অযান্ত্রিক: ব-দ্বীপ আয়োজিত ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ প্রদর্শনীর একটি শিল্পকর্ম। অ্যাকাডেমিতে।
ভারত-বাংলাদেশের তরুণ চিত্রকর-ভাস্করদের যৌথ প্রতিনিধিত্বমূলক এক প্রদর্শনী ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ অনুষ্ঠিত হল অ্যাকাডেমিতে। উপস্থাপনায় ‘ব-দ্বীপ’। এটিই তাদের প্রথম কাজ। প্রায় সকলের কাজেই শিক্ষানবিশির ছাপ স্পষ্ট। তার মধ্যেও নতুন প্রয়াসের অভিনবত্ব আছে। ছিল আটজন মহিলা শিল্পী, চার জন পুরুষের কাজ। যাঁদের মধ্যে ন’জন বাংলাদেশের এবং তিন জন ভারতের।
তাঞ্জিলা সুমাইয়া সিদ্দিকির স্টোনওয়্যার-এর ‘রিকল মেমোয়ার্স’-এ অভিনবত্ব আছে। বহির্তলের খসখসে মসৃণতা, কোথাও ক্ষুদ্র উচ্চাবচ ডটের মতো গর্ত। বুজে থাকা দু’টি চোখের বুদ্ধসদৃশ মুখাবয়বের মনোটোনি ভেঙে একটা ভারসাম্য এনেছেন। সেখানে গাঢ় খয়েরি বর্ণের আলঙ্কারিক চিত্রাঙ্কন মানানসই। রোহিঙ্গাদের যন্ত্রণার ভেসে আসা স্মৃতি নিয়ে করা কাজটিতে মুরগিছানা পদ্মপাতা, জল— তবুও সেই গভীরতা নেই।
বৈজয়ন্তী সরকার স্বর্ণার বর্তুলাকার দু’টি স্টোনওয়্যার-এর কাজে মুনশিয়ানা আছে। যদিও সেরামিক্স স্টোনওয়্যারে চারটি রং ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা ছিল। ম্যাট ও গ্লেজড দু’রকম টেকনিককে প্রয়োজন মতো প্রাধান্য দিয়েছেন শিল্পী। ফর্ম গোল, কিন্তু কম্পোজিশনের গুণ এবং রূপারোপ যেন প্রকৃতই একে অন্যের পরিপূরক।
এমএস মিজানুর রহমানের ক্যাটালগে মুদ্রিত কাজটি প্রদর্শনীতে নেই। মাধ্যম পিভিসি বোর্ড হলেও সরু করে কেটে বোর্ডগুলিকে রেখার মতো সমান্তরাল বিন্যস্ত করে দ্বিমাত্রিকতার মধ্যে বিভ্রম তৈরি করেছেন। ওই সমান্তরাল দৃশ্যপটে মুখাবয়ব খুঁজতে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে।
বাংলাদেশে রিকশার পেছনে ছবি আঁকানোর রেওয়াজ অনেক কালের। উজ্জ্বল চড়া এনামেল পেন্টের সে সব ছবি শিশুসুলভ, মজাও আছে। বানু রোকসানা আখতার ‘রিকশা পেন্টিং’ নামে যে কাজটি করেছেন, সেখানে শিশুদের আঁকা ছবির সামান্য অনুষঙ্গ থাকলেও লোকশিল্পের আলঙ্কারিক নকশাও মিলেমিশে থাকে সমগ্র পরিবেশের নিসর্গদৃশ্যের সঙ্গে। অন্যটি বরং তুলনায় দুর্বল একটি অ্যাক্রিলিকের কাজ।
মারিয়া আখতার পান্নার চারটি গোল রিলিফ সেরামিক্স। বিস্কিট ফায়ার ও মিক্সড ক্লে মাধ্যমে করা। অতি সাধারণ। রং ও রূপের পরীক্ষানিরীক্ষা কিংবা বিভিন্ন টোন এবং উজ্জ্বলতার বিভ্রম তৈরির সম্ভাবনার দিকে মারিয়া যেন এগোতেই চাননি।
নাসিমা খানম কুইনির তিনটি কাজ তিন রকম। কাগজে অ্যাক্রিলিক। রঙিন ছাপছোপের ইমপ্রেশন ও ব্রাশিং টেক্সটাইল প্রিন্টের আভাস দেয়। রং গড়িয়ে যাওয়ার মতো সরু স্পেসনির্ভর লাইন, ডট, পশ্চাদপটের হাল্কা জমিকে নির্ভরতা দিলেও বর্ণ-বিন্যাসের মধ্যে দূরত্ব তৈরির সম্ভাবনা কেন থামিয়ে দিলেন? ছবির অন্যত্র রূপারোপের বিন্যাস সমতলীয় বর্ণের আঙ্গিককে একটি জায়গাতেই আটকে রাখে।
প্রতীক মল্লিক কাগজে মিশ্র মাধ্যম করেছেন। যেন পুরনো কাজের মতো। উদভ্রান্ত উড়ন্ত গুচ্ছ দাড়িওয়ালা-মুখ সাধু। অন্ধকারাচ্ছন্ন কোথাও কোথাও। পালি, ব্রাহ্মী লিপির ব্যবহার কেন? ব্রাশিংয়ের ঝোড়ো আবহ যেন অযথা কম্পোজিশনকে নিয়ন্ত্রণ করে, এক জায়গায় নির্দিষ্ট হয়ে যায়। অনাবশ্যক শূন্য স্পেসে তাই শিল্পের চাহিদাগুলো ধরা পড়েনি।
মনীষা সাহার ব্রাশের ড্রয়িংসদৃশ ছোট কাজগুলি অতি সরলীকরণ। যা বুদ্ধিদীপ্ত নয়। দ্রুত সচিত্রকরণের ড্রয়িংয়েও টানটোনের এক সহজাত গভীরতা থাকে। এখানে তা নেই। রঙিন কালি-তুলির নিসর্গেও মুনশিয়ানার অভাব।
‘এন্ট্রি অব ফ্রিডম’ সন্নিবদ্ধ রচনা। সুস্মিতা সাহা রিমি ইন্ডিয়ান পেন্টিংয়ের মতো ঐতিহ্যপূর্ণ রচনার আবহ আনতে চেষ্টা করলেও তাতে অনেক উপসর্গই অনুপস্থিত। এমনকী কাগজে ওয়াশ পেন্টিংয়ের যে অনেক শর্ত থাকে, টেকনিক-প্রধান তেমন সিরিয়াস উপস্থাপনার কথাও সুস্মিতা ভাবেননি।
পলাশ শেখের ক্যানভাস অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে করা। বেশ দুর্বল কম্পোজিশনের জন্য আলাদা ভাবে কোনও ভাবের উদ্রেক করে না। অনেক হাত কি অন্ধকারের ক্ষমতাকে প্রতীকায়িত করে?
স্বাধীনতা থাকলে ইচ্ছেকে যেমন খুশি রূপ দেওয়াই যায়। তবু তারও অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তাকে ছাপিয়ে চিন্তার গভীরতা থাকে। দ্বিমাত্রিকতার বিন্যাসেও ভাবনা কাজ করে। কী নির্মাণ, কী ভাবে নির্মাণ? যা বিমূর্ততার কথা বললেও তন্ময় দাশগুপ্তর কাজে সে ভাবে মান্যতা পায় না।
শার্মিন হক স্টোনওয়্যার-এর কাজে অনুন্নত শ্রেণি কিংবা উচ্চবিত্ত শ্রেণির লম্বা মুখগুলিতে ট্রাইবাল আর্টের আদিমতাকে রূপ দিতে গিয়ে টেক্সচার নির্মাণের তাগিদেই সরু লম্বা উঁচু নিচু একঘেয়েমিকে কাটাতে পারেননি— ট্রাইবাল আর্টে যা নেই। তার তুলনায় হোয়াইট ক্লে, লেড গ্লেজড সেরামিক্স-এর কাজে সুদৃশ্য লম্বা প্লেটে একজোড়া লাল চিংড়ি এবং নিশিরাতে চাঁদের নীচে আধুনিক রূপারোপের রিলিফে পেঁচার কাজ দু’টি প্রশংসনীয়।
লুকোনো স্ফুলিঙ্গের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি ভবিষ্যতের প্রদর্শনীতে আরও বাঙ্ময় হয়ে, দুই বাংলার শিল্পকলাকে সমৃদ্ধ করার দিকেই যাত্রা করুক।
সময়ের আবর্তে বিনোদিনী
সুকোমল ঘোষ
এক কথায়, চমৎকার! নান্দীপট-এর ‘আরশি’ নাটকের উপস্থাপনা, নির্দেশনা, অভিনয় মন ভরিয়ে দেয়। নাট্যকার এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীসত্তার প্রতি অবিচারের এক চিরন্তন দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন শুধুমাত্র মঞ্চাভিনেত্রীদের মধ্য দিয়ে—যা খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের বিনোদিনী দাসীর সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার জন্য বিনোদিনী মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ‘বাবু’র মৃত্যুর পরেই তাঁকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়— নাটকে বলা হয়েছে। নাট্যশালা তাঁর নামে হয়নি, এই কথা বহুল প্রচারিত। প্রভা দেবী আইনত ছোট কর্তার স্ত্রী হলেও, ছেলেমেয়ের পিতৃ-পরিচয় নেই বলে অনুযোগ করেন। একই অবস্থা ষাটের দশকের এক প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীর। তফাত সামান্যই— ওঁদের কিছু করার স্বাধীনতা ছিল না। তবু উনি প্রতিবাদে দল ছাড়েন। বাকিটা মঞ্চে...
নাট্যকার এবং নির্দেশক দু’জনকেই ধন্যবাদ, এই রকম বক্তব্যের রচনা ও মঞ্চস্থকরণের জন্য। মঞ্চ পরিকল্পনা যথাযথ। সংগীত মাঝে মাঝে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। দর্শকদের মধ্য থেকে একবার আপত্তিও উঠেছে। যে নাটকে জোনের ব্যবহার হয়, তার আলোকসম্পাত আরও সৃষ্টিধর্মী হওয়া উচিত।
ব্যাক প্রোজেকশনে পোস্টারের আলো জ্বলছিল মঞ্চ অন্ধকার হওয়ার পরেও। নাটকের শেষ দিকে অনুপমার একার বক্তব্য শেষে আলো সরাতে বা নেভাতে দেরি হওয়া চোখে লেগেছে। বয়স্কা বিনোদিনী ঠিক মতো আলো পেলেন না অন্যদের তুলনায়। এই সব সামান্য ত্রুটি পরিহার করতে পারলে ‘আরশি’ আরও রসোত্তীর্ণ হবে।
সুরস্নাত শ্রদ্ধার্পণ
চিত্রিতা চক্রবর্তী
বিশিষ্ট বেহালাবাদক প্রয়াত বিষ্ণু গোবিন্দ যোগের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করল ‘স্বরসাধনা’। সহযোগিতায় ছিল ‘সংগীত আশ্রম’। সম্প্রতি তাদের ‘গুরুপ্রণাম’ অনুষ্ঠান সংঘটিত হল কলামন্দির প্রেক্ষাগৃহে। এই অনুষ্ঠানে বিশ্বমোহন ভাটকে পণ্ডিত ভি জি যোগ পুরস্কার প্রদান করা হল।
‘গুরুপ্রণাম’ অনুষ্ঠানের সূচনা হল স্বরসাধনা সংস্থার ছাত্রছাত্রীদের বেহালাবাদন দিয়ে। তাঁদের প্রথম উপস্থাপনা ছিল রাগ ইমন। একতালে নিবদ্ধ একটি কম্পোজিশন বাজালেন তাঁরা। তার পরে শোনালেন ভারতীয় সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার অন্যতম পথিকৃৎ তিমিরবরণ ভট্টাচার্যের একটি কম্পোজিশন— মানভঞ্জন। তাঁদের বৃন্দবাদন উপভোগ করেছেন শ্রোতারা।
পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেহালাবাদন শুনতে খারাপ লাগেনি। তিনি বাজিয়ে শোনালেন বেহাগ। তবে প্রথম পর্বে সম্মাননাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানটি অতিদীর্ঘ হওয়ায়, মূল অনুষ্ঠানে তার বেশ প্রভাব পড়েছে। যার ফলে শিল্পী বেহালাবাদনের সময় সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য হয়েছেন। তাই একটি রাগের গভীরে প্রবেশ করার আগেই শিল্পী চলে গেছেন অন্য রাগে। তাঁর দ্বিতীয় পরিবেশনা ছিল নানা রাগের মিশ্রণে সৃষ্ট রাগসাগর।
এই রাগে দু’টি কম্পোজিশন শোনালেন পল্লব। তবে রাগবিন্যাসের সময় সংক্ষিপ্ত হওয়ায় কোনও রাগকেই তেমন ভাবে পাওয়া গেল না। শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত করেছেন সমর সাহা। তাঁর তবলাবাদন প্রশংসনীয়।
স্বল্পশ্রুত গাওতি রাগ বাজিয়ে শোনালেন বিশ্বমোহন ভাট। রাগবিন্যাসে তাঁর মুনশিয়ানা এর আগে শ্রোতাদের বহু বার মুগ্ধ করেছে। কিন্তু এ বার তাঁর মোহনবীণা তেমন ভাবে হৃদয় স্পর্শ করতে পারল না। আগাগোড়া তীব্র লেগেছে তাঁর বাদন। পেলবতার ভাগ অনেকটাই কম ছিল। মোহনবীণার মাধুর্য ধাতব শব্দে চাপা পড়ে গিয়েছে। শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সহযোগিতা করেছেন রামকুমার মিশ্র। তাঁর বেনারস বাজ মন ছুঁয়ে গিয়েছে।
অনুষ্ঠান
• রবিনন্দনের বার্ষিক অনুষ্ঠান আয়োিজত হয় বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচারে। ‘বাঁশরীর মধুগুঞ্জরণে’ নামে গীতি আলেখ্য পরিবেশিত হয়। দ্বিতীয়ার্ধে রবীন্দ্র সংগীত সহযোগে, কথাকলি ও মোহিনীআট্যমের নৃত্যছন্দে উপস্থাপিত হয় নৃত্যনাট্য ‘দারুণ বাঁশী কাহ বাজাওত’।
• সম্প্রতি ‘অস্থায়ী’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিশির মঞ্চে আয়োজন করেছিল আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটকের একটি অনুষ্ঠান। অংশগ্রহণ করেছিলেন সিদ্ধিতা সরকার, উজান সিংহ, অহনা ঘোষ, অন্বেষা সাহু, পূজা পণ্ডিত, জিতমিত্রা চট্টোপাধ্যায়, স্রোতস্বিনী ঘোষাল, সুদর্শনা ভট্টাচার্য, অনামিকা সাহা, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ ঘোষ প্রমুখ।
• পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাঘরে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মানসী বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাস্করজ্যোতি সেনগুপ্ত, শঙ্কর রায়চৌধুরী, সুকুমার ঘোষ, কাজল সুর, অলোক মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত ঘোষ, ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়, সাতকর্ণী ঘোষ, বাসুদেব নন্দী, আশিস চক্রবর্তী, শ্বেতা গুপ্ত প্রমুখ। গোটা অনুষ্ঠানটি সংযোজনা করেন অলোক রায় ঘটক এবং সুদীপ্তা ভাদুড়ি। উপস্থিত ছিলেন ইন্দ্রনীল রায়, প্রদীপ ঘোষ, ঊর্মিমালা বসু প্রমুখ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy