দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাসে শিল্পী অতীন বসাকের একটি অনলাইন প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল সম্প্রতি। ১৯৬৬ সালে জন্ম এই শিল্পীর। বাংলার চিত্রকলার জগতে নতুন করে অতীন বসাকের কোনও পরিচয় দেওয়ার দরকার হয়তো নেই। তাঁর এই দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সমসাময়িক শিল্পীদের চেয়ে সম্পূর্ণ অন্য রকম এক ধরনের শিল্পকর্ম তাঁকে আলাদা একটি আসনও দিয়েছে। সব সময়েই প্রিন্টমেকিং বা গ্রাফিক্সের উপরে ভালবাসা অটুট থেকেছে। এ ছাড়া টেম্পেরার একটি নিজস্ব ধরনও তাঁকে আলাদা করে দিয়েছে অন্য শিল্পীদের চেয়ে। এই দু’টির মেলবন্ধনে সৃষ্টি হল ২৫টি নতুন কাজ। নাম দিলেন ‘টেম্পেরা অন এচিং’। দর্শক পঁচিশটি কাজই দেখে ঋদ্ধ হবেন ওয়েবসাইটে।
অতীন বসাক এক সময়ে শিল্পী সনৎ কর এবং অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে আসেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রচুর রসদ গ্রহণে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তাঁর নিজের কথায়, এন্টালিও প্রিন্টিংয়ে যে রকম দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি, হয়তো সেখানে সনৎ কর এবং অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যথেষ্ট অবদান ছিল। এন্টালিও প্রিন্টিং বলতে আমরা এচিং, এনগ্ৰেভিং, ড্রাইপয়েন্ট, অ্যাকোয়াটিন্ট ইত্যাদি সমস্তটাই বুঝি। কিন্তু শিল্পী এই অনলাইন প্রদর্শনীকে ‘টেম্পেরা অন এচিং’ নাম দিয়েছেন।
সাধারণত এচিং বলতে আমরা বুঝি ধাতুর প্লেটের উপরে আ্যসিড দিয়ে খোদাই করে তার পর একটি বা দু’টি রঙ লাগিয়ে স্তরে স্তরে তৈরি করা প্লেট। তার পর সেটিকে ভার্নিশ করার পর শেষে সেটার ছাপ নেওয়া হয়। অতীন বসাকও সে ভাবেই প্রিন্টিং ইঙ্ক দিয়েই প্লেটে রং বসানোর পর নিজের পদ্ধতিতে পালিশ করতেন। তার পর সেটির ছাপ নিয়ে কাজটি পর্যবেক্ষণ করতেন। বহু বছর ধরে অনেক প্রিন্ট জমা করেছেন।
পরবর্তী পর্যায়ে শিল্পী অতীন বসাক সেই সব রেখে দেওয়া প্রিন্টের উপরে আবার সফ্ট প্যাস্টেল বা টেম্পেরা রং দিয়ে ছবিগুলিকে অন্য সাজে সাজালেন। এটি একটি অনবদ্য পদ্ধতি, কারণ এর কোনও মুদ্রিত সংস্করণ (এডিশন) হয় না। এই যে কাজ, সেটি না পেন্টিং, না প্রিন্ট। এটি একান্ত ভাবেই অতীন বসাকের সৃষ্টি।
আলো-কালোর ভারসাম্যেই তো ডায়মেনশন বা মাত্রা তৈরি হয়। অতীন বসাক যখন কালো থেকে আলোর দিকে আসেন, তাঁর ছাপাই ছবি থেকে একটা অদ্ভুত আলো বা দ্যুতি বেরিয়ে আসে। আর ওই ঔজ্জ্বল্য থেকেই তাঁর ছবিতে ভাস্কর্য-সুলভ একটা ব্যাপার তৈরি হয়। এই সমস্ত ছবিতেই ভাস্কর্যের চরিত্র দেখতে পাবেন দর্শক। ছাপাই ছবিতে কোনও শিল্পী সম্ভবত এই প্রথম এ ধরনের ব্যাপার ঘটাতে পেরেছেন।
এটি কিন্তু কোনও ভাবেই আকস্মিক নয়। শিল্পী জেনেবুঝেই এই ফলাফল লাভ করেছেন। পুরনো দিনের এচিং তাঁর অনেক সময়েই ক্লান্তিকর লেগেছে। তাঁর মনে হয়েছিল, এচিং-কে একটা অন্য মাত্রা দিতে হবে। তবেই তাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া সম্ভব, না হলে মানুষ তা ভুলে যাবে। সেই ভুলে যাওয়া এচিংকে তিনি পুনরুজ্জীবিত করলেন। তাকে সুন্দর এক দেহ বা অবয়ব প্রদান করলেন।
অনলাইনে শিল্পীর যে সমস্ত এচিং দেখতে পাবেন দর্শক, সেখানে মুখাবয়বের মধ্যে ভাস্কর্যের মূল্য অনবদ্য এবং তা ছাড়াও একটি ছবিতে একটিই মুখ। শিল্পী যেন প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে অপর একটি মানুষের ছায়া দেখেন। সেটিই সেই মানুষটির আসল সত্তা।
আরও দেখা গেল অনমনীয় সব পাখির মুখাবয়বের ছাপ। সেগুলি প্রধানত চড়াই জাতীয় পাখি। শিল্পীর ছোটবেলায় দেখা চড়াই পাখি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে আশপাশ থেকে। সেই মনখারাপ থেকেই ওদের বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন শিল্পী, তাঁর ছাপাই ছবির ভিতর দিয়ে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যারা হয়তো আর ওদের দেখতে পাবে না।
মানুষের মুখাবয়বে অন্য মানুষের ছায়ামাত্র নেই। সেখানে কিছুটা যেন প্রশান্তি। কিছু ধ্যানস্থ মানুষ। আবার কয়েকটি ছবিতে প্রকট বা প্রত্যক্ষ অর্থের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা দেখতে পাওয়া যায় সরাসরি। সেখানে দেখা যায় নারীবক্ষ, যোনি, গার্ডেন অব ইডেনের অর্ধেক আপেল, সর্পের আবির্ভাব ইত্যাদি, যা বাইবেলের সেই ‘অরিজিনাল সিন’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই সব ‘না প্রিন্ট না পেন্টিং’-এর দৃশ্যগত সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে উঠেছে শিল্পী অতীন বসাকের তুলির ভালবাসার টানে। অনলাইন হলেও এই প্রদর্শনী তৃপ্ত করবে শিল্পপ্রেমী দর্শককে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy