বাবার মৃত্যুসংবাদ
ফিরে এলাম দক্ষিণ ভারত থেকে। ১ মে, ১৯৪৯। স্টেশনে ওঁর সঙ্গে দেখলাম দিদি আর ছোট বোন আর আমার কন্যা এসেছে। বাড়ি পৌঁছে স্নানটান সেরে, দিদিদের দেব বলে মাদ্রাজী শাড়ি বার করতেই, দিদি কেঁদে বলল, ‘বাবা কাল সকালে মারা গেছেন।’
মনে হয় যত দিন মানুষের মা-বাবা বেঁচে থাকে, তত দিন তাদের সম্পূর্ণ সাবালকত্ব লাভ করার পথে একটা বাধা থাকে। সে বাধাটা অবিশ্যি সম্পূর্ণ মানসিক এবং একতরফা।
আসলে এ সব কিছু নয়। মা-বাবা চলে গেলেই হঠাৎ যেন বয়সটা অনেকখানি বেড়ে যায়। মাথার ওপর থেকে একটা চন্দ্রাতপকে তুলে নেয়। নিজেদের কেমন অসহায় মনে হয়। আমার বাবার সঙ্গে আমার ২৫ বছর বয়েসের পর থেকে কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমার ওপর অভিভাবকত্ব ছাড়তে চাননি বলেই তাঁর সঙ্গে আমার বিরোধ। তার পর ১৬ বছর কেটে গেছিল, বাবাকে বাদ দিয়ে জীবন কাটাতে আমি অভ্যস্থ হয়ে গেছিলাম। ভাই-বোনদের যত কষ্ট হয়েছিল, আমার তার কিছুই হয়নি। শুনতে হৃদয়হীন লাগলেও এই হল সত্য।
নাইট লাইফ
এক বার পণ্ডিচেরী থেকে দিলীপ লিখে পাঠালেন, আমার এক ফরাসি বন্ধুকে পাঠাচ্ছি। তোমাদের বাড়িতে কিছু দিন অতিথি করে রেখো। এলেন জাঁ এরবের বলে চমৎকার একজন মানুষ।
জাঁ অনেক দেশ ভ্রমণ করেছিলেন, চিন, তিব্বত ও নানা দুর্গম জায়গায়। তিব্বতের বিষয়ে একটা মজার গল্পও বলেছিলেন। সেখানকার কোনও বড় গুম্ফায় কাজকর্ম সেরে ভারতে ফিরে আসার কথা ভাবছেন, এমন সময় ওঁর গাইড এবং দোভাষী বলল, তা হয় না। আমাদের নাইট-লাইফ না দেখে ফিরে গেলে অন্যায় হবে।
অগত্যা গেলেন তার সঙ্গে। নাইট লাইফ মানে পানালয়ে সান্ধ্য সমাবেশে। মস্ত ঘর, ভদ্র আবহাওয়া, মেলা লোকজন নিচু গলায় গল্পগুজব করছে। গাইড বলল, ‘সবাই পরিবার নিয়ে এসেছে, দেখেছেন?’
দেখেননি জাঁ। দেখলেও কাউকে পরিবার বলে চিনতে পারেননি। সব এক চেহারা, এক পোশাক। কে পুরুষ কে মেয়ে বুঝবার জো নেই। ক্রমে সন্ধ্যা বাড়তে লাগল। যারা পরিবারে এসেছিল তারা আস্তে আস্তে বিদায় নিল। তারা গেলেই আবহাওয়াটা একটু করে বদলাতে আরম্ভ করল। ক্রমে উঁচু গলা, কর্কশ স্বর, তর্কাতর্কি শোনা যেতে লাগল। আরও রাত বাড়ল। মাথা আরও গরম হয়ে উঠল। তারপর তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতিতে গড়াতে বেশি দেরি হল না। তখন জনসাধারণের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা যেতে লাগল। জাঁও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু গাইড বলল, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, এক্ষুনি সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। আপনাদের দেশে এই রকম হলে চাকার-আউটরা গোলমালকারীদের বের করে দেয়। আমাদেরও চাকার-আউট আছে।’
বলতে বলতে ভীষণ ষণ্ডা একটা লোক ভেতর থেকে ছুটে এসে, যে-দুজন মারামারি করছিল, তাদের জোব্বার ঘাড় ধরে, দেখতে দেখতে সামনের দরজা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ফিরে এল! পাশ দিয়ে যাবার সময় জাঁ দেখলেন চাকার-আউট হলেও কিঞ্চিৎ তফাত আছে। ইনি মহিলা!
জওয়ানরা কবিতা পড়ে
আশিস সান্যালকে গুণী কবি ও লেখক বলে এখন সবাই চেনে। ১৫ বছর আগে সে নিতান্ত ছেলেমানুষ ছিল এবং প্রেমেনবাবুর ভারী ভক্ত। রোজ বিকেলে গল্প করতে আসত। তাতে প্রেমেনবাবুও খুব অখুশি ছিলেন না, কারণ ও না এলে আমরা হয়তো সবাই মিলে ওঁকে পাহাড়ে চড়াতাম। তাতে ওঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। আশিস আলাদা নিজের দায়িত্বে গেছিল। কালীবাড়িতে উঠেছিল। ফেরার দিন ছোট ট্রেন থেকে নেমে দেখি কিউলে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের রিজার্ভেশন ছিল। কিন্তু আশিসের ছিল না। এ দিকে গাড়ি বোঝাই সব ছুটি-ফেরতা আর বেঙ্গল জওয়ান! ওই শেষের গাড়িতে ছাড়া মাছি-মশারা ঢুকতে পারছে না। ঢুকতে পারছিল না। শুনেই প্রেমেনবাবু নেমে গেলেন। আমি খুব বিরক্ত। আশিস ছেলেমানুষ, সে-ই পারল না, আর ওঁর ৬৪ বছর বয়স, উনি ওকে ওঠাবেন! আধ ঘণ্টা পর ফিরে এসে বললেন, ‘দিয়েছি ঢুকিয়ে জওয়ানদের গাড়িতে। সত্যি আমাদের জওয়ানদের তুলনা হয় না।’ পর দিন সকালে শুনলাম কোথাও জায়গা নেই দেখে জওয়ানদের গাড়ির দরজার সামনে গিয়ে বলেছিলেন—‘আমার নাম প্রেমেন্দ্র মিত্র। আমার এই বন্ধুটির কি তোমাদের গাড়িতে জায়গা হবে না?’ সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল, আশিসকে ওরা আদর করে নিয়ে নিল! আমিও খুশি হলাম। আমাদের জওয়ানরা তা হলে কবিতা পড়ে।
কবিতার মানে
কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হল। মনে আছে এক বার ওদের বাড়িতে যামিনী রায় এসেছিলেন, শিল্পসৃষ্টি নিয়ে কিছু বলবেন। কামাক্ষী আমাকেও যেতে বলল।
গিয়ে দেখি চাঁদের হাট। বুদ্ধদেব, অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তী এবং বহু সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধব। আমাকে অমিয়বাবুর পাশে বসাল। তখনও সভার কাজ আরম্ভ হয়নি। অমিয়বাবুর সঙ্গে সেই আমার শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার সময় থেকে প্রীতির সম্বন্ধ। এখনও তাই। ভাবলাম এই সুযোগে বুদ্ধদেবের বৈশাখীতে সদ্য প্রকাশিত অমিয়দার আধুনিক কবিতাটির মানে জেনে নিই। আমি আবার মানে না বুঝলে রস উপভোগ করতে পারি না, নিজেও পারি না আবার বন্ধুবান্ধবরা পারে বলেও বিশ্বাস করিও না।
কবিতাটির শুধু গোড়াটুকু মনে আছে, ‘‘বিশুদ্ধ এক জন নলিনীচন্দ্র পাকড়াশী,/ মাছ বা ল্যাংড়া আম— ইত্যাদি।’’
সত্যি বলছি আজ পর্যন্ত ওর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি না। তা অমিয়দাকে মানে জিজ্ঞাসা করাতে উনি কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। খালি বললেন, ‘কবিতা লিখলেই কি তার মানে বলতে হয়ই?’ আমিও অর্বাচীনের মতো বললাম, ‘লিখলেই বলতে হয় না। কিন্তু ছাপবার পরে কেউ জানতে চাইলে নিশ্চয় বলবেন।’
শান্ত কোমল মানুষটি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, উঠে গেলেন। বুদ্ধদেবকে কী যেন বললেন। তারপর তাঁকে আর দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ বাদে বুদ্ধদেব এসে ভারী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘খুব ভাল কাজ করা হল। কবিরা কত স্পর্শকাতর, তা ভুলে গেলে চলবে কেন? উনি বাড়ি চলে গেলেন, বলছেন শরীর ভাল লাগছে না।’
সংকলন, সংযোজন: সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়।
সৌজন্য: পাকদণ্ডী (লীলা মজুমদার)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy