সম্প্রতি রবীন্দ্র সদনে ‘অভিশ্রী’ আয়োজিত অনুষ্ঠান ‘দ্য ট্রায়াঙ্গল’ ছিল গান ও কবিতার বিশেষ কোলাজ। তিন শিল্পীর রঁদেভু’র (বা আড্ডার) মুহূর্ত। শিল্পীরা ছিলেন সাহেব চট্টোপাধ্যায়, ইমন চক্রবর্ত়ী ও শোভনসুন্দর বসু। এ দিন মঞ্চকে সাজানো হয়েছিল কফিশপের আদলে। ব্যবহার হয়েছিল ইকো-ফ্রেন্ডলি হ্যান্ডমেড কাগজ। শুরুতেই জয়শ্রী সেনগুপ্তের পরিচালনায় চারটি সমবেত সঙ্গীত মন কাড়ে।
এ দিন প্রবীণ যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী প্রতাপ রায়কে সংবর্ধনা জানালেন সংস্থার কর্ণধার অভিজিৎ সেনগুপ্ত। মূল অনুষ্ঠানের শুরুতেই সাহেব জানিয়ে দিলেন যে এই আড্ডায় ইমন ও শোভনসুন্দরের সঙ্গে দর্শকরাও অংশ নেবেন মাঝে-মধ্যে।
‘অমল ধবল পালে’ ভৈরবী রাগের চলন ও আবেশে ইমনের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে মূল আড্ডায় প্রবেশ। লোকগান ‘পিণ্ডারেতে পলাশের বন’ ইমন সাবলীল।
‘ফাঁকি দিয়া চালাইলি আসাম’ থেকে শুরু করে ‘আজ যানে কি জিদ না ক্যারো’ অনবদ্য। সব শেষে ‘তুমি যাকে ভালবাসো’। কয়েকটি গানে ইমনের ‘উচ্চকিত’ গলা গানের রেশকে যথেষ্ট বিঘ্নিত করেছে।
ইমন, সাহেবের গানের মেজাজকে এগিয়ে নিয়ে গেল শোভনসুন্দরের কবিতাও। শব্দ উচ্চারণ ও সুন্দর প্রকাশ ভঙ্গিমায় শিল্পীর নির্বাচিত কবিতাগুলি এ দিন অন্য মাত্রা পায়।
‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ কবিতায় হারানো শৈশব বেদনার সঙ্গে বাঁশির ব্যবহার খুবই সুপ্রযুক্ত। সার্থক রায়চৌধুরীর ‘আগামী শতকের’ প্রেমের কবিতাটি সত্যি-ই দর্শকদের এক ‘অ-দেখা’ ভালবাসার জগতে উত্তীর্ণ করে। রবীন্দ্রনাথের ‘দুই পাখি’ কবিতায় সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ও তেওড়া তাল অক্ষুণ্ণ রেখেও শিল্পী যে ভাবে তা পরিবেশন করলেন তা অবশ্যই শিক্ষণীয় আবৃত্তি-রূপ। উপস্থাপনা ও তাল-বাদ্যের ব্যবহার ‘খাঁচার পাখি’ ও ‘বনের পাখি’ কবিতাকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়।
শ্রীজাতের কবিতা নিয়েও সেই একই কথা বলতে হয়। কনসার্টের শেষ লগ্নে শোভনসুন্দরের কণ্ঠে ‘পথের পাঁচালি’র অন্তিম ভাগের আবৃত্তি ছিল এ দিনের সমাপ্তির মূল সুর।
সাহেব রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও পুরনো দিনের বাংলা গানও শোনালেন। ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে ভেবেছিল একটি পাখি’ বা ‘যদি কাগজে লেখো নাম’ অনবদ্য। তবে ‘তোমায় নতুন করে পাবো বলে’ ও ‘আজি ঝড়ের রাতে’ টপ্পা অঙ্গের গানে সাহেব অনেক সাবলীল তা বুঝিয়ে দিলেন এ দিন।
মাইক্রোফোনের ত্রুটি শিল্পীর গানের ভাবে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে বেশ কয়েকবার। এ ছাড়াও রবীন্দ্রগানে কয়েকটি শব্দ মধ্যম ও পঞ্চম সুরে যাতায়াত করে। পঞ্চম স্থানে টানা বেশিক্ষণ অবস্থান করলে তা কিছুটা একঘেয়ে হয়ে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। অন্তরার শেষে সেটাই লক্ষ করা গেছে।
এ ছাড়াও রবীন্দ্রগানের নীচের স্বরগুলিতে যে তাঁর গলা স্ববশে ছিল তাও বলা গেল না। ভবিষ্যতে শিল্পী সতর্ক হবেন নিশ্চয় এ কথা বলা যায়।
অনুষ্ঠানের মূল ভাবনা ও পরিকল্পনায় ছিলেন কবি অদিতি বসু রায়।
শুরুতেই হংসধ্বনি
ললিতকলা ও আইসিসিআর-এর যৌথ উদ্যোগে শুরুতেই শোনা গেল হংসধ্বনি রাগে ‘বরদে বীণাপাণি’। পরে মধুবন্তী রাগে খেয়াল ধরলেন জয়ন্ত সরকার। প্রথমে বিলম্বিত একতালে নিজের তৈরি বন্দিশ ‘কাহে সতাও মোহে’, এবং পরে দ্রুত তিনতালে ‘যা রে যা রে পাপিহা’-র মধ্যে মুলতানির আভাস মেশানো রাগটির সার্থক রূপায়ণ শোনা গেল তাঁর কণ্ঠে। সোহিনী রাগে পরিবেশিত ঠুমরি ‘অব না যাও মোরে সইয়া’-র মধ্যেও রইল দক্ষতার পরিচয়। দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গান শোনালেন সংস্থার চার ছাত্রছাত্রী। শ্রেয়াণ, রূপরেখা, দেবাঞ্জনা ও সোনাক্ষী। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় শ্রেয়াণের গলায় রাগেশ্রী-তে আধারিত ‘বাজিছে এ কী সুর আজি তোমার বীণার তারে’ গানটি।
কবিতার প্রাণ
সম্প্রতি আবির্ভাব-এর অনুষ্ঠানে আবৃত্তি শোনালেন তাপস নাগ। তিনি পাবলো নেরুদার একটি কবিতার পাশাপাশি আরও কয়েকজন কবির কবিতার আবৃত্তি শোনালেন শ্রোতাদের। সংস্থার ছাত্রছাত্রীরাও ওই অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শর্বরী মুখোপাধ্যায়, ব্রততী ভট্টাচার্য, প্রলয় সেনগুপ্ত, রাজশীর্ষ ও রূপশীর্ষ দাস প্রমুখ। সংযোজনায় ছিলেন কৃষ্ণা মজুমদার ও সুজিত মজুমদার।
মুদ্রা-নৃত্য
সম্প্রতি শিশির মঞ্চে ব্যারাকপুর মুদ্রা আয়োজিত নৃত্য-সন্ধ্যায় সংবর্ধনা দেওয়া হল ওড়িশি নৃত্যগুরু গিরিধারী নায়েক ও সঙ্গীতশিল্পী অলোক রায়চৌধুরীকে।
প্রথমার্ধে তিমির রায় শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, শাপমোচনের বিশেষ কিছু অংশ নিয়ে পরিবেশন করলেন নৃত্যআলেখ্য। নতুন প্রচেষ্টা।
দ্বিতীয়ার্ধে শাস্ত্রীয় নৃত্যে মালবিকা সেনের (কুচিপুড়িনৃত্য) অবশ্যই প্রশংসনীয়। মিলন অধিকারী (ভরতনাট্যম), সোমা ঘোষ (কত্থক) যথাযথ। তবে আশিস ঘোষের (ভারতনাট্যম) আরও অনুশীলন প্রয়োজন।
এ দিন সব শেষে সুজাতা নায়েকের (ওড়িশি) পরিবেশন দর্শকদের মন কেড়ে নেয়। এ ছাড়াও নৃত্য পরিবেশন করলেন পরমা ভট্টাচার্য, অনুশ্রী চৌধুরী, দেবযানী মজুমদার।
প্রথম আদি
সম্প্রতি অহীন্দ্র মঞ্চে শোনা গেল শ্রাবণী সেন ও অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। শুরুতেই এ দিন ‘প্রথম আদি তব শক্তি’ গানটি দৃপ্ত ভঙ্গিতে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুললেন শ্রাবণী।
অন্য দিকে মন ছুঁয়ে গেছে অগ্নিভর ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো’ গানটি। অনুষ্ঠানে প্রথম গান শুনিয়ে নজর কাড়লেন রামকৃষ্ণ মালি।
তুমি অকুন্ঠিতা
গীতিআলেখ্যটি শুনলেন পিয়ালী দাস
নারীর সংগ্রাম চিরন্তন। সে সংগ্রাম সামাজিক হোক, পারিবারিক, নিজ অস্তিত্বের কিংবা বৃহত্তর স্বার্থের। আর সেখানে গিয়েই বোধ হয় সাহিত্য ও বাস্তব-জীবন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ খুব গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন নারী মনকে, তার সামাজিক অবস্থান ও যাতনাকে। যার প্রমাণ তাঁর সৃষ্টিতে। সেই চিরন্তনতায় আজও আশ্রয় তিনিই। এই ভাবনা থেকেই বোধ হয় ‘ভবানীপুর বৈকালী অ্যাসোসিয়েশন’-এর নিবেদনে আইসিসিআর-এ মঞ্চস্থ হল এক অভিনব গীতিআলেখ্য ‘তুমি অকুন্ঠিতা’। পরিচালনায় ছিলেন প্রমিতা মল্লিক। এই ভাবনাও তাঁরই মস্তিস্ক প্রসূত। শুধু তাই নয়, গীতিআলেখ্যটির ভাষ্য পাঠেও ছিলেন তিনি।
এছাড়াও অংশগ্রহণে ছিলেন প্রমিতা মল্লিকের চার কৃতী ছাত্রী — শাম্ভবী, প্রিয়াঙ্গী, দেবলীনা এবং সুপর্ণা। স্ক্রিপ্ট লিখেছেন পূরবী ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় চারটি ছোটগল্পের (অনধিকার প্রবেশ, দিদি, স্ত্রীর পত্র, বদনাম) প্রধান চার নারী চরিত্রের সামাজিক অবস্থান, দৈনন্দিন যাপন, স্বকীয়তা ও আত্মত্যাগ-এর ওপর লেখা স্ক্রিপ্ট এবং ১৮ টি রবীন্দ্রসঙ্গীতের মিশেলে অনুষ্ঠিত হয় ‘তুমি অকুন্ঠিতা’।
‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ সমবেত রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সমগ্র অনুষ্ঠানটি চারটি পর্বে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি পর্বে ছিল রবীন্দ্রনাথের একটি করে ছোটগল্পের নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে বিশেষ অংশের পাঠ, চারিত্রিক বিশ্লেষণ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই চলন প্রযোজনাটিকে অন্য মাত্রা দেয়।
‘তুমি অকুন্ঠিতা’-য় জয়কালী, শশীকলা, মৃণাল ও সৌদামিনী — এই চারটি নারীচরিত্রের উত্তরণ ধরা পড়ে। প্রখর বুদ্ধিমতী, দৃঢ়চেতা এই নারীরা নিজ অবস্থানেই তাদের ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখেছেন। পাঠে, সঙ্গীতে ১৩০১ থেকে ১৩৪৮ — সময়কালে নারী মুক্তি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তনের বিবর্তনের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে শ্রোতাদের। প্রমিতা মল্লিকের আন্তরিক ও সুমধুর ভাষ্য পাঠে তীব্রভাবে ধরা দেয় এই নারীদের প্রতিবাদ, আর্তনাদ কিংবা উত্তরণ। যা ছুঁয়ে যায় শ্রোতাদের মন।
উল্লেখের দাবি রাখে — ‘তুই কেবল থাকিস সরে সরে’ (শাম্ভবী), ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি’ (দেবলীনা), ‘নাই নাই ভয়’ (সুপর্ণা), ‘এই কথাটা ধরে রাখিস মুক্তি তোরে পেতেই হবে’ (প্রিয়াঙ্গী) ইত্যাদি গানগুলি। শিল্পীদের গায়কিতে কখনও ঝরে পড়ে অভিমান, নিবেদন, প্রতিবাদ, কখনও বা মুক্তির আস্বাদ।
বঙ্কিমের মঞ্চগান
যা শোনা গিয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠেও
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এখনও বাংলার সেরা নভেলিস্টের অন্যতম দাবিদার। পাশাপাশি সঙ্গীতাচার্য যদুনাথ ভট্টাচার্য যদুভট্টের কাছে নিয়মিত পাঠ নিয়েছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের চর্চারও সাক্ষ্য মেলে বান্ধব কবি নবীনচন্দ্র সেনের স্মৃতিচারণে।
সেই আকর্ষণেই তাঁর নানান উপন্যাসের চরিত্ররা কথার ফাঁকে গেয়ে উঠেছে গান। তাঁর উপন্যাসের নাট্যরূপ নাট্যকার ভেদে বারবার জনপ্রিয় হয়েছে বঙ্গরঙ্গমঞ্চে। সময়ের তালে তাল রেখে নানা নাট্যকারের সৃজনে চরিত্রের সংলাপী ভাষা বদলালেও রয়ে গেছে উপন্যাসের মূল গান। কখনও ভিন্ন নাট্যকাহিনির সঙ্গীও হয়েছে বঙ্কিমের গান। সে সব অধ্যায় ঘিরে ভারতীয় সাহিত্যচর্চা কেন্দ্রের আয়োজনে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত হল দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা ও নির্মাণে ‘বঙ্কিমের মঞ্চগান’।
‘সাধের তরণী আমার’ গেয়ে মাতিয়ে দিলেন দেবজিত। জানা যায় এ গান এক সময় দেশে-বিদেশে গেয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। কীর্তন-আশ্রিত ‘মথুরাবাসিনী’ গাইলেন ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের গান দুটি প্রেমের। একটি সোচ্চার অন্যটি নিরুচ্চার। ‘কাঁটা বনে তুলতে গোলাপ’ যেমন মূর্ত হল দেবজিতের কণ্ঠে, তেমনি মূর্ত হল ঋদ্ধির কণ্ঠে ‘ভালবাসা ভুলি কেমনে’।
তবু মনে রেখো
সম্প্রতি শিশির মঞ্চে ‘আন্তরিক’ সংস্থার হয়ে মধুমিতা বসু সংবর্ধনা দিলেন সুমিত্রা রায়কে। যিনি অগ্নীশ্বর সিনেমায় ‘তবু মনে রেখো’ গানটি গেয়েছিলেন। এ দিন তিনি নিজেই সেই গানটি শোনালেন শ্রোতাদের। পরের শিল্পী ছিলেন বিভবিন্দু ভট্টাচার্য। তিনি গাইলেন ‘তুমি রবে নীরবে’। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ছিল শ্রুতি আবৃত্তি। শিল্পীরা ছিলেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্ত়ী ও মধুমিতা বসু। এই জুটি পরবর্তীতে দুটি শ্রুতি নাটকও শোনালেন। ‘দোহারে দেখেছি দোঁহে’ ও ‘উমার প্রস্তুতি’। অসাধারণ অনুভূতি। সঞ্চালনায় ছিলেন সাম্য কার্ফা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy