E-Paper

ফিরলেন ফিরপো

ফিরপো মানে সুভাষচন্দ্র, গায়ত্রীদেবী বা সত্যজিতের ছবির গল্প। খোলা মনের স্বাদ-সুরভি। ফিরপোর উত্তরপুরুষের কলকাতা-সফরে সমকালে সোনালি অতীতের ছোঁয়াচ।

ছবি: সংগৃহীত।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:২৭
Share
Save

‘ধন্যি কলকাতা’!

ফিরপোর লিডো রুমের ডিনার টেবলে অস্ফুটে বললেন শর্মিলা ঠাকুর। ডান্স ফ্লোরে হাওয়াইয়ান নাচে তখন হিল্লোল তুলছেন মিস শেফালি। ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির ক্লাইম্যাক্স মুহূর্তের জন্য ফিরপোকেই বেছে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ফিরপোর নাচের আবহেই বুদ্ধিমতী শ্যালিকাটির (শর্মিলা) চোখে দেবতুল্য কর্পোরেট কর্তা শ্যামলেন্দুর (বরুণ চন্দ) মুখোশ খসে পড়বে। শ্যালিকা বুঝবেন, চাকরির সাফল্যের শৃঙ্গ ছুঁতে কারখানায় অশান্তি বাধিয়ে লোকের জীবন নিয়ে খেলতেও দ্বিধা করেন না শ্যামলেন্দু। ঠিক যেন গ্রিক নাটকের ধ্রুপদী ‘অ্যানাগনরিসিস’ বা রেকগনিশন দৃশ্য। কর্পোরেট জগতে সফল শিক্ষিত সুভদ্র পুরুষের বেআব্রু হওয়ার আখ্যান।

এর জন্য চৌরঙ্গির ফিরপোর মতো জুতসই পটভূমি আর কোথায় কলকাতায়! মিস শেফালির আত্মকথা বলছে, গ্র্যান্ড, পার্ক, স্পেনসেস হোটেলে তখন স্ট্রিপটিজ়ও হত। নাচগান হত ব্লুফক্স, মোক্যাম্বো, ট্রিঙ্কাজ়েও। তবু লোকগাথা, কিংবদন্তিতে ফিরপোর আলাদা মহিমা। আজকের চৌরঙ্গির ফুটপাতে জামাজুতোর জঙ্গল সেই অতীতকে ভেংচি কাটে। ১৯৭৭-এ রাজনীতি ধ্বস্ত শহরে নানা ঝামেলায় ঝাঁপ বন্ধ করে ফিরপো।

কর্ণধার আঞ্জেলো ফিরপো জুনিয়র সে-বছরই দেশে ফিরে চোখ বুজেছিলেন। তাঁর ভাগ্নে (খুড়তুতো বোনের ছেলে) এনরিকো দে বারবিয়েরি তখন ১০-১১ বছরের। তিনিই এখন ফিরপো পরিবারের উত্তরাধিকারী। ইটালির জেনোয়ায় ফিরপোর ব্র্যান্ডটির নবজাগরণ ঘটিয়ে উৎকর্ষ খাদ্য বিপণিও গড়ে তুলেছেন। ইটালিয়ান কনসুলেটের ডাকে এনরিকোর সফর অনেক দিন বাদে কলকাতাকে তার গত জন্মের কথামনে করাল।

ফিরপো না ফার্পো

অফিসপাড়ার ‘গৎ-বাঁধা লাঞ্চ’ বলতে বুদ্ধদেব বসু ‘ফার্পোর’ কথাই লিখেছেন। ইংরেজি দুরস্ত পরিশীলিত জিভে ‘ফার্পো’ই সহজে আসে। তবে ১৯৬৭-র ‘রাত অওর দিন’ ছবির ট্যাক্সিতে ওঠার দৃশ্যে নার্গিস ‘ফিরপো’ই বলেছিলেন। ট্যাক্সিচালক শুনেই বুঝে নেন। এনরিকো দে বারবিয়েরি ‘ফিরপোই সঠিক ইটালিয়ান উচ্চারণ’ বলে রায় দিচ্ছেন। ‘ইটালিয়ান স্বাদঘরানা সপ্তাহ’ উপলক্ষেই কলকাতায় এসেছিলেন এনরিকো। কনসাল জেনারেল রিকার্দো দাল্লা কোস্তা বলছিলেন, “কলকাতার অনুষঙ্গে ইটালির ভোজ-শিল্পের কথায় ফিরপোকে মনে পড়বেই।” স্বাধীনতার পরে কলকাতার আর এক ইটালিয়ান ভোজশালা পেলিতি শহর ছাড়ে। এনরিকোর মা মারিয়ার আপন খুড়তুতো দাদা আঞ্জেলো ফিরপো জুনিয়র আরও তিন দশক ফিরপোর হাল ধরে ছিলেন। ফিরপোর প্রতিষ্ঠাতা তাঁদের কাকা আঞ্জেলো ফিরপোই। এনরিকো বলছিলেন, “ছোটবেলা থেকে বাড়িতে কলকাতা কলকাতা এত শুনেছি, প্রথম বার এখানে এসেছি বলে মনেই হল না!” একদা বাঙালির ঘরে প্রসিদ্ধ ফিরপোর পাঁউরুটির বিজ্ঞাপন দেশলাই বাক্সেও থাকত। জেনোয়ায় ‘ফিরপো’ এখন উৎকৃষ্ট পেস্তো, পাস্তা, অলিভ-টলিভের কারবারি। কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের আর এক চিরস্মরণীয় মহারথী পেলিতিও তাদের ভারতীয় মশলায় জারিত হোয়াইট ভেরমুথের পরম্পরা ধরে রেখেছে।

ছবি: সংগৃহীত।

ফিরপো ও পেলিতি

পেলিতিকে বাদ দিলে ফিরপোর গল্পও অসম্পূর্ণ থাকবে। ভীম নাগের সন্দেশ? না পেলিতির কেক? পত্রিকায় নিজের লেখা বেরোনোর আনন্দে সত্যজিতের ‘চারুলতা’র অমল তাঁর বৌঠানদের এই দুটোর মধ্যে অফার দিয়েছিলেন। ১৮৮০-’৯০-এ বাঙালি ভদ্রবিত্তের এতটাই কাছের পেলিতি। এই পেলিতির হোটেলে ম্যানেজারি করতেই ১৯০৫-এ কলকাতায় আসেন আঞ্জেলো ফিরপো। ইটালির পিয়েডমন্টের যুবক ফেদেরিকো পেলিতি তুখোড় হেঁশেল-শিল্পী। বড়লাট লর্ড মেয়োর রান্নার চাকরি নিয়ে ১৮৬৯-এ শহরে আসেন। ক্রমে কেকের দোকান থেকে ইউরোপীয় রেস্তরাঁর পত্তন তাঁর হাতে। আঞ্জেলো ফিরপোর ব্যবসায়িক বুদ্ধি পেলিতির স্বাদ উৎকর্ষে মণিকাঞ্চন যোগ ঘটাল। ১৯১৭-য় ফিরপোর (বা লোকমুখে ফার্পো) ডানা মেলা। খানাপিনা, নাচাগানায় তা শহরের সেরার সেরা হয়ে ওঠে। রাজভবনের পাশে ১১ নম্বর গভর্নমেন্ট প্লেস ইস্টে এলআইসি-র বাড়িতে এখন পেলিতির খণ্ডহর। শুধু পুরনো ফলকটুকু আছে। চৌরঙ্গিতে ফিরপো মার্কেটও বীভৎসতম দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। এনরিকো দে বারবিয়েরি এ বার পেলিতি ও ফিরপো, দুটোই ঘুরে দেখেছেন। চৌরঙ্গিতে ফিরপোর শূন্য বারান্দায় একটু থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, “জীবন এমনই!”

ছবি: সংগৃহীত।

আর কি কখনও কবে

বিশ শতকের গোড়ায় পেলিতির লাঞ্চ-ডিনারের দক্ষিণা ছিল দেড় টাকা। কলকাতার অতীত সংগ্রাহক গোপাল বিশ্বাস ইউরোপ, আমেরিকার মান্যগণ্যদের পরিবার থেকে কিছু পুরনো মেনুকার্ড খুঁজে পেয়েছেন। ১৯৪৪-এ ফিরপোর দু’টাকা আট আনার তিন কোর্স মধ্যাহ্নভোজে স্মোকড ইলিশ বা চিংড়ি মেয়োনিজের মধ্যে বাছতে হবে। পরের কোর্সগুলোয় বিফ সারলয়েন রোস্ট, ইয়র্কশায়ার পুডিং বা মাটন কোর্মা, নানা কিসিমের কোল্ড মিট। মেনুতেও ছুতমার্গহীন খোলা মনের ছাপ। চেরি খচিত গিমলেট ককটেলও তখন এক টাকা চার আনা। আধ পেগ জিন এবং মল্ট হুইস্কি যথাক্রমে ১২ আনা ও ১৪ আনা।

এনরিকোর সফর উপলক্ষে ওবেরয় গ্র্যান্ডের নৈশ আসরে ফিরপোর পুরনো মেনুরই কিছুটা পুনর্নির্মাণ ঘটায় ইটালিয়ান কনসুলেট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দু’টাকায় যে ডাক ইন ট্যামারিন্ড সস মিলত, তার সঙ্গে জুতসই ইতালীয় রেড ওয়াইন মেলাতে চিন্তায় পড়েন ইটালিয়ান সুরাবিদ জুলিয়া বিস্কন্তিন। শেষপাতের স্ট্রবেরি মুজ়ের সঙ্গতে পেলিতির ধ্রুপদী ভেরমুথকেই বাছাই করা হয়। যার বোতলের লোগোয় টুরিনের মনুমেন্টের পাশে দক্ষিণেশ্বর মন্দির। মেনু গবেষণায় ইটালিয়ান কনসুলেটের শরিক গোরমেই সংস্থার অর্ঘ্য সেন বলছিলেন, “সে যুগে ফিরপোয় ফরাসি ভোজ চালু থাকলেও আমরা পরিবেশন ও ওয়াইন বাছাইয়ে সমকালের মেজাজটাই রেখেছি।” কনসুলেটও দুর্লভ ইটালিয়ান ওয়াইন জোগাড় করেছে। জ্যোতিষ্ক দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজ়িকের শিল্পীরা ধ্রুপদী ইটালিয়ান সুরকার ভিভাল্দি, রোসিনি, বোকেরিনির কিছু কম্পোজ়িশনও পরিবেশন করেন। এনরিকো সুভাষচন্দ্রের ভক্ত। নেতাজি রিসার্চ বুরোর কর্তা এলগিন রোডের বসু-বাড়ির সুমন্ত্র বসু ১৯৩৮-এ ফিরপোর এক চা-চক্রে সুভাষচন্দ্র বসুকে সম্বর্ধনার কথা শোনালেন। কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরে ‘রাষ্ট্রপতি সুভাষবাবু’র সম্মানে ফিরপোয় অনুষ্ঠান আয়োজন করেন তখনকার মেয়র মহম্মদ জ়াকারিয়া।

ছবি: সংগৃহীত।

আগামীর স্বপ্ন

সুভাষচন্দ্র থেকে গায়ত্রী দেবী, চিত্রপরিচালক পিয়ের পাওলো পাসোলিনি, সাহিত্যিক আলবার্তো মোরাভিয়া— ফিরপো-কাহিনি জুড়ে অজস্র স্মৃতিচারণ। হবু স্বামীর সঙ্গে প্রথম ডেটে এসে পার্ট্রিজের রোস্ট (তিতির) ছুরি-কাঁটায় সামলাতে নাজেহাল হন নার্ভাস গায়ত্রী। ফিরপোর মদির সন্ধ্যা যুগে যুগে কত নরনারীর চোখের তারায় আয়না ধরেছে। সত্যজিতের ছবি হয়তো চিনিয়েছে কলকাতার রক্তে বণিক সভ্যতার শূন্য মরুভূমি। আবার সংস্কৃতির বহু স্বরের মিশেলে ফিরপো খুলে দিয়েছে বাঙালির আন্তর্জাতিকতা বোধের জানালা।

ফিরপোর পরে পেলিতির পরিবারও কলকাতায় আসতে আগ্রহী। অতীত-সমকালের মেলবন্ধনে আলেসান্ড্রিয়া শহরের মেয়র কলকাতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এনরিকো ভাবছেন, যদি কলকাতায় কোনও ‘ফিরপো ক্লাব’ করা যায়। কনসুলেটের চোখেও ফিরপো, পেলিতির ঐতিহ্যেই বাংলা-ইটালির বন্ধুতার চাবিকাঠি। খানাপিনা, নাচগান, বাজনার ককটেলে যা গড়ে তোলে সমন্বয়ের খোলা আকাশ।ধন্যি কলকাতা!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kolkata memories Old Memories

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।