দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে, গ্রেট ডিপ্রেশন সময়কালে — আমেরিকার এক ফার্মহাউজকে কেন্দ্র করে আমেরিকান ঔপন্যাসিক জন স্টাইনবেক রচনা করেছিলেন ‘অফ মাইস অ্যান্ড মেন’ উপন্যাসটি। ব্রাত্য বসু’র পৃষ্ঠপোষকতায় এবার এর নাট্যরূপ দিলেন নির্দেশক দেবাশিস বিশ্বাস। ‘ইঁদুর ও মানুষ’ নাটকটির প্রযোজনায় ‘হাওড়া ব্রাত্যজন’।
মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার জর্জ মিলটন এবং লেনি স্মল - দুই বিপরীতধর্মী মানুষের কৃষক জীবনের ওঠা পড়া, স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন ভঙ্গ এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই মূলত গল্প এগোতে থাকে। পাশাপাশি এসে পড়ে আরও অনেক চরিত্র। আবেগ, ভালবাসায় ভর করে যারা স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। তবুও রাষ্ট্রশক্তির জাঁতাকলে তাঁরা হয়ে ওঠে শুধুই শ্রম উৎপাদনকারী কতগুলো মূল্যহীন প্রাণ! ঠিক ফাঁদে আটকে পরা ছটফটিয়ে মরতে থাকা ইঁদুরের মতো। প্রয়োজন অপ্রয়োজনের ভিত্তিতে যেখানে এক হয়ে যায় মানুষ ও পশুও। নাটকের এই ইঁদুর যেন প্রতীক হয়ে ধরা দেয়। যে ইঁদুর (সত্তা) কামনা, বাসনার, স্বপ্নপূরণের, নির্ভীক চিত্তে বাঁচার। তবুও যেন অধরা স্বপ্নের মতোই! অপর দিকে জর্জ ও লেনিও যেন একই মানুষের ভিন্ন দুই সত্তা। একজন স্বপ্ন দেখে, অন্য জন কঠোর পরিশ্রমী। এ গল্পের ভারতীয়করণ না করায় নাটকটি কোথাও গিয়ে যেন আলাদা হয়ে যায় বিদেশি উপন্যাস নির্ভর অন্য অনুবাদক নাটক থেকে। এই কৃতিত্বের দাবিদার অবশ্যই নির্দেশক দেবাশিস বিশ্বাস। ভাষাটা বাংলা হলেও বিদেশি ঘরানার অনুসরণেই এগোতে থাকে গল্প।
তরুণ প্রজন্মের মঞ্চসফল অভিনেতা কৌশিক করকে এ নাটকে দেখা যায় বুদ্ধিমান জর্জের ভূমিকায়। আবেগের আতিশয্য ছাড়াও ভাবলেশহীন ভাবেও যে মঞ্চে স্বপ্ন বোনা যায় (সংলাপ: ‘একটা খামার হবে আমাদের। ... হ্যাঁ, দশ একর জমিতে। সেখানে শুয়োর থাকবে... একটা বড় খাঁচায় অনেক ইঁদুর থাকবে।...’) তা দেখিয়ে দিয়েছেন কৌশিক। খাটো বুদ্ধির বলিষ্ঠ, অতীব সরল, লেনি স্মল চরিত্রে অভিনয় করেছেন শঙ্কর দেবনাথ। সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘তিস্তাপারের বৃন্তান্ত’র বাঘারুর পর তিনি আবারও তাঁর জাত চিনিয়ে দিলেন। এই কঠিন পৃথিবীতেও মনের মধ্যে নিরাপদ একটা জগৎ গড়ে নিয়েছে লেনি। সে ভালবাসে নরমের ছোঁয়া পেতে। (‘আমি তো শুধু আদর করতে চাই’)। সে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে চায় সমস্ত ইঁদুর ও খরগোশদের। বৃদ্ধ শ্রমিক ক্যান্ডির চরিত্রে সেরাটা দিয়েছেন নির্দেশক দেবাশিস বিশ্বাস। মুগ্ধ করেন কার্লের লাস্যময়ী স্ত্রী-এর ভূমিকায় তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস। স্বামী থাকতেও যার মনে পরিপূর্ণতা নেই। স্বপ্ন ছিল অভিনেত্রী হওয়ার। হতে পারেননি। সেকারণেই তার মধ্যে সব সময় নিজেকে প্রকাশ করার মানসিকতা কাজ করে। তবে যৌনতার জন্য নয়, এক খোঁজ থেকে, অপূর্ণতা থেকে যে ধাওয়া করে বেড়ায় খামারের সব পুরুষদের। আবেদনময়ী এই নারীর প্রাণটিকে বের করে আনেন তন্নিষ্ঠা। কার্লে চরিত্রে ভাল লাগে সুমিত রায়কে। এছাড়াও উল্লেখের দাবি রাখেন কল্যাণী বিশ্বাস, অভিরূপ ঘটক, কৃষ্ণেন্দু অধিকারী প্রমুখ। রবিরঞ্জন মৈত্রের সুনিপুণ আবহ নাটকটির চলনকে প্রাণ দেয়। মঞ্চসজ্জা (দেবাশিস দত্ত), আলো (শেখর সমাদ্দার) এবং পোশাক (সংগীতা পাল) এর নিখুঁত ব্যবহারে নাটকের সময়কালটাও জীবন্ত হয়ে ওঠে।
অন্তরের ধর্ম জাগল যখন
‘ধর্মমঙ্গল’ নাটকে। লিখছেন আশিস চট্টোপাধ্যায়
ছবি: অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়
বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর অপেরাধর্মী প্রযোজনা ‘ধর্মমঙ্গল’। এই কাব্যকে এখনও রাঢ় বাংলার জাতীয় মহাকাব্য বলা হয়। যদিও এই নিয়ে মতভেদও আছে। তবু ১৭১০ খৃষ্টাব্দ বা তার পরবর্তীতে ঘনরাম চক্রবর্তীর লেখা যে ‘ধর্মমঙ্গল কাব্য’, তার আখ্যান ভাগ কিন্তু সমসাময়িক চণ্ডী বা মনসা বিষয়ক মঙ্গলকাব্যগুলির মতোই ইতিহাস ঘেঁষা। মনসামঙ্গলে দেখা যায় দেবী মনসা জোর করে চাঁদ সদাগরের পুজো আদায় করছেন। চণ্ডীমঙ্গলে দেবী চণ্ডী উৎকোচ দিতে চাইছেন কালকেতুকে। কিন্তু ধর্মমঙ্গলে রাজা লাউসেন কোনও বিগ্রহ নয়, মানবধর্মকেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। তার জন্য লাউসেনের যে লড়াই তাকে রাঢ়ের বীরগাথা বলা হলেও বাস্তবে সেটাই প্রবহমান। ‘ধর্মমঙ্গল’ নাটকে তাই তুলে ধরতে চেয়েছেন নাট্যকার নির্দেশক উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়।
ধর্মমঙ্গল সম্ভবত এই প্রথম মঞ্চে এল। জেলার একটি নাট্যদলের শিল্পী সমন্বয়ে দুঘণ্টা পনেরো মিনিটের এই নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে নানান লোক উপাদান। রায়বেঁশে, রণপা, বহুরূপী, ঢাক, ঢোল, বাউল, ঘোড়ানাচ। বীরগাথাই যদি ধর্মমঙ্গলের মূল বিষয় হয় তাহলে এই ধরনের লোক আঙ্গিকের ব্যবহার খুবই অর্থবহ। যা দর্শকদের কাছে খুবই গ্রহণীয় হয়েছে।
উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় লাউসেনের চরিত্রটি অতি যত্নে নির্মাণ করেছেন যা খুবই প্রশংসনীয়। অন্যান্য ভূমিকায় নজর কাড়েন চন্দনা মণ্ডল (রঞ্জাবতী), রূপা সুতার (কলিঙ্গ), অন্বেষা ঘোষ (কনোরা)। এ ছাড়াও গৌতম আচার্য (কর্ণ সেন), রথীন্দ্রনাথ ভাণ্ডারী (দেব পাল), কৌশিক রায় (কামরূপ রাজ) বেশ ভাল। আবহ সঙ্গীতে কার্তিক দাস বাউল ও তার সম্প্রদায় অনবদ্য সুর দিয়েছেন। তবে সংলাপের সঙ্গে প্যাথোজ মিউজিকের ব্যবহার খুব ক্লিশে মনে হয়। খইরুল ইসলাম ও রাধামাধব ঘোষের আলোর কাজ ভাল। কিন্তু মাঝে মধ্যে অকারণে উজ্জ্বল আলো ফেলে মঞ্চ-মায়াসৃষ্টিতে কিছুটা বিঘ্ন ঘটিয়েছেন এই দুই আলোক শিল্পী। শেষ দৃশ্যটির অভিঘাত ভোলার নয়। যুদ্ধ জয়ের পর উন্মুক্ত জনতা যখন লাউসেনকে সিংহাসনে বসাতে চাইছে তখন দূর থেকে ভেসে আসে রঞ্জাবতীর সেই অমোঘ উচ্চারণ, ‘পুত্র ওখানে বসলে মানুষ ভুলে যায় বন্ধুত্ব’। কনড়া বলে ওঠে, ‘ওই সিংহাসন স্নাত হয়েছে শত সহস্র নারীর রক্তে’। কালু ডোমের কথায়, ‘ওখানে বসলে মানুষ ভুলে যায় মনুষ্যত্ব’। আর তার পরই মঞ্চে ফুটে ওঠে অত্যাশ্চর্য এক দৃশ্য। সংখ্যাধিক মানুষ মাথায় করে নিয়ে আসে অতিকায় এক সিংহাসন। সেই সিংহাসনে লাউসেন নিজে না বসে ধর্মকে প্রতিস্থাপন করেন। এ ধর্ম কোনও বিগ্রহ নয়। অন্তরের ধর্মচেতনার জাগরণ, যা মানুষকে মানুষ হিসেবে বাঁচতে শেখায়।
অমলের মুক্তি কোথায়
দুর্বল নাট্য ভাবনা। লিখছেন শিখা বসু
রূপদর্শন নাট্যগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘ডাকঘর’ এবং ‘রক্তকরবী’র ভাবনায় গড়ে ওঠা ‘খ্যাপাদের খ্যাপামি’। প্রয়াতা সুতপা দাশগুপ্তের হাতে মেলবন্ধন ঘটেছে এবং নির্দেশনার দায়িত্বে অর্পিতা চক্রবর্তী। এঁদের প্রত্যেকেরই অভিনয় খুবই ভাল। বিশেষ করে ডাকঘর-এ। অমল ও তার খেলার সাথি হয়ে আসা বাচ্চাদের দলগত অভিনয় খুব ভাল। স্বাভাবিক আবেগে অভিনয় করেছে পিসিমা রিনা।
কিন্তু দুর্বলতা রয়ে গেছে মূল নাট্যভাবনায়। ডাকঘরে অমলের মুক্তি আর রক্তকরবীর রাজার জাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসা কি কোনও যুক্তিতে মেলানো যায়? ডাকঘর অংশে অনেকটাই মূলানুগ থেকেও (পিসিমা যদিও মূল নাটকে নেই) শেষে রাজ কবিরাজের অনুপস্থিতিতে অমলের কাছে রাজার চিঠি আসা সত্যি না হয়ে তা হয়ে দাঁড়ায় শরীরী মৃত্যু। সেই অমল যখন আবার গিয়ে দাঁড়ায় সবার সঙ্গে রক্তকরবীর রাজাকে জাল ছিঁড়ে বেরোবার ডাক দিতে – বেশ ধরে নেওয়া গেল সে আনন্দের প্রতীক। মুক্তির প্রতীক। কিন্তু তাকে জীবিত হতে দেখে পিসিমার এত আনন্দ কেন? রক্তকরবীতে পাওয়া যায় রাজা, নন্দিনী, বিশু পাগল, গোকুল, অধ্যাপক আর কিশোরকে। সর্দার, গোসাঁই সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। রাজাকে প্রথম থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। অমল, নন্দিনীদের ডাকে বের হয়ে আসে রাজা। কিন্তু এই রাজা নন্দিনীর হাত ধরে রঞ্জনের পথে, মুক্তির পথে সর্দারদের সঙ্গে লড়াই করতে এগিয়ে যায় না। নাট্য অংশের এই দুর্বলতা সত্ত্বেও, বিভিন্ন বয়সি শিল্পীদের নিয়ে যত্নে কাজ করেছেন যা প্রশংসনীয়।
লোক ঠকিয়ে সাধক
নাটকের শুরুতেই ব্রেখটীয় কায়দায় দর্শকাসনের ভেতর দিয়ে পুণ্যবাবুর পালানোর দৃশ্য। পেছনে তার পাওনাদার। সম্প্রতি দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত রচিত নাটক, নিউ থিয়েটার্স-এর ‘পুণ্যবানের বোঝা’-তে এমনই সূচনা। ধার দেনায় জর্জরিত পুণ্যবাবুর সংসারে মানুষ বলতে তিনি আর তার মেয়ে পরী। খামখেয়ালি পনায় চাকরিও ছেড়েছেন কয়েকটা। স্ত্রী বিয়োগের পর সংসার লাটে উঠতে বসেছে। প্রতিদিনই দরজায় হানা দেয় পাওনাদাররা। সামলাতে হয় মেয়ে পরীকে। পালিয়ে বেড়ান পুণ্যবাবু। অবশেষে পাড়ার ছেলে বিষ্ণুর পরামর্শে লোক ঠকানো উপার্জনের পথ বেছে নেন। পুরো নাটকটাই দাঁড়িয়ে পুণ্য’র চরিত্রে পরিচালক বেণু চট্টোপাধ্যায়-এর অভিনয় দক্ষতায়। পরী তানিয়া দাশগুপ্তকে বেশ মিষ্টি লাগে। প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের বিষ্ণু’কে অতিনাটকীয় লাগে। মনে থাকে সুভাষ সরকারের সূরচাঁদ চরিত্রটি। তবে, আলো এবং সঙ্গীতের ব্যবহারে বেশ তাল কাটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy