যশপ্রীত বুমরা। —ফাইল চিত্র।
কোচ থাকাকালীন রবি শাস্ত্রী গর্ব করতেন ভারতীয় দলের জোরে বোলিং আক্রমণ নিয়ে। যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি, মহম্মদ সিরাজ, উমেশ যাদব, ইশান্ত শর্মাদের নিয়ে তৈরি ভারতের টেস্ট বোলিং আক্রমণকে সমীহ করত বিশ্বের সব দল। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, তখন ভারতের জোরে বোলিং আক্রমণই ছিল বিশ্বের সেরা। তিন বছর পর সেই বোলিং আক্রমণই ধুঁকছে। শিবরাত্রির সলতের মতো উজ্জ্বল শুধু বুমরা।
একটা সময় ভারতের বোলিং আক্রমণ সম্পূর্ণ স্পিনারদের উপর নির্ভরশীল ছিল। কপিল দেব সেই ধারণা ভেঙেছিলেন। ক্রিকেট বিশ্বের সামনে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ভারতের মাটিতেও জোরে বোলার তৈরি হয়। তার পর একে একে উঠে এসেছেন জাভাগল শ্রীনাথ, বেঙ্কটেশ প্রসাদ, অজিত আগরকর, আশিস নেহরা, জাহির খানের মতো বোলারেরা। তবে জোরে বোলিং দিয়ে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার মতো শক্তি অর্জন করতে ভারতীয় ক্রিকেটের সময় লেগেছে অনেকটা। না হলে কি আর অবসর নিয়ে ফেলা শ্রীনাথকে ২০০৩ সালের এক দিনের বিশ্বকাপের জন্য ফিরিয়ে আনতে হত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে!
সৌরভের দল বিদেশের মাটিতে টেস্ট জিততে শুরু করেছিল। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির জমানায় বিদেশে লাল বলে জয়ের সংখ্যা বেড়েছিল আরও। বিরাট কোহলির নেতৃত্বে বিদেশের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেটে দাপট দেখিয়েছে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে তাদের কোণঠাসা করেছে। সবুজ পিচে প্রতিপক্ষকে ভয় পাইয়েছে। আউটফিল্ডের মতো সবুজ পিচ তৈরি করে ভারতের সঙ্গে টেস্ট খেলার সাহস পায়নি। ইশান্ত, বুমরা, শামি, উমেশ, সিরাজেরা ভয় পেতে বাধ্য করেছিলেন জো রুট, স্টিভ স্মিথ, কেন উইলিয়ামসনদের।
প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের ঠকঠকানি ধরিয়ে দেওয়া সেই বোলিং লাইন আপই এখন ধুঁকছে। ইশান্ত, উমেশরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অনেক দূরে। বাকিদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পিচেও বুমরা ছাড়া কেউ সুবিধা করতে পারছেন না। বর্ডার-গাওস্কর সিরিজ় খেলতে যাওয়া ভারতীয় দলে বুমরার পর অভিজ্ঞতম জোরে বোলার সিরাজ। মাঠের বিভিন্ন ব্যাপারে তাঁর মনোযোগ যতটা, লাইন-লেংথ ঠিক রাখার ক্ষেত্রে ততটা নয়। পার্থে ৭১ রানে ৫ উইকেট নিয়ে আশা দেখিয়েছিলেন হায়দরাবাদের ক্রিকেটার। পরের দু’টি টেস্টে তিনি ব্যর্থ। শেষ চার ইনিংসে তাঁর সংগ্রহ আট উইকেট। তার মধ্যে চারটি উইকেটই টেলএন্ডারদের। বলার মতো উইকেট অ্যাডিলেডে ট্রেভিস হেডকে ১৪০ রানে আউট করা। অথচ পার্থের সেই পাঁচ উইকেটে টেলএন্ডারদের ছিল একটা। সিরাজের ব্যর্থতার প্রভাব পড়ছে দলের পারফরম্যান্সেও।
প্রথম দু’টেস্টে গৌতম গম্ভীর খেলিয়েছিলেন হর্ষিত রানাকে। অভিষেক টেস্টে ৪৮ রানে ৩ উইকেট নিয়ে নজর কেড়েছিলেন। আউট করেন হেডকেও। তার পর বোধহয় তাঁরই নজর লেগে গিয়েছে। পার্থের দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩.৪ ওভার বল করে ৬৯ রান দেন। উইকেট পাননি। অ্যাডিলেড টেস্টে মোট ১৬ ওভার বল করে ৮৬ রান দিয়েও তাঁর প্রাপ্তির ঝুলি ছিল শূন্য। লাল বলের ক্রিকেটে রান দিচ্ছেন সাদা বলের ক্রিকেটের মতো। উইকেটও পাচ্ছেন না। দিল্লির ২৩ বছরের বোলার দু’ম্যাচ পরই ভরসা হারিয়েছেন গম্ভীরের।
ব্রিসবেনে সুযোগ পান বাংলার আকাশ দীপ। প্রথম ইনিংসে ২৯.৫ ওভার বল করে ৯৫ রানে ১ উইকেট নেন। ভাগ্য সহায় থাকলে আরও উইকেট পেতে পারতেন। স্মিথও তাঁর বলের প্রশংসা করেন। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। গোটা ম্যাচে ১২৩ রান দিয়ে ৩ উইকেট পান। হর্ষিতের পরিবর্তে খেললেও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। চতুর্থ বোলার হিসাবে বর্ডার-গাওস্কর ট্রফিতে খেলানো হচ্ছে অলরাউন্ডার নীতীশ রেড্ডিকে। ব্যাট হাতে দলকে ভরসা দিলেও বল হাতে তেমন কিছু করতে পারেননি এখনও। তিনটি টেস্টে তাঁর সংগ্রহ তিন উইকেট। ওভার প্রতি রান দিয়েছেন ৪.৫৫।
জোরে বোলিংয়ের এমন বেহাল পরিস্থিতিতে ভারতীয় শিবির তাকিয়ে ছিল শামির দিকে। আশা করা হয়েছিল, অন্তত শেষ দু’টি টেস্ট খেলতে পারবেন তিনি। তাতেও জল ঢেলেছে শামির ফিটনেস সমস্যা। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) জানিয়ে দিয়েছে, শামির অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। গোড়ালির চোট সারিয়ে প্রায় এক বছর পর মাঠে ফিরেছিলেন বাংলার জোরে বোলার। সাদা বলের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আবার চোট পেয়েছেন। তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটু ফুলে গিয়েছে। পাঁচ দিনের ক্রিকেট খেলার মতো জায়গায় নেই তিনি। শামি ফিট হতে না পারায় ভারতীয় দল এক রকম দিশাহারা। চাপে ফেলে দিয়েছে বুমরাকেও।
প্যাট কামিন্সের দলের ব্যাটারেরা বুমরা ছাড়া কাউকে সমীহ করছেন না। সমীহ পাওয়ার মতো কেউ কিছু করে দেখাতেও পারেননি। বুমরার উপর চাপ বেড়েই চলেছে। এ বারের বর্ডার-গাওস্কর ট্রফিতে এখনও পর্যন্ত ২১ উইকেট নিয়েছেন বুমরা। দু’বার পাঁচ উইকেট পেয়েছেন। উইকেট প্রতি খরচ করেছেন ১০.৯০ রান। শুধু এটুকু নয়। ২০২৪ সালে বিশ্বের সব জোরে বোলারের মধ্যে বুমরা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বোলিং করেছেন টেস্ট ক্রিকেটে। ব্রিসবেন পর্যন্ত বুমরা করেছেন ৩০৩.৪ ওভার। সবচেয়ে বেশি ২৪টি টেস্ট ইনিংসে বল করতে হয়েছে তাঁকে। চলতি বছরে ১২টি টেস্ট খেলা হয়ে গিয়েছে ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়কের। যা তাঁর ক্রিকেটজীবনে সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ২৯.৪ ওভার। বুমরা একাই টেনে নিয়ে চলেছেন ভারতের বোলিং আক্রমণকে। ২২ গজের অন্য প্রান্ত থেকে সে ভাবে কারও সাহায্য পাচ্ছেন না। শামি হয়তো পারতেন এই অভাব ঢাকতে।
রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, ঋষভ পন্থ, শুভমন গিলদের ম্যাচের পর ম্যাচ ব্যর্থতার ধাক্কাও সামাল দিতে হচ্ছে তাঁকে। ব্যাটারেরা যত কম রান করছেন, বুমরার উপর তত চাপ বাড়ছে প্রতিপক্ষকে বেঁধে রাখার। কিন্তু তাঁর চেষ্টাকে মর্যাদা দিতে পারছেন সতীর্থেরাই। পারছেন না বোলারেরা। পারছেন না ব্যাটারেরা। সব মিলিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মানসিক এবং শারীরিক চাপ পড়ছে বুমরার উপর। অস্ট্রেলিয়া সফরে দু’টি টেস্ট বাকি। অর্থাৎ আরও চাপ সামলাতে হবে বুমরাকে। তিনি পারলেও বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো দশা হতে পারে। বুমরা এক দিকে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা করছেন, অন্য দিকে বাকিরা সেই চাপ আলগা করে দিচ্ছেন। অথচ এই বুমরার নাম শুনেই একদা রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর অধিনায়ক কোহলি কটাক্ষের সুরে বলেছিলেন, কোনও বুমরা-ফুমরাকে দলে নিতে চান না। প্রথাগত ভাবে কখনও ক্রিকেট না শেখাই হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে গিয়েছিল।
বুমরা তখনও নিঃসঙ্গ ছিলেন। এখনও নিঃসঙ্গ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy