Advertisement
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

সেই ট্র্যা়ডিশন সমানে চলিতেছে

ছোঁয়াছুঁয়ি, এক পঙ‌্‌ক্তিতে খাওয়া নিয়ে বাছবিচার। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত চমৎকার স্মৃতিকথা লিখতেন। বিবেকানন্দের কথা, রামকৃষ্ণের কথা, বিবেকানন্দের গুরুভাইদের কথাই শুধু তাতে থাকত না। থাকত দেশ-কাল সমাজের কথা।

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত চমৎকার স্মৃতিকথা লিখতেন।

বিবেকানন্দের কথা, রামকৃষ্ণের কথা, বিবেকানন্দের গুরুভাইদের কথাই শুধু তাতে থাকত না। থাকত দেশ-কাল সমাজের কথা।

উনিশ শতকের বাঙালি কী খেত, কী পরত, বাড়ি-ঘরের চেহারা-চরিত্র কেমন ছিল সেই সব নানা খুঁটিনাটির হদিস থাকত তাঁর লেখায়।

বাঙালির খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বাছ-বিচারের নানা কথা লিখেছেন তিনি। ‘তখনকার দিনে খাওয়া-দাওয়া একটা বিষম সমস্যার বিষয় ছিল।’ নানা শ্রেণি আর বর্ণের মানুষে ভরা কলকাতা। তারা একে অপরের সঙ্গে বসে খায় না। খেলে নাকি জাত যাবে।

কেবল শিমলেপাড়ায় পরমহংস মশাইয়ের যাতায়াতের পর থেকেই অবস্থা গেল বদলে।

পরমহংস মশাই আসতেন রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে। প্রথম প্রথম শিমলেপাড়ার কলকাত্তাইয়া বাবুরা ভেবেছিলেন দক্ষিণেশ্বরের পূজারি বামুনকে নিয়ে বেশ আমোদ করবেন, প্রয়োজনে কান মুলে দেবেন।

কান মুলে দেওয়া শব্দটি তখন বেশ চালু ছিল। কেউ কাউকে অবজ্ঞা করে হারিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেই বলত কান মুলে দেব।

মহেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন ‘পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে … বারকতক আসা-যাওয়া করাতে পাড়ার লোকের’ তাঁর প্রতি আর বিদ্বেষ রইল না।

বরং বিচিত্র এক কাণ্ড হল। রামদাদার বাড়ির ছাদে পরমহংস মশাই এলে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হত। বিনা নেমন্তন্নে নানা জাতের মানুষ একসঙ্গে খাচ্ছে এ তখনকার কলকাতা কমলালয়ে অসম্ভব কাণ্ড।

অথচ রামদাদার বাড়ির ছাদে পঙক্তিভোজন। ব্রাহ্মণ-কায়স্থে ভেদাভেদ নেই। বেপাড়ার লোকজনও আছেন। পরিতৃপ্তি করে লুচি-তরকারি খাচ্ছেন সকলে। তখনকার যজ্ঞিবাড়ির বেগারঠেলা খাওয়া নয়, আনন্দ করে খাওয়া। একসঙ্গে বসে কি শুধু পুরুষেরা খাচ্ছেন? মেয়েরাও খাচ্ছেন ।

নীচে দালানে বসেছেন পরমহংস মশাই। হাঁটু দুটি উঁচু করে আসনের ওপর বসে কিছু একটা খাচ্ছিলেন। নানা বাড়ির মেয়েরা তাঁর সামনে ও বাঁদিকে।

কারও মুখে ঘোমটা নেই। যে যুবকেরা ওপরে পরিবেশন করতে যাচ্ছেন তাঁরা যাওয়ার পথে দালানে একটু থেমে এই সহজ-দৃশ্য দেখছেন। বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া ঘিরে মানুষে মানুষে যে ভেদ তা যেন মুছে যাচ্ছে।

বিবেকানন্দের ভাইয়ের লেখা এই বিবরণ উনিশ শতকের আশির দশকের কলকাতার, কলকাতায় এ নতুন ঘটনা। তবে অন্যের সঙ্গে বসে খাব কি খাব না এই বাছ-বিচার নানা সময় ফিরে ফিরে আসে।

বাংলাভাষার জন্মকাল থেকেই খাওয়া-ছোঁওয়া নিয়ে এই বাছ-বিচার।

তা হবে নাই বা কেন ?

বর্ণাশ্রমের কুফল তো লোকসমাজে নানা ভাবে প্রকাশিত। সংস্কৃত শাস্ত্রজ্ঞরা খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে ‘আশ্রয় দোষ’-এর কথা বলেছিলেন।

আশ্রয় দোষ অনুসারে ব্যক্তিবিশেষের ছোঁয়া খাবার চলবে না, ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে বসে খাওয়া চলবে না। সেখান থেকেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে নানা লোকাচার, ভেদ জ্ঞান।

তবে মাঝে মাঝেই উদার মানুষেরা আসেন। এই ভেদ জ্ঞান দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। চৈতন্যদেব করেছিলেন।

চৈতন্যভাগবতে আছে নিমাইয়ের নগর ও বাজার পরিক্রমার কথা। নবদ্বীপে তখন এক এক জাতি এক এক পাড়ায় থাকেন।

নিমাই ব্রাহ্মণের ছেলে, বিনা আমন্ত্রণে গিয়ে গোয়ালপাড়ায় হাজির। গোয়ালপাড়ায় তো হাল আমলের মাদার ডেয়ারির মতো আউটলেট ছিল না যে, গেলেই দুধ-দই কেনা যাবে।

গোপেরা অবশ্য বাজারে গিয়ে দুধ-দই বিক্রি করত। তবে কোনও ব্রাহ্মণসন্তান তাদের বাড়ি গিয়ে বসে দুধ-দই চাইছে এমন ‘দুর্ঘটনা’ ঘটত না।

নিমাই গিয়ে বলেন ‘দধি দুগ্ধ আন’। শুধু কি দই-দুধ!

গোপেরা ঘাড়ে করে নিমাইকে ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলল, তাদের আবদার ‘চল মামা ভাত খাই গিয়া’।

নিমাইয়ের ভক্তিধর্মে চণ্ডাল ব্রাহ্মণের থেকে শ্রেষ্ঠ – তিনি খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আশ্রয় দোষ মানবেন কেন! খেটে খাওয়া মানুষদের সঙ্গে বসে খেতে তাঁর আপত্তি থাকার কথা নয়, ছিলও না। ভেদজ্ঞান ছিল না নিমাইয়ের পরিকর নিত্যানন্দেরও।

তবে চৈতন্যদেবের ভক্তিধর্ম কি পেরেছিল খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সামাজিক ভেদ ও বঞ্চনা পুরোপুরি মুছে দিতে?

মহাশ্বেতা দেবী সমাজের প্রান্তে থাকা মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন চিরকাল। সামাজিক প্রবঞ্চনার প্রকৃত চেহারা নিজের হাতের তালুর মতো চেনেন তিনি। ভক্তি আন্দোলনকে উচ্চবর্ণের মানুষেরা যে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল এমনই সন্দেহ তাঁর।

‘বান’ নামে মহাশ্বতার গল্প।

১৫১৩ সালের কথা সে গল্পে। নিমাই তখন চৈতন্যদেব। রান্নাপুজোর দিন। কাটোয়ার কাছের একগ্রাম। রূপসী বাগদিনীর ছেলে চিনিবাস খুব খুশি। পূর্বস্থলীর শ্রীনিবাস আচার্য ঠিক করেছেন চাঁড়াল-বাগদি সবাইকে বাড়িতে ডেকে দাওয়ায় বসিয়ে ভাত খাওয়াবেন। যুবক সন্ন্যাসী নিমাই মাকে দেখে নীলাচল ফিরছেন। পথে এ গ্রামে আসবেন।

তাঁকে ঘিরে বিত্তশালী সিরস্তদার পোতদার আচার্যের এই খাওয়ানোর আয়োজন। এতে তাঁর ‘নামডাক হবে’। এই তো চাই।

চৈতন্য চলে গেলে ‘চাঁড়াল বাগদী আবার যেমন ছিল তেমন রইবে।’

বাচ্চা ছেলে চিনিবাস এত-শত জানে না। সে একসঙ্গে দাওয়ায় বসে দুটো ভাতের স্বপ্ন দেখেছিল— একদিনের জন্য হলেও তো সত্যি। ‘গৌরাঙ সন্ন্যাসী নাকি উঁচুকে নিচু আর নিচুকে উঁচু করবে বলে লেচে বেড়াচ্ছে।’

চিনিবাসের স্বপ্ন একদিনের জন্যও সত্যি হল না। চৈতন্যদেব শান্তিপুর-কাটোয়া হয়ে কুমারহট্টের পথ ধরলেন। চিনিবাসের গ্রামে ঢুকলেন না বলে দাওয়ায় বসে একসঙ্গে গরমভাত খাওয়া হল না। তাদের না-খাইয়ে দাওয়া থেকে নামিয়ে দিল।

মহাশ্বেতা যা লিখেছেন তা মর্মে মর্মে সত্য, বর্ণহিন্দু সমাজ একসঙ্গে পাশাপাশি বসে খাওয়া সহজ ভাবে মেনে নেয়নি, জাতের বিচার ধীরে ধীরে হয়তো কেটে গেছে খানিক।

তার জায়গায় এল মানুষে মানুষে ভেদ তৈরি করার নতুন মাপকাঠি। সাদা গায়ের রং যাদের সেই সাহেবরা অনেকেই কালো-বাদামি দেশিদের সঙ্গে বসে খেতে চায় না।

বড়লোকেরা গরিব-খেটে খাওয়া মানুষদের খাওয়ার টেবিলে দূরে রাখতেই পছন্দ করে।

ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা ‘ইংরেজি নববর্ষ’। সে কবিতায় আছে সাহেবদের নববর্ষ পালনের কথা।

অভিজাত সাহেবদের পাড়ায় সেই নববর্ষের উৎসবে কালো-বাদামি বাঙালিরা ঢুকতে পারেন না।

ঈশ্বর গুপ্ত তাই যেন একটু দূর থেকেই দেখছেন— তাদের খানা-পিনা।

তবে চপ-কাটলেট-মুরগি এসব খাওয়ার বাসনা তো পৌষ উৎসবে পিঠে-পুলি খাওয়া বাঙালির মনে জেগে ওঠা স্বাভাবিক।

সে বাসনা পূর্ণ করার জন্য কলকাতায় গড়ে ওঠা ‘হোটেলের শপ’ই ভরসা। তবে সেই হোটেলে নেটিভদের মধ্যে তারাই যায় যাদের পেটে দু-পাত্তর ইংরেজি শিক্ষা পড়েছে, যাদের কলকাতায় ব্যবসা করে দুটো পয়সা হয়েছে।

গরিব-গুর্বো বাঙালি সে হোটেলে যাওয়ার কথা ভাবে না। তাদের জন্য সদ্য গড়ে ওঠা কলকাতার ময়রার দোকানই ভরসা।

নেটিভ বাঙালি বিলেতে গেলে অবশ্য সেখানকার বড় ইংরেজরা সাদা-বাদামির ভেদ খুব একটা করেন না।

কায়স্থ বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী হয়েছেন, কালাপানি ডিঙিয়ে বিদেশে গেছেন, তার আগে দেশে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরির সময় কার সঙ্গে বসে কী খেয়েছেন তার ঠিক নেই।

এ জন্য সিমলে পাড়ার নরেন দত্তকে সন্ন্যাসী হয়েও অকথা-কুকথা শুনতে হয়েছে। বিলেতে গিয়ে অবশ্য সাদাদের মাঝে বসে খেতে গিয়ে বিভেদের শিকার হতে হয়নি।

বিবেকানন্দের শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর সন্ন্যাসী গুরুকে, ‘‘মশাই আপনি বিলেতে গিয়ে কী খেতেন?’’

বিবেকানন্দ খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে ‘গাঁধীবাদী’ নন। গাঁধী যখন ওকালতি পড়তে বিলেত গিয়েছিলেন খাওয়া-দাওয়ার সংস্কার নিয়ে তাঁকে অসুবিধেয় পড়তে হয়েছিল।

সে বালাই বিবেকানন্দের ছিল না। শিষ্যকে জবাব দিয়েছিলেন তিনি বিলেতে ওদের মতোই খেতেন। খেতেন যে তা বোঝা যায় বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ লেখাটি পড়লে।— ‘‘এ সকল দেশেই ডিনারটা প্রধান খাদ্য— ধনী হলে, তাঁর ফরাসি রাঁধুনি এবং ফরাসি চাল।

প্রথমে একটু আদটু নোনা মাছ বা মাছের ডিম; তারপর আজকাল ফ্যাশন— একটা ফল; তারপর মাছ; তারপর মাংসের একটা তরকারি; তারপর থান মাংস শূল্য, সঙ্গে কাঁচা সব্‌জি; তারপর আরণ্য মাংস মৃগপক্ষ্যাদি; তারপর মিষ্টান্ন; শেষে কুল্পী – মধুরেণ সমাপয়েৎ।

ধনী হলে প্রত্যেকবার থাল বদ্‌লাবার সঙ্গে সঙ্গে একটু মদ্‌ বদলাচ্ছে – সেরি, ক্ল্যারেট, ন্যামপা ইত্যাদি এবং মধ্যে মধ্যে মদের কুল্পী একটু-আধটু। থাল বদ্‌লাবার সঙ্গে সঙ্গে কাঁটা চামচ্‌ সব বদ্‌লাচ্ছে।’’

ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা বিবেকানন্দের বেশ প্রিয় ছিল। তবে গুপ্তকবি তো আর ইংল্যান্ড-আমেরিকা জয় করেননি। তাই সাহেবদের সঙ্গে একাসনে সাহেবি কায়দায় খাওয়া-দাওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর নেই, বিবেকানন্দের আছে।

বিবেকানন্দ বেশ বুঝেছেন সাহেবদের সঙ্গে খেতে বসে টেবিলের আদব-কায়দায় ভুল করলে চলবে না। সে কায়দায় ভুল করলে সাহেবরা ঠাট্টা করতে ছাড়বে না, নেটিভদের বাঁকা চোখে দেখবে। জাতপাত নয়, এক টেবিলে খেতে বসলে আদব-কায়দা জানা চাই।

ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত ইংল্যান্ডে গেছেন। দাদা নরেন্দ্র তখন ইংল্যান্ডে বিবেকানন্দ খাওয়ার টেবিলে বসে ভাইকে কলকাত্তাইয়া বাংলায় মাঝে মাঝে টেবল-ম্যানারস শেখাচ্ছেন। ওভাবে ধরতে নেই, ওভাবে খেতে নেই।

বিবেকানন্দ খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে যে দেশে যেমন সে দেশে তেমন মেনে চলতে কসুর করেননি। রামকৃষ্ণ ও গাঁধী খাওয়া-দাওয়ার ভেদ দূর করার ক্ষেত্রে আরেক পথের পথিক। তাঁদের দেশজ চাল তাঁরা ছাড়েননি, রামকৃষ্ণকে বিদেশে যেতে হয়নি । গাঁধী মহাত্মা হয়ে ওঠার আগে একরকম— নিজের নিরামিষ চাল ও মদ্যপান বিরোধিতা বজায় রেখেছেন । দক্ষিণ আফ্রিকায় গাঁধী যখন মহাত্মা হয়ে ওঠার দিকে এগোচ্ছেন তখন তাঁর নিজস্ব রীতি , ক্রমে তা আজকের ভাষায় গাঁধীগিরি হয়ে উঠেছে।

হরিজনদের সঙ্গে বসে ভোজনে গাঁধীবাবা তৃপ্ত। সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে— আহমেদাবাদ আশ্রমে দুদাভাই এসেছেন। দুদাভাই গাঁধী আশ্রমের নিয়মকানুন মেনে চলেন, তবু তাঁকে নিয়ে চাঞ্চল্য। তিনি অন্ত্যজ পরিবারের সন্তান।

গাঁধী তাঁকে আশ্রমে ঠাঁই দিয়েছেন তাই যে কুয়ো থেকে জল তোলে সে বলল তুলব না।

মগনলাল এমনিতে গাঁধী ভক্ত, টাকা দেন আশ্রমে। দুদাভাই এসেছেন, আশ্রমে আছেন বলে তিনি টাকা দেওয়া বন্ধ করলেন।
গাঁধী অবিচল।

বললেন, আশ্রম বন্ধ হলে অন্ত্যজদের পাড়ায় গিয়ে থাকবেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদাদের হাতে বর্ণবিদ্বেষের শিকার গাঁধী, তিনি সে স্মৃতি কী ভাবে ভুলবেন।

রবীন্দ্রনাথকে অবশ্য শান্তিনিকেতন আশ্রমে খানিকটা সমঝোতা খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে করতে হয়েছিল।

ব্রাহ্মণ ছাত্র অব্রাহ্মণকে প্রণাম করবে কি না, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ একাসনে খাবেন কিনা, অব্রাহ্মণের হাতে ব্রাহ্মণ খাবেন কি না এই প্রশ্নগুলি উঠত।

রবীন্দ্রনাথ একরকম সাম্যবাদী নিয়ম চালাতে পারেননি। তাঁর ‘অচলায়তন’ নাটকে পঞ্চক আবাসিক বিদ্যালয়ের পাঁচিল ডিঙিয়ে বাইরে চলে যায়। ব্রাত্যদের পাড়ায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়াতে তার আপত্তি নেই। ‘গোরা’ উপন্যাসের শেষে গোরা আনন্দময়ীর ভারতবর্ষকে চিনতে পারে— তখন তার খাওয়া-দাওয়ার বাছবিচার চলে গেছে।

মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের অনুধ্যান’ বইতে লিখেছেন খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে পরমহংস মশাই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পেরেছিলেন।

তবে রামকৃষ্ণদেবের খাওয়া-দাওয়ার সংস্কার সহজে যায়নি।

সারদানন্দের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন রানি রাসমণির অন্ন গ্রহণে আপত্তি ছিল রামকৃষ্ণের, পরে তা চলে যায়।

তবে বঙ্গ-সংস্কৃতির এই সব টুকরো-টাকরা থেকে বোঝা যায় খাদ্যাখাদ্যবিচার সহজে যাওয়ার নয়, তবে যাওয়াটাই শিক্ষা।

তা অর্জন করতে হয়।

সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে!

গন্ধে জাত যায়

তৎপর একদিন (পীরআলি) এক জলসায় ব্রাহ্মণাদি সকল জাতিকেই নিমন্ত্রণ করিলেন, এমন সময়ে মজলিসের চারি দিকে মুসলমানী খানার সুগন্ধ বহিল … ধূর্ত পীরআলি কামদেব ও জয়দেবকে ধরিয়া কহিলেন যে, ‘ঘ্রাণে যখন অর্ধেক ভোজন হয়, তখন নিশ্চয়ই গোমাংসের ঘ্রাণ পাইয়া তোমাদের জাতি গিয়াছে।’

(রবীন্দ্রজীবনী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)

স্পর্শদোষ

একদিন সকলের খাওয়ার পরে শুনিলাম, একটি অস্পৃশ্য জাতির বালকের কোনোপ্রকার সংস্পর্শে অবশিষ্ট অন্নব্যঞ্জন দূষিত হইয়াছে । …আমরা দুগ্ধাদি খাইয়া মধ্যাহ্নভোজন শেষ করিয়া স্বস্থানে আসিলাম।

(রবীন্দ্রনাথের কথা, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

অধোগতির কারণ

আমাদের কি আর ধর্ম ? আমাদের ‘ছুঁৎমার্গ’, খালি ‘আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না।’ হে হরি ! যে দেশের বড় বড় মাথাগুলো আজ দু-হাজার বৎসর খালি বিচার করছে— ডান হাতে খাব, কি বাম হাতে; ডান দিক থেকে জল নেব, কি বাম দিক থেকে এবং ফট্‌ ফট্‌ স্বাহা, ক্রাং ক্রুং হুঁ হুঁ করে, তাদের অধোগতি হবে না তো কার হবে?

(রামকৃষ্ণানন্দকে লেখা, পত্রাবলী, স্বামী বিবেকানন্দ)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy