প্রাণবন্ত: চিত্রকূট গ্যালারিতে আয়োজিত গোপীনাথ রায়ের একক প্রদর্শনীর একটি ছবি
শিল্পচর্চার পরিণতিই হল শিল্পীকে ক্রমে তা এক বোধের জায়গায় পৌঁছে দেয়, যেখানে সে নিজের সঙ্গে বসবাস করে। এই নিজ ‘ইনার সেলফ’— যা শরীরে নয়, মনে। গোপীনাথ রায় এ রকমই এক শিল্পী ছিলেন। চিত্রকূট গ্যালারিতে প্রদর্শিত তাঁর ভাস্কর্যগুলির মূল ভাবনা ছিল প্রকৃতির পঞ্চভূত তত্ত্বের ক্ষিতি, অপ তথা জল এবং পাথর। তাই তাঁর সৃষ্ট কাজগুলি উঁচু টিলার ছাদ বেয়ে বৃষ্টির নেমে আসা, পাথুরে জমির মাঝখান দিয়ে খরস্রোতা নদী, তরঙ্গায়িত রেখায় শায়িতা মানবী, আবার নির্জন দ্বীপে আছড়ে পড়া ঊর্মিমালা। পাথর হাতে এলে তিনি এর ভেতরের সুরটি ধরতেন আগে। পরে আসত রূপ, নাম। কুশলী দক্ষতায় এবং পরিমিত ছেনির ব্যবহারে প্রতিটি ভাস্কর্য তাই প্রাণবন্ত কাব্যিক হয়ে ওঠে। ছোট ছোট মিনিয়েচার ফর্মের কাজগুলি বেশির ভাগই কালো গ্র্যানাইটে করা। ‘আইল্যান্ড’ ভাস্কর্যটি একটি দ্বীপ। সফেন তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে চারিদিকে, বেলাভূমিতে কয়েকটি জলের দাগ, বার্ডস আই ভিউ পার্সপেক্টিভ যেন রূপকথা। ‘মাদার চাইল্ড’ সাদা মার্বেল পাথরের কয়েকটি নাতিউচ্চ ঢেউ, মাঝখানে মাতৃবক্ষে একফোঁটা ঘুমন্ত শিশুমুখ। ‘স্লিপিং উওমেন’ কাজগুলির স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ ভঙ্গি, সহজ আকার, আবার মনুমেন্টাল গুণসম্পন্ন, সবুজ কালো আনুভূমিক রেখায় ধরা মানুষী ছবিগুলি স্পষ্টতই প্রকৃতির ভূমিরূপ। শিল্পী বরাবরই প্রকৃতির অন্তর্লীন সত্তাটিকে জানতেন এবং সেটিকে আত্তীকরণ করেছিলেন। গ্র্যানাইট পাথরের টুকরো থেকে বেরিয়ে আসছে শিকারোন্মুখ অজগর, পান্না-সবুজ বর্ণপ্রয়োগ এবং হালকা চিজেল মার্ক টেক্সচারে প্রায় জীবন্ত। উল্লম্ব ভাবে করা ‘মাই ফেয়ার লেডি’ পাথরের মধ্য থেকে একটি নারীমুখ প্রস্ফুটিত হয়ে রয়েছে—যেন পাথরের মধ্যেই ছিল, শিল্পী কেবল সেখান থেকে মুক্ত করেছেন। প্রদর্শনী কক্ষে একটি উডকাট এবং একটি এচিং ছিল, এচিংটিতে পবিত্র সরস্বতী নদীর প্রবাহ থেকে দেবী সরস্বতী রূপ পরিগ্রহ করেছেন। সুন্দর ভাবনা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভাস্কর্যটি ‘ওয়েভ’। বেলাভূমিতে ঢেউ, সফেন পাথরের আনুভূমিক বিস্তৃতি যেন ছোঁয়া যাবে, এ রকমই তা লালিত্যপূর্ণ এবং প্রাণময়।
ভারতীয় শিল্পীরা এ জন্যই প্রণম্য। তাঁরা প্রকৃতির ইনার স্পিরিটকে নিজেদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম করতে পারেন। প্রাণ ছুঁয়ে যায়। শিল্পীর শেষ ভাবনাও ছিল—‘প্রতিদিন তব গাথা গাবো আমি সুমধুর...।’
মনে থাকে
শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়
সম্প্রতি আইসিসিআর-এ ‘সর্জন আবৃত্তি অ্যাকাডেমি’ নিবেদন করল ছন্দা রায়ের আবৃত্তি ও কথানাট্যের একক। প্রথমেই মন ভরে যায় রুচিশীল মঞ্চসজ্জায়। পরে ছন্দা একের পর এক পরিবেশন করলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে আধুনিক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনির্মল বসু, শুভ দাশগুপ্তর মতো কবিদের কবিতা।
শিল্পী যেমন স্বচ্ছন্দ রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘বোঝাপড়া’-য়, তেমনই স্বচ্ছন্দ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘কিশোরী’ কবিতায়। এই কবিতায় যন্ত্র সহযোগিতা মনে দাগ কাটে।
শিল্পীর কণ্ঠে কাজী নজরুলের কবিতার কোলাজ বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘একবার তুমি’ শুনে মুগ্ধ হতে হয়। শুভ দাশগুপ্তের ‘ফিরে এসো আগুন’ কবিতাটি শিল্পীর আরও এক অসাধারণ পরিবেশন। কবিতা যে মানুষের অন্তরে দাগ কাটে তা এ দিন বার বার প্রমাণ করেছেন শিল্পী। বিশেষ করে বহুদিন বাংলার বাইরে থেকেও কিভাবে বাংলা কবিতার চর্চা করা যায় তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। শেষ পর্বে পরিবেশিত হল দেবেশ ঠাকুরের ‘কথানাট্য’। কথানাট্যের রাধা ও দ্রৌপদীর চরিত্রের সঙ্গে এক হয়ে বিভোর হয়ে যান শিল্পী। শুনতে শুনতে শ্রোতারাও নিজেদের মিশিয়ে দেন চরিত্রগুলির সঙ্গে।
হৃদয় আমার নাচেরে
পলি গুহ
গ্লোবাল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস বেহালা শরৎ সদনে সম্প্রতি তাদের তৃতীয় বার্ষিক অনুষ্ঠান উদযাপন করল নৃত্যের ছন্দে। অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ছিলেন দেবস্মিতা রায়চৌধুরী। শুরুতেই বেদগানের সঙ্গে ছাত্রীদের নৃত্য ও শিশুশিল্পীদের কত্থকে ফুটে উঠল ‘মাখন চুরি’, ‘কবিত্ব’ ও ‘হৃদয় আমার নাচেরে’। খুব সুন্দর প্রযোজনা। দর্শকদের প্রশংসাও পেয়েছে তারা। তবে এ দিন অনুষ্ঠানে নজর কেড়েছে দেবস্মিতার একক কত্থক নৃত্য। শেষ পর্বে ছিল ‘অন্য রবি’। রবীন্দ্রনাথের মূল গান ও ভাঙাগানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করলেন দেবস্মিতা ও সংস্থার ছাত্রীরা। গান ও নৃত্যের সুন্দর মেলবন্ধন। ভাল লেগেছে ‘মম চিত্তে’ গানটির সঙ্গে সমবেত নৃত্য। সংস্থার ছাত্রীদের আলাদা প্রশংসা অবশ্যই প্রাপ্য।
বেঁচে থাকার লড়াই
মলয় রক্ষিত
সদ্য গড়ে ওঠা নাট্যদল বহুস্বর এবং নিভা আর্টস-এর যৌথ উদ্যোগে তাদের প্রথম প্রযোজনা ইসমত চুগতাইয়ের ‘চৌথী কা জোড়’ অবলম্বনে পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের নাট্যরূপ ‘চতুর্থীর জোড়’। চুগতাই-এর এই কাহিনিতে এক প্রান্তিক মুসলমান নারী আয়েশা বিবির গল্প। দুই কন্যা কুবরা ও হামিদাকে নিয়ে আয়েশা বিবির বেঁচে থাকার লড়াই। হতদরিদ্র গ্রামের মানুষগুলির কাছে আয়েশা বিবি ‘মুশকিল আসান’ হিসেবেই পরিচিত। তাঁর সেলাই-শিল্পের গুণে ছোট, কাটাছেঁড়া কাপড়ও অপরূপ পোশাক হয়ে ওঠে। এহেন মুশকিল আসান মানুষটির ঘরে হঠাৎই এসে জু়ড়ে বসে রাহত মিঞা, যাকে বড় মেয়ের সঙ্গে শাদি দেওয়ার স্বপ্নে আয়েশা মশগুল। কিন্তু প্রায় বর্বর এই রাহত মিঞাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে আয়েশার সমস্ত ঘটিবাটি শেষ হয়। এই মুশকিলের আসান সে করবে কী ভাবে? শেষ পর্যন্ত রাহত মিঞার হাতে ধর্ষিতা হয় তার ছোট মেয়ে হামিদা। এর পরও কি আয়েশা বিবি চুপ থাকবে?
বহুস্বরের নির্দেশক তুলিকা দাস পরম যত্নে এই প্রযোজনা নির্মাণ করেছেন। নীল কৌশিকের পরিকল্পনায় মঞ্চের তিন দিকে ফুট দেড়েক তিনটি পাটাতনে তিনটি আলাদা প্ল্যাটফর্ম।
কোণে কোণে গোটা চারেক বাঁশের খুঁটি আর দুটি প্ল্যাটফর্মের পিছনে বাঁশের বেড়া—এটাই আয়েশা বিবির ঘর। সেই ঘরদুয়ার ঘিরেই যেন গড়ে ওঠে গোটা একটা গ্রাম। অভিজিৎ আচার্যের সংগীত পরিচালনায়, দীপঙ্কর দে’র পরিমিত আলোর বোধে আড়ম্বরহীন ছিমছাম মঞ্চে চমৎকার নাট্য পরিবেশ ফুটে ওঠে। কুবরা চরিত্রে সমাদৃতা পাল ও হামিদা চরিত্রে মনোমিতা চৌধুরী বেশ পরিণত অভিনয় করেছেন। রাহত মিঞা চরিত্রে ময়ূখ দত্ত আরও একবার তাঁর অভিনয়-বৈচিত্রের দক্ষতা দেখালেন। আর আয়েশা বিবিরূপী তুলিকা দাস প্রথম থেকেই অনবদ্য।
বিশেষ করে হামিদা ধর্ষিতা হওয়ার পরে ঘর থেকে রাহতের ব্যাগপত্র-জুতো ঘরের বাইরে ছুড়ে ফেলে, আয়েশা যখন প্রায় ক্ষিপ্ত বাঘিনির মতো রাহতের দিকে পিছন ফিরে পা ছোড়ে—আশ্চর্য এক নাট্যমুহূর্ত তৈরি হয়, যা কখনও ভোলার নয়। অনুবাদে সংলাপের টানটান ভাষা, পরিমিতিবোধ, আবহে করুণ সুরের বেহালা ও আলোর বৃত্তে ফুটে ওঠা দৃশ্যখণ্ডগুলি বড় অপরূপ করে তুলেছিল।
অনুষ্ঠান
• সম্প্রতি ত্রিগুণা সেন মঞ্চে রিদম আয়োজন করেছিল ৩৬তম বার্ষিক শাস্ত্রীয় সংগীতানুষ্ঠান। শুরুতেই ছিল সংস্থার শিক্ষার্থীদের সমবেত তবলা লহরা। পরে একক তবলা লহরায় ছিলেন সুজিত সাহা। কণ্ঠসঙ্গীতে ছিলেন নবদীপ চক্রবর্তী, মন্দিরা লাহিড়ি। সঙ্গতে ছিলেন সমর সাহা ও সুরজিৎ সাহা। হারমোনিয়ামে হিরণ্ময় মিত্র ও প্রদীপ পালিত।
• বেঙ্গালুরুর নাট্যদল স্মরণিকের আয়োজনে উত্তম মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল দু’দিনের নাট্যোৎসব। প্রথম দিনে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘সদিচ্ছার রং বদল’। দ্বিতীয় দিনে মঞ্চস্থ হয় দুটি নাটক ‘সীমন্তিনী’ এবং ‘নটী বিনোদিনী’। নাটকগুলির নির্দেশনায় ছিলেন সায়নদেব ভট্টাচার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy