নিসর্গ: দেবভাষা আয়োজিত ‘ল্যান্ডস্কেপ’ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
উপলক্ষ রামকিঙ্কর উৎসব। ওয়েব-অনলাইন প্রদর্শনী। ৩০জনের ১০০টি ছবি। ‘ল্যান্ডস্কেপ’ নামে এই প্রদর্শনীর আয়োজক দেবভাষা।
নিসর্গ বা ল্যান্ডস্কেপ বলতে বিশেষত চিত্রকলার ক্ষেত্রে ভেসে ওঠে নির্দিষ্ট কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য। আকাশ, জল, জমি, গাছপালা, আলো-বাতাস, পাহাড়-পর্বত এমন সব দৃশ্যকল্প। ১২-১৪ শতক বা তারও কিছু পূর্ব থেকে সমকালীন সময় পর্যন্ত শিল্পীরা বিশ্বব্যাপী অজস্র নিসর্গের ছবি এঁকেছেন। বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, করেও চলেছেন। বিবর্তনগত দিক থেকে বিষয়টির ব্যাপক বৈচিত্র লক্ষণীয়। নিসর্গচিত্রে প্রয়োজনে অবয়ব স্থান পেয়েছে, বিবিধ জন্তু-জানোয়ার, পশু-পাখি সবই এসেছে ছবিতে। ভারতীয় মিনিয়েচার ছবিতে মানুষ, পশুপাখি, নানা গৃহপালিত ও বন্য জন্তুর অবস্থান চোখজুড়োনো সব নিসর্গচিত্রে। রেনেসাঁ পূর্ববর্তী-পরবর্তী সময়েও বহু কাজ আছে এমন।
তাঁর ‘ল্যান্ডস্কেপ ইনটু আর্ট’-এ কেনেথ ক্লার্ক প্রায় ৭২ বছর আগে নিসর্গচিত্রের নানা দিক নিয়ে বহু ঐতিহাসিক তথ্য-সহ বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন, যা আজও অনেক দিক থেকেই প্রাসঙ্গিক। সে যতই নিসর্গচিত্র শিল্পের বিবর্তনের ভাবনা-চিন্তার দিক প্রসারিত হোক না কেন। ছাত্রাবস্থায় পড়া ক্লার্কের বিভিন্ন লেখা, লেকচার ইত্যাদি এই প্রসঙ্গে প্রদর্শনী দর্শনে মনে পড়ছিল।
নিসর্গচিত্রের নির্বাচিত শিল্পীদের মধ্যে ভাল লাগত রবীন্দ্র-অবনীন্দ্র-গগনেন্দ্র, বিনোদবিহারী, নন্দলাল, রামকিঙ্কর, শৈলজ মুখোপাধ্যায়, গোপাল ঘোষ, ইন্দ্র দুগার, হেমন্ত মিশ্র প্রমুখের কাজ দেখতে পেলে।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, ‘ল্যান্ডস্কেপ’-এর এই প্রদর্শনীটি তেমন উচ্চ মানের হয়নি। অনেক শিল্পীই অত্যন্ত সাদামাঠা নিসর্গচিত্র দিয়েছেন।
অতি সাধারণ কয়েকটি ছাত্রসুলভ কাগজে করা পেনসিল স্কেচ আছে অতুল বসুর। আছে হরেন দাশের চমৎকার দু’টি রঙিন এচিং ও একটি সাদাকালো উডকাট। আগে দেখা, বিখ্যাত কাজ। সোমনাথ হোরের একটি ছোট লিথো, যা কোনও ভাবেই ল্যান্ডস্কেপ পর্যায়ভুক্ত নয়। একটি বিহঙ্গের ডানা, পুচ্ছ-সহ গোটা শরীর। রেবা হোরের ছোট অয়েলটি একগুচ্ছ গোলাপ, মানুষের মাথাসদৃশ। বিভ্রম জাগে রূপকল্পের কথা ভেবে। পানেসরের কাগজে করা হালকা বর্ণের মিশ্র মাধ্যমে উপরে মুখ তোলা কয়েকটি লম্বা ঠোঁটের পাখির কাজটি বেশ অন্যরকম। ছবিতে হঠাৎ ওষ্ঠাধরের ড্রয়িংও লক্ষ করা যায়, যেমন একটি জন্তু-মুখও। শৈলেন মিত্রর আপাত-গাঢ় নীল পটভূমিতে কালো মুখ-তোলা মরালের এচিং, বিমূর্ত অ্যাক্রিলিকের কাজটিও বেশ লাগে। নৌকোর আধুনিক সজ্জা ঘোর লাল তটভূমিতে স্থির— কাজটিও দৃষ্টিনন্দন। বড়ই রোম্যান্টিক ছবি। অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’টি জলরংই নয়নসুখকর। তাঁর বিখ্যাত ‘স্মল বার্ড ইন আ ট্রি’ ও ‘বাটারফ্লাই’ এচিং দু’টিও ছিল। গণেশ হালুইয়ের নেপালি কাগজে গোয়াশটি আধুনিক নিসর্গের অতিসরলীকৃত রূপবন্ধের জ্যামিতিক বিন্যাস। একই কাগজে পেন-ইঙ্ক-ব্রাশের কাজ দু’টিও নয়নাভিরাম। আটটি কাজে তিনি নিসর্গের গীতিকবিতা লিখেছেন। ত্রিকোণ রূপবন্ধের জ্যামিতিকে অনন্য বর্ণ-সমারোহে সূর্য বা চন্দ্রসদৃশ অসামান্য নিসর্গ রচনা করেছেন দু’টি এচিংয়ে সুহাস রায়। একটি আপাত বাদামি পটভূমিতে কালো রেখায় করা একক বৃক্ষের ডালপালা ছড়ানো বিস্তারের এচিংটি বড়ই মনকেমন করা নিসর্গের কাব্যসম। হ্যান্ডমেড কাগজে সনৎ করের মিশ্র মাধ্যমের চোখমুখগুলোয় অনেক লুকোনো সংলাপ ও কৌতূহলের নাটকীয়তা। ছোটদের মতো এলোমেলো রেখায় করা অনিতা রায়চৌধুরীর কাজ দু’টি আহামরি নয়। প্রকৃতির কবিতায় হিরণ মিত্র সিদ্ধহস্ত। চারকোলে, কাগজে সাদা-কালোর চরম নৈঃশব্দ্যের মধ্যেও স্তব্ধতা যেন কিছুটা অলৌকিক। জমি, আকাশ ও বিশাল নেমে আসা কালো ঘন মেঘ মুহূর্তকে চমকে দেয়।
এ ছাড়াও অলয় ঘোষালের নিসর্গের আধুনিকতার সরলীকরণে গাঢ় লালের ব্যবহার ও ‘মাইন্ডস্কেপ’, শেখর রায়ের রাত্রির চাঁদ ও উড়ন্ত ভাঙা ভেসে যাওয়া মেঘ, প্রদীপ রক্ষিতের স্থাপত্যময়, কাঠামোগত বাড়ি-ঘর-বারান্দা-সিঁড়ির অনবদ্য নাটকীয় আলো-আঁধারি কাব্য, সামান্য মোটা ব্রাশিংয়ে সমীর আইচের প্রায়ান্ধকার চন্দ্রিল ‘নিসর্গ’ কাজগুলি ভাল লাগলেও, সকলের সব কাজ ভাল লাগেনি।
শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, সৌমিত্র করের কাজগুলি মন্দ নয়। এ ছাড়াও ছিলেন পার্থ দাশগুপ্ত, অতীন বসাক, ছত্রপতি দত্ত, সুশোভন অধিকারী, কৃষ্ণেন্দু চাকী, তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, কাবেরী বন্দ্যোপাধ্যায় মুখোপাধ্যায়, সুজিত দাস, চন্দনা হোর, আদিত্য বসাক প্রমুখ। তবে প্রদর্শনীর বেশ কয়েকটি কাজকে নিসর্গচিত্র হিসেবে উল্লেখ করা যায় না। তবে শুধু ল্যান্ডস্কেপে ডুবে থাকা চিত্রশিল্পী বাদল পালের নামটি না দেখে একটু অবাকই লাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy