বাংলা গানের বৈশিষ্ট্য হল কথা ও সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপ। ভাবের সঙ্গে, ভাষার সঙ্গে সুরের মিলন। কথার মালা গাঁথা হল, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুরটি বাঁধা হল না, এটি চলবে না। আবার শুধু সুরের লহরি চলল, কিন্তু তার সঙ্গে কোনও বাণী নেই, অথবা বাণীর অর্থ বোধগম্য হচ্ছে না, তা-ও চলবে না। বাণী ও সুরের মালা গাঁথা একটি নিটোল রূপই যথার্থ গান। ভাবের সঙ্গে সুরের সঙ্গতিই বাংলা গান। বাঙালির স্বধর্ম সুরের সঙ্গে কাব্যের সমন্বয় করে কাব্যসঙ্গীত সৃষ্টি করা।
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়ে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত বা দ্বিজেন্দ্রলাল একই মত পোষণ করতেন। এমনকী রবীন্দ্রনাথও। তিনি একবার বলেছিলেন ‘আমাদের গানে হিন্দুস্থানী যত বাঙালি হয়ে উঠবে, ততই মঙ্গল।’ আসলে ভারতীয় রাগ রাগিণী বৃথা নয়। তার অসামান্য অবদান। রাগ রাগিণীর সুর শিখিয়ে দেবে, সেই সুরে বাংলা গান বাঁধতে হবে। দ্বিজেন্দ্রলাল বলেছিলেন ‘গানের দুটি দীক্ষা। এক, হিন্দুস্থানী সুর শেখার, দুই, সে সুরে বাংলা গান বাঁধার।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘হিন্দুস্থানী সুর সম্পদে বাংলা গান সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। হিন্দুস্থানী সঙ্গীত আমরা শিখব পাওয়ার জন্য, ওস্তাদি করার জন্য নয়।’ তাই রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল অসংখ্য গান লিখেছেন ভারতীয় রাগ রাগিণীতে এবং সে গান ‘গৌড়জন আনন্দে ‘করেছে’ পান সুধা নিরবধি’। এখানে কয়েকটি গানের উল্লেখ করি যে গানগুলি দৃঢ় ভাবে রাগ রাগিণীর উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রচিত খম্বাজে ‘আজি গাও মহাগীত’, টপ্পা অঙ্গে ‘এ বার তোরে চিনেছি মা’। অতুলপ্রসাদ সৃষ্ট আশাবরী রাগে ‘মুরলী কাঁদে রাধে রাধে বলে’ গুজরাটি খম্বাজে ‘তুমি মধুর অঙ্গে নাচো গো রঙ্গে’, ভৈরব-এ ‘সংসার যদি নাহি পাই সাড়া’, বেহাগে ‘নিদ নাহি আঁখিপাতে’। রজনীকান্তের গান ভৈরবীতে ‘ভারত কাব্য নিকুঞ্জে’ সুরট মল্লার-এ ‘সে যে পরম প্রেম সুন্দর’, ভৈরবীতে ‘তব তরণ’, আর রবীন্দ্রনাথ বিরচিত মালকোষ রাগে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ বাহার-এ এ কী করুণা করুণাময়, ছায়ানট রাগের আধারে ‘গোধূলি লগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’ ভূপালিতে ‘একি এ সুন্দর শোভা’।
শুধু তাই নয়। বাউল কীর্তনের উপর ভিত্তি করেও রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত অনেক গান রচনা করেছেন। আবার কীর্তনের আধ্যাত্মিক চেতনাও ভক্তিপ্রবণ বাঙালির মনের গভীরে প্রবেশ করে। এই দুই ধরনের গানই বাংলা লোকসঙ্গীতের অন্তর্গত। দ্বিজেন্দ্রলাল বাউল কীর্তন ভিত্তিক গান লিখেছেন অসংখ্য। ‘একবার গাল ভরা মা ডাকে’ (বাউল), ‘ও কে গান গেয়ে চলে যায়’ (কীর্তন), ‘চাহি অতৃপ্ত নয়নে’ (কীর্তন), ‘ছিল বসি সে কুসুম কাননে (কীর্তন), ‘জীবনটা তো দেখা গেল’ (বাউল)। রজনীকান্তও বাউল ও কীর্তনাঙ্গ গান রচনা করেছেন। ‘প্রেমে জল হয়ে যাও গলে’, ‘তারে যে প্রভু বলিস’ (বাউল), ‘ভাসা রে জীবনতরণী, ‘ভবের সাগরে’ (বাউল), ‘তুমি সুন্দর তাই তোমারি বিশ্ব সুন্দর’ (কীর্তন), অতুলপ্রসাদের ‘ওরে বন তোর বিজনে (বাউল), ‘যদি দুখের লাগিয়া’ (কীর্তন), ‘যদি তোর হৃদয়যমুনা’ (বাউল কীর্তন)। রবীন্দ্রনাথের ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ (বাউল) ‘আমি ফিরব না আর’ (বাউল), ‘আমার ভুলতে দিতে নাইকো তোমার ভয়’ (বাউল), ‘ওহে জীবন বল্লভ, ওহে সাধন দুর্লভ’ (কীর্তন)।
সেই কোন যুগে এস ডি বর্মন একটি ফিল্মে সঙ্গীত সৃষ্টি করলেন—‘তদবির সে বিগড়ি হুয়ি’, তখনকার দিনে কী আলোড়নই না সৃষ্টি হয়েছিল গানটি নিয়ে। সঙ্গীতে যাঁরা ভারতীয় রাগ রাগিনী বা লোক সঙ্গীতের ভিত্তিতে সুর রচনা করতেন (যেমন বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদ), তাঁদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল যে এই সব গান লঘুরসের এবং এর প্রভাব গানের যথার্থ মর্যাদা হারাচ্ছে। আবার সাধারণ দর্শকেরা তো এই গানকে ভালবেসেছিলেন এমন ভাবে যে সেই পপুলারিটি এতদিন পরে এখনও আছে। তার পর সলিল চৌধুরী, রাহুলদেব বর্মন পাশ্চাত্য সুরের ধাঁচে অসংখ্য গান তৈরি করেছেন যা যুগ যুগান্তর পার হয়ে এখনও লোকের মনে ঢেউ তুলেছে। মনে পড়ে ও পি নায়ারের ‘ও মেরে সোনা’, রাহুলের ‘পিয়া তু আব তো আজা’ ইত্যাদি গানের কথা। এখানেই তিন জন সুরকার-এর কথাই আলাদা ভাবে আলোচনা করা যায়। রাহুল দেব ওয়েস্টার্ন স্টাইল-এর দ্রুত ওঠানামার সঙ্গে গ্রামীণ লোকগীতির অসাধারণ রসায়ন ঘটিয়েছেন এবং সে রসায়ন এমনই, যা কোন জায়গাটায় ফোক আর কোন জায়গাটা পাশ্চাত্য স্টাইল, আলাদা করা যায় না। একেই বলে স্বীকরণ। সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত ও নচিকেতা ঘোষ-এর কথা ভাবুন। সুধীন দাশগুপ্ত পিয়ানোর কর্ড আয়ত্ব করেছিলেন দারুণ ভাবে। ‘ভিনদেশী কোনও ভ্রমর আমার মনকে ভেবে ফুল’ অথবা ‘দক্ষিণে তার মনের মানুষ’ (গানগুলি রেকর্ডে গাওয়া হয়েছে কিনা জানা নেই) ওয়েস্টার্ন স্টাইল-কে বাংলা গানে স্বীকরণ করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাবতে অবাক লাগে যিনি সুর করেছেন ‘ডাকহরকরা’ সিনেমায় ‘ও তোর শেষ বিচারের’ গানটি, তিনিই আবার সুর করেছেন ‘জীবনে কী পাবো না, ভুলেছি সে ভাবনা’।
আগেকার গানগুলি এখনও মুখে মুখে ফেরে। সায়গলের গান, সুরাইয়ার গান, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র গান। কাননদেবীর গলায়, ‘আমি বনফুল গো’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় সলিল চৌধুরীর সুরে ‘কোন এক গাঁয়ের বধূ’, ‘পাল্কি চলে’ সবই বেসিক ডিস্ক। গান শোনার পদ্ধতিও পাল্টে গেছে। এখন এই ‘সময় নেই’-এর যুগে হাঁটতে হাঁটতে ছুটতে ছুটতে গান শোনা। এখনকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অভ্যাস হল রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু’কানে দুটি কর্ড লাগিয়ে গান শোনা। অবশ্য গান শোনা ছাড়া আবৃত্তি, নাটক সবই শোনা যেতে পারে, যায়ও। কিন্তু বেশির ভাগই কানে তার গুঁজে গান শোনা। বাসে, ট্রেনে, মেট্রোয় সেই একই দৃশ্য। দু’কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে গান শোনা। কিন্তু গানকে অনুভব করা, গানের সঙ্গে একাত্ম হতে পারা যায় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy