সঙ্গীত পরিবেশনায় ছাত্রছাত্রীরা।
সমাজ-সংস্কৃতির নানা কাজে যুক্ত থাকার সূত্রে এবং বহুবর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে শহুরে-অভিজাত মহলে একদা বহুচর্চিত ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও কাব্য, নাট্য, সাহিত্য, অনুবাদ, চিত্রকলার পাশাপাশি সঙ্গীতে তাঁর দক্ষতা, তাঁর সঙ্গীত-ভাবনা এবং দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শিতা গোটা দেশের নিরিখেই নাক্ষত্রিক ছিল। তার সঙ্গে স্বরলিপি-নিরীক্ষা ছিল আরও একটি জ্যোতিক্ষেত্র, যেমন অবিসংবাদী ছিল সংগ্রাহক ও সংগঠক জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভূমিকাও। তবে এ সবই তাঁর সময়ের কথা। বলা ভাল, তাঁর জীবনের অল্প-কম মধ্যভাগ অবধি সময়কালের কথা। পরে, ক্রমে উদয় তাঁর সহোদর রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃজনশীলতার পেখম-পল্লব মেলেছেন যত, তত তার সুবিস্তার ছায়ায় ঢাকা পড়ে যেতে শুরু করেছেন ঠাকুর-পরিবারের একাধিক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। সে তালিকায় ছিল জ্যোতির জ্যোতিও।
এ সবই ইতিহাস এবং স্বাভাবিক ইতিগতি। তুমুল আলোকপ্রভের পাশে বহু অনির্বাণ শিখাই আপাত-নিষ্প্রভ। তবে রবীন্দ্রনাথ জীবনভর তাঁর সঞ্চারিত হয়ে ওঠায় ‘জ্যোতিদাদা’র অকৃপণ প্রভাবের কথা সুস্পষ্ট আখরে উল্লেখ করে গিয়েছেন— ‘সাহিত্যের শিক্ষায় ভাবের চর্চায় বাল্যকাল হইতে জ্যোতিদাদা আমার প্রধান সহায় ছিলেন’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নানা কৃতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাস্বর তাঁর রচিত-সুরারোপিত গান। তবে তা আজকের বাঙালির কাছে বিস্মৃত, খণ্ডিত, অবহেলিত। হাতেগোনা কয়েকটি গানকে জ্যোতিরিন্দ্রের গান বলেই এই সময়ের খণ্ডাংশ জানে। এমন বহু গান রয়েছে এবং থাকে, যা কার রচনা, তা নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না বিস্মৃতিপ্রবণ জাতির। আবার, কিছু গান হারিয়েও যায়। এহেন সব প্রবণতারই শিকার জ্যোতি-প্রতিভা।
এমন অনেক গান রয়েছে, যার কথারূপ রবীন্দ্রনাথের, সুর জ্যোতিরিন্দ্রের। এর উল্টোটাও ঘটেছে এবং সমধর্মী তালিকায় আছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথেরাও। ঠাকুরবাড়ির বিস্মৃত, প্রায়-বিস্মৃত সেই সব গান বাঙালিকে শোনানোর গবেষণাসূত্রী প্রয়াস শুরু করেছিলেন সুভাষ চৌধুরী। সেই ধারাতেই ‘ইন্দিরা শিল্পীগোষ্ঠী’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রয়াণ-শতবর্ষ উপলক্ষে কলকাতার দু’টি প্রেক্ষাগৃহে সম্প্রতি আয়োজন করেছিল স্মরণানুষ্ঠানের, যেখানে জ্যোতিরিন্দ্র লিখিত-সুরারোপিত গানের পাশাপাশি মিলল ঠাকুরবাড়ির গানের সার্বিক চুম্বক নির্যাস। সে সুগন্ধে সঙ্গীত-নিরীক্ষার নানা কৃৎকৌশলের পাশাপাশি ধরা দিল যুগান্তরে ফেলে আসা বাঙালির এক তুলনাহীন গানসময়, সুরজীবন।
‘তব জ্যোতি নেহারে’ আয়োজনের নাম। অনুষ্ঠান-শীর্ষকের এই তিনটি শব্দ আদতে সময়-ভ্রমণ করায়। শব্দ-তিনটি যে গানের অংশ, তার প্রথম পঙ্ক্তি— ‘তুমি হে ভরসা মম অকূল পাথারে’। কাফি-নিবদ্ধ ঝাঁপতালের ব্রহ্মসঙ্গীত। সে কালের কিংবদন্তি সঙ্গীত-বিশারদ তথা ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীত-প্রশিক্ষক যদুনাথ ভট্টাচার্য ওরফে যদুভট্ট বেঁধেছিলেন ‘রুমঝুম বরখে আজু বাদরবা পিয়া বিদেশ মোরা’। বৃষ্টিভেজা প্রেমের ধ্রুপদ। সেই গান জোড়াসাঁকোর তিন প্রতিভার কাছে ব্রহ্ম-আরাধনার তিন প্রকরণে অনূদিত হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ বাঁধলেন ‘দীনহীন ভকতে নাথ’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রচনা করলেন ‘তুমি হে ভরসা মম’। এবং সর্বাধিক পরিচিত রবীন্দ্রনাথের সুরফাঁক তালের বয়ান ‘শূন্য হাতে ফিরি, হে নাথ’। জ্যোতিরিন্দ্রের বাঁধা গানটি থেকেই ইন্দিরার আয়োজনের নামশীর্ষ চয়ন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গান নিয়ে প্রথম দিনের আয়োজন ত্রিগুণা সেন অডিটোরিয়ামে। ঠাকুরবাড়ির গানের ডালি নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র এবং তাঁর সুরারোপিত রবীন্দ্রগানের সঙ্কলন দ্বিতীয় দিনে অবন মহলে। দু’দিনের পরিসরে একক-দ্বৈত-সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হল নির্বাচিত এমন বেশ কিছু গান, যা আজকের অনেকের কাছেই অশ্রুত। সে সব গানের সুর-ঐশ্বর্য চমকিত করে, তাল-ব্যবহার সমীহ জাগায় এবং তার পাশাপাশি বাণী-ব্যবহার রবীন্দ্রনাথের পূর্ণবিকাশের প্রত্যাশায় কাব্যগীতির অহল্যা-প্রতীক্ষার প্রমাণও দেয়। তাই অনুষ্ঠানে নির্বাচিত সে সব গানের সিংহভাগ জ্যোতিরিন্দ্রের হলেও সার্বিক ভাবে তা এক বিবর্তন-অনুলেখও, যার আলোয় নবীন রবি থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার যাত্রাপথের আন্দাজ মেলে। বেশ কিছু গানের সুর চেনাও লাগে স্বরবিতান সূত্রে। দু’দিনের পরিবেশনাতেই স্বাভাবিক ভাবে ব্রহ্মসঙ্গীতের প্রাধান্য। ‘ধন্য তুমি ধন্য’, ‘আদিনাথ প্রণবস্বরূপ’, ‘জানি তুমি মঙ্গলময়’, ‘ও হৃদয়নাথ’, ‘আজ আনন্দ প্রেমচন্দ্রে’, ‘অনেক দিয়েছ নাথ’, ‘বিমল প্রভাতে’র মতো গানের নিবেদন-শান্তি মোহিত করে যেমন, তেমনই ‘এ কী এ মোহের ছলনা’ বা ‘কত দিন গতিহীন’ বা ‘ধীরে ধীরে বায়ু বহিতেছে’ নিবেদন-স্নিগ্ধতার পাশাপাশি নানা স্তরের আর্তিতেও মুগ্ধ করে। একই ভাবে ‘সে প্রেম কোথা রে’ গানে মজলিশির পূর্ণাভাস, ‘আয় রে আয় দেশের সন্তান’ গানে গণনাট্য-সংস্কৃতির রান্নাঘ্রাণ এবং অতি-পরিচিত ‘চল রে চল সবে’র তুলনারহিত অর্কেস্ট্রেশন। ধ্রুপদ, ঠুংরির রাগাশ্রয়ের সঙ্গে পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রেশনের সুষম সমাহার গানে-গানে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচনায় আরও এক অমোঘ মাধুর্য নাট্যময়তা। নিঃসন্দেহে দু’দিনের আয়োজনের সব শিল্পীই সে রসের কুর্নিশ-দাবিদার।
নানা বয়সের শিল্পীদের পরিবেশনার মধ্যে অনুভূতির প্রকাশ-বৈচিত্রও ছিল প্রাপ্তি। ঠাকুরবাড়ির গানের শিক্ষাক্রমের সদস্য ও সংগঠনের শিল্পীদের সতীর্থ ছিলেন রবীন্দ্রগানে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও। একক-দ্বৈত সব শিল্পীই অসামান্য, সমবেত সব পরিবেশনাই নিখুঁত। তার মধ্যেও স্মরণীয় শ্রীনন্দা মল্লিক, প্রমিতা মল্লিক, শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়, অলক রায়চৌধুরী, জয়তী চক্রবর্তী, অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রুতি গোস্বামী, দেবপর্ণা রায় দাশগুপ্তদের পরিবেশনা। তালসঙ্গত-যন্ত্রানুষঙ্গ সার্বিক ভাবেই সুন্দর, তার মধ্যে বিশেষ ভাবে ছুঁয়ে যান এসরাজে তথাগত মিশ্র।
‘ইন্দিরা’র বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য, কারণ তাদের এই আয়োজন সর্ব অর্থেই সার্থক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy