গোলমুখে চিমা
শ্যুত-শ্যুত... শ্যুত-শ্যুত-শ্যুত! কাম-কাম! চ্যালেঞ্জ... এনি চ্যালেঞ্জ?”
আশিতে ইস্টবেঙ্গলে আমার ফিরে আসার পর ওই মাঠে সকালের কোচিংয়ে এক বিদেশি ফরোয়ার্ডের এটা প্রায় রোজকার কথা ছিল।
মজিদ বাসকার।
শুধু আমার কোচিং জীবনের প্রথম বিদেশি ফুটবলার নয়, ভারতীয় ফুটবলে খেলা সেরা বিদেশি প্লেয়ার মজিদ।
হ্যাঁ, ধারাবাহিকতা দেখলে অনেকে বলতে পারেন, ওই শিরোপা হোসে ব্যারেটোর পাওয়া উচিত।
মজিদ এখানে আড়াই-তিন বছরের বেশি টপ ফর্মে খেলেনি ঠিকই। সেখানে ব্যারেটো টানা এক দশক দুর্দান্ত খেলেছে। কিন্তু সত্যিকারের জাত তো আর নিছক সংখ্যা দিয়ে কখনও বিচার হয় না!
সৌরভ (গঙ্গোপাধ্যায়) একটা দারুণ কথা বলে থাকে। যার সঙ্গে আমি একশো দশ ভাগ একমত। ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট। মজিদ-ব্যারেটোর তুলনা করতে গিয়ে সৌরভের ওই কথাটাই আমি সামান্য পাল্টে বলছি, ইফ ফর্ম ইজ পার্মানেন্ট, দেন ক্লাস ইজ ফরএভার! মজিদ সত্যিকারের জাত ফুটবলার। অদ্ভুত একটা টাচ ছিল ওর খেলায়।
সত্তর দশকে পিন্টু (সমরেশ) চৌধুরীও তিরিশ-পঁয়ত্রিশ গজের নিখুঁত থ্রু-পাস বা লং-পাস নিজের দলের অর্ধ থেকে অপোনেন্ট বক্সে সতীর্থ ফরোয়ার্ডের পায়ে বা মাথায় পাঠাত। আমার কোচিংয়েই পিন্টু ইস্টবেঙ্গলে ওই কাজে স্পেশ্যালিস্ট ছিল। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে আমার দ্বিতীয় ইনিংসে সেটাই মজিদকে করতে দেখেছি আরও নিখুঁত, আরও কার্যকর, আরও রাজসিক ভঙ্গিতে। সেই সঙ্গে তেমনই দুর্ধর্ষ বল কন্ট্রোল, ড্রিবলিং, স্পিড, শ্যুটিং, বিপক্ষ ডিফেন্ডারকে ধোঁকায় ফেলা বডিফেইন্ট!
বল পায়ে মজিদের একটা অদ্ভুত শরীরের মোচড় ছিল। যেটা ওর সামনে থাকা অপোনেন্ট প্লেয়ারকে টপকাতে শেষ মুহূর্তে দিত। আর শরীরের মোচড়টা যে দিকে দিত, তার উল্টো দিকে বলটা ডজ করত অসাধারণ দক্ষতায়! মজিদ ইরানে না জন্মে ব্রাজিল, স্পেন, ইতালি, জার্মানিতে জন্মালে বলে-বলে ইউরোপের টপ ক্লাবে নিয়মিত খেলত। হয়তো বাড়াবাড়ি শোনাবে, কিন্তু আমি এই বুড়ো বয়সে এখনও মাঝেসাঝে রাত জেগে বার্সেলোনার ম্যাচ-ট্যাচ যখন দেখি, লিওনেল মেসির খেলা দেখে মজিদ বাসকারকে মনে পড়ে যায়!
সেই মজিদ ইস্টবেঙ্গলের প্র্যাকটিসে এক দিন শ্যুত-শ্যুত-শ্যুত... বলতে বলতে আমাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসল!
ব্যাপারটা ছিল, সামনে একা গোলকিপার থাকবে। পেনাল্টি বক্সের মাথা থেকে কে কত বার শট মেরে গোল করতে পারে।
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য তখন শুধু ইস্টবেঙ্গলে নয়, ইন্ডিয়া টিমে এক নম্বর স্টপার। মনাকে রোজ প্র্যাকটিসে মজিদ ওয়ান-টু-ওয়ান ড্রিবলিংয়ের চ্যালেঞ্জে হারাত।
সত্যি বলতে কী, মজিদের চ্যালেঞ্জে সেদিন ঘাবড়েই গিয়েছিলাম আমি। যদিও তখনও বুড়িয়ে যাইনি। এমনকী ফুটবল থেকে তার বহু বছর আগে অবসর নিয়ে ফেললেও তখনও মোটামুটি ভাল ফিটনেস রয়েছে। তা সত্ত্বেও কোচিংয়ে শিষ্যদের ডেমনস্ট্রেশন দেওয়া এক জিনিস, আর শিষ্যের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলে শ্যুটিং-যুদ্ধে নেমে পড়াটা আর এক জিনিস।
যদি হেরে যাই, নিজের টিমের এক বিদেশি ছেলের চোখে খাটো হয়ে যাব। ছেলেটা যে রকম ‘মুডি’ আর যেমন হাবভাব, হয়তো এর পর আর মানবেই না আমাকে! এ রকম নানা ছাইপাশ চিন্তা সেই মুহূর্তে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা আবার না নিয়েও পারছি না। তা হলেও তো মজিদ ওর কোচকে একটা ফালতু লোক ভেবে বসতে পারে!
সোনালি দিনের মজিদ
দুগ্গা বলে পেনাল্টি বক্সের মাথায় বল বসিয়ে মজিদকে বললাম, “এসো, তুমি একটা মারো, পরেরটা আমি মারব। দশটা করে শট, কেমন!”
গোলের নীচে কিপার দাঁড়িয়ে। এত বছর পরেও দিব্যি মনে আছে, মজিদ দশটার মধ্যে সাতটা গোল করেছিল। আমি দশে আটটা। তার পর থেকে যত দিন মজিদ আর আমি ইস্টবেঙ্গলে ছিলাম, এক দিনের জন্যও ও আমাকে কোনও ভাবে ট্রাবল দেয়নি।
তবে আমাকে সরাসরি জ্বালাতন না করুক, এক নম্বরের ট্রাবলমেকার-ফুটবলার ছিল মজিদ। জীবনযাপন একেবারে উচ্ছৃঙ্খল। মদ খাওয়া, বেশ্যাপাড়ায় যাতায়াত।
মধ্য কলকাতার বাসিন্দা এক বিখ্যাত সর্বভারতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। শুনেছিলাম, সেই মহিলার মাধ্যমেই আরও মারাত্মক মাদকসেবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল মজিদ।
এ রকম চূড়ান্ত বেহিসেবি জীবনযাপন করলে আর কোন পেশায় কোন প্রতিভাবান নিজের প্রতিভার সুবিচার করতে পারে? অন্য পেশার কথা থাক। ফুটবলেই জর্জ বেস্ট থেকে মারাদোনা, কেউ পারেনি। মজিদ বাসকর তো কোন ছার!
মজিদের সঙ্গেই জামশিদ নাসিরি ইরান থেকে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটবলার কোটায় পড়তে এসে শেষমেশ ইস্টবেঙ্গলে সই করেছিল। কিন্তু জামশিদ মোটেই মজিদের স্বভাব-চরিত্রের ছিল না। মজিদের মতো অত বড় জাতের ফুটবলারও অবশ্য ছিল না জামশিদ।
পেনিট্রেটিভ জোনে হেডটা ভাল করত। গোলটা চিনত। অনেকটা আমাদের রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়ের আরও উন্নত সংস্করণ।
তো মজিদ-জামশিদকে কোচিং করাতে গিয়েই আমি প্রথম খুব ভাল ভাবে বুঝেছিলাম, একটা টিমের ভাল পারফরম্যান্সের জন্য ভাষার আদানপ্রদানও কতটা বেশি জরুরি! ইরানিয়ান ভাষা ছাড়া মোটামুটি ইংরেজি আর একটু-আধটু উর্দু জানত মজিদরা। কিন্তু বেশ বুঝতাম, ওদের মাতৃভাষা ইরানিতে একটা-দু’টো কথাও এখানে কেউ ওদের সঙ্গে বললে ওরা কী ভীষণ খুশি হয়। সারাদিন আহ্লাদিত থাকে। যার ভাল প্রভাবটা ইস্টবেঙ্গলের প্র্যাকটিসে, ম্যাচেও পড়ে।
এক দিন নামী ব্যাডমিন্টন তারকা দীপু ঘোষ (ও-ও আমার মতো ইস্টার্ন রেলে চাকরি করত) আমার সঙ্গে কী একটা ব্যক্তিগত কাজে দেখা করতে সকালে ইস্টবেঙ্গল মাঠে প্র্যাকটিসের সময় এসেছিল। মজিদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে দীপু ওর সঙ্গে ইরানি ভাষায় কুশল বিনিময় করে ওকে অবাক করে দেয়।
আসলে দীপু বেশ কিছু দিন তেহরানে ছিল, ওই দেশে ব্যাডমিন্টন কোচিংয়ের কাজে। সেই সময়েই ওর কিছু-কিছু ইরানিয়ান শব্দ, বাক্য-টাক্য শেখা। সে দিনের পর থেকে দীপুর কাছে আমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যতটা সম্ভব আর কী, ইরানি ভাষা শিখতে শুরু করে দিলাম। আর তার কিছু দিনের মধ্যে ইস্টবেঙ্গল প্র্যাকটিসে বা ম্যাচের দিন-টিন মজিদ-জামশিদের সঙ্গে আমি একটু-আধটু ইরানিয়ান ভাষায় কথা বলা শুরু করেছিলাম।
মাঝমাঠে বল দখলের লড়াইয়ে জামশেদ
আর কী আশ্চর্য! তার পর থেকে দেখলাম, মজিদরা আমাকে আরও বেশি শ্রদ্ধার চোখে দেখছে! মাঠে যা বলছি তা-ই করছে। এখনও মাঝে-মধ্যে দুঃখ হয়— মজিদ যদি পরের দিকে মহমেডানে চলে না যেত, যদি ময়দানে আমার কোচিংয়েই বরাবর খেলত, তা হলে হয়তো এত তাড়াতাড়ি ফুটবল-মাঠ থেকে হারিয়ে যেত না! হয়তো ওই রকম উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠত না। নিজের অমন অসাধারণ ফুটবল প্রতিভাকে শেষ করে দিতে পারত না! মজিদের আসলে দরকার ছিল কোচের মোড়কে একজন সত্যিকারের অভিভাবকের!
যেটা চিমা ওকোরি ময়দানে দুই প্রধানে ওর খেলার বছরগুলোতে বেশির ভাগ সময় আমার মধ্যে পেয়েছিল।
চিমাও ফুটবলার-জীবনে খুব খুশি হত, যদি আমি ওর সঙ্গে নাইজিরিয়ান ভাষায় সামান্য হলেও কয়েকটা কথা-টথা বলতাম। নাইজিরিয়ান কয়েকটা কথা শেখার জন্য আমাকে অবশ্য দীপু ঘোষের মতো আর কোনও মাস্টারমশাইয়ের কাছে যেতে হয়নি। আসলে তার অনেক বছর আগে সর্বভারতীয় রেল টিম নিয়ে আমার আফ্রিকা সফরের সময় নাইজিরিয়ায় কয়েকটা ম্যাচ খেলতে গিয়ে সে দেশের গোটাকয়েক শব্দ শিখেছিলাম।
ওদের বিখ্যাত গ্রিন ইগলস্ দলের সঙ্গে আমাদের রেল টিম ২-২ ড্র-ও করেছিল। এই জায়গায় একেবারে অন্য প্রসঙ্গ হলেও একটা কাহিনি না বলে থাকতে পারছি না। নাইজিরিয়ায় অল ইন্ডিয়া রেল টিম কয়েক দিন থাকার সময় আমাদের সম্মানে ও দেশের রাজা একটা নৈশভোজ দিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখেছিলাম, রাজার তিনশো বৌ! না, লেখার ভুল নয়। ৩০০ বৌ-ই!
একেবারে প্রথম বৌয়ের বয়স রাজার কাছাকাছিই। রাজা পঁচাত্তর হলে সেই বৌয়ের বয়সও সাতষট্টি-আটষট্টি। তার পরে কমতে কমতে পঁচাত্তর বয়সি রাজার তিনশো নম্বর বৌটি মেরেকেটে বছর আঠারোর এক কিশোরী! দেখে চক্ষু চড়কগাছ!
চিমাও ইস্টবেঙ্গলে প্রথম দিন প্র্যাকটিসে আমার মুখে নাইজিরিয়ান ভাষা শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল। “কোচ, তুমি কি আগে আমার দেশে থাকতে?” বড় বড় চোখ করে ওর সেই বাজখাঁই গলায় বলেছিল চিমা।
এমনিতে চিমা বেশ শান্তশিষ্ট। কিন্তু মাথায় কোনও মতলব ঘুরলেই মুশকিল! তখন ও কোচের কাছে ব্যাড বয়।
শিলিগুড়িতে ফেডারেশন কাপ খেলতে যাওয়ার সময় চিমা যেমন আমার কাছে ব্যাড বয় হয়ে উঠেছিল। শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেখি ফুটবলাররা সব ট্রেনে উঠে পড়েছে। আমি ট্রেনে উঠলাম আর উঠেই আবিষ্কার করলাম, চিমা সঙ্গে একজন মহিলাকে নিয়ে শিলিগুড়ি চলেছে।
মহিলা চিমারই বয়সি। বিদেশিও। তখনও চিমার বিয়ে হয়নি। ফলে ওকে আমি সরাসরি বলে দিলাম, “চিমা, তুমি এটা পারো না। আমি তোমাকে সঙ্গে মহিলা নিয়ে টিমের সঙ্গে যেতে দেব না। এটা তোমার ব্যক্তিগত শিলিগুড়ি ট্যুর নয়।” চিমা প্রথমে নাছোড়বান্দা ভাব দেখালেও শেষমেশ নতিস্বীকার করল।
ইরানিয়ান সমাজে মহিলাদের পর্দানাশীন থাকার ব্যাপারটা না হয় আছেটাছে। কিন্তু আফ্রিকা-ইউরোপে তারকা প্লেয়ারের সঙ্গী হয়ে সুন্দরী মহিলার ঘোরাফেরাটা পঁচিশ-তিরিশ বছর আগেও তেমন কোনও ব্যাপার ছিল না। আর এখন তো রোনাল্ডো বা নেইমারের সঙ্গে অর্ধ-উলঙ্গ পর্নস্টার নায়িকার ঘনিষ্ঠ ছবিটবি মাঝেমধ্যে মিডিয়ায় না বেরোলে পৃথিবী বিখ্যাত ওই সব ফুটবলারের যেন বাজারদর কমে যায়!
এমনকী এই সেদিন অনড় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড পর্যন্ত ইন্ডিয়া টিমের বিদেশ সফরে বিরাট কোহলিদের বান্ধবীদের হোটেলে একসঙ্গে থাকার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে! আমিও যদি এখন বড় ক্লাবে কোচিং করাতাম, র্যান্টি মার্টিন্স, কাতসুমিদের বান্ধবীদের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান টিমের সঙ্গে দিল্লি-বেঙ্গালুরু-পুণে-মুম্বই যেতে কি বাধা দিতে পারতাম? মনে হয় পারতাম না। মনে হয় কেন? পারতামই না।
ক্লাব-কর্তারাই হয়তো আমার জ্যাঠামশাইপনায় খেপে উঠতেন। এই যে বার্তোস বলে ইস্টবেঙ্গলে এক নিউজিল্যান্ডার ফুটবলার এ বার খেলতে এসেছে, সে তো কলকাতায় প্রথম দিন থেকেই ক্লাবের ম্যাচে, প্র্যাকটিসে— সর্বত্র বৌকে বগলদাবা করে নিয়ে ঘুরছে।
ইস্টবেঙ্গল কোচ আর্মান্দো কোলাসো গোয়ান বলে আরও সুবিধে হয়েছে। গোয়ান সমাজে বান্ধবীটান্ধবি নিয়ে যে কোনও জায়গায় যাওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। মোহনবাগানে ভৌমিকও প্র্যাকটিসে ওর কোনও ফুটবলারের বান্ধবীকে মাঠের ধারে দেখলে মনে হয় না সেই মহিলাকে বার করে দেবে বলে!
টোলগে তো গত তিন-চার বছর এখানে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহমেডান যখন যে টিমে খেলেছে ওর বান্ধবীকে নিয়ে ক্লাবে যেত, প্র্যাকটিসে যেত, এমনকী ম্যাচের পর ড্রেসিংরুমেও মাঝেসাঝে সেই মহিলাকে ঢুকিয়েছে।
পৃথিবী একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে পৌঁছে যাওয়ার পর এখন আর এগুলো বিদেশের মতো ময়দানি ফুটবলেও কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। চিমার খেলার সময় যেটা ভাবা যেত না! অন্তত এখানকার ক্লাব ফুটবলে।
শিলিগুড়ি পৌঁছে চিমাকে নিয়ে আবার আরেক বিপত্তি! প্রথম ম্যাচের আগের দিন প্রচণ্ড বেশি খেয়ে রাতের দিক থেকে ভয়ঙ্কর পেট খারাপ, অম্বল বাধিয়ে বসেছিল। মেঘের গর্জনের মতো বিকট আওয়াজ করে হোটেলের ঘরে বিছানায় শুয়ে একের পর এক ঢেকুর তুলে চলেছে। একবারে চোঁয়া ঢেকুর! আর পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সে বিচ্ছিরি এক অবস্থা!
সারা রাত ধরে আমি চিমার ঘরে, বিছানার পাশে জেগে বসে ওর চিকিৎসা করে গেলাম। পেটে তেল-জল বুলিয়ে দিচ্ছি তো ঘড়ি ধরে-ধরে ওষুধ খাওয়াচ্ছি। চিমা ভোররাত পর্যন্ত প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় কাটিয়ে সকাল থেকে একটু সুস্থ হল। আমাকে বলল, “তুমি সারা রাত আমার ঘরে ছিলে! মায়ের মতো আমাকে সেবাযত্ন করে সারিয়ে তুলেছ! পিকে স্যর, আপনি ঠিক আমার মায়ের মতো!”
বিশ্বাস করুন, তার পর থেকে চিমা আর একদিনের জন্যও আমার অবাধ্য হয়নি। না ইস্টবেঙ্গলে, না মোহনবাগানে। দু’টো টিমেরই কোচ হিসেবে আমি যা বলেছি ওকে, তা-ই শুনেছে। এমনকী টলিউডের কিংবদন্তি নায়িকার বিখ্যাত মেয়ে তথা অভিনেত্রীর ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুম থেকে চিমার হাত ধরে নিয়ে চলে যাওয়ার সেই মুচমুচে এপিসোডের সময়ও ও কিন্তু শেষমেশ আমার কথাই শুনেছিল। সেদিনও চরম বিতর্ক থেকে ওকে বাঁচাতে যেটা বলেছিলাম সেটাই করেছিল চিমা!
ক্যাথির সঙ্গে
চিমার যেন যত কাণ্ড শিলিগুড়িতেই! ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুম থেকে ওকে হাত ধরে সেই সময়ের ডাকসাইটে সুন্দরী অভিনেত্রীর বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনার স্থানও তো শিলিগুড়ি। আশির দশকের শেষের দিকে এয়ারলাইন্স কাপ টুর্নামেন্ট চলছিল তখন। ফাইনালে মহমেডানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল আমার দল। কিন্তু তার আগে যা সব ঘটনা!
ম্যাচ শুরুর আগে ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমে প্লেয়ারদের ফাইনাল টিউনিং সারছি, আচমকা সেই তরুণী অভিনেত্রী ওই শহরেরই জনাকয়েক বিশিষ্ট মুখের সঙ্গে সটান আমাদের ড্রেসিংরুমে এসে উপস্থিত। কিনা, চিমার সঙ্গে কথা বলবেন। চিমার দারুণ ভক্ত তিনি।
আগে কোনও দিন দেখা করা, আলাপ করা কিংবা কথা বলার সুযোগ পাননি। শিলিগুড়িতে নিজের পরের সিনেমার শ্যুটিংয়ে এসেছেন এখন। এই সুযোগ ছাড়তে চান না।
চিমাও দেখলাম সুপরিচিত অভিনেত্রীকে দেখে চনমন করছে। পারলে আড্ডা দিতে বসে পড়ে আর কী! আমি খুব বিনীত ভাবে সেই অভিনেত্রীকে বললাম, “দ্যাখো মা, দেশজোড়া বিখ্যাত তোমার ফ্যামিলির সঙ্গে আমার একটুআধটু পরিচয় আছে। চিমার সঙ্গে তুমি আলাপ করতে চাও, খুব ভাল কথা। কিন্তু সেটার সঠিক সময় এটা নয়। একটু পরেই ও একটা ফাইনাল ম্যাচ খেলতে নামবে। আমার গোটা টিম খেলতে নামবে। এখন চিমা আর টিমের প্রত্যেক ফুটবলার খেলার জন্য চূড়ান্ত মনঃসংযোগ করছে। এই অবস্থায় এখানে সিনেমার মতো বিনোদন জগতের এক জন বিরাট সেলিব্রিটির উপস্থিতি ওদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাবে। চিমার একজন ভক্ত হিসেবে তুমি কি চাও ও আজ মাঠে নেমে ব্যর্থ হোক? চিমার টিম ব্যর্থ হোক? তা ছাড়া, ড্রেসিংরুমটা খেলোয়াড়দের একেবারে পুরোপুরি নিজস্ব জগৎ। এখানে ওরা ইচ্ছে হলে, পোশাকআশাক ছাড়াও থাকে। একজন মহিলার সে ক্ষেত্রে এ রকম জায়গায় না থাকাটাই ভাল দেখায়। তাই না মা! তুমি কী বলো?”
সেই অভিনেত্রীর দেখলাম আমার ব্যাখ্যা পুরোটা পছন্দ না হোক, ঠিক তখনই আর চিমার সঙ্গে কথা বিশেষ বাড়ালেন না। কিন্তু যাওয়ার আগে চিমাকে হাত ধরে ড্রেসিংরুমের একটা দিকে অনেকটা টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, “ম্যাচের পরে আমি তোমাকে একটা পার্টিতে নিয়ে যাব। ঠিক যাবে কিন্তু!”
চিমার উজ্জ্বল চোখমুখ দেখে বুঝলাম, ও-ও মোটামুটি রাজি। কিন্তু যে কারণেই হোক, ম্যাচের পরে সেই অভিনেত্রী আর চিমার কাছে বা ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমের দিকে আসেননি। হয়তো সেই অভিনেত্রীর সঙ্গীরা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, চিমার সঙ্গে তাঁর আড্ডা দেওয়ার এটা ঠিক আদর্শ সময় বা জায়গা নয়। মজার ব্যাপার হল, ওই টুর্নামেন্টের পরেই চিমা ওর বান্ধবী ক্যাথিকে বিয়ে করে ফেলে।
কেউ কেউ বলে থাকে, এয়ারলাইন্স কাপ ফাইনালের দিন ভারতবিখ্যাত বাঙালি নায়িকার সেই ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ে তথা অভিনেত্রীর চিমার সঙ্গে আলাপ করার খবর ক্যাথির কানে পৌঁছতে চিমার বান্ধবী আর বিয়ের ব্যাপারে অপেক্ষা করাটা সমীচীন মনে করেনি। দ্রুত চিমার সঙ্গে বিয়েপর্বটা সেরে ফেলেছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy