নাটকের একটি দৃশ্য।
যাত্রাজগতের নক্ষত্র, বাংলা অভিনয়জগতের এক বিরাট তারকা চপল ভাদুড়ী— যাত্রাজগতের শেষ অভিনেতা, যাঁর নারীচরিত্রের অভিনয় তদানীন্তন যাত্রার দুনিয়াকে আলোড়িত করেছিল। দমদম শব্দমুখ নাট্যকেন্দ্র তাঁরই জীবনকথার উপরে নির্ভর করে উপস্থাপনা করেছে এই নাটক। রাকেশ ঘোষ পরিচালিত ‘উপল ভাদুড়ী— টেল অফ আ ডেড স্টার’ মনের মধ্যে দোলা দিয়ে যায়। এই ধরনের নাটকে অডিয়ো-ভিডিয়ো ক্লিপ প্রয়োগের প্রবণতা থাকে। কিন্তু এই নাটকে পরিচালক রাকেশ ঘোষ সে পথে না গিয়ে, পুনর্নির্মাণের পথ অবলম্বন করেছেন নাচের ব্যবহার কম্পোজ়িশনের মাধ্যমে— অতীতের ছবিকে জীবন্ত করে তুলেছেন সেই ভাবে।
এ বার মূল নাটক প্রসঙ্গে আসা যাক। এটি জীবনকথা, তাই স্বল্প সময়ে স্টেজ-উপযোগী করে উপস্থাপনা করা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই হিসেবে এই নাটক নিঃসন্দেহে সফল। যদিও শেষের দিকে কাহিনির গতি হঠাৎই বেড়ে গিয়েছে। নাটকের মূল চরিত্র উপল ভাদুড়ী— হারিয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধ অভিনেতা। তারই স্মৃতির রাস্তা ধরে নাটকের এগিয়ে যাওয়া। তার অভিনয়জীবনের শুরু মায়ের হাত ধরে। মায়ের মতো গলার জন্য তাকে কণ্ঠস্বর পাল্টাতে বলা হয়। কিন্তু সত্যিই কি চাইলেই পাল্টানো যায়? নিজের সত্তাকে, শিল্পীর ভিতরকার অভিনেতাকে পাল্টে ফেলা মোটেই সহজ নয়।
অসংখ্য বার উপল বলে, তার অভিনয়ের প্রেরণা তার মা আভা দেবী। সেই আভা দেবীর উপস্থিতি এ নাটকে উপলেরই অন্তর্মনের রূপক। অভিনয় সত্তা, বাসনার নানা স্তরে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছে সে মায়ের কাছে— নিজের অন্তরের কাছে। অন্য রকম হওয়া তো সত্যিই আমাদের সমাজ সহজে মেনে নেয় না, ঠেলে দেওয়া হয় একদম কোণে, করে দেয় প্রান্তিকেরও প্রান্তিক। গলার স্বরে, কিছুটা স্বভাবে নারীসুলভ হয়েও গোটা বাংলায় যাত্রার শ্রেষ্ঠ নায়িকা ‘উপলরানি’ হয়ে ওঠার পথ মসৃণ ছিল না মোটেই— আসলে প্রান্তিক যে! তার পর সেই ‘রানি’ থেকে সাফল্যের সোপানে ওঠার স্মৃতিচারণার উপস্থাপনা এক কথায় অপূর্ব! আর এই অপূর্ব উপস্থাপনা এ নাটকে দেখা গিয়েছে বারবার।
বৃদ্ধ উপল ভাদুড়ীর চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বয়ং চপল ভাদুড়ী। তাঁর বলিষ্ঠ উপস্থিতি, কণ্ঠের অসাধারণ এবং ব্যতিক্রমী ব্যবহার এ নাটককে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। তাঁরই অভিনয়ের রেশ টেনে, গোটা নাটকের বাকি অংশে ‘উপল ভাদুড়ী’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন রঞ্জন বসু। পরিচালনার পাশাপাশি, গৌরমোহনের চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করেছেন রাকেশ ঘোষ। এ ছাড়া নীলাঞ্জন সাহা, প্রদীপ রায়, জয়েশ লাহা-সহ প্রত্যেকেই নিজ নিজ চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এক কথায়, অভিনয় এ নাটকের সম্পদ। আবার এই নাটকে যাত্রা ও থিয়েটারের মিশ্রণ রয়েছে, তাই অভিনয় মেলোড্রামাটিক হওয়া স্বাভাবিক—অন্তত কিছুটা হলেও। কিন্তু এই মেলোড্রামা কখনওই নাটকের গতিপথকে রুদ্ধ করেনি। এ ব্যাপারে পরিচালক এবং অভিনেতা উভয়ের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।
এই নাটকের সাফল্যের কারণ আলো, সঙ্গীত ও নাচের ব্যবহার। বাবলু সরকার নাট্যজগতের আলোর ব্যাপারে প্রতিষ্ঠিত নাম। নাটকে সেটের বিশেষ ব্যবহার না থাকায়, আলোর ব্যবহার বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে। বাবলু সরকারের আলোর সংযত ব্যবহার, প্রয়োজনে আলো-ছায়া দিয়ে মোহময় পরিস্থিতির উপস্থাপনা এক কথায় অনবদ্য। শুধু একটি দৃশ্যে মঞ্চের এক কোণে বৃদ্ধ উপল, আর অন্য কোণে কিশোর উপলের নাটকীয় উপস্থিতিতে বৃদ্ধ উপল আলোকিত হয়ে রইলেন, আর অন্যজন অন্ধকারে। এ যদি পরিচালকের কোনও ইঙ্গিত বহন করে, তবে তার ঠিক প্রকাশ হয়নি। আর তা না হলে বলতে হবে যে, বাবলু সরকার শুধু আলোই করেন না, অন্ধকারও করেন।
এ নাটকে সঙ্গীতের ব্যবস্থাপনা করেছেন অভিজিৎ আচার্য। নেপথ্য সঙ্গীত ও মিশ্রণের কাজ করেছেন জগমোহন সিংহ। প্রাণবন্ত ও প্রাসঙ্গিক সঙ্গীতের প্রয়োগ নাটকটিকে আলাদা মর্যাদা দান করেছে। যাত্রা-থিয়েটার মিশ্রণে একক গানের চেয়ে কোরাসের গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়। কিন্তু এই কোরাস অংশ বারবার ছন্দপতন ঘটিয়েছে। এ ব্যাপারে পরিচালক ও সঙ্গীত পরিচালক তাঁদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।
যাত্রাপালায় সখীর দল এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে চিরকাল। এই নাটকে নাচের অংশে তাদের অবদানের কথা না বললে, এ লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। দলগত নাচ এ নাটকের এক সম্পদ।
এই নাটক যেমন তথ্যনির্ভর, তেমনই আবেগঘন। পাশাপাশি, একটি নির্দিষ্ট সময়কে মনে রেখে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নাটক। এত অনুভূতি একসঙ্গে উপলব্ধি করতে হলে মনে হয়, নাটক সামনাসামনি দেখাই ভাল। আসলে সব কথা কি লিখে বোঝানো যায়, না কি চাইলেই তা পারা যায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy