লন্ডন, ওয়েস্ট এন্ড। ১৮৯৫। নভেম্বর মাস। কনকনে ঠান্ডা। বিকেল নেমেছে।
লেডি মার্গসনের বাড়িতে এসেছেন এক ভারতীয় সন্ন্যাসী। তাঁর সামনে অর্ধচন্দ্রাকারে বসে আছেন পনেরো-ষোলোজন পরস্পর পরিচিত সাহেব-মেমসাহেব।
এই ঘরোয়া জমায়েতে সন্ন্যাসীটিকে নানা প্রশ্ন করছেন তাঁরা। তিনিও জবাব দিচ্ছেন সেই সব প্রশ্নের, কথা থামিয়ে সুরেলা কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন সংস্কৃত স্তোত্র।
সেই বৈঠকে আছেন আঠাশ বছরের তরুণী মিস মার্গারেট নোবল। আয়ার্ল্যান্ডের মেয়ে। শিক্ষিকা। তবে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে আস্থা নেই। রাগবি, রেক্সহ্যাম, চেস্টারে শিক্ষকতার পর উইম্বলডনে ডি.লিউ-এর স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন।
কিছু দিন হল গড়ে তুলেছেন নিজের ‘দ্য কিংসলে স্কুল’। লেখার হাতও চমৎকার। লেখার বিষয় অনেক সময়েই সভ্যতা ও ক্ষমতার চাকচিক্যের বাইরের মানুষ। কয়লাখনির শ্রমিকদের নিয়ে, রেক্সহ্যামের জীবনযাত্রা নিয়ে লিখেছেন।
যুবা সন্ন্যাসীটি আমেরিকার শিকাগো ধর্ম মহাসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন। আমেরিকাবাসীদের কাছে ভারতবর্ষের ‘অন্য রূপ’ তুলে ধরতে সচেষ্ট তিনি।
মার্গারেটেরও ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কৌতূহল যথেষ্ট। বুদ্ধমূর্তি রেখেছেন তাঁর ঘরে। সামনের এই সন্ন্যাসীর, বিবেকানন্দের, সংস্কৃত স্তোত্রগীতি শুনতে শুনতে মার্গারেটের চার্চের গ্রেগরিয়ান চ্যান্টের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, তবে সুমিষ্ট এই প্রাচ্যস্তোত্রের সুর আলাদা।
বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে ধ্যানমগ্নের সুদূরতা। মার্গারেটের মনে হল র্যাফায়েলের আঁকা সিস্টিন চাইল্ডের সঙ্গে এ চাহনির মিল আছে।
বিবেকানন্দ বলছিলেন, হিন্দুধর্ম ও খ্রিস্টধর্ম— এ দুই ধর্মই ভালবাসাকে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক আবেগ বলে মনে করে ।
তোমার মা কেমন আছেন মার্গারেট?
১৮৯৮। মোম্বাসা জাহাজ তখনও জেটিতে লাগেনি। মার্গারেট জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছেন তাঁর স্বপ্নের ভারতবর্ষকে।
আগের বছর জুলাই মাসে বিবেকানন্দ তাঁকে একটি অকপট চিঠি লিখেছিলেন। ভারতবর্ষ কুসংস্কারে ভরা। চারদিকে অর্ধ উলঙ্গ নরনারী। জাত ও ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে বিকট বিচার। ভারতীয়রা শ্বেতাঙ্গদের এড়িয়ে চলে। ইউরোপে খাওয়া-পরা-থাকার যে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য তার বিন্দুমাত্রও এ দেশে পাওয়া যাবে না।
এই বাইরের দুঃখকষ্টের কথা লিখেছিলেন বটে, তবে চিঠির শুরুতে এ কথা জানাতেও ভোলেননি যে, ভারতবর্ষের মিস নোবল-এর মতো মহীয়সীর দরকার।
‘মোম্বাসা’ জেটিতে লাগলে বিবেকানন্দের সঙ্গে আবার দেখা হবে মার্গারেটের।
জাহাজ যত তীরবর্তী হচ্ছে ততই চোখে পড়ছে সবুজ গাছপালা। দেখা যাচ্ছে লোকালয়ের খোড়ো চালের বাড়ি।
জাহাজ জেটিতে লাগল। মার্গারেট দেখতে পেলেন বিবেকানন্দকে। গৈরিক বস্ত্র, মাথায় পাগড়ি, পায়ে চটি।
জেটি থেকে এগোতেই ঘর্মাক্ত মানুষের ভিড়, গরু আর ঘোড়ার গাড়ির হট্টগোল। খালি গায়ে কুলিরা মাথায় পিরামিডের মতো বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে এ-দিক ও-দিক ছোটাছুটি করছে।
ভিড় ঠেলে খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার লন্ডনের বন্ধুরা কেমন আছেন? তোমার মা কেমন আছেন মার্গারেট? কেমন চলছে তোমার স্কুল?’
সারদা মায়ের সঙ্গে
মার্গারেট এলেন, মুখে মশার কামড়ের দাগ
এ দেশে আসার পর স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গ অনেক বেশি করে পাচ্ছেন মার্গারেট।
১৮৯৮ সাল তাঁর জীবনে বড় আনন্দের সময়। প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে যে একটু অসুবিধে হয়নি তা নয়।
জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখ এরিক হ্যামন্ডকে চিঠিতে মার্গারেট লিখেছিলেন, তাঁর শোওয়ার ঘর আর বাথরুমের কথা।
ক্যামেরা থাকলে নাকি ছবি তুলে পাঠাতেন। চিঠির সঙ্গে ছবিই এঁকে দিলেন। আট দরজাওয়ালা ঘর, লাগোয়া বাথরুম। বাথরুমে স্নানের জায়গাতে আলাদা কোনও ঘেরাও নেই। টিনের মগে করে কল থেকে নিয়ে শরীরে মাথায় জল ঢালতে হয়। মার্গারেটের মনে হয় যেন রাস্তায় চার মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে স্নান করছেন।
এর মধ্যেই বিবেকানন্দ ব্যবস্থা করেছেন বাংলা ভাষা শিক্ষার। যিনি বাংলা শেখাতে আসেন সেই তরুণ ব্রহ্মচারীর মেমসাহেব সন্দর্শনের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।
ফেব্রুয়ারি মাসে রামকৃষ্ণদেবের সাধারণ জন্মোৎসব। দক্ষিণেশ্বরে গেলেন মার্গারেট। তার পর বেলুড়ে পূর্ণচন্দ্র দাঁর বাড়িতে ঠাকুরের জন্মোৎসবে যোগ দিলেন।
সারা বুল আর মিস ম্যাকলাউড বিবেকানন্দের দুই আমেরিকান শিষ্যা ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে এলেন।
বেলুড়ে মঠ নির্মাণের কাজ চলছে। তাঁরা সেখানে ছোট্ট গেস্ট হাউসে উঠলেন, মঠ নির্মাণের কাজ দেখেন, বিবেকানন্দের সঙ্গে কথায়-বার্তায় ভরে ওঠে তাঁদের সময়।
কথায় কথায় জানতে পারলেন তাঁরা আয়ার্ল্যান্ডের মার্গারেটও এসেছেন ভারতে।
সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘স্বামীজি, মার্গারেট আমাদের সঙ্গে এখানে থাকতে পারেন না !’
ম্যাকলাউডের বার্তা নিয়ে লোক গেল কলকাতায়। পরের দিন এলেন মার্গারেট। মুখে মশার কামড়ের দাগ —উজ্জ্বল দুই চোখে অপরিসীম উৎসাহ।
নিবেদিতার অভিমান কষ্ট
মার্চ মাসের গোড়ায় কলকাতার বিশিষ্ট জনেদের সঙ্গে মার্গারেটের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য স্টার থিয়েটারে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল।
আয়ার্ল্যান্ডের পার্নেল, রাশিয়ার ক্রপটকিনের বিপ্লবী ভাবনার সঙ্গে পরিচিত মার্গারেট সাদা মানুষ, কিন্তু ভাল মানুষ। ভারতে এসেছেন ভারতবাসীকে ভালবাসবেন, সেবা করবেন বলে।
কথাটা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল।
সে দিন শুক্রবার। বেলুড় মঠে বিবেকানন্দের এ কী অপরূপ বেশ! জটা, বিভূতি, হাড়ের কুণ্ডল। ঠিক যেন পুরাণের মহাদেব।
মার্গারেট এখন নিবেদিতা, ডেডিকেটেড। মানবতার জন্য নিবেদিত।
দীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর ওপরে এলেন সবাই। স্বামীজি কখনও গুনগুন করে, কখনও উদাত্ত কণ্ঠে আলাপন করছেন ভারতীয় সঙ্গীত।
শিববেশী স্বামীজির সঙ্গীত শুনতে শুনতে আনন্দে ভরে ওঠেন নিবেদিতা। শিব তো হিমালয়কন্যা উমার আরাধ্যা।
দীক্ষার পর স্বামীজির সঙ্গে উত্তর ভারত ভ্রমণে চললেন তিন বিদেশিনী।
বুধবার বিকেলে সদলবল স্বামীজি হাওড়ায়। নিবেদিতা, ম্যাকলাউড, ওলি বুল, তুরীয়ানন্দ, নিরঞ্জনানন্দ, সদানন্দ, স্বরূপানন্দ — স্বামীজির দলটি খুব ছোট নয় ।
আলমোড়ায় পৌঁছে বন্ধু এরিক হ্যামন্ডকে চিঠি লিখতে বসেন নিবেদিতা। তাঁর মনে পড়ে যায় সারদা মায়ের কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখেননি, তাঁর সহধর্মিণীকে দেখলেন, দীক্ষার আগেই।
দার্জিলিং-এ নিবেদিতার স্মারক
চিঠিতে লেখেন, ‘‘সাদা সুতির কাপড় পরেছিলেন মা সারদা। প্রখর বাস্তববোধের অধিকারিণী। মাদুরের ওপর বসেছিলেন মা। খুব আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন। মাঝে মাঝে বাচ্চা মেয়ের মতো খুশিতে ভরে উঠছিলেন। এমনিতে আচারনিষ্ঠ। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিদেশিনীদের সঙ্গে বসে ফল খেলেন। এই মর্যাদা পেয়ে আমার মন আনন্দে ভরে উঠল। ভারতীয় সমাজের ভেতরে প্রবেশ করার অধিকার যেন পেলাম।’’
মে মাসে হিমালয় অপরূপ। তিন বিদেশিনী দেখেন ফরগেট মি নট ফুলের সমারোহ। হিমালয়ের কোলে পাইন বনের সারি।
আলমোড়ায় পৌঁছে স্বামীজি খুব সকালে চলে আসেন বিদেশিনীদের কুটিরে। সকালে ব্রেকফাস্ট করতে করতে নানা কথা হয়।
বিবেকানন্দ বলেন, ভারতের পুরাণ ইতিহাসের কথা। নিবেদিতা প্রশ্ন করেন, তর্ক করেন, বকুনিও খান।
মাঝে কয়েক দিন স্বামীজির দেখা নেই। বনের মধ্যে কোথাও নিভৃতে গিয়ে ধ্যান করছেন। নিবেদিতার মাঝে মাঝে অভিমান হয়, কষ্ট পান।
বোসপাড়া লেনের নিবেদিতা
নিবেদিতার কাজ মানুষকে নিয়েই। কলকাতায় ফিরে এসে তাঁর কাজ শুরু হয়ে গেল।
যে দেশে তাঁর কাজ, সেই দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যাওয়া চাই।
এ দেশে নেমেই প্রথমে পার্ক স্ট্রিটে ছিলেন কিছু দিন, এ বার আর সাহেবপাড়া নয়, কিন্তু উত্তর কলকাতার ব্ল্যাক টাউনে মেমসাহেবকে থাকতে দেবে কে?
১০/২ বোসপাড়া লেনে সারদা মা থাকেন। লাল মেঝের ঘর। আসবাবের বালাই নেই। মাদুর পাতা। মাদুরের ওপর একটা বালিশ আর মশারি। সেখানে নিবেদিতার থাকার ব্যবস্থা হল ।
নিবেদিতা তো মায়ের কাছে ম্লেচ্ছ নন। নরেনের সঙ্গে মেয়েটা এ দেশে কাজ করতে এসেছে, সে আবার ম্লেচ্ছ হবে কেন!
পল্লিগ্রামের আত্মীয়স্বজনরা কিন্তু ছি ছি করছে। সারদা মাকে না তারা এ বার একঘরে করে দেয়।
মা সারদা অবশ্য নির্বিকার। বুঝতে পেরে নিবেদিতাই চলে যেতে চান। উলটো দিকে ১৬ নং বোসপাড়া লেন।
ঘর পাওয়া গেল। তবে কাজের লোক পাওয়া গেল না। নিবেদিতা ফল দুধ খেয়ে চালিয়ে দিলেন। শেষে একটি মেয়ে কাজ করতে রাজি হল, তবে সে যখন খাবে বা রান্না করবে তখন নিবেদিতার ত্রিসীমানায় যাওয়া চলবে না।
এখানে একটা ইস্কুল খুলতে চান নিবেদিতা। মেয়েদের জন্য অন্য রকম ইস্কুল।
ছাত্রী জোটানোর জন্য সভা ডাকা হল। মাস্টারমশাই, সুরেশ দত্ত, হরমোহনবাবু ও আরও অনেকে এসেছেন।
নিবেদিতা ইংরেজিতে আবেদন জানাবেন, বাংলায় এখনই এত কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
স্বামীজি এসে সবার পেছনে বসলেন। নিবেদিতা খেয়াল করেননি। স্বামীজি কাউকে কাউকে গুঁতোচ্ছেন।— ‘‘মেয়ের বাপ হলেই তো হবে না। পড়াশোনার বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে। উত্তর দে । বল রাজি।’’
শেষে হরমোহনের হয়ে নিজেই বলে দিলেন, ‘‘ওয়েল, মিস নোবল, দিস জেন্টলম্যান অফার্স হিজ গার্ল টু ইউ।’’
স্বামীজিকে দেখতে পেয়ে আর ছাত্রী পাওয়ার কথা শুনে নিবেদিতা আনন্দে বিভোর হয়ে হাততালি দিয়ে নেচে উঠলেন ।
নিবেদিতা চান ভারতীয় মেয়েরা শিক্ষিত হবে, কাজ করবে, সাহসী হবে, আবার মেয়েদের সহজাত যে সৌন্দর্যবোধ, তা’ও হারিয়ে ফেলবে না।
কালীমূর্তি নিবেদিতার বড় প্রিয়। সেই মূর্তি সাহসিনীর মূর্তি, দেখতে জানলে তার মধ্যে অন্য রকম সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়।
স্বামীজি উত্তর ভারতে ভ্রমণকালে কালীর রূপ ও ভাব নিয়ে ইংরেজিতে অপরূপ একটি কবিতা লিখেছেন।নিবেদিতার বোসপাড়া লেনের বাড়িতে একটা উঠোন আছে। এই উঠোনটি নিবেদিতার বড় ভাল লাগে।
উঠোনে দাঁড়িয়ে রাতের তারা ভরা আকাশ দেখেন তিনি। দেখতে দেখতে নিবেদিতা ভাবেন ভারতীয় সমাজ বাইরে থেকে দেখলে হবে না, বাড়ির ভেতরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে।
নিবেদিতা এখন বোসপাড়া লেনের রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় ভাঙা বাংলায় পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন, তারাও মুখ ফিরিয়ে নেয় না।
বাগদি বস্তির ছেলেকে কোলে নিয়ে
ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছেন রাধাগোবিন্দ কর। শ্যামবাজারের বাড়িতে চিকিৎসা শুরু করেছেন।
কলকাতায় প্লেগ এল। লোকজন কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছে। ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি দ্বিগুণ তিনগুণ ভাড়া হাঁকছে। শিয়ালদহ স্টেশনে পাঁচখানা অতিরিক্ত ট্রেন দেওয়া হয়েছে, তবু পালিয়ে যাওয়া মানুষের ভিড় শেষ হচ্ছে না।
রাধাগোবিন্দ দেশের মানুষদের চেনেন। স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সাধারণ জ্ঞানের অভাব এদের মজ্জায়। রাধাগোবিন্দ সারাদিন প্লেগ রোগীর পরিচর্যায় মগ্ন ।
ড. আর জি কর বাগদিবস্তিতে দেখলেন এক ইউরোপীয় মহিলাকে। স্যাঁতস্যাঁতে মলিন ঘর। নিবেদিতা রোগগ্রস্ত শিশুটিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। দিনের পর দিন সেখানেই আছেন।
রাধাগোবিন্দ জানিয়ে দিয়েছেন শিশুটির বাঁচার আশা নেই বললেই চলে। নিবেদিতার লড়াই চলছে।
ঘর পরিশোধন করছেন। ছোট একটা মই নিয়ে ঘর চুনকাম করছেন।
ছেলেটি বাঁচল না। নিবেদিতা নেমে পড়লেন বস্তি পরিষ্কারের কাজে। বস্তিতে বস্তিতে ঘোরেন, পরিদর্শন করেন, কাজে হাত লাগান। খেয়াল করে দেখেছেন রাস্তা-নালি পরিষ্কারের কাজ করে যারা, যাদেরকে এ দেশের লোক ধাঙ্গড় বলে, অপূর্ব তাদের দেহ সৌষ্ঠব, কর্মদক্ষতা।
গোপালের মায়ের পায়ের কাছে বসে িনবেদিতা
স্বামীজি বললেন, সৌন্দর্য থাকে অন্তরে
১৮৯৯। গোলকোণ্ডা জাহাজ চলেছে ইংল্যান্ডে।
বিবেকানন্দের এই দ্বিতীয়বার বিদেশ যাত্রা ।
এবার তাঁর সঙ্গী নিবেদিতা আর তুরীয়ানন্দ।
জাহাজে বিবেকানন্দ লেখালিখিতে ব্যস্ত। বাংলা পত্রিকা ‘উদ্বোধন’-এর জন্য ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখছেন— ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’।
নিবেদিতা ম্যাকলাউডকে চিঠিতে জানিয়েছেন, এ লেখায় বিবেকানন্দ ইচ্ছে করে সাধু ভাষার বদলে বাংলা মুখের ভাষা ব্যবহার করছেন।
লেখার ফাঁকে ফাঁকে নিবেদিতার সঙ্গে কথা হয় বিবেকানন্দের। নিবেদিতা ভাবেন ইউরোপে গিয়ে তাঁর ইস্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
জাহাজ মাদ্রাজ বন্দরে থামল। বিবেকানন্দকে দেখার জন্য মানুষের ভিড়। আলাসিঙ্গা পেরুমল জাহাজে এলেন। কলম্বো অবধি যাবেন, স্বামীজির সঙ্গে নানা বিষয়ে পরামর্শ করতে চান।
জাহাজে যাচ্ছেন সস্ত্রীক পাদ্রি বোগেশ। সাত বছর বিয়ে হয়েছে তাঁদের, ছ’টি ছেলেমেয়ে। তাদের ডেকের ওপর শুইয়ে বোগেশ আর তার ঘরনি কোথায় যে চলে যায়!
বাচ্চাগুলো কেঁদে-কেটে গড়াগড়ি দেয়। নিবেদিতা তাদেরকে মাতৃস্নেহে সামাল দেন। যাত্রাপথে একটা হাঙর মারা হল। সে দেখার মতো দৃশ্য ।
জাহাজ তখন সিসিলির কাছাকাছি। সূর্য ডুবু ডুবু। দূরে এটনা। একটু পরে আকাশে চাঁদ উঠল। আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে চারপাশ। ডেকে হাঁটতে হাঁটতে স্বামীজি বললেন নিবেদিতাকে, ‘‘সৌন্দর্য বাইরের রূপে থাকে না, সৌন্দর্যবোধ থাকে মানুষের অন্তরে।’’
বিয়াল্লিশ দিন পরে গোলকোন্ডা লন্ডনের মাটি স্পর্শ করল।
বিবেকানন্দ প্যারিসে, ইংল্যান্ডে নিবেদিতা
উইম্বলডন। ২১ নং হাই স্ট্রিট। মেয়ে ঘরে ফিরেছে। সঙ্গে দুই ভারতীয় সন্ন্যাসী।
সামনেই মার্গারেটের ছোট বোন মে-র বিয়ে। বাড়িতে আনন্দের ঢেউ।
নিবেদিতার ভাই রিচমন্ড বিবেকানন্দকে খুব ভালবেসে ফেললেন। বিবেকানন্দদের সেখানে বেশি দিন থাকার জো নেই। আমেরিকাতে প্রচারের কাজে যেতে হবে।
মার্গারেট কিছু দিন বাড়িতে থেকে যাবেন আমেরিকা, সেখানে ভারতীয় আদর্শ প্রচারের কাজে স্বামীজিকে সহায়তা করবেন, নিজের ইস্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করবেন।
রিজলি ম্যানর। পল্লি অঞ্চলে লেগেটদের মস্ত ভদ্রাসন। সেখানেই স্বামীজি আছেন, নিবেদিতা এলেন।
আমেরিকা সত্যি আজব দেশ। নিবেদিতার সঙ্গে বিবেকানন্দ আমেরিকার বন্ধুদের আলাপ করিয়ে দেন।
স্বামীজির আমেরিকার বন্ধুরা সবাই যে মার্গারেটের কথা শুনছেন তা নয়, বিবেকানন্দ সম্বন্ধে শ্রদ্ধা আছে, ভারত সম্বন্ধে নেই এমন লোকও আছেন।
বক্তৃতার সময় নানা বিচিত্র প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নিবেদিতা হতাশ হয়ে পড়েন। যে ছেলেরা স্বামীজির জন্য এত কিছু করেছেন তাঁরাও মার্গারেটের কথা মানেন না। মন খারাপ হয়।
ম্যাকলাউডের চিঠি এল। ‘‘তোমাকে নতুন লোকের মধ্যে কাজ করতে হবে, নতুন অনুগামী তৈরি করতে হবে।’’
সে চিঠি হাতে পেয়ে চুপ করে বসে রইলেন নিবেদিতা।
প্রতিভাবানদের কী ভাবে নাজেহাল করে সাদা মানুষেরা, নিবেদিতা ভারতে গিয়ে তা নিজের চোখে দেখেছেন।
তিনি আসার আগেই জগদীশচন্দ্র কলকাতার টাউন হলে অদৃশ্য আলোকরশ্মির অস্তিত্ব যন্ত্রের সাহায্যে দর্শকদের দেখিয়েছিলেন। কলকাতা হতবাক। তবে মার্কনি, টেসলা, ম্যাসিন প্রমুখ বিজ্ঞানী যে সুবিধে পান তার একফোঁটাও জগদীশচন্দ্র পান না।
কলেজ-রুটিনের বোঝা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের ওপর জগদ্দলের মতো চাপিয়ে দেন সাহেব আমলারা।
১৮৯৮তে বসু দম্পতির সঙ্গে নিবেদিতার আলাপ। এঁরা ব্রাহ্ম। মূর্তি পুজোতে বিশ্বাসী নন।
প্যারিসে কিছু দিনের মধ্যেই বিরাট প্রদর্শনী হবে। সেখানে ধর্ম নিয়ে কথা বলবেন স্বামীজি।
জগদীশচন্দ্র সস্ত্রীক আসছেন বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে যোগ দিতে। নিবেদিতা ঠিক করলেন এই ভারতীয় বিজ্ঞানীকে সব রকম ভাবে সাহায্য করবেন তিনি।
প্যারিস। সভাপতি বসুদের নিয়ে সভায় ঢুকলেন। এমনিতে জগদীশচন্দ্র বিবেকানন্দের মতো বাগ্মী নন। তবে আজ যেন তিনি অনর্গল। কখনও গম্ভীর ভাবে বিষয়ের ব্যাখ্যা করছেন, কখনও সুনিপুণ পরিহাসে শ্রোতাদের মন জয় করে নিচ্ছেন।
স্বামীজিও জগদীশচন্দ্রের কৃতিত্বে উচ্ছ্বসিত। প্যারিস থেকে বসুরা যাবেন ইংল্যান্ডে। ব্রাডফোর্ড ব্রিটিশ অ্যাসোশিয়েশনে তাঁর পেপার পড়ার কথা।
নিবেদিতাও ইংল্যান্ডে ফিরলেন। কিষেণগড়ের বালিকাদের জন্য ইস্কুল খুলবেন। টাকা চাই।
বিবেকানন্দ প্যারিসে, নিবেদিতা ইংল্যান্ডে। দু’জনের পথ যেন দু’দিকে।
বিবেকানন্দ প্যারিস থেকে লেখেন নিবেদিতাকে, ‘‘তোমার চিঠি পড়ে মনে হল তুমি ভেবেছ তোমার নতুন বন্ধুদের আমি বুঝি ঈর্ষা করি। তোমাকে বলি, আমার আর যাই দোষ থাক না কেন, জন্ম থেকেই আমার ঈর্ষা নেই।’’
বিবেকানন্দ যেন একটু একটু করে নিজেকে কাজ থেকে প্রত্যাহার করছেন। মঠের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন।
অক্টোবর মাসে ক্রিস্টিনকে লিখছেন, ‘‘আমেরিকায় রোজগার করা সব টাকা ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন আমি মুক্ত।’’
কনস্তান্তিনোপল্, গ্রিস, মিশর ঘোরার কথা স্বামীজির। মিশরের পিরামিড ভাল লাগল না তাঁর।
মিশরের স্থানীয় মানুষরা সাহেবদের কাছে ব্ল্যাক, নেটিভ। বিবেকানন্দের তাঁদের জন্য খুব কষ্ট হয়।
হঠাৎ দেশে ফেরেন।
১৯০০ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি। বেলুড় থেকে নিবেদিতাকে চিঠিতে লেখেন, ‘‘মহাদেশগুলির একপ্রান্ত থেকে একটি স্বর তোমাকে প্রশ্ন করছে: কেমন আছ ?’’
জগদীশচন্দ্রের শরীর ভাল নেই। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি অপারেশন হল।
১৯০১। ৪ জানুয়ারি।
ম্যাকলাউডকে চিঠিতে খবর দিলেন নিবেদিতা, ‘‘ড. বসু এখন প্রায় সুস্থ। মা তাঁর ছোট বাড়িটি তাঁদের ও আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। তাই আমরা এখন উইম্বলডনে।’’
জগদীশচন্দ্রকে বই লিখতে সাহায্য করছেন নিবেদিতা। ভারতে, স্বামীজির কাছে ফিরতে দেরি হচ্ছে তাঁর ।
দেহ রাখলেন নরেন্দ্রনাথ
১৯০২। ফেব্রুয়ারি মাস। নিবেদিতা মাদ্রাজে নামলেন। তাঁর সঙ্গে একই জাহাজে এ বার দেশে ফিরলেন রমেশচন্দ্র দত্ত।
কয়েক বছর আগে যখন প্রথম এ দেশে এসেছিলেন মার্গারেট, তার সঙ্গে এ বারের প্রত্যাবর্তনের কোনও তুলনাই চলে না।
পরের দিন চার তারিখ, মাদ্রাজের মহাজন সভা নিবেদিতা ও রমেশচন্দ্র দত্তকে সংবর্ধনা দিল।
জাপান থেকে ভারতে এলেন ওকাকুরা। ওকাকুরা খুব ভাল ইংরেজি জানেন না, নিবেদিতা নাকি তাঁর দি আইডিয়াল অব দি ইস্ট বইটি লিখতে সহায়তা করবেন।
অবনীন্দ্রনাথ ওকাকুরা আর নিবেদিতাকে দেখেছিলেন আমেরিকান কনসালের বাড়িতে।
সে দিন নিবেদিতা পরেছিলেন গলা থেকে পা পর্যন্ত নেমে যাওয়া সাদা ঘাগরা, গলায় ছোট্ট ছোট্ট রুদ্রাক্ষের একছড়া মালা, সাদা পাথরের তপস্বিনীর মতো লাগছিল তাঁকে। ক্রিস্টিন, ওকাকুরা, নিবেদিতা গেলেন মায়াবতী।
ফিরলেন ২৬ জুন।
নানা কাজে নিবেদিতা স্বামীজির থেকে দূরে, তখনও বুঝতে পারেননি বিবেকানন্দের সময় ফুরিয়ে আসছে।
২ জুলাই মঠে গেলেন নিবেদিতা। সামান্য আহারের আয়োজন। ভাত, আলুসেদ্ধ, কাঁঠাল বিচি সেদ্ধ, দুধ।
খাওয়ার পর নিবেদিতার হাতে জল ঢেলে দিলেন স্বামীজি, কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিলেন।
খুবই বিব্রত নিবেদিতা।
‘‘স্বামীজি, আমারই উচিত আপনার হাত ধুয়ে দেওয়া।’’
উত্তরে স্বামীজি বললেন, ‘‘যিশু তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন।’’
ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বেলুড়ে গিয়ে দেখলেন, স্বামীজি অন্তিম শয্যায়। তাঁকে ঘিরে আছেন মঠের সাধুরা, অতুলচন্দ্র বসু, নিবেদিতা।
নিরঞ্জনানন্দ বললেন, ‘‘নরেন চলে গেল।’’ গিরিশ বললেন, ‘‘চলে যাননি, দেহত্যাগ করলেন।’’
জয়া, ধীরামাতা, স্বামীজি, নিবেদিতা
নিবেদিতার কথায় উপন্যাস বদলালেন রবীন্দ্রনাথ
১৮ এপ্রিল, ১৯০৩। ডিয়ার মিস্টার টেগোর— চিঠি লিখছেন নিবেদিতা। সে চিঠি জগদীশচন্দ্রের কথায় পরিপূর্ণ। টেগোর জানতে চেয়েছেন জগদীশচন্দ্রের কথা।
এ দেশে আসার পর স্বামীজির সঙ্গে গিয়েছিলেন টেগোরদের বাড়ি। দেবেন্দ্রনাথকে পছন্দই করতেন বিবেকানন্দ, স্নেহ করতেন ঠাকুরবাড়ির সরলাকেও। সরলা তখন ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক ।
নিবেদিতা গিয়েছিলেন সরলাকে বেলুড়ে আসার নিমন্ত্রণ করতে। সরলা এসেছিলেন।
বাঙালি মেয়েরা তখনও একা একা পথ চলতে অভ্যস্ত নয়। সঙ্গে সুরেন ছিল।
বাগবাজার ঘাটে নিবেদিতা অপেক্ষা করছিলেন। নৌকা করে বেলুড়ে যাওয়া হল। স্বামীজির সঙ্গে বসে চা খেলেন সবাই। সরলার বীরভাব।
স্বামীজি বলতেন, ‘‘সরলার এডুকেশন পারফেক্ট। ভারতীয় নারীদের সরলার মতো হওয়া চাই।’’
তবে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বিবেকানন্দের কোথাও একটা কিন্তু-কিন্তু ছিল। নিবেদিতা চেয়েছিলেন দু’জনকে কাছে নিয়ে আসতে, পারেননি।
বিবেকানন্দ টেগোরের লেখা পড়ার সময় পাননি, নিবেদিতা টেগোরের কয়েকটা গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
মিস্টার টেগোরকে চিঠির শেষে নিবেদিতা লিখলেন, ‘‘বড় ভালবাসার এই দেশটির ওপর নিয়তির আঘাত যেন নেমে না আসে।’’
এ দেশের প্রতিভাবান মানুষগুলিকে নানা মতভেদের মধ্যেও বড় আপন মনে করেন নিবেদিতা, বড় ভালবাসেন এই দেশকে।
পরের বছর দলবেঁধে বুদ্ধগয়ায় যাওয়া হল। ক্রিস্টিন, জগদীশচন্দ্র, অবলা, রবীন্দ্রনাথ, একটি পত্রিকার সম্পাদক ও তাঁর স্ত্রী, সঙ্গে সদানন্দ।
এই বড়র দলে গিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথও। রথীন্দ্রনাথ অবাক হয়ে দেখেন, অনেক রাত হয়েছে, মন্দির ছেড়ে তবু কেউ উঠছে না। জগদীশচন্দ্র, নিবেদিতা, পিতৃদেব রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেবকে নিয়ে নানা কথা আলোচনা করছেন ।
দলের সঙ্গে থাকা খবরের কাগজের সম্পাদক মানুষটি আবার নিবেদিতার বন্ধুও।
তাঁর কাগজেই নিবেদিতা জানিয়ে দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তাঁর আর সরকারি সম্পর্ক নেই। বিপ্লববাদে গভীর আস্থা তাঁর। অরবিন্দ, তিলকের সঙ্গে কথা বলেছেন।
ভূপেন, স্বামীজির ভাই সেও তো বিপ্লবী। টেগোর অবশ্য চরমপন্থায় বিশ্বাস করেন না।
টেগোরের শিলাইদহের জমিদারি দেখে এলেন নিবেদিতা, পল্লি বাংলা বড় সুন্দর।
টেগোর উপন্যাস লিখেছেন, ‘গোরা’। গোরার কথা টেগোরের মুখে শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়েন নিবেদিতা।
জন্মসূত্রে গোরা অভারতীয়, সাহেব। কর্মসূত্রে বাঙালি। গ্রাম দেখতে গিয়ে গোরার রক্ষণশীলতা ধুয়ে মুছে গেল। ছোট ধর্মের থেকে মানুষ হয়ে উঠল বড়। কিন্তু গোরার সঙ্গে তো বাঙালি মেয়ে সুচরিতাকে মিলিয়ে দিচ্ছেন না কবি। পাশ্চাত্যের সঙ্গে কি প্রাচ্য মিলতে পারে না!
নিবেদিতার কথায় ডিয়ার মিস্টার টেগোর তাঁর উপন্যাসের শেষে গোরা আর সুচরিতাকে মিলিয়ে দিলেন।
রবিকা’র অবনও নিবেদিতাকে খুব পছন্দ করে। বাইরের বাস্তব নয়, ভেতরের ভাব তুলে ধরে যে ছবি— তাই নিবেদিতার প্রিয়। হ্যাভেলের বন্ধু নিবেদিতা অবনীন্দ্রনাথের ছাত্রদের খুব ভালবাসেন। নন্দলাল যায় নিবেদিতার বাড়ি, সে ঘরের স্কেচ করেছে। নিবেদিতার উদ্যোগেই নন্দলাল যেতে পারল অজন্তা, ভারতশিল্পের রূপ চিনতে পারল।
সালতামামি
বিসর্জনের দিন
১৯১১। অক্টোবর মাস। দার্জিলিং শহর কয়েক দিন ধরে মেঘ কুয়াশায় মুখ ঢেকেছে। পুজোর ছুটি কাটাতে এসেছেন নিবেদিতা। সঙ্গে জগদীশ আর অবলা।
নিবেদিতার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। অবলা খেয়াল রাখছেন নিবেদিতার। শরীরের আর কী দোষ। ধকল তো কম যায় না।
পূর্ববঙ্গে ত্রাণকার্যে গিয়ে সেই যে শরীর ভাঙল, আর যেন সারেই না।
কাছের মানুষরা চলে যাওয়ার পর কেমন উদাসীনও হয়ে গেছেন। নিবেদিতার মা গেলেন, ওলি বুল গেলেন। তাঁদের যাওয়ার সময় নিবেদিতা গিয়েছিলেন ও-দেশে।
বিবেকানন্দের মায়ের খোঁজ নিতেন নিয়মিত, ভূপেনকে কথা দিয়েছিলেন। তাঁরও দেহ গেল।
নিবেদিতা একটা উইল করেছেন। তাঁর জমা টাকা আর বইয়ের রয়্যালটি বিবেকানন্দের মঠের ট্রাস্টিদের দিয়ে দিয়েছেন। মন যেন সব কিছু থেকে তুলে নিয়েছেন।
১৩ অক্টোবর। আজ মেঘ নেই।
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। হিমালয়–শিব দুর্গার হিমালয়।
কমলালেবু রঙের বস্ত্র পরেছেন নিবেদিতা আজ। একটু যদি ভাল থাকেন। নীলরতন সরকার এখন দার্জিলিং-এ। নিয়মিত দেখে যাচ্ছেন। সকালবেলার আলো এসে পড়ছে আজ কয়েক দিন পর। অবলা শুনতে পান নিবেদিতা বলছেন নৌকা ডুবে যাওয়ার কথা।
নৌকা ডুবছে।
কিন্তু সূর্যোদয় দেখতে পাবেন তিনি। নিবেদিতার চুয়াল্লিশ বছরের দেহটা ভাঁজ করা কাপড়ের মতো পড়ে রইল।
হিলকার্ট রোড দিয়ে যাচ্ছে নীরব শোকগ্রস্ত মানুষের দল।
আজ তাঁদের বিসর্জনের দিন।
••••
লর্ড কারমাইকেল এসেছেন অবনীন্দ্রনাথের কাছে। ঝুঁকে পড়ে দেখছেন একটি ছবি।
‘‘এ কার ছবি?’’ নিবেদিতার, প্রয়াত মিস মার্গারেট নোবলের।
কারমাইকেল বগলদাবা করে সেই অপরূপ ছবি নিয়ে চলে গেলেন।
এই সেই মেয়ে, কোনও কোনও সাহেবি কাগজ যাঁকে কালীর উপাসক হিসেবে ব্যঙ্গ করেছিল। কৃষ্ণবর্ণা রমণী শ্বেতবর্ণ পুরুষের বুকের ওপর নাচছে, শ্বেতবর্ণ শিবের বুকে দাঁড়ানো কৃষ্ণকায় কালী।
এ দৃশ্য সাহেবদের ভাল লাগেনি। না লাগুক।
শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ এই মেয়েকে ঠিক বুঝেছিলেন, কে বলেছে এ বিদেশিনী?
ইনি মহাশ্বেতা।
ঋণ: নিবেদিতার দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম, দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ, ফুটফলস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি, নোটস অব সাম ওয়ান্ডারিংস উইথ দ্য স্বামী বিবেকানন্দ। শঙ্করীপ্রসাদ বসু সম্পাদিত লেটারস অব সিস্টার নিবেদিতা, লোকমাতা নিবেদিতা (১-৪), প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণার ভগিনী নিবেদিতা, স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলি। লিজেল রেমঁ/দ্য ডেডিকেটেড, নিবেদিতা প্রসঙ্গে (সূত্রধর প্রকাশিত বইটি নিবেদিতা সম্পর্কিত নানা জনের মূলত স্মৃতিকথার সংকলন)
(পুনঃপ্রকাশিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy