি জায়গা বাছা হয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। প্রকল্পে জড়িত রয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্লাজমা রিসার্চ ও রাজা রামান্না সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড টেকনোলজিও।’’
আপেক্ষিকতাবাদের শতবর্ষে মহাকাশবিজ্ঞানের চালু ‘হট বিগ ব্যাং’ মডেল নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। তরুণবাবুর কথায়, ‘‘এত দিন ধারণা ছিল, ‘বিগ ব্যাং’-এর পর ব্রহ্মাণ্ড হঠাৎই বেলুনের মতো ফুলে-ফেঁপে উঠে (ইনফ্লেশন) সব দিকে সমান ভাবে প্রসারিত হতে শুরু করেছিল। এখনও সেটাই হয়ে চলেছে। আর সেই সময়েই প্রচণ্ড শক্তিশালী মহাজাগতিক বিকিরণের (কসমিক মাইক্রোওয়েভ বা সিএমবি) জন্ম হয়েছিল। সেই বিকিরণ এখনও ছড়িয়ে রয়েছে গোটা ব্রহ্মাণ্ডে। এত দিন ধারণা ছিল, সেই বিকিরণের বাড়া-কমাটাও (ফ্লাকচুয়েশন্স) ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই সমান ভাবে হয়ে চলেছে। কিন্তু খুব সম্প্রতি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ‘প্ল্যাঙ্ক’ উপগ্রহের পাঠানো তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন অংশে সেই বিকিরণের বাড়া-কমারও তারতম্য রয়েছে। কোনও দিকে একটু বেশি (সাত শতাংশ) বাড়ছে। কোনও দিকে একটু কম (সাত শতাংশ)। এই ‘হেমি-স্ফেরিক্যাল অ্যাসিমেট্রি’ কিছুটা হলেও মহাকাশবিজ্ঞানের চালু মডেলকে ধাক্কা দিয়েছে। এর ফলে, এখন মনে হচ্ছে, জন্মের পর ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও কোথাও সাম্য ছিল না। যাকে বলে ‘সিমেট্রিক ব্রেক ডাউন’। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে যার সমর্থন মেলেনি।’’
পুণের ‘আয়ুকা’র অধিকর্তা সোমক রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘দুটো ব্ল্যাক হোলের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হলে বোঝা যায়, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জোরালো টানেই তা হয়েছে। কিন্তু ব্ল্যাক হোল থেকে আলো বেরিয়ে আসে না বলে সেই তরঙ্গ দেখা যায় না। তাই ভারতে কয়েক জন বাঙালি বিজ্ঞানী পালসার ও নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সঙঘর্ষের মাধ্যমে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে দেখার চেষ্টা করছেন। কারণ, সেই সঙ্ঘর্ষে নিউট্রন নক্ষত্র ভাঙলে আলো বেরিয়ে আসবে। আবার সেই নক্ষত্রের কণা বা পদার্থ ব্ল্যাক হোলে পড়ে যাওয়ার সময় এক্স-রে বা রেডিও তরঙ্গও পাওয়া যাবে। তার ফলে ‘মাল্টি-মেসেঞ্জার অ্যাস্ট্রোনমি’র মাধ্যমে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যাবে।’’
সোমক রায়চৌধুরী বিমান নাথ
সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গবেষণায় মগ্ন রয়েছেন কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সেসে’র অ্যাকাডেমিক ডিন, বিশিষ্ট পদার্থতত্ত্ববিদ সৌমিত্র সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ সময়কে সঙ্গে নিয়ে এই ব্রহ্মাণ্ডের মোট চারটি তলের (ডাইমেনশন) কথা বলেছিল। কিন্তু অধ্যাপক অশোক সেন ও আরও কয়েক জন বাঙালি বিজ্ঞানী মূলত যা নিয়ে গবেষণা করছেন, সেই ‘স্ট্রিং থিয়োরি’ এই ব্রহ্মাণ্ডের আরও অন্তত ছ’টি তলের পূর্বাভাস দিয়েছে। আমার গবেষণার অন্যতম দিকটি হল, সেই বাড়তি তলের সন্ধান। যে তলে প্রোটনের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাও ব্ল্যাক হোল তৈরি করতে পারে। সেই ‘মাইক্রোস্কোপিক ব্ল্যাক হোল’ই গুচ্ছ গুচ্ছ ফোটন বা আলোক-কণার জন্ম দেবে। তাতে সেই তলগুলিকেও বোঝা সহজতর হবে। সৌরমণ্ডলের মতো ব্রহ্মাণ্ডে দুর্বল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ রয়েছে যেখানে-যেখানে, এখনও পর্যন্ত সেখানেই সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের নিয়মকানুনগুলি ঠিকঠাক খাটছে বলে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের খুব কাছাকাছি জায়গায়, যেখানে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের টান অসম্ভব রকমের জোরালো, সেখানেও আপেক্ষিকতাবাদকে খাপ খাওয়ানো যায় কি না, সেটা আমার গবেষণার আরও একটি লক্ষ্য। আপেক্ষিকতাবাদ যা কখনও বলেনি, সেই ব্রহ্মাণ্ডের যে জলের মতো ঘূর্ণিও (টর্শন) রয়েছে, সেটাও আমার গবেষণার অন্যতম বিষয়বস্তু।’’
সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাধনায় মগ্নপ্রাণ নৈনিতালের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এরিস’-এর অধ্যাপক ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায় ও বেঙ্গালুরুর রাজা রামন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বিমান নাথ জানাচ্ছেন, ‘‘আমাদের গবেষণা মূলত ব্ল্যাক হোলের চার পাশে চৌম্বক ক্ষেত্রের চেহারাটা কেমন হয়, তার তল্লাশ করা। প্রায় সর্বত্রই এই কাজটা করা হয় আপেক্ষিকতাবাদের সমীকরণগুলিকে ‘বেয়াড়া’ গ্যাসগুলির ওপর চাপিয়ে। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের চার পাশে যে গ্যাসগুলি আপেক্ষিকতাবাদের সমীকরণ মেনে চলে, আমরা সেগুলিকেই এ ব্যাপারে কাজে লাগাতে চাইছি।’’
গঙ্গার প্রবাহের ওপর গঙ্গোত্রীর বাঁচা-মরা নির্ভর করে না!
আর সেই ‘গঙ্গোত্রী’র নাম যদি হন আইনস্টাইন, তা হলে তা আরওই অসম্ভব!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy