Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে

তবু আজও তাঁর সুরে পদ্মায়, গঙ্গায় ঢেউ ওঠে, নামে! শচীনদেব বর্মন। আজ তাঁর মৃত্যুদিন। কর্তার চড়াই উতরাই জীবনের কাহিনি লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়রাগের চোটে বাদই দিয়ে দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকরকে! ‘সিতারোঁ সে আগে’ ছবির গান ‘সাঁইয়া ক্যায়সে ধরু ধীর’। লতাকে দিয়ে রেকর্ড করানোর বেশ কিছু পর শচীনদেবের মনে হল, আবার ‘টেক’ হলে ভাল হয়। অসম্ভব খুঁতখুঁতে যে! হোক মুক্তোদানা গলা, তার শেষ রতিটুকু সওদা না করলে তাঁর স্বস্তি নেই!

আশা, মীরা, পঞ্চমের সঙ্গে

আশা, মীরা, পঞ্চমের সঙ্গে

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

রাগের চোটে বাদই দিয়ে দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকরকে!
‘সিতারোঁ সে আগে’ ছবির গান ‘সাঁইয়া ক্যায়সে ধরু ধীর’। লতাকে দিয়ে রেকর্ড করানোর বেশ কিছু পর শচীনদেবের মনে হল, আবার ‘টেক’ হলে ভাল হয়।
অসম্ভব খুঁতখুঁতে যে!
হোক মুক্তোদানা গলা, তার শেষ রতিটুকু সওদা না করলে তাঁর স্বস্তি নেই!
এ দিকে সময় কই লতা মঙ্গেশকরের! কিছু দিন বাদেই তাঁর বিদেশ সফর। পড়িমড়ি করে হাতের কাজ গোটাচ্ছেন।
শুনে কর্তা তাঁর ‘লোতা’-কে নিমেষে ছেঁটেই ফেললেন। বদলে ডাক পাঠালেন বোন আশাকে। সে সময় লতার নামডাকের কাছে আশা কী! তবু।
আহত, অভিমানী লতা মঙ্গেশকর এর পর টানা পাঁচ বছর কাজই করেননি শচীনদেবের সঙ্গে।
কর্তা কিন্তু অনড় তাঁর জেদে! এমন এক বার নয়, বারবার।

•••

এমনও হয়েছে, একই গান একে একে গাইতে ডেকেছেন মান্না দে, তালাত মামুদ, মুকেশ, মহম্মদ রফিকে। শেষে যাঁর গলায় গানটি ধরেছে, তাঁকেই নিয়েছেন।

বাকিরা বাদ তো, বাদই।

তখনকার মুম্বইয়ে কর্তার এই ছিল দস্তুর। আর জহুরির মতো তাঁর চোখও এক্কেবারে অব্যর্থ, নিপুণ। প্রতি বারই।

গুরু দত্তর পরিচালনায় ‘জাল’। ছবির গান তৈরির নেপথ্যকাহিনি বলতে গিয়ে কর্তা বলছেন, ‘‘তখন প্রধান সব গাইয়ে ছিল রফি, তালাত, মুকেশ। কিন্তু ঠিক একই সময় হেমন্তকুমার বম্বেতে এসেছিলেন ফিল্মিস্তানে চাকরি নিয়ে।… ঠিক করলাম গানটা হেমন্তকে দিয়েই গাওয়াব।’’

কী গান? ‘ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনি ফির কাঁহা’। এই একটি গান হিন্দি ছবিতে ভবিষ্যৎ হেমন্তকুমারের বীজ বুনে দিল!

•••

গীতা দত্তকেও (তখন রায়) তো এ ভাবেই প্রায় মাটি থেকে আবিষ্কার কর্তার। নইলে ফরিদপুরের মেয়ে গীতাকে ক’জন চিনত তখন!

‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ ছবিতে কোরাসে গাওয়া মেয়েটির একটি লাইন শুনেই শচীনকর্তার মন আহ্লাদে ভরে গিয়েছিল।

সে বছরই ‘দো ভাই’-এর মুক্তি। কর্তার ডাকে গীতা গাইলেন ‘মেরা সুন্দর স্বপ্না বিত গ্যয়া’। এর পর গীতাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

•••

কিশোরকুমার। সেও প্রায় তাই-ই। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর দাদা অশোককুমারের স্টুডিয়োতে বেড়াতে আসতেন কিশোর (তখন আভাষকুমার)।

কর্তা লিখেছেন, ‘‘আমি তখন ফিল্মিস্তানে কাজ করছি। দাদামণি অশোককুমারের নিজস্ব প্রোডাকশন ‘এইট ডেজ ১৯৪৬’। … এক দিন দাদামণি আমাকে কিশোরের গান শুনতে বললেন। …ওর গলা শুনে আমি মুগ্ধ। তখনই ওই ছবির একটি গান কিশোরকে দিয়ে গাওয়ালাম। প্রথম ‘টেক’-এই একেবারে ‘ওকে’ করতে হল। আমি তখন দাদামণিকে বলেছিলাম, কিশোরকে আর কলেজে পড়িয়ে দরকার নেই, এই গানের লাইনেই যেন সে চলে আসে।’’

সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে কিশোরকুমার বলতেন, ‘‘মুম্বইতে এসেছিলাম অভিনয় করব, প্রযোজনা করব বলে। গান করার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। বুড়ো লোকটা আমার পিছু নিতেন। রাগ হত। পালিয়ে পালিয়ে যেতাম।’’

•••

কিশোরকুমারের সেই ‘পালিয়ে যাওয়া’ মনটা হঠাৎই উধাও হল এক দিন।—

‘‘গাড়ি করে যাচ্ছি। ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি থেমেছে। হঠাৎই পাশ থেকে আওয়াজ শুনি, ‘আরে কিশোইরা না?’ দেখি, ওই বুড়োমানুষটা দরজা খুলে নেমে আমার গাড়িতে ঢুকে পড়লেন। ড্রাইভারকে বললেন, ‘শহর ছাড়াইয়া গাড়ি লইয়া চল।’

গাড়ি চলতে চলতে এক সময় সবুজ মাঠের ধারে পৌঁছল। মানুষটা গাড়ি থেকে নেমে খেতের মধ্যে চলে গেলেন। হাঁটুর ওপর ধুতি তুলে আল ধরে হাঁটতে লাগলেন। গলায় একটার পর একটা গান।

আমি কেমন স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে গেলাম। দিকজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কেবল মনে হতে লাগল, এই মানুষটাতেই তো এত কাল খুঁজেছি, আজ থেকে ইনি যা বলবেন, তার বাইরে কক্ষনো যাব না।’’

একটি অনুষ্ঠানে মাধবী মুখোপাধ্যায়, কামিনী কৌশল, শচীনদেব, রাজ কপূর, সত্যজিৎ রায়় ও অন্যরা

মান্না দে-র গল্প শোনা যাক—

‘‘তালাশ ছবির ‘তেরি ন্যয়না তালাশ করকে’ গানটা তুলতে গেছি শচীনদার মিউজিক রুমে। পরিচালক এলেন গান শুনতে। শচীনদা আমাকে বললেন, মানা (এ নামেই ডাকতেন), তুই গেয়ে শোনা।’’

মান্না দে তখন বোম্বেতে। কর্তার সহকারী।— ‘‘শচীনদার নির্দেশে গানের নোটেশন করি, ওঁর নতুন করা সুর শিল্পীদের গলায় তুলিয়ে দিই। … এ ছাড়া শচীনদা বললেই পান এনে দিই, থলে বয়ে দিই। বাজারদোকান করে দিই। শচীনদা কলা খেতে ভালবাসতেন খুব। তাই চাইলে কলাও আনতাম।’’

তো, এই মান্না দে তাঁর নতুন ছবিতে গাইবেন শুনে পরিচালক বলে উঠলেন, ‘‘মান্না দে গাইবেন নাকি? মুকেশ কী হল?’’

এ বার তাঁর মুখের উপর শচীনদেবের সোজাসাপ্টা জবাব, ‘‘মুকেশ এ গান গাইতে পারবে না।’’

উষ্মা দেখিয়ে পরিচালক বললেন, ‘‘এমন গান কেন বানালেন যেটা মুকেশ গাইতে পারবে না?’’

সাদা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি পরা নির্মেদ শরীরটাকে এ বার ছিলার মতো টান টান করে কর্তা জবাব দিলেন, ‘‘শোনো, তালাশ-এ যদি এসডি বর্মন সুর দেয়, তো এই গানটা থাকবে। আর গাইবে মানা-ই। তোমার অপছন্দ হলে তুমি অন্য মিউজিক ডিরেক্টর নাও।’’

মানতে বাধ্য হয়েছিলেন পরিচালক। আর তার পরিণতি কী, আজ তামাম দুনিয়ার অজানা নয়।

ছবির সিলভার জুবিলিতে পরিচালক বাধ্য হয়েছিলেন বলতে, ‘‘আপনি আমাদের দাদা, চিরকালের দাদা।’’

নিজের প্রতি কতটা বিশ্বাস, কতটা আস্থা থাকলে এতটাই অচল থাকা যায়!

•••

এমনই আরেক বারের কথা। গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতি থেকে—

‘‘ঘরে আরও লোকজন ছিলেন। এক ভদ্রলোক আমার সামনেই তার হাতের ছোট টিনের স্যুটকেস খুলে ওঁকে দেখালেন নোটের গোছা। শচীনদা ওঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে বললেন, তুম জিতনা রুপাইয়া দেখাও, হাম তুমারা পিকচার নেহি করেঙ্গা।’’

ভদ্রলোক এর পরও অনেক কাকুতিমিনতি করে শেষে হাল ছেড়ে চলে গেলেন।

ঘরের মধ্যে বসা এক জন তখন বললেন, ‘‘সাতসকালে এতগুলো টাকা ছেড়ে দিলেন!’’

কর্তা উত্তর দিলেন, ‘‘কুয়া জানো? পাতকুয়া? পাতকুয়া থেকে সব জল তুলে নিলে কুয়া শুকিয়ে যায়। কুয়াতে জল জমবার সময় দিতে হয়। মিউজিক ডিরেকশনও তাই। টাকার লোভে এক গাদা ছবিতে কাজ করলে আমি ফুরিয়ে যাব। আমার ইয়ারলি কোটা আছে। তার বেশি আমি কাজ করি না। আমার এ বছরের কোটা কমপ্লিট। যে যত টাকাই দিক, এ বছর আর কাজ করব না।’’

অথচ এই মানুষটিই যখন কাজের মধ্যে, তখন তিনি আর নিছক সঙ্গীতকার নন, ধ্যানরত তপস্বী!

রবীন চট্টোপাধ্যায়, রাহুলদেব, মজরু সুলতানপুরির পাশে

পঞ্চাশের দশকের শেষ।

শক্তি সামন্ত ছবি করবেন ‘ইনসান জাগ উঠা’। ছবির একটা গান ছিল ‘জানু জানুরে’।

নাগার্জুন সরোবর বাঁধ তখন তৈরি হচ্ছে। শ্যুটিং সেখানেই। সিচ্যুয়েশন বুঝিয়ে পরিচালক শচীনকর্তাকে বললেন, ‘‘দুটো ট্র্যাক্টর থাকবে, যে-দুটোর মধ্যে দূরত্ব হবে আট-ন ফুট। তার মধ্যেই নায়িকা নাচবে, গান করবে ইত্যাদি।’’ কথার মধ্যেই দেখা গেল, বার কয়েক দূরত্বটা মেপে নিলেন কর্তা।

দিন কয়েক বাদে তাঁর ফোন পরিচালককে।— ‘অফিস যাওয়ার পথে আমার বাড়ি ঘুরে যাস’।

কর্তা থাকেন তখন বান্দ্রায়। সেই বিখ্যাত বাড়ি, নাম ‘জেট’। জেট-এ ঢোকার আগে থেকেই শক্তি সামন্ত শুনলেন মিউজিক বাজছে।

ঘরে গিয়ে দেখেন একটা আট-ন’ফুটের দাগ কেটেছেন কর্তা। আর ইন্টারল্যুড অংশটা মাপ মতো হয়েছে কিনা দেখার জন্য চোখবুজে নিজেই গান করছেন আর মাপ দেখছেন।— ‘‘আমি যে গেছি ওঁর খেয়ালই হয়নি। এক সময় চোখ খুলে আমায় দেখে বললেন, ‘কখন এলি?’ বললাম, মিনিট দশেক হবে। ‘আমায় ডাকলেই পারতি’ বলে গানের অংশটি শুনে জানতে চাইলেন ঠিক আছে তো?’’

•••

যে গানটি নিয়ে শক্তি সামন্তের এত কথা, সেই ‘জানু রে জানু কাঁহে ছনকে হ্যায় তেরা কঙ্গনা’ গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে আর গীতা দত্ত।

সে-গান শেখানোর কাহিনিটিতেও লুকিয়ে আছে এক নিমগ্ন সঙ্গীত-কারিগরের আত্মার বর্ণমালা!

‘ছাত্রী’ আশা ভোঁসলের বয়ানটি পড়ে ফেলা যাক।—‘‘দাদাই প্রথম আমাকে গানের মধ্যে হাসতে শিখিয়েছিলেন।… ‘জানু রে জানু’র একটা জায়গায় হাসির প্রয়োজন ছিল। তিনি নিজে হেসে দেখিয়ে দিলেন। আমি হাসলাম। কিন্তু তাঁর পছন্দের হল না, বললেন, হাসার পর তুমি যদি নিশ্বাস নাও তা হলে শুনতে খুব ভাল লাগবে। আমি তাঁর পছন্দ মতো করলাম। চমৎকার হল। আর সেই থেকেই গানের মধ্যে আমার হাসিটা খুব ফেমাস হয়ে গেল।’’

প্রায় একই রকম অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন ‘জুয়েল থিফ’ ছবিতে। ‘রাত একেলি হ্যায়’ গানটি শেখানোর সময়। সে-গানও আশা ভোঁসলের।

এক নায়িকা তনুজা। উদ্দাম, বেপরোয়া। চপল। তাঁর লিপেই আশার গান।

পরিচালক চাইলেন, নায়িকার চরিত্রের সেই উদ্দামতা যেন গানকেও ছুঁয়ে যায়।

‘রাত একেলি হ্যায়/ বুঝ গ্যয়ে দিয়ে/ আকে মেরে পাশ, কানোমে মেরে যো ভি চাহে কহিয়ে’।— গানের কথায় সুর দিলেন কর্তা।

গুন গুন করে ধীরে ধীরে গান শুরু হয়ে হঠাৎ উচ্চগ্রামে উড়ান দিয়ে সে-সুর নায়িকার লাস্যে মিলিয়ে গেল!

এ নিয়ে এক জায়গায় আশা বলেছেন, ‘‘আমি সোজা ভাবেই গাইছিলাম। দাদা বললেন, এক কাজ কর। ছেলেবেলায় আমরা কারও কানের কাছে গিয়ে যেমন প্রথমে আস্তে আস্তে তার পর জোরে কুও-ও-ও-ও করতাম, তুইও ঠিক সেই রকম কর। তাই করলাম…।’’

•••

কর্তার শেখানোর তরিকার মতো তাঁর সুরের তল্লাশিগুলোও একই রকম অদ্ভুত!

‘রূপ তেরা মস্তানা’ যেমন।

সুরের কাঠামোটা পেয়েছিলেন এক কিশোরীর কাছ থেকে! তার পর নিজের গানের মূর্তিটা গড়েছিলেন নিজেই।

সে কেমন? শোনা যাক।

নিজের সুরলোকে দু’জন মানুষকে সঙ্গী নিতেনই নিতেন শচীনদেব।

তাঁদের এক জন দক্ষিণামোহন ঠাকুর। তার-সানাইয়ের বিখ্যাত শিল্পী। অন্য জন ব্রজেন বিশ্বাস। ব্রজতরঙ্গের স্রষ্টা।

কর্তার ‘রূপ তেরা’-র গল্পটি পাওয়া যায় ব্রজেনবাবুর কাছে থেকে।

বোম্বে থেকে কলকাতায় এসেছেন কর্তা। আড্ডায় মশগুল তাঁর সাউথ-এন্ড পার্কের বাড়ি।

কথা বলতে বলতেই হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন শচীনদেব। হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে গল্প পাড়লেন—

‘‘আরে জানস, শক্তি (সামন্ত) একটা ছবি করতাসে। আমারে কইল সুর দিতে। আরও কইল একটা সেক্সের গান করতে হইব। কী হইল জানস, বহুকাল আগের একটা কথা মনে পইড়্যা গেল। এক ব্যাটার বাড়িতে গেছিলাম। তারে ডাকতাছি। কিছুতেই আর বাইর হয় না। অনেক পরে ঘরের থেইক্যা বাইরে আইল। দিলাম ব্যাটারে বকা।

কয় কী, ‘কর্তা মাফ করেন। পোলাডারে বিয়া দিমু আইজকা, তাই কাপড় পরাইতাছিলাম।’

যখন আমাগো কথা হইতাসে, তখন একটা ছোট্ট মাইয়া দেখি ঝিক লইয়া খেলতাছিল। পোলাডারে দেইখ্যা মাইয়াডা হাইস্যা উঠল।

আমি কইলাম, ‘এইটুকু পোলারে বিয়া দিবি কী?’ ব্যাটায় কয়, ‘অহন দেওনই ভাল নইলে বিগড়াইয়া যাইতে পারে।’

শুইন্যা ওই এক ফোঁটা মাইয়ার কী হাসি! হাসতে হাসতে গাইয়া উঠল— ‘কালকে যাব শ্বশুরবাড়ি/ আহ্লাদে খাই গড়াগড়ি/ দেখব তোরে প্রাণভরে সুন্দরী।’

শক্তির কথা শুননের পর এই গানডা আমার হঠাৎ মনে পইরা গেল। ঠিক কইরা ফালাইলাম, গানডার লয়ডারে কমাইয়া কিশোরারে গাইতে কমু। আর কমু জোরে জোরে একটু নিশ্বাস ফালাইতে। তাইলেই তো সেক্সের গান হইয়া যাইব।’’

•••

লতা মঙ্গেশকরের ‘ঠান্ডি হাওয়ায়ে লেহরাকে আয়ে’ গানটির নেপথ্যেও এমন একটি আশ্চর্য আহরণের কাহিনি।

পরিচালক মহেশ কৌলের কিছুতেই মনে ধরছে না সুর। দু’তিন রকম ভাবে শোনাবার পরও তিনি মাথা নাড়ছেন।

জুহু বিচে বসে উদভ্রান্ত কর্তা। সুর আসছে না কিছুতেই। হঠাৎই বিরক্ত হয়ে এক পেয়ালা চায়ের খোঁজে রেস্তোরাঁয় ঢুকলেন।

চায়ে চুমুক দিতে দিতেই শুনলেন পিয়ানোতে সুর বাজছে— সা-রে-সা-সা-সা।

এক টানা। অনবরত।

কর্তা ছিটকে উঠলেন। এর পরই তাঁর মাথায় খেলে গেল সুর— ‘ঠান্ডি হাওয়ায়ে লেহরাকে আয়ে’!

মাঠঘাট থেকে সুর খুঁজেছেন। মাঝিমাল্লার মুখে সুর পেয়েছেন। কীর্তন-বাউলাঙ্গে অঞ্জলি পেতে সুর ধরেছেন। চরাচরে, বিস্তীর্ণ প্রান্তরের খেয়ালি ডাকেও তাঁর কান মজেছে। কিন্তু বরাবর ভেবে এসেছেন, বোদ্ধা সঙ্গীতরসিক নয়, গান যদি না বেসুরো হয়েও বেয়ারা, মুচি, পানওয়ালার গলায় না বাজে, তো সব বৃথা।

এক জায়গায় বলেছেন, ‘‘প্রথম ছবি শিকারি-র সুর করার সময় স্টুডিয়োর সবাই খুব প্রশংসা করেছিল।… আমি খুশি হতে পারিনি। কিছু দিন পর শ্রী যামিনী দেওয়ানের ‘রতন’ ছবি মুক্তি পেল। বম্বে শহর ‘রতন’ ছবির গানে ছেয়ে গেল।

ফিল্মিস্তানে আমার ঘরে বসে একদিন হারমোনিয়াম নিয়ে সুর করছি, হঠাৎ কানে এল আমার বেয়ারা ছোকরাটির গলায় গান। সে গাইছিল— ‘যব তুমহি চলে পরদেশ’। ‘রতন’-এর গান।

সে দিন আর কাজ করলাম না। এই ‘রুমবয়’ এত দিন আমার সঙ্গে কাজ করছে, কিন্তু কই আমার গানে তাকে তো এমন গুন গুন করতে দেখিনি!

আমার চোখ খুলে গেল। কয়েক দিন বাদে ‘দো ভাই’-এর ‘মেরা সুন্দর স্বপ্না বিত গ্যয়া’-র সুর করছি।

পাশের ঘর থেকে আমার সেই রুমবয়কে গানখানা মশগুল হয়ে গাইতে শুনলাম। তখনই বুঝেছিলাম, ফিল্মের হিট গান মানেই অতি সোজা সুর।’’

মঞ্চে নতজানু কিশোর

সুর নিয়ে যাঁর এমনই উলটপালট খোঁজ, তিনিই আবার উদ্ভট এক কাণ্ড করে বসেছিলেন নিজের ছেলের সঙ্গে।

পঞ্চম তখন সবে ষোলো। কিন্তু ওই বয়েসেই গানের সুর দেবেন বলে বায়না করতেন। আর ধমক খেতেন।

‘ফান্টুস’ মুক্তি পেল। তার একটি গানের সুর শুনে পঞ্চম তাজ্জব! এ যে তাঁর সুর। কোনও এক সময় বাবাকে শুনিয়েছিলেন।

উত্তেজিত ছেলে বাবার কাছে কৈফিয়ত চাইলে কর্তার উত্তর, ‘শচীনদেব বর্মন নিজে তর সুর পছন্দ কইরা লইছে, ইডাই তর ভাগ্যের মনে রাখিস।’

পঞ্চমের সুরের তালিম কিন্তু বাবার কাছেই। পঞ্চম তখন এগারো-বারো। কর্তা একা থাকতেন বম্বে। সুযোগ পেলেই কলকাতা আসতেন। এলেই গাঁ-গঞ্জে গিয়ে পুকুরে ছিপ হাতে বসা ছিল বাঁধা। ছেলেকেও সঙ্গে নিতেন।

পুকুর-জলে ছিপের সড়-সড় শব্দ, গাছের ফাঁকে পাখির ডাক, বৈঠার ঘায়ে ছলাৎছল যেখানে নৈঃশব্দের আড় ভাঙত— বাবা সেখানে ফিসফিসিয়ে শব্দ চেনাতেন ছেলেকে। বাতাসের গায়ে সুর, ফাঁক, তাল, ছন্দ, মিড় কানে ধরাতেন।

সেই সহজ পাঠে মন বেঁধে, ছেলে যখন সুর-আকাশে ডানা ছড়াল, বাবার তখন তো আসমানি-আহ্লাদে বাতাসে ভাসান দেওয়ার কথা!

তা হলে অমন হল কেন!

সময়টা আরও খানিক এগিয়ে যাওয়া যাক।

প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন বড়কর্তা। হঠাৎ কানে এল কারা যেন তাঁকে দেখিয়ে বলছে, ওই দ্যাখ, আর ডি বর্মনের বাবা।

মর্নিংওয়াক মাথায় উঠল।

বাড়ি ফিরে স্ত্রী মীরার উপর হম্বিতম্বি, ‘‘কত বড় লায়েক হইসে পোলায়! কী এমন সুর করতাসে, অ্যাঁ?’’

মীরাদেবী কিছু না বলে ছেলের নতুন রেকর্ড বাবার হাতে তুলে দিলেন।

সিনেমার নাম ‘অমরপ্রেম’। ‘চিঙ্গারি কই ভরকে’, ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে’, ‘ইয়ে কেয়া হুয়া’…। শুনতে শুনতে পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ পিতার সব অভিমান যেন সাফা হয়ে যাচ্ছিল!

‘অমরপ্রেম’ শুনে যতটা উদ্বেল হয়েছিলেন, কেউ বলেন, ততটাই দুঃখ পেয়েছিলেন বোধ হয়, যে দিন স্টুডিয়ো-য় দাঁড়িয়ে শুনলেন ‘দম মারো দম’।

‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’য় দেব আনন্দ যখন তাঁকে বাদ দিয়ে ছেলেকে নিয়েছিলেন, এত কষ্ট পাননি।

পেলেন এ বার।

সে কি ঐতিহ্যের, উত্তরাধিকারের, কৌলীন্যের সৌধকে চূর্ণ হতে দেখে?

রাহুলদেব দেখলেন, মাথা নিচু করে ধীর পায়ে স্টুডিয়ো ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন বাবা। হাঁটা চলার ঋজু ভাবটা উধাও। ন্যুব্জ, ক্লান্ত, পরাজিত এক নায়ক চলেছেন যেন মহাপ্রস্থানের পথে!

উস্তাদ আলাউদ্দিন খান ও সরোদিয়া রাধিকামোহন মৈত্রের সঙ্গে

বম্বেতে এসে কয়েক বছরের মধ্যেই চলে যেতে চেয়েছিলেন। মন টিকছিল না। তাঁর সেই সময়ের কথা ‘জীবন নাইয়া’ বইতে লিখেছেন অশোককুমার— ‘‘কলকাতা থেকে যেমন বিমল রায়কে এনেছিলুম, তেমনি এনেছিলুম শচীনকর্তাকে।… কিছুতেই সুবিধে করতে পারছিলেন না। তিন-চার বছরে কোনও গান তেমন হিট করল না। উনি ঠিক করলেন, আবার কলকাতাতেই ফিরে যাবেন। মুম্বই টকিজ-এ তখন ‘মশাল’ শুরু হচ্ছে। শচীনকর্তাকে বললুম, ‘এই ছবির মিউজিকটা তো করে যান।’ উনি বললেন, ‘না না এখানে কাজ করে কিছু হচ্ছে না।, আমি কলকাতায় ফিরে যাই।’ বললুম, ‘আচ্ছা ফিরেই যাবেন, কিন্তু এই ছবিটা করে তবে যান।’… শেষপর্যন্ত রাজি হলেন তিনি। বললেন, ‘ঠিক আছে তা হলে। এটা করেই কলকাতা ফিরে যাব।’’’

ফিরতে তো হয়ইনি, উপরন্তু ‘মশাল’ আগুন জ্বেলে দিয়েছিল সারা ভারতে!

দুঃসময় কি আসেনি? এসেছে।

যাটের দশকের শুরুতে যেমন। অসুস্থ হয়ে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। সেই সময়ের কথা বলেছেন রাহুলদেব, ‘‘১৯৬১ সালে বাবার যখন হার্ট অ্যাটাক হল, আমি বুঝতে পারলাম ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই সুসময়ের বন্ধু।

গুরু দত্তর ‘বাহারে ফির ভি আয়েগি’-র পাঁচটা গানে বাবা আগেই সুর করে রেখেছিলেন। বাবা-মা গুরু দত্তকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে আমি গানগুলির রেকর্ডিং করাতে সক্ষম, কিন্তু তিনি ওঁদের কথা না মেনে বললেন, ‘সরি, আমি অপেক্ষা করতে পারব না।’

এর পর এক জন এক জন করে সব প্রযোজক বাবাকে ছেড়ে চলে গেলেন। একমাত্র দেব আনন্দ বাবাকে ছাড়েননি। বলেছিলেন, ‘একটুও ভাববেন না, আপনি ভাল হয়ে ওঠা অবধি আমি অপেক্ষা করব, যত দেরিই হোক।’

পাঁচ মাস বাদে বাবা সুস্থ হতে ‘গাইড’ ছবির সব গান মাত্র পাঁচ দিনে আমরা তৈরি করেছিলাম। বিশ্বাস করুন, এক বার শুনেই দেব আনন্দ চারটি গানের সুরকে সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। শৈলেন্দ্র ‘সেট’-এ বসেই তিনটি গান লিখেছিলেন— ‘আজ ফির জিনে কি তমন্না হ্যায়’, ‘দিন ঢল যাঁয়ে’, ‘তেরে মেরে স্বপ্নে’।’’

শেষ জীবনটায় ‘জেট’-এ বসে সায়াহ্নের সূর্যকে দেখতে খুব ভালবাসতেন। গোমতীর ঘোলাটে জলে লালরঙা আভা মেলাতে মেলাতে এক সময় অন্ধকার নামত। কর্তা জানলায় বসে ভাটিয়ালি গাইতেন আনমনে।— ‘সেই যে দিনগুলি, বাঁশি বাজানোর দিনগুলি…’। তাঁকে পিছু ডাকত কি তাঁর কুমিল্লা, নানুয়া দিঘি, বাঁশবাগান, সন্ধেবেলায় রামায়ণীর সুর…?

’৭৫-এ দুটো ছবি মুক্তি পেল। ‘চুপকে চুপকে’, ‘মিলি’। দুটোই সুপার হিট!

মিলি-র মাত্র তিনটে গান— ‘ম্যায়নে কাঁহা ফুলোসেঁ’, ‘আয়ে তুম ইয়াদ মুঝে’, ‘বড়ি শুনি শুনি হ্যায়’।

মিলি-র রেকর্ডিং চলার সময়ই প্যারালিটিক স্ট্রোক হল কর্তার। রেকর্ডিং-এর দায়িত্ব নিলেন রাহুল। কিশোরকুমার যখন গাইছেন, ‘বড়ি শুনি শুনি হ্যায়’, এসডি তখন কোমায়! সবাই কাজ করবে কী, কান্না ডুকরে উঠছে গলার কাছে।

•••

টানা পাঁচ মাস কোমায় কাটালেন। মীরা-রাহুল কত বার ডেকেছেন, এক বারের জন্য সাড়া দেননি।

অক্টোবরের শেষ দিনে ইহলোক-এর সব রকমের পাকদণ্ডি খেলা সাঙ্গ করে অনন্তের পথে পাড়ি দিলেন সুরলোকের সম্রাট!

… কই গেলা রে বন্ধু …

… কই গেলা রে…

… আমারে ছাড়িয়া বন্ধু

… কই গেলা রে …

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy