ব্যতিক্রমী বিহঙ্গ: এ এম মাল্টি ডিসিপ্লিনস গ্যালারিতে অতীন বসাকের প্রদর্শনীর কাজ
স্ট্রাকচারাল কোয়ালিটিকে কত রকম ভাবে দেখানো যায়? যদি সে মাধ্যম ড্রয়িং, পেন্টিং, প্রিন্ট মেকিং (ছাপাই ছবি) হয়? সাদা-কালোয় তাঁর নির্মিত কাঠামোর বৈচিত্র ও গভীরতায় যে কৌতূহল লুকিয়ে থাকে, অন্য দুই মাধ্যমে এসে তাদের দ্রবীভূত করে দেন বর্ণের ও ছায়াতপের ট্রিটমেন্টে। মিশ্রবর্ণের বিন্যস্ত রূপের আড়ালে থেকে যায় ব্রাশিংয়ের ক্ষুদ্র সূক্ষ্মতার নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। যা ব্রাশস্ট্রোকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্রমান্বয় থেকে ছায়াতপে অথবা আলো-আঁধারের কাব্যময় কোনও অনির্দেশের দিকে মিশে যায়। বহু পেন্টিংয়ে এই কাঠামোগত বিশ্লেষণের পাশাপাশি ডিজ়াইনসদৃশ রঙিন অনুষঙ্গের শরীরী ব্যঞ্জনার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে থাকে ছবির অন্তর্নিহিতে থাকা কিছু ভাষা। কাঠামোর মিশ্র রূপের ত্বকে থাকা বর্ণ ও বর্ণভেদের সারল্য ছবির অন্যান্য অ্যারেঞ্জমেন্টের সঙ্গে কখনও লৌকিক থেকে অলৌকিক, কখনও আশ্চর্য রঙিন রহস্যময়তার দৃষ্টিনন্দন মায়াজালে আচ্ছন্ন করে।
কিন্তু পটভূমি যখন শুধুই সাদা, মাধ্যম বলতে কালো সফ্ট প্যাস্টেল আর কালো কালির পেন? সেখানেও দর্শককে দাঁড় করিয়ে রাখে চিত্রভাষার রেখার এক ধরনের নৈঃশব্দ্য। কাঠামোগত বিন্যাসের মধ্যে থেকে যাওয়া চড়ুইপাখির মুক্তির চেষ্টা ও বেদনাবোধের নৈর্ব্যক্তিকতা। পাখির স্থিরতা অথবা চাঞ্চল্যের গভীরে থাকা যন্ত্রণা। কাককেও শামিল করেছেন তাঁর ড্রয়িংয়ে শিল্পী অতীন বসাক।
এ এম মাল্টি ডিসিপ্লিনস গ্যালারিতে সদ্য শেষ হল ‘আ পার্ট/ অ্যাপার্ট’ নামে শিল্পীর সাদা কালো ৫০টিরও বেশি ড্রয়িংয়ের প্রদর্শনীটি।
প্রধানত কয়েকটি বিশেষ দিক মাথায় রেখেই অতীন এমন ভাবে ভেবেছিলেন। এখানে সাম্প্রতিক সময়, অস্থিরতা, কোলাহল, বিভিন্ন ভয়ঙ্কর শব্দ, চিৎকার, ডিশ অ্যান্টেনার নিঃশব্দ বৈদ্যুতিক প্রভাব— এ সবই চড়ুইপাখি, ছোটবড় পাখির ক্ষেত্রে মারণাস্ত্রসম। কবিতায় শক্তিশালী কলমেও দেখা গিয়েছে এমন লাইন। ‘পাখি থেকে নেমে আগে ডানার কামড়’ কিংবা স্থিতধী কবিও লিখেছেন যে, পাখির উদ্যত-নখর পা দু’টিকেও রাত্রে মনে হয়েছিল ‘বাঘিনীর থাবা’। জীবনানন্দে যে চড়ুইয়ের বিবিধ চঞ্চলতা, সেই স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে গিয়েছে অচিরে। কাঠামো-স্কেলিটনকে আশ্চর্য দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন রচনায়। পাখির নৈঃশব্দ্যময় আতঙ্কের রূপ বেশ ফুটিয়েছেন শিল্পী। নির্দিষ্ট ভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায়, কী ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন সাদা কাগজের সঙ্গে কালো রেখা ও ছায়াতপ-গাঢ়ত্বের এক আশ্চর্য কথোপকথনকে। কী ভাবে?
এখানে সংঘাত আছে। বৈপরীত্যর মধ্যেও আছে সাহচর্য। এক অমোঘ আকর্ষণে যেন পটের মধ্যবর্তী অংশে একটির পর একটি সুচিন্তিত বিন্যাসে তিনি জীবনের অন্য এক সত্যকে উপলব্ধি করাতে চেয়েছেন। তাঁর নিজস্ব ভাবনাচিন্তার মোড়কে ছিল কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক। এক এক করে বললে, প্রধানত দুটি মিডিয়াম, সূক্ষ্ম ধাতব নিব, সফ্ট কালো প্যাস্টেল, সাদা কাগজ ও তার টেক্সচার, কম্পোজ়িশন অ্যারেঞ্জমেন্ট, যার ফলে তৈরি হওয়া জিয়োমেট্রি। দু’রকম স্পেস তৈরি ও তাকে ব্যবহার। এই পজ়িটিভ ও নেগেটিভ স্পেস-সচেতনতা। নন-ইলাস্ট্রেটিভ কম্পোজ়িশন, স্ট্রাকচারাল ও অ্যানাটমিক্যাল ব্যালান্স। সর্বোপরি টোনাল ভ্যারিয়েশনের মাধ্যমগত বৈচিত্র ও কনস্ট্রাকশন। একটি স্টোরিলেস স্টোরিও কিন্তু কাজগুলির মধ্যে প্রকাশিত। অংশের মধ্যে থাকা ও অংশ ব্যতীত— দুই-ই।
কাগজের টেক্সচারকে মাধ্যমের সাহায্যে বিবর্তিত করেছেন। ত্বকের উচ্চাবচ অংশ নিম্নাংশের সাদাকে নিয়ে তৃতীয় একটি টেক্সচারের বিভ্রম এনেছেন। নখ ও পায়ের অ্যানাটমিকে ড্রয়িংয়ের বৈচিত্র রচনায় তৈরি করেছেন অদ্ভুত কনস্ট্রাকশন। মাঝে বা উপর-নীচে পাখির ডানা মেলা অস্তিত্ব বা উড়ে এসে বসার ভঙ্গিতেও নীচে তৈরি হয়েছে এক জ্যামিতিক টানাপড়েন। গাঢ় অন্ধকার বা সাদার বিস্তৃতিতে কখনও বা পেনের সূক্ষ্ম স্ট্রোকের আপাতহালকা ছায়াতপ এবং ঘন কালো আনুভূমিক লাইনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া কাকের সর্বাঙ্গ বা বিচিত্র কাঠামোগত ফর্মেশনকে অনেকাংশে রেখে আলো-আঁধারি রহস্যময়তা অসাধারণ।
কখনও মুহূর্তের একটি অসম্পূর্ণ রূপকে নিয়ে গিয়েছেন স্পেসের পজ়িটিভ ও নেগেটিভ দূরত্বের মধ্যবর্তিতায়। অ্যানাটমিকে বিবর্তিত করে এক চরম কৌতূহল তৈরি করেছেন। সিলিংজোড়া প্রচুর ড্রয়িং। ঘাড় ঘুরিয়ে, মাথা উঁচু করে দর্শককে দেখতে বাধ্য করা। বিরক্ত হওয়া ও বিরক্ত করার মধ্যে বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়া কী? পাখি জানে, মানুষও।
আঙুল দিয়ে গ্রাফাইট ঘষামাজা করেছেন। তাঁর কম্পোজ়িশনে এমন পরীক্ষানিরীক্ষা, ড্রয়িংয়ের কবিতা ও টেনশন এড়ানো যায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy