প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরেই ছাপচিত্র। পরবর্তী সময়ে মাধ্যম বদলে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার চড়াই উতরাই। পাশাপাশি অন্য ধরনের কাজও চালিয়ে গিয়েছেন বিভিন্ন মাধ্যমে। তবে গ্রাফিক্স নিয়ে নীরব, নিরবচ্ছিন্ন একটি লড়াই তাঁর আজও বিদ্যমান। এই অশীতিপর বয়সেও শিল্পচর্চায় বিরাম নেই। ১৯৭২ থেকে ২০১৯— গত সাঁইতিরিশ বছরের লিনোকাট, লিথোগ্রাফ, এচিং, সেরিগ্রাফ, মিশ্র মাধ্যম, অ্যাক্রিলিকের ৪৪টি কাজ নিয়ে দেবভাষা গ্যালারিতে লালুপ্রসাদ সাউয়ের ‘মাই প্লেজ়ার’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনী সম্পন্ন হল। উদ্বোধনে শিল্পী তিনটি ছবিও আঁকেন।
গ্রাফিক্সে তাঁর দীর্ঘ একটি যাত্রা প্রত্যক্ষ করলে সহজেই ধরা পড়ে, তিনি দ্বিমাত্রিক তলের উপরে সাদা-কালো ও রঙের নানা রকম সাহসী নিরীক্ষায়, এক বৈপ্লবিক অন্বেষণের মধ্যে নিজেকে কী ভাবে ভেঙেছেন বারবার। এই ভাঙাগড়া ও নতুন একটি বাঁকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে কিছু ফর্মেশন ও ডায়মেনশনকে গুরুত্ব দিয়েছেন এ জন্যই। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিবিষ্ট থেকেই তিনি স্ট্রাকচার, জিয়োমেট্রি, ক্যালিগ্রাফি, ইলিউশন, ইম্প্রেশন, রিদম অফ অ্যাবস্ট্রাকশনকে যে ভাবে তাঁর গ্রাফিক্সের পৃথিবীতে একটি স্থায়িত্বের মধ্যে বেঁধে রেখেছেন, তা সত্যিই অসাধারণ।
স্পেস বরাবরই তাঁর ছাপচিত্রে এক বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ। যেখানে আকৃতি ও বর্ণের সংঘবদ্ধতায় সমগ্র শূন্যতাকে চাপা দিয়েছেন, সেখানেও তৈরি হয়েছে ওই দুই সমন্বয়ের মধ্যে একটি বৈপরীত্য ও ছন্দের বিমূর্ততা। সেখানে ওই ভার্টিকাল-হরাইজ়ন্টাল এই দুই রেখান্বিত সমন্বয় বা দ্বন্দ্বের মধ্যে একটি আশ্চর্য সমীকরণ গড়ে ওঠে। তৈরি হয় স্ট্রাকচারের মধ্যেও অবাধ এক রকম শূন্যতা, পাশাপাশি ক্ষুদ্র ফর্মেশনের বিমূর্ত রূপারোপের অবস্থানে এক ঘন নিবিড় সাংগঠনিক আবহ। ওঁর লিনোকাটের নানা পুরনো কাজে এ রকম কম্পোজ়িশনের মধ্যে তিনি ওই বিভ্রম তৈরি করেছিলেন, যা আধুনিক ছাপচিত্রের সব উন্মাদনাকে চকিতে উসকে দেয়। কারণ বর্ণ এখানে বিভ্রমের চোরাগলিতে আটকে না থেকে, তা থেকে বেরোনোরও একটি দিশা বাতলে দিচ্ছে যেন! বর্ণের গাঢ়ত্ব ও আপাতহালকা টোন সারফেস জুড়ে এক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য প্রকাশ করছে।
বিমূর্ততার যে ছন্দকে প্রশ্রয় দিয়েছেন সচেতন ভাবে, দেখা যাচ্ছে সেখানেও কম্পোজ়িশনেই তাঁর সৃষ্ট ফর্মগুলির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে আর একটি ভাষা, যা প্রয়োজনীয় আলোর প্রেক্ষাপটটিকে ওই রেখান্বিত ফর্মেশনের বাহুল্যের মধ্যেও তৈরি করছে আরও একটি স্পেস। ফলে ছন্দ ও বিভ্রম ছাড়াও দারুণ আশ্চর্য এক ইন্টারভ্যালও তৈরি হয়ে যাচ্ছে অচিরেই।
মাধ্যমটিকে কতখানি আয়ত্ত ও দক্ষতার মধ্যে এনে, তবে তিনি এই অবিস্মরণীয় সৃষ্টিগুলিকে পরিয়েছেন জড়োয়া গয়নার সাজপোশাক! এখানেই রঙের বৈপরীত্যের সঙ্গে সহাবস্থানে নিবিড় হয়ে থাকে কিছু আলাদা টেক্সচারাল কোয়ালিটি। মশারির জাল, চিরুনির দাঁতের দ্রুত টানটোনের আঁচড় থেকে স্প্যাচুলার অবাধ গতির চলাচলের মধ্যে গড়ে ওঠে ক্যালিগ্রাফিক ব্রাশিংয়ের চাতুর্য। মিশ্রবর্ণের এক রোমাঞ্চকর দৃশ্যপট তৈরি হয়। যেখানে আলোই কখনও আহ্বান করছে অন্ধকারকে, বিপরীত দিক থেকে তিমিরাবৃত অংশই যেন কম্পোজ়িশনের নিহিত ঔজ্জ্বল্যকে প্রকাশ করছে কী আশ্চর্য বর্ণময়তায়! ফলে সামগ্রিক এক কনস্ট্রাকশনের মধ্যে তিনি একই সঙ্গে অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়ে, তার সমাধানের ভাষা হিসেবে সুদীর্ঘ সময়ের গ্রাফিক্সকে দিয়েছেন এক আধুনিক বর্ণমালা।
ছাপচিত্রের বাইরে তাঁর অন্যান্য মাধ্যমের কাজগুলির মধ্যে লাইন, ফ্ল্যাট কালার, টেম্পারা, মিশ্র মাধ্যম প্রভৃতি কাজেও কিন্তু অন্য ধরনের সারল্য প্রকাশ পায়। লৌকিক অনুষঙ্গের প্রেক্ষিত মনে পড়ে, সেখানে পাশাপাশি ভারতীয় অণুচিত্র, কালীঘাট পট, যামিনী রায় প্রসঙ্গও চলে আসে, যে সব ঘরানা কোনও সময়ে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
তাঁর রেখা বরাবরই কবিতা। নির্দিষ্ট স্পেস তৈরি করেও, হঠাৎ রেখাকে তার বাইরে বার করে অদ্ভুত এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করেছেন ড্রয়িংয়ে, আবার এই চিকন রেখার গণ্ডি ছাড়িয়ে অপেক্ষাকৃত মোটা রেখা ও ব্রাশিংয়ের ড্রয়িংয়েও রেখারই বৈচিত্র এনেছেন সাদা-কালো ও বাবু-বিবি সিরিজ়ের কিছু কাজে। তাঁর ছবি বারবার এক নৈঃশব্দ্যের আবহ তৈরি করে। মনে হয় বিষাদগ্রস্ত যেন! কিংবা বুঝি বিষণ্ণতার কথা বলছে কুশীলবেরা। আসলে তা নয়। স্টাইলাইজ়েশনের এই কায়দার মধ্যেই কৌতূহল ও কিছু ভাষা আত্মগোপন করে থাকে, দর্শকের তা খুঁজে নিতে অসুবিধে হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy